হাত পা বাঁধা অবস্থায় মাইক্রোবাসের ভিতর শুয়ে আছি। কালো কাপড়ে চোখও বাঁধা। কেউ একজন গাঁয়ের উপর পা দিয়ে বসে আছে। নড়াচড়া করার চেস্টা করলেই মাথায় চাটি মেরে বলছে, খবরদার। শব্দ করবি না, খুন করে ফেলব।
আমি চুপচাপ আছি আপাতত, চেস্টা করছি নড়াচড়া না করার। ভয় করছে অনেক। হুট করেই বিপদে পড়ে গেছি। কঠিন বিপদ। অথচ ঘটনা খুব সামান্য ছিল।
আজ সকালের দিকে আসাদগেট পার হয়ে আমি আর গুলজার আংকেল হেঁটে আসছিলাম সংসদ ভবনের দিকে। রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একটা মাইক্রোবাসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক লোক ধাক্কা দিলো গুলজার আংকেলকে । তারপর উনার কলার চেপে ধরে বলল, ওই মিয়া ধাক্কা দিলেন কেন?
আমার চট করে মাথায় রক্ত উঠে গেল। ব্যাটা নিজে ধাক্কা দিলো এখন এসে মাস্তানি করছে। এগিয়ে গিয়ে বললাম, ওই মিয়া কি করছেন? ধাক্কা তো আপনিই দিলেন।
গুলজার আংকেল শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, হঠাৎ বললেন মেহেদী সাবধান!
একজন আমাকে বলল, ওই আগ বাড়ায় ঝামেলা করেন কেন? আপনারে কিছু কইছি? ফুটেন।
আমার মাথায় রাগ উঠে গেল। গুলজার আংকেলকে যে ধরে ছিল তার গাঁয়ে ধাক্কা দিলাম। সে একটু সরে গিয়ে চট করে পকেট থেকে পিস্তল বের করে ফেলল। সাথের জনকে বলল, ওই দুইটারেই উঠা। ছোটটার তেজ বেশী। তেজ কমাইতে হইব।
একজন পিস্তল ধরে রাখল আর দুইজন হ্যাচকা টানে আমাদের মাইক্রোবাসে উঠিয়ে ফেলল। ছুটির দিন সকালে এম্নিতেই লোকজন কম থাকে তার উপর ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটল আমার বিশ্বাস আশেপাশের কেউই ভালো করে কিছু বুঝতে পারেনি।
মাইক্রোবাস ছুটে চলছে। কোথায় যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। গুলজার আংকেল কোন শব্দ করছেন না, তার কি অবস্থা সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। চুপচাপ থাকলে এরা কিছু বলছে না কিন্তু নড়াচড়া করলেই মার এসে পড়ছে এইজন্যে হয়ত গুলজার আংকেল চুপ করে আছেন। এতোক্ষণ ভাবছিলাম এরা হয়ত মারধর করে ছেড়ে দেবে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এরা পরিকল্পিত ভাবেই ধরেছে আমাদের। ঘটনা তাহলে সামান্য না। সম্ভবত এরা ছিনতাইকারি চক্রের সদস্য। নিরাপদ জায়গায় নিয়ে জিনিসপত্র রেখে ছেড়ে দেবে। আবার আমাদের আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের চেস্টাও করতে পারে। ভাবলাম সেটা করলে এরা ভুল করবে। এরা জানে না গুলজার আংকেল পিবিআইএর নামকরা ডিআইজি ছিলেন। তাকে অপহরণ করে হজম করা অসম্ভব। আমার এই কিডন্যাপারদের জন্য মায়া হল। ধরা পড়ে যাবে বেচারারা। গুলজার আংকেল কি জিনিস জানে না ওরা।
সময়জ্ঞান আমার খুব একটা নেই। কতক্ষণ মাইক্রোবাস চলল খেয়াল থাকল না আমার। ক্লান্তিতে ঝিম এসে গিয়েছিল। মোবাইল মানিব্যাগ এরা আগেই নিয়ে গেছে। অনেকক্ষণ ধরে গাড়ি চলার পর থামল। সেটা আসলে এক ঘন্টা পর না পাঁচ ঘন্টা পর কিচ্ছু আন্দাজ করতে পারলাম না আমি। এরমধ্যে অবশ্য দুএকবার গাড়ি কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়েছিল। সম্ভবত সিগন্যালে। আজ শুক্রবার। ছুটির দিনের এই সকালে ঢাকার রাস্তায় গাড়ি চলাচল কম থাকে।
মাইক্রোবাস থামার পর ঝিমুনি ভাব কাটিয়ে সজাগ হয়ে গেলাম। কেউ একজন আমাকে ধরে গাড়ি থেকে নামাল। ঠেলে ধাক্কিয়ে একটা রুমের মধ্যে ঢোকাল। তারপর হাত পা আর চোখের বাঁধন খুলে দিল। তাকিয়ে দেখি একটা রুমের মধ্যে আমি আর গুলজার আংকেল বসে আছি। ওরা সবার শেষে চোখের বাঁধন খুলেছে তারপর রুম থেকে বের হয়ে দরজা লাগিয়ে চলে গেছে। আমার হাত পা অবশ হয়ে গিয়েছিল, ডলে রক্ত চলাচল চালু করলাম। তারপর গুলজার আংকেলের দিকে তাকিয়ে বললাম, এরা কি কিডন্যাপ করল আমাদের আংকেল?
গুলজার আংকেলও হাত পা ডলে রক্ত চলাচল বাড়াচ্ছিলেন। চারিদিকে একবার তাকিয়ে বললেন, তা-ই তো মনে হচ্ছে।
আমি বললাম, মুক্তিপণ চাইবে নিশ্চয়ই। কি বিপদ, হুট করে আমরাই এদের খপ্পরে পড়ে গেলাম! কিন্তু কোথায় আনল আমাদের? ঢাকার ভিতরেই আছি নাকি?
গুলজার আংকেল একটু চিন্তা করে বললেন, আমরা সম্ভবত গাজীপুরের পাহাড়ি এলাকায় আছি।
ধুর কি বলেন আংকেল? গাজীপুর ? এতোদূর? শিওর হচ্ছেন কিভাবে?
গুলজার আংকেল চিন্তিত ভঙ্গীতে বললেন,
আমার হিসাবে প্রায় ঘন্টা চারেক গাড়ি চলেছে। মাঝে বেশ খানিকটা ভাঙ্গা রাস্তা পার হয়েছে গাড়ি, শেষের দিকে রাস্তা উঁচুনিচু আর আঁকাবাঁকা ছিল। আজ শুক্রবার হিসাব করলে ঢাকার আশেপাশে ঘন্টা চারেকের রাস্তায় টিলার উপর বাড়ি আছে গাজীপুর আর কুমিল্লা। কিন্তু কুমিল্লা যাওয়ার রাস্তা ভালো, এখানে আসার পথে অনেক খারাপ রাস্তা পার হতে হয়েছে সঙ্গে জ্যামও ছিল অল্প, সবমিলিয়ে এটা গাজিপুরই মনে হচ্ছে।
আমি বললাম, বলেন কি আংকেল ঘন্টা চারেক মানে এখন দুপুর । সকাল সাতটায় বের হয়েছিলাম। মিলি এতোক্ষণ চিন্তা শুরু করেছে। প্লিজ একটা উপায় করেন, চলেন কেটে পড়ি।
গুলজার আংকেল রুমটা ভালো করে লক্ষ্য করলেন, তারপর দরজা পরীক্ষা করলেন। শেষে হতাশ হয়ে বললেন, এই রুম থেকে বের হওয়ার উপায় নেই। ওরা কি চায় সেটা আগে জানতে হবে তারপর পরিকল্পনা।
আমি ভালো করে রুমটার দিকে তাকালাম। আশ্চর্য একটা রুম এটা। তিন পাশেই জানালা বিহীন দেয়াল। এক পাশে দরজা, সেটা বাইরে থেকে বন্ধ এখন। রুমের ভিতর আবার এসি বসানো আছে এবং সেটা চলছে। একটা এটাচড বাথরুম আছে। ভিতরে ফার্নিচার বলতে একটা খাট একটা চেয়ার আর একটা ছোট টেবিল। গুলজার আংকেল ঠিকিই বলেছেন এই রুম থেকে বের হওয়ার উপায় নেই।
