#এক কাপ চা
পর্ব ১৯
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
(৫৫)
“আমার আম্মুর আবার বিয়ে হবে। তিনটা বিয়ে। আমার মায়ের বিয়ে। তিনটা বিয়ে।”
স্নেহা পুরো ঘর জুড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলছে আর এই কথা জোড়ে জোড়ে বলছিল।সাগরিকা, তুলি আর ইখুম বসেছে ক্যারামবোর্ডে। তাদের সামনে ধোঁয়া উঠা গরম চা এবং চালভাজা মুড়ি।
কিছুক্ষণ পর বাড়ি এক কাজের লোক এসে ছোলা মটরশুঁটি ভাজা এবং চানাচুর মাখা দিয়ে গেল।
সাগরিকা চা বানাতে বানাতেই রাশেদ, তাজবীদ, তাশদীদ আর মুনির হাজির। মুনিরের স্ত্রী মিষ্টি একটা মেয়ে।কিন্তু কিছুটা ভয়ে আছে তাকে দেখলে বুঝা যায়।
আসার পর তারাও যোগ খেলায়। রাশেদ এসে সাগরিকার পাশে বসেছে। সে খেলায় হারছিল কারণ ইখুম এই খেলায় বাজিমাৎ করতে পটু।
সাগরিকা চাচার দিকে চা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“রাঙ্গামায়ের কাছে আমি হারতে চাই না।তুমি জিতিয়ে দাও।”
রাশেদ হেসে বলল,
“তবে তুই জুটি বাধ তাশদীদের সাথে।ইখুমকে আমি হারাতে পারবো না।আমি এ খেলা এত পারি না।”
ঠিক তখন স্নেহা ঘরে ঢুকলো এসব বলতে বলতে। তার কথা শুনে ইখুমের মুখ শুকিয়ে আমচুর হয়ে গেল।সাগরিকা মন খারাপ করে তাকালো তুলির দিকে। এদিকে মুনিরের স্ত্রী জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার স্বামীর দিকে।তাশদীদ সাগরিকার ডান পাশে বসলো।আলাদা একটা কম্ফর্টার নিয়ে তার ভিতর স্নেহাকে নিয়ে বলল,
“কে বলেছে তোমার মায়ের বিয়ে?”
“আমি জানি।কাল অনুষ্ঠান হবে।অনেক অনেক রান্না, আমি নানাবাড়ি গিয়েছিলাম, হলুদ শাড়ি পরেছিলাম।আবার পরবো।কয় দিন আগেও তো আমার মায়ের বিয়ে হলো।তুমি, আমি, আপু গেলাম না?”
“ওটা তোমার মায়ের বিয়ে ছিল না।ওটা তোমার মামার বিয়ে ছিল।আর কয়েকদিন আগে এই যে ভাইয়া? এই ভাইয়ার বিয়ে ছিল।”
মুনিরকে দেখিয়ে তাশদীদ কথাটা বলতেই সবার মুখের অভিব্যক্তি কিছুটা স্বাভাবিক হলো।কিন্তু স্নেহা জেদ করে বলল,
“আমি মানি না।আমার মায়ের বিয়ে। আমার মায়ের বিয়ে।”
“না আপু।এসব বলে না। লোকে খারাপ বলবে।”
স্নেহা কোনো জেদ না করে চুপচাপ রইল। তাশদীদ তার দিকে চকলেট এগিয়ে দিলো।সাগরিকা ঝাল ঝাল করে মাখা চানাচুর স্নেহার দিকে এগিয়ে দিতেই ইখুম তাকে ধমকে বলল,
“ওর সমস্যা আছে তুমি জানো না?ঝাল ওকে দিও না।আর এগুলো তেল মশলা দেওয়া। ওর জন্য এসব ক্ষতিকর।”
সামিনা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইখুমের কথা গুলো শুনছিল।সে এসেছিল স্নেহার খোঁজে। কথাগুলো শুনে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
(৫৬)
সাগরিকা হাত পরিষ্কার করার জন্য ওয়াশরুমে গিয়েছিল, ফিরে এসে দেখতে পেল মৌসুমি তার জায়গায় বসেছে। তাশদীদ এবং মৌসুমি জুটি বেধে খেলবে। ইখুমের সাথে তাজবিদ, তুলির সাথে মুনির আর মুনিরের স্ত্রীর সাথে রাশেদ।
সাগরিকা এসে জিজ্ঞেস করলো,
“আমি? আমি নেই?”
মৌসুমি হেসে বলল,
“সাগরিকা তুই দুধভাত।সবার সাথেই খেলবি আবার কারোর সাথেই না।এক কাজ কর তুই আমাদের সবাইকে চা সার্ভ করবি। আর আমাদের যা যা প্রয়োজন তাই দিবি।”
সাগরিকা অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল।তার দিকে কেউ কোনো পাত্তাই দিলো না।
বিশেষ করে তাশদীদ যখন তাকে একটা ধমক দিয়ে বলল ওখান থেকে স্নেহাকে নিয়ে চলে যেতে। স্নেহা ঘুমিয়ে পড়েছে।
সাগরিকার প্রচন্ড মন খারাপ হলেও সে প্রকাশ করলো না। স্নেহাকে কোলে নিয়ে সাগরিকা বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।মাঝে ফিরে এসেছিল ফোন নিতে তখন তাদের খেলা জমে উঠেছে। মৌসুমি তাশদীদের অনেকটা কাছাকাছি বসেছিল।সাগরিকা ফোন নিয়ে ছাদে চলে এলো।কানে ইয়ারফোন দিয়ে এক মনে গান শুনছিল।কী গান শুনছে তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।তখন বাড়ির গেটে এসে দাঁড়িয়েছে কালো রঙের একটা পাজেরো জিপ।দিনের বেলা হলেও শীত জেঁকে বসেছে। কে এসেছে দেখার জন্য উঁকি দিতেই সাগরিকার দেখতে পেল কালো রঙের জিন্স পরা একটা পা নামিয়েছে গাড়ি থেকে। কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানে গাড়ি থেকে নেমে এলো সাদা হুডি পরা এক সুদর্শন যুবক।যার চোখে কালো রঙের রোদ চশমা।কুয়াশা মাঝে রোদ চশমা পরার কোনো কারণ সাগরিকা খুঁজে পেল না তবে সামনে থাকা মানুষকে সে চিনতে পারছে না।হয়তো মন খারাপ তাই মানুষটাকে চিনতে সমস্যা হচ্ছিলো কিন্তু মিনিট খানেকের মাঝেই তাকে চিনে ফেলল।দ্রুত সিড়ি বেয়ে নেমে চলে যেতে চাচ্ছিলো কিন্তু তাশদীদদের সামনে দিয়ে সে দৌড়ে যেতে চায় না।সে তুলিকেও এই খুশির খবর দিতে চায় না।তাই শান্ত ভাবে নিচে নেমে এলো।বাকীটা রাস্তা দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো সেই যুবকের সামনে।
(৫৭)
“আপনি কামডা ভালা করেন নাই। এত কিসের সম্মানের কথা কন?”
কাজের মেয়ে জুলির কথায় কান না দিয়ে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিল সামিনা।কোনো জবাব না পেয়ে জুলি আবার বলল,
“খালাম্মা কি আফনের ক্ষতি চায়?না আফনের মেয়ের ক্ষতি চায়? আমরা কি আফনার ভবিষ্যৎ চিন্তা কইরা বলি নাই?”
“ভবিষ্যৎ সৃষ্টিকর্তার হাতে।”
“না চাইলে আল্লাও দেয় না।আপনার যুবক বয়স। কেমনে যাবো দিন?”
“আল্লাহ্ নিবে।”
“এত নীতি ভালা না।আপনি কেন মানতাছেন না?”
সামিনা এবার হাতের সুঁই সুতো রেখে জুলির দিকে তাকিয়ে বলল,
“রাশেদের সাথে বিয়ে হলেই আমার ভবিষ্যৎ ঠিক হয়ে যাবে?আপনারা জাদু, জোড় করে দিলেন ওর সাথে বিয়ে কিন্তু ইখুম?”
“ইখুমকে বড়াফা মানে না।”
“আম্মা ওকে কেন মানে না জানি না কিন্তু আপনাদের কথায় আমি আর খারাপ হতে পারবো না।”
“তোমার মাইয়্যারে ওরা বেইচ্চা খাইবো।”
“তা খাবে কেন?”
“কিছুই দিবো না তোমার মেয়েরে।সব নিয়া নিবো ওরা।”
“রাশেদের সাথে বিয়ে হলেও ঠকাতে পারে। যদি ঠকানোর ইচ্ছে থাকে।”
“বাপের নামে রাশেদ থাকলে পারবো না।”
“আমায় মাফ করেন।আমি আর ওদের চোখে খারাপ হতে পারবো না।আর আমার সন্তানের অন্য কারো নাম লাগবে না। ও ওর বাবার নামে, আমার স্বামীর নামেই বড় হবে। জন্মদাতা পিতার নামে।”
“তুমি ভুল করতাছো।”
“এত দিন করেছি।রাশেদ আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। আমি যখন ব্যথায় ছটফট করেছি আমার মেয়েকে পুরো রাত সামলেছে। আমার দেখাশোনা করেছে। আপনারা তার চোখে নয় আমার চোখে সেদিন আমাকে মেরে ফেলেছেন যেদিন স্নেহার মাথায় হাত রাখিয়ে বলেছিলেন
রাশেদ কে বিয়ের কথা বলতে। আমাকে আর এমন কিছু বলবেন না যাতে আমি মেয়েকে নিয়ে চলে যেতে বাধ্য হই।”
জুলি রাশেদের মা কে এসে সব কথা বললে সে বলল,
“ওর আবার ন্যায় নীতির গোড়াতেই গলদ। যাই হোক যুদ্ধের মাঠে অসুস্থ, খোড়া ঘোড়া কোনো কাজের না।বাকীটা ভালোই বুঝিস কি করবি তুই।
ঘন্টা খানেক পরের কথা।সামিনার মনে হচ্ছিলো।তার পেটের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসছে গলা দিয়ে।
হরহর করে বমি করে দিলো সে। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখতে পেল ওয়াশরুমের সাদা ফ্লোর লাল হয়ে গেছে তার রক্ত বমিতে।
চলবে …