#এক কাপ চা
পর্ব ৪০
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
(১৯৮)
খুব মন খারাপ হলে যেমন গলায় কান্নাগুলো আটকে আসে ঠিক তেমনি খুব খুশি হলেও দম বন্ধ হয়ে আসে। সাগরিকার আজ খুশিতে দম বন্ধ হয়ে আসছে। রাশেদ, ইখুম তাদের সন্তান নিয়ে কিছুক্ষণ আগে বাসায় ফিরেছে। ইখুমের হাসি-খুশি চেহারা দেখে রাশেদের অনুতপ্ততা আরো বেড়ে গেল কয়েক গুণ।যেখানে সে নিজেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি সেখানে অন্যের থেকেও ক্ষমা আশা করাটা ভুল।
ইখুম ছেলেকে কোলে তুলে নিতেই কাঁদতে লাগলো বাচ্চাটা। সে ঠিক বুঝতে পারছে না তার কী কী করতে হবে। প্রথম প্রথম মা হয়েছে, তাছাড়া ডাক্তার বলে দিয়েছে ছেলেকে সাবধানে রাখতে৷ প্রিম্যাচিউর বেবীদের অনেক সমস্যা হতে পারে।
স্নেহা,সাগরিকা,তুলি তিন জনে বাচ্চাটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।ছোট্ট স্নেহার সাথে ঘটে যাওয়া বাজে ঘটনা পর আজ সে নিজ থেকে কথা বলছে, হাসছে।ভয়ে ভয়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বাচ্চাটার মাথায়।এক আংগুল দিয়ে হাতে স্পর্শ করতেই বাচ্চাটার কান্না থেমে গেল।ইখুমপাশে স্নেহাকে বসার জন্য ইশারা দিয়ে বলল,
“কোলে নিবে?”
তার কথায় দুপাশে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় স্নেহা। হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিতে চাইলো সে। ইখুম চাইলে না করে দিতে পারতো, যথেষ্ট কারণ আছে তার কাছে কিন্তু সে না করলো না।স্নেহাকে বিছানায় বসিয়ে কোলে দিলো।সাগরিকা ইখুমের কাধে হাত রেখে বলল,
“আমরা কেউ পারফেক্ট নই তাই না রাঙামা?”
“কেন?”
“তোমার জায়গায় আমি হলে কখনো দিতাম না।অন্তত ডাক্তারের কথা মেনে।”
“ডাক্তার তো কারোর কোলে দিতে না করেনি।”
“এতটা সহ্য শক্তি আছে বলেই হয়তো তুমি মা।তবে আদৌও কী বড় মা তাশদীদ ভাইয়ের মা হতে পেরেছিল?”
“কেন?”
“জানিনা।”
সাগরিকার বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।তুলির থেকে রাশেদ এবং ইখুম সবটা শুনলো।ইখুমের খুব আফসোস লাগে এই পরিবারের মানুষের জন্য।কেন কেউ কোনো কিছু স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না?
বিয়ের শাড়ির জন্য সাগরিকার মন খারাপ হয়েছিল, বিকেল হতে না হতেই সে তিনটে বিয়ের শাড়ি উপহার হিসেবে পেলো।সাগরিকার বাবা মেয়ের জন্য আগে থেকেই শাড়ি কিনে রেখেছিলেন কিন্তু পরিস্থিতির কারণে দেওয়া হয়নি।আজ সকালে তিনি বাসায় ছিলেন না।ফোনে যখন সাগরিকার মা কেঁদে কেঁদে সকালের ঘটনা বলছিল তখন তিনি বললেন ক্লোজেটে রাখা আছে তার মেয়ের জন্য বেনারসি।বিকেল বেলা এসে তিনি নিজ হাতে মেয়েকে বেনারসি দিলেন,সাগরিকার মা নিজের সব গয়না মেয়েকে পরিয়ে দিয়ে বললেন,
“আমার যা আছে সব তোমার।তুমি কেন পুরাতন শাড়ির জন্য মন খারাপ করো?”