আমি অস্থির হয়ে গেলাম। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। ছিনতাইকারিরা আর লোক খুঁজে পেল না। আমাদেরই ধরতে হবে। ব্যাটারা জানে না যে আমার টাকা পয়সা তেমন নেই। যা বেতন পাই তার বেশিরভাগই যায় বাড়ি ভাড়ায় আর বাকিটা খরচ করে ফেলি। জমা প্রায় নেই বললেই চলে। ওইদিকে গুলজার আংকেলও তেমন বড়লোক না। সারা জীবন সৎ ছিলেন। এখন সম্বল বলতে কিছু সঞ্চয়পত্র আর পেনশন। ছিনতাইকারিদের খুব একটা সুবিধা হবে না। কিন্তু একটা ভয় আছে। এরা যদি আমাদের আটকে রেখে আমাদের আত্মীয়স্বজনদের চাপ দেয় টাকার জন্য তাহলেই মুস্কিল। অনেক সময় টাকা না দিলে খুনও করে ফেলে মানুষকে। আমার ভয় ভয় করতে লাগল।
সন্ধ্যা পর্যন্ত ওইঘরে আটকা থাকলাম। কেউ এলো না। কোন খাবারও দিল না। এক গ্লাস পানি পর্যন্ত না। এই রুমে একটা এটাচ বাথরুম আছে। আমি সেখানকার কল থেকে একবার গিয়ে পানি খেয়ে এলাম। দুর্বল লাগছে, সারাদিন না খাওয়া। এরা কি চায় কিছু বোঝা যাচ্ছে না। এই রুমের কোন জানালা নেই, ফলে বাইরের কিছু দেখাও যাচ্ছে না। রুমের ভিতর একটা খাট, একটা টেবিল একটা চেয়ার। আমি খাটে শুয়ে থাকলাম ক্লান্ত হয়ে। গুলজার আংকেল চেয়ারে বসে আছেন চুপচাপ, চিন্তিত। বোঝা যাচ্ছে এই মুহুর্তে গুলজার আংকেলও কোন পথ খুঁজে পাচ্ছে না।
গুলজার আংকেল আন্দাজ করে যখন বললেন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে তখন দরজা খুলে গেল।
আমার অবস্থা ততক্ষণে কাহিল। তীব্র ক্ষিধার সঙ্গে ভয় মিশিয়ে দুর্বল হয়ে গেছি। ঘরের মধ্যে তিনজন লোক ঢুকলো।
একজন রুমে ঢুকেই আমার চুলের মুঠি ধরে আমাকে বিছানায় বসাল।
কি ক্ষিধায় কাহিল না? ঠিক ঠাক মতো কথা যা বলি তাই শোন তাহলে খাবারও পাবি আর মুক্তিও পাবি।
চুলের মুঠি ধরার সাথে সাথে আমার মধ্যে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মুহুর্তে ক্ষিধা আর ভয় চলে গেল। রাগ উঠল মারাত্মক। ইচ্ছে হল ঝাপিয়ে পড়ি ব্যাটাদের উপর। গুলজার আংকেল সব দেখছিলেন। বললেন,
শান্ত হও মেহেদী। বোকামি করো না।
আমি শান্ত থাকলাম। এই দুর্বল শরীরে তিনজনের সাথে লাগতে যাওয়া মানে মার খেয়ে ভুত হয়ে যেতে হবে। তারপর এদের কাছে নিশ্চয়ই অস্র আছে।
একজন আমার মোবাইলটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, তোর বউকে ফোন কর। আগামীকালের মধ্যে পঞ্চাশ লাখ জোগাড় করতে বল। নইলে তোর কল্লা কুরিয়ার করে তার কাছে পাঠামু।
আমি বললাম, পঞ্চাশ লাখ? মাথা খারাপ? ছোট খাট চাকরি করি, এতো টাকা চোখে দেখিনি কখনও।
একজন এগিয়ে এসে আমার মাথায় চাটি মারল।
ব্যাংকে চাকরি কর আর পঞ্চাশ লাখ চোখে দেখোনি? আরাকবার উল্টাপাল্টা কথা বললে থাবরায়ে দাঁত ফেলাই দিব।
ভাবলাম আমার ব্যাংকের চাকরির খবর এরা কিভাবে জানল? তারপরই মনে হল মানিব্যাগে আমার অফিসের পরিচয় পত্র আছে, আর এদের হাতে আমার মানিব্যাগ।
বললাম, ভাই ব্যাংকে চাকরি করলেও বেতন যা পাই সারা মাসের খরচ চালাতেই চলে যায়, জমানো নাই কিছু। বিশ্বাস না হলে খোঁজ নিয়ে দেখেন। এতো টাকা আমার বউ দিতে পারবে না মাঝখান থেকে আমার জান যাবে আর আপনারাও কিছু পাবেন না, সবারই লস। তারচেয়ে প্লিজ ভাই দেয়ার মতো কিছু চান, হাজার পঞ্চাশেক। কষ্ট হলেও আমার বউ হয়ত সেটা জোগাড় করতে পারবে।
এই কথায় লোক তিনজন একটু থমকাল। সরু চোখে তাকিয়ে বোঝার চেস্টা করছে আমি রসিকতা করছি কি না। মোটা লোকটা হঠাৎ বলল, এই ব্যাটা বেশী স্মার্ট। এর পিঠে স্ট্যাম্প ভাঙ্গলে এ লাইনে আসবে। ওই স্ট্যাম্পটা দে।
একজন একটা ক্রিকেট স্ট্যাম্প মোটা লোকটার হাতে ধরিয়ে দিল। মোটা লোকটা নির্বিকারভাবে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি ভয় পেলাম। প্রচন্ড মার নেমে আসছে আমার উপর।
হঠাৎ গুলজার আংকেল বললেন, শুভ তুমি যে বখরার টাকা এদের দুইজনকে ঠিক মতো দাও না সেটা এরা জানে?
মোটা লোকটা আমাকে মারার জন্য স্ট্যাম্প তুলে ফেলেছিল, সেই অবস্থায় সে থেমে গিয়ে ঘুরল।
অন্য দুইজনও চমকে গেছে। বিস্মিত হয়ে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।
কে? কে আপনি? কিভাবে আমার নাম জানলেন?
আমি তোমাদের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি। এই যেমন তুমি শুভ, ইটের ভাটায় কাজ কর আর পার্ট টাইম ছিনতাই কর। কিন্তু বখরার টাকার বড় অংশ তুমি রেখে দাও ।
শুভ নামের লোকটা অন্য দুইজনের দিকে চকিতে তাকাল। বলল, এর কথা বিশ্বাস করিস না জিল্লু মানিক্যা। ব্যটা মিথ্যুক।
সে আমার দিকে মোবাইল ছুঁড়ে দিল। আমি মিলিকে কল দিলাম,
–মিলি? হ্যালো?
–হ্যালো মেহেদী, তুমি কোথায়? সারাদিন তুমি আর গুলজার আংকেল নিখোঁজ। ফোন বন্ধ। কি হয়েছে তোমাদের?
–কিছু না মিলি। একটু ঠান্ডা মাথায় শোন, আমাদের কিডন্যাপ করা হয়েছে, এখন এরা টাকা চাচ্ছে,
এই সময় আমার হাত থেকে একজন ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল,
আপনার জামাইকে ফিরে পাইতে হইলে পঞ্চাশ লাখ লাগবে। কালকের মধ্যে বিশ লাখ জোগাড় করবেন আর বাকি টাকা একদিন পরে নেব। কোন চালাকি না। পুলিশ বা র্যাবে কিছু জানালে জামাইকে আর পাবেন না, মাইরে ফেলব, লাশের হদিসও পাবেন না।
কথা শেষ করে সে আবার ফোন আমার হাতে দিলো। মিলি তখন ফোনের ওইপাশে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
আমি ফোন ধরে বললাম, মিলি তুমি ভয় পেয় না।
সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল, আমি এতো টাকা কোথায় পাব, তোমেকে কি ওরা সত্যি মেরে ফেলবে?
আমি কিছু বলার আগেই একজন ফোন নিয়ে সেটা বন্ধ করে দিল। শুভ আমাকে ধরে টেনে উঠালো, যারা ভুল করে তাগো কি হয় আইসা দেখেন।
ওরা আমাকে বের করে নিয়ে এলো। অন্ধকার হয়ে গেছে চারপাশ। বাইরে উঠান পেরিয়ে তারা একটা ঘর খুলল, ঘরটার ভিতর উৎকট ঘন্ধ। কেউ একজন লাইট জ্বালালো। দেখলাম ঘরের মধ্যে একটা চৌবাচ্চার মত, পানি নেই। সেখানে কিছু শাদা হাড়গোড়। ঘরের চারপাশে ড্রাম ।
শুভ হেসে বলল, ভালো করে দেখ, টাকা না দিলে ঐ হাড়গোড়ের সঙ্গে জায়গা হবে। চৌবাচ্চাতে ফেলায় দিয়া এসিড দিয়ে নাই কইরা দিমু।
আমি বুঝতে পারলাম কি হয় এখানে। চৌবাচ্চায় লাশ ফেলে এসিড দিয়ে পুরানো হয়। কি ভয়ংকর!
আমি ভীষণ ভয় পেলাম। এরা বোঝা যাচ্ছে ঠান্ডা মাথার খুনি। গুম করে নিয়ে আসে, টাকা পয়সা নে পেলে মেরে এসিড দিয়ে গলিয়ে দেয়। কি ভয়ংকর!
মিলি এখন কি করছে? সে বুদ্ধিমতি মেয়ে। পুলিশে যাবে না, চেস্টা করবে টাকা জোগাড় করে আমাকে আগে ছাড়াতে। সে টাকার জন্য এখন তার বাবা ভাইয়ের কাছে যাবে। তাদের কি বলবে মিলি? মিলির জন্য মায়া হলো, বেচারি নিশ্চয়ই এখন উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটছে আত্মীয়স্বজনের কাছে। টাকা জোগাড় করতে না পারলে আমাদের পরিণতি কেমন হবে এইমাত্র দেখে এলাম। কিন্তু এতো টাকা কিভাবে জোগাড় করবে মিলি?
#থ্রিলার মৃত্যুর মুখে প্রথম পর্ব
লেখক ঃ খোন্দকার মেহেদী হাসান
#থ্রিলার_মৃত্যুরমুখে_দ্বিতীয়ওশেষপর্ব
পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গল আমার। সারারাত ভালোমত ঘুম হয়নি। বারবার মিলির কথা মনে হয়েছে। বেচারি উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটাছুটি করছে নিশ্চয়ই। এতো টাকা সে কিভাবে জোগাড় করবে? রাতে এরা খাবার দিয়েছিল। সারাদিন না খেয়ে থেকে সেটা খেয়ে নিয়েছি, ভাত মুরগি আর ডাল। শরীরে এখন শক্তি পাচ্ছি বেশ।
গুলজার আংকেলকে সকাল বেলা দেখলাম শান্ত। গতকাল রাত পর্যন্ত তাকে গভীরভাবে চিন্তিত দেখেছি, আজ সকালে মনে হচ্ছে সে খানিকটা নিরুদ্বিগ্ন।
সকালে জিল্লু নামের লোকটা খাবার দিতে দরজা খুলল। জিল্লু খাটো ধরনের মানুষ। গাঁট্টাগোট্টা শরীর, বোঝা যায় শক্তি প্রচন্ড। সে একটা ছেঁড়া জিন্সের প্যান্ট পরে আছে, উপরে ঢিলাঢালা একটা ফতুয়া। ফতুয়াটার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেটাতে অনেকগুলো পকেট ।
গুলজার আংকেল শান্ত ভঙ্গীতে বললেন, জিল্লু তোমার মেয়ে কতদিন ধরে অসুস্থ ? লিউকেমিয়া না ? কতদিন পর পর রক্ত দিতে হয়?
জিল্লু হতভম্ব হয়ে গেল। সন্দেহের গলায় বলল, আপনি কিভাবে জানলেন? আপনি কে? আমাকে কি চেনেন?
গুলজার আংকেল বললেন, তোমাকে চিনি না জিল্লুর তবে আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি। এই যেমন ধর তুমি ইটের ভাটায় কাজ কর , সেখানেই সম্ভবত শুভ তোমাকে এক্সট্রা ইনকামের জন্য এই দলে ভিড়িয়েছে। কিন্তু তুই আসলে এদের মতো এতো খারাপ লোক নও। আচ্ছা কতদিন ধরে তুমি এই দলে? খুব বেশিদিন হয়নি বোধহয়।
জিল্লু এই কথায় থমকালো। তারপর নীচু গলায় বলল, স্যার মাত্র মাস ছয়েক হইছে। কি করব স্যার মেয়ের প্রতি মাসে দুইবার রক্ত লাগে। এক ব্যাগ রক্ত কিনতে হাজার দুয়েক থেকে হাজার পাঁচেক টাকা লাগে। কে দেবে এতো টাকা? বিশ্বাস করেন স্যার নইলে এই খারাপ কামে রাজি হইতাম না।
আচ্ছা এই ছয়মাসে কি কাউকে তোমরা মেরে ফেলেছ?
জিল্লু এই কথায় কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, কাউরে মারতে চাইলে শুভ নিজের হাতে মারেন, আমি ওর মধ্যে নাই।
গুলজার আংকেল কথা ঘুরালেন। আচ্ছা জিল্লু এই জায়গাটা তো উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা, গেট আটকানো, দারোয়ান আর অনেক পাহারাদার আছে। আমাদের আটকে রেখেছ কেন রুমে? টাকা জোগাড় হচ্ছে, তোমরা পেয়ে যাবা, আমরা কি একটু হাঁটা চলা করতে পারি ?
জিল্লু কিছুক্ষণ গুলজার আংকেলের দিকে তাকায় থেকে বলল, ঠিক আছে স্যার, আমি শুভকে বোঝায় বলবনে, আপনারা হাত পা ঝাইড়া চলা ফেরা করেন। ইচ্ছা করলেও পালাতে পারবেন না। দেয়াল টপকানো সম্ভব না। তাছাড়া এখানে অনেক গার্ড আছে, সবার হাতেই যন্ত্র আছে।
আমি বুঝলাম যন্ত্র বলতে সে অস্রকে বোঝাচ্ছে।
আমি আর গুলজার আংকেল ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। বিঘা তিনেক জায়গার উপর একটা বাগানবাড়ির মতো। চারপাশে উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা, দেয়ালের উপর কাঁটাতারের বেড়া। ভেতর থেকে মই ছাড়া ওই দেয়ালের উপর ওঠা অসম্ভব। মূল বিল্ডিং তিনতলা। ভিতরে এক তলা আরো দুইটা বিল্ডিং আছে। গাছপালা ঘেরা বিল্ডিং গুলো বাইরে থেকে দেখা যাওয়ার কথা না। আমরা তিনতলায় উঠলাম, ছাদের দরজা তালা দিয়ে বন্ধ করা। তিনতলার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দেখি আশে পাশে গাছপালার জন্য তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে বোঝা যায় একটা ছোট টিলার উপর এই বাগান বাড়িটা করা এবং আশে[পাশে তেমন কোন বাড়িঘর নেই। মানে এখান থেকে গলা ফাটিয়ে চেচালেও লাভ হবে না। নীচে কয়েকজন গার্ডকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। এরা মাঝে মাঝেই বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। আমার আশ্চর্য লাগল। কি পরিমান কনফিডেন্ট থাকলে ওরা এভাবে আমাদের ছেড়ে রেখেছে। ভাবছে আমরা দুই জন ওদের কোন ক্ষতিই করতে পারব না। ওরা