#এক কাপ চা
পর্ব ২৮
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
(৮২)
তাশদীদের বাবার ইচ্ছে ছিল তাশদীদের বায়োলজিকাল মায়ের বোনের মেয়ের সাথে তাশদীদের বিয়ে দেওয়ার।
সে সরাসরি না বললেও মাঝেমধ্যে তাশদীদকে কথার ছলে বলেছিলো।একমাত্র এভাবেই তাদের সাথে পুনরায় একটা সম্পর্কে জড়ানো যাবে।
কিন্তু তাশদীদ এভাবে সাগরিকার পাগলামোতে মত চাইবে সে বুঝে উঠতে পারেনি।
সে চেয়েছিল তাশদীদের সাথে খুব দ্রুত এসবে কথা বলবে কিন্তু তার ছেলে তাকে নিরাশ ছাড়া কিছুই করেনি।
“আপনি এসব নিয়ে এখন আফসোস করছেন অথচ মৌসুমির সাথে বিয়েতে তো মত ঠিক দিয়েছিলেন।”
তাশদীদের মায়ের কথায় সে বলল,
“আমি তখনো কথাটা বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু মায়ের উপর দিয়ে কথা বলার সাহস হয়নি।”
“এখন আপনার মায়ের কথার উপর দিয়েই কথা হয়েছে। তাছাড়া ওরা যদি সুখে থাকে আমাদের কী সমস্যা।”
“সাগরিকার বাবা তো সব জানতো।সে কেন অনুমতি দিলো? ভাই হয়েই ভাই আমার সাথে বেঈমানী করলো।শুধু নিজের মেয়েকে কাছে রাখতে পারবে বলে?”
“তাশদীদ যে সাগরিকাকে ভালোবাসে এটা আপনার চোখে না পড়লেও আমাদের সবার চোখেই পড়ে। তাছাড়া সন্তানের ক্ষেত্রে সব বাবা-মা সন্তানের সুখ,খুশীটাই দেখে। “
“ভালোবাসা?জানালা দিয়ে পালাবে। মিলিয়ে নিও।”
“আপনার ছেলেকে আপনি তাহলে চিনেন না।আপনি আমি কিংবা পরিবারের সবাই ওর বিপক্ষে গেলেও সে সাগরিকাকে ছাড়বে না।স্বয়ং সাগরিকাও যদি ছাড়তে চায় তাও ছাড়বে না।”
“সময় কথা বলবে।আজকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আগামীকাল তাশদীদ সহ তোমরা সবাই পস্তাবে।
মনে রেখো
সাগরিকা শীতল বরফ আর তাশদীদ উষ্ণ হাওয়া।দুজন দুজনের বিপরীতে।এক জনের সংস্পর্শে যে কেউ তার স্বকীয়তা হারাবে।”
“আর যদি দুজনে মিলে মিশে জল হয়?”
পুরুষ মানুষ সব সময় চায় তার মনের সকল ভাবনার সাথে তার প্রেয়সী কিংবা স্ত্রী সহমত হোক।তারা যদি এ বিষয়ে কোনো তর্ক বির্তক করে তবে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে প্রেয়সীকে চূড়ান্ত মানসিক আঘাত দিতেও দুইবার চিন্তা করে না। তাশদীদের বাবা তার স্ত্রীর কাছ থেকে সাগরিকার বিরুদ্ধে কিছু না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়েই তাকে চূড়ান্ত আঘাত করে বসল।
“শান্তি মারা যাওয়ার পর আমি তোমাকে ঘরে তুলেছিলাম আকলিমা।আমার বিশ্বাস ছিল তুমি শান্তিকে মন থেকে মেনে নিয়ে তার সন্তানকে মানুষ করতেছো। কিন্তু তুমি কোনো দিন শান্তিকে মেনেই নিতে পারোনি।তাই শান্তির সব স্মৃতি তো মুছেই ফেলছো সাথে শেষ যে সুতোটা ছিল তাও কেটে যাওয়ায় উল্লাস করতেছো।
আমার এখন সত্যি আফসোস হচ্ছে কেন আমি শান্তির জায়গায় তোমারে আনলাম?”
দীর্ঘ সাতাশ বছর বিবাহিত সম্পর্কের পর তাশদীদের বাবার এমন কথায় ভিতর থেকে নিজের নারী সত্ত্বা ভেঙ্গে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল তাশদীদের মায়ের।
তার স্বামী ঘর থেকে বেরিয়েছে অনেক ক্ষণ হলো।বিছানার একপাশে বসে ছিল সে। হঠাৎ নিচ থেকে কেউ ডেকে উঠলো তাশদীদের মা বলে।
অন্য সময় হলে সে এক ডাকেই জবাব দিতো কিন্তু আজ সে দ্বিধায় ভুগছে। আসলেই কী সে তাশদীদের মা হয়ে উঠতে পেরেছে না কী তাশদীদের নজরেও সে কেবল মাত্র তার বাবার দ্বিতীয় পক্ষ!
(৮৩)
দরজার সামনে থেকে তিনবার ফিরে এসেছে সাগরিকা।তাশদীদ তার ঘরে বিছানায় মনে হচ্ছে।
যাবে কী যাবে না করতে করতেই তিনবার ফিরে এলো সে।
ফিরে আসার সময় এবার তার দেখা হলো তাজবীদের সাথে। তাজবীদ তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু-কুঁচকে বলল,
“আমার চা কই?বিয়ে হয়েছে বলে চা পাবো না?এটা কোথাকার আইন।”
সাগরিকা দ্রুত এসে তাজবীদের হাত ধরে বলল,
“ও ভাইয়া, সত্যি বলো না!আমার বিয়ে হয়ে গেলো?কী করে হলো?আমার কিছুই তো মনে নেই।”
“নেশার ঘোরে মানুষ সব সময় সত্যি কথা বলে। তার মনে যা থাকে মানে সে যা চিন্তা ভাবনা করে সব’টা তার মুখে চলে আসে। তাছাড়া গত দিন তুই বেশ বিরক্ত ছিলি ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে। তোর মনে যা ছিল তাই হয়েছে।”
“কিন্তু!”
“কী?”
“বড় বাবা মনে হয় রাজী ছিলেন না।”
“তোর মাথা। আব্বুই তো বেশি খুশি হয়েছে।”
“শোনো না!”
“চুপ যা। ঘরে বিয়ে করে তো একে আমার হক মেরেছিস। না তুই আমাকে জুতো চুরি করার কোনো স্কোপ দিলি না আছে তোর সুন্দরী ননদ। এর জরিমানা তোকে দিতে হবে।”
“কী জরিমানা হয়েছে? আমি কী করেছি আমি?তোমরা বিয়ে দিলে কেন?”
“আশ্চর্য তুই।কার কাছ থেকে ট্রিট নিবো?ভাইয়াকে দুলাভাই ডাকবো?নিজের ভাইয়ের জুতো চুরি করাবো?”
“সত্যি আমার বিয়েটা হয়ে গেলো?শাড়ি পরা হলো না।মেহেদী দিলাম না।ফটোসেশান হলো না।আমি কী করে নিজে নিজের ভাবী হয়ে গেলাম?”
“তাই বলে আমি তোকে ভাবী ডাকতে পারবো না।”
সাগরিকার মন খারাপেও মন ভালো হয়ে গেলো।সে তাজবীদের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলল,
“বেয়াদব ছেলে। আমি তোমার বড় না?আমাকে তুই করে বলছো?দেবো কান মলে।”
সাগরিকা তাজবীদের কান মনে দিতে যাচ্ছিলো সেই মুহুর্তে পিছন থেকে তাশদীদ বলল,
“কী করছিস তোরা দুজন?তাজ সাগরিকার শরীর ভালো না ওকে জ্বালাস না।আর এই তুই ঘরে আয়।”
তাশদীদ ঘরে চলে যেতেই সাগরিকার কানের কাছে মুখ নিয়ে তাজবীদ বলল,
“ভাবী!ও ভাবী যাও না ঘরে তোমার বর যে অপেক্ষা করে।”
সাগরিকা কপট রাগ দেখাতেই তাজবীদ বলল,
“বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান। এই বার ঘুঘু তোমার বধিবে পরাণ।মু হা হা হা হা, শয়তানের খালা।”
ঘরে ঢুকেই সাগরিকা দেখলো তাশদীদ ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে। তার গা দিয়ে টুপ টুপ করে পানি ঝরছে। চিবুক গড়িয়ে পানি পড়ার দিকটায় তাকাতেই সাগরিকার হঠাৎ পানির তৃষ্ণা পেলো।হঠাৎ অনুভব হলো তৃষ্ণায় তার গলা ফেটে যাচ্ছে।
পানির গ্লাসের দিকে হাত বাড়াতেই তাশদীদ বলল,
“ফ্রেশ হয়ে আয়।”
সাগরিকা চুপচাপ চলে গেল।ওয়াশরুমের ভিতরে গিয়ে সে দরজা লাগালো না।একটু ফাঁক করে দেখার চেষ্টা করছে তাশদীদ কী করছে। চোরের মতোন চুরি করে দেখতে গিয়ে সে হঠাৎ শুনতে পেল তাশদীদ বলছে,
“দেখার ইচ্ছে হলে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে যা।ওয়াশরুমের ভিতর থেকে দেখার কোনো দরকার নেই।”
তাশদীদের কথায় সাগরিকা এতটা হচকচিয়ে উঠেছে যে সে ধুপ করে ওয়াশরুমের ফ্লোরে বসে পড়েছে।
(৮৪)
সামিনার শরীর কিছুটা ভালো হলে সে স্নেহাকে ধরে মরা কান্না শুরু করেছে। ইখুম তার পাশে বসে তাকে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। সামিনা এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না তার মেয়ের সাথে এত কিছু হয়ে যাচ্ছিলো।কী হতো যদি তাশদীদ ওরা সঠিক সময়ে না পৌঁছাতে পারতো?
ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। মেয়ের জন্য হলেও তাকে বাঁচতে হবে। মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে সে বলল,
“মাফ করে দিস মা।আমি জানতাম না।আমি তোর জন্য সব করতে পারি। কারণ মা কখনো খারাপ চায় না।আমাদের আর কাউকে লাগবে না। আমি তুই দুজনে মিলেই আমাদের সব হবে।”
স্নেহা কিছু না বলে অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল।গত দু দিনে সে কোনো কথা বলেনি। কারোর সাথেই নয়। ব্যথায় কাঁদেনি। চুপচাপ সব সহ্য করছে। পাঁচ বছরের একটা মেয়েকে এতটা চুপচাপ দেখে সবার ভয় করছে। স্নেহার মধ্যে যেন প্রান নেই। যা আছে শুধু টিম টিম করে জ্বলতে থাকা এক চিলতে আলো।যে আলোর সাহায্যে সে সবাইকে দেখে যাচ্ছে কিন্তু কোনো রেসপন্স দিতে পারছে না।
তাশদীদ,রাশেদ থানার উদ্দেশ্যে বের হবে।বের হওয়ার পূর্বে সে সাগরিকাকে বলল,
“বিয়ে যখন করেই ফেলেছেন তখন দায়িত্ব নিতে শিখুন ম্যাম।স্বামী কোথাও যাওয়ার আগে তাকে উষ্ণতা দিতে হয়। তো দিন আমার উষ্ণতা।”
গতকাল সাগরিকা যেভাবে হাত পেতে বলেছিল বিয়ে দিতে ঠিক সেভাবে তাশদীদ হাত পেতে কথাটা বলল।
সাগরিকা অবাক চোখে বলল,
“উষ্ণতা হাতে দেওয়া যায়?”
“তবে কোথায় দেয়?”
“ওটা তো অনুভূতি ,বস্তু নয়।”
“বিয়েটাও অনুভূতি বস্তু নয়। কাল তো এভাবেই চেয়েছেন।”
সাগরিকা কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।নিচ থেকে রাশেদের ডাক পড়তেই তাশদীদ দুই হাতে সাগরিকাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করলো নিজ বাহুতে। কপালে অধরের গভীর স্পর্শ দিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
থানায় গিয়ে যখন স্নেহার বিষয় নিয়ে তারা কর্তব্যরত পুলিশের সাথে কথা বলছিল তখন জানতে পারলো স্নেহার মামাতো ভাই স্বীকারোক্তিতে বলেছে,
কেউ একজন তাদের মোটা অংকের টাকা দিয়েছে স্নেহার সাথে এই কাজ করার বিনিময়ে।
চলবে….