সাগরিকা কিছু না বলেই তার বাবা মাকে জড়িয়ে দীর্ঘ সময় বসে রইল।এক বাড়িতে থাকার কারণে বুঝতেই পারেনি সে। অথচ আজ যখন তার মা তাকে বেনারসি এবং গয়না নিজ হাতে পরিয়ে দিচ্ছিলো তখন মনে হলো সে পর হয়ে গেছে।এখন সে তাদের মেয়ে সাথে অন্যের স্ত্রী।লাল বেনারসি এবং গয়না পরিয়ে সাগরিকাকে তার মা নিয়ে এলো বাইরের ঘরে।সেখানে বসে ছিল বাড়ির সকলে।মৌসুমির মা সাগরিকাকে দেখে বলল,
“তোকে একদম বড় ভাবীর মত লাগছে। তুই জানিস?তাশদীদের মায়ের অনেকটাই তোর মধ্যে দেখা যায়।তার অনেক কিছুই তোর সাথে মিলে।যেটা তাজবীদের মায়ের সাথে মিলে না।”
ভদ্রমহিলার কথার খোটাটা বাড়ির বড় বৌ ঠিক ধরে পেরেছিল কিন্তু কোনো জবাব দিলো না সে। তাশদীদের বাবা ইতিমধ্যে সেখান থেকে উঠে চলে গিয়েছিল। ফিরে এসে সাগরিকার হাতে তুলে দিলো একটা বাক্স। তার পাশে বসিয়ে বলল বাক্স খুলতে।
সাগরিকা বাক্স খুলে দেখতে পেল সেখানে একটা শাড়ি রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে অনেক পুরোনো ডিজাইন কিন্তু শাড়িটা নতুন।নিশ্চয়ই খুব যত্নে রাখা ছিল।সাথে দুটো হাতের চুড়ি, একটা সরু চেইন এবং নাকফুল।
ভদ্রলোক সেগুলো সাগরিকার হাতে তুলে দিয়ে বললেন,
“এগুলো তোমার শাশুড়ি।তোমার নিজ শাশুড়ির। আমার প্রথম জীবনের ছয় মাসের সঞ্চয় করে বানিয়েছিলাম। তাশদীদের মায়ের জন্য। এসব গয়না বিয়ের দিন তোমার দাদী পরিয়ে দিয়েছিল মৃত্যু পর তোমার দাদীই খুলেছিল।আজ থেকে তোমাকে দিলাম।”
সাগরিকার আনন্দে দুই চোখ চকচক করে উঠলো।তাজবীদের মায়ের মুখের দিকে ভদ্রলোক হাসলেন।আজ অবধি এসব তাকেও ধরতে দেননি তিনি।হুট করেই কী সে তাশদীদের উপর বিরক্ত?মোটেই নয়। কারণ আর কেউ না জানুক একই ঘরে, একই বিছানায় থাকা এই মানুষটা জানে যে মা মরা ছেলেকে তার দ্বিতীয় পক্ষ কখনো মেনে নিতে পারেনি।
(১৯৯)
নিজের ঘরে ফিরে এসে সাগরিকার আরো একটি শাড়ি খুঁজে পেলো নিজের ক্লোজেটে। এত গরমে শাড়ি গয়না পরে থাকতে তার অস্বস্তি লাগছিল।কিন্তু সে ভুলেই গিয়েছিল যে তাশদীদের মন ভালো করে দেওয়ার জন্য হলেও শাড়িটা আর কিছু সময় এভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো সে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে কয়েকবার দেখে নিলো সে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হলেও তাশদীদের বাসায় ফিরেনি।অথচ সাগরিকা চোখে অপেক্ষায় ঘুম নেমে এলো।
তাশদীদ বাসায় ফিরে প্রতিদিনের মতোন আজ নিচে ড্রয়িং রুমে বসেনি।পিছন থেকে তুলি ডাকছিল,তার ডাকেও সাড়া দেয়নি সে। ক্লান্ত শরীরে নিজ রুমে ফিরেছে সে। পুরো রুম অন্ধকার। বাইরে থেকে হালকা আলো এসে পড়েছিল তার বিছানায়। সেখানে তাকিয়ে দেখতে পেল,
সাগরিকা ঘুমিয়ে আছে। তার গায়ে জড়ানো লাল বেনারসি। চুলগুলো এলোমেলো। কিছু চুল ছড়িয়ে আছে তার মুখ জুড়ে। কপালের টায়রাটা এক পাশে হয়ে আছে। তাশদীদের মন খারাপ, ক্লান্তি সব উবে গেল মুহুর্তেই।
সাগরিকাকে না ডেকে সে ফ্রেশ হয়ে এলো।ফিরে এসে সাগরিকার পাশে বসে তার দিকে তাকিয়ে ছিল সে।কপালের চুলগুলো ঠিক করে দিতেই সাগরিকার ঘুম ভেঙ্গে গেলো।
উঠে বসার চেষ্টা করছিল সে কিন্তু তাকে বাধা দিয়ে তাশদীদ বলল,
আমি আজ ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত মিটিয়ে দিবি আমার তৃষ্ণা।
তোর তৃষ্ণা?
আমাকে একটু শান্তি দিলে হয়না? একটা লম্বা সুখের দীর্ঘশ্বাসের অনেক প্রয়োজন আমার।”
(২০০)
পরদিন সকালবেলা তাশদীদের পাশে নিজেকে এলোমেলো অবস্থায় পেলো সাগরিকা।চুলগুলো।হাত খোপা করে বেরিয়ে এলো রুম থেকে।গত রাতে বৃষ্টি হয়েছে।বৃষ্টিতে ভিজেছে সাগরিকা নিজেও। আজকের সকালটা একটু বেশিই মিষ্টি লাগছিল তার।
ধীর পায়ে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো সে। বাড়ির সবাইকে সকালের চা নাস্তা তৈরী করে দিলো।ছুটির দিনে আজ বাড়ির ছেলেরা বেশ বেলা করে ঘুমায়।
বাড়ির মেয়েরা ডায়নিং রুমে বসে রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
নিজ মায়ের জন্য আফসোস করছিল নীলুফার বেগম।নিজের সংসার দিয়েও সে শান্তি পায়নি সে। কথায় কথায় আজ তাশদীদের মায়ের কথা তুললেন তিনি।বললেন,
“তাশদীদের মা একা হাতে সংসার সামলেছে। সব ভাইয়েরা তার হাতেই মানুষ।অথচ তার জীবনটা কত ক্ষণস্থায়ী।”
তার কথায় তাজবীদের মা বলল,
“এ জন্যই আমি সাগরিকার সাথে তাশদীদের বিয়েটা মানা করছিলাম।”
এই কথাতে সাগরিকার মা বলল,
“এতে আমার মেয়ে কেন আসছে?”
“কারণ তুই কী জানিস?এক গুণকে তার হাত দেখে বলছিল সে বেশিদিন বাঁচবে না।বছর খানেকের মধ্যে মারা যাবে সে।তাই হয়েছে।”
“তো?”
“গুণকের কথা সত্যি হইছিল।শুধু তাই নয়, কায়সার ভাইয়ের কথাও বলছিল।তার হাত দেইখা সে বলছিল যে সে আগুনে পুইড়া মরবো।মরে নাই?”
নীলুফার বেগম সম্মতি জানালেন।কিন্তু সামিনা প্রতিবাদ করে বলল,
“এসব কুসংস্কার মাত্র। স্নেহার বাবার মৃত্যুতে কারোর হাত ছিল না ভাবী।আমার মৃত স্বামীকে ইস্যু বানিয়ে সাগরিকাকে কেন কথা শোনাচ্ছো।”
“কারণ সেই গুণকেই বলছে সাতাশ বছর বয়সে তাশদীদ বড় একটা আঘাত পাবে।আর তাশদীদের সাতাশ বছর চলছে।”
পিছন থেকে সাগরিকা কথাগুলো শুনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।গত রাতের স্বপ্নটা যেন এখন স্পষ্ট হচ্ছিলো।স্বপ্নে দেখা
সাদা শাড়ি পরিহিতা মেয়েটা সে নিজেই ছিল।
চায়ের ট্রে রেখে সে দ্রুত সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল নিজের ঘরে যাওয়ার সময়।কিন্তু মাঝে সীমার সাথে ধাক্কা লেগে গেল।হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়েও ধরতে পারলো না সে। তার চোখের সামনেই গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিলো সীমা।
চলবে…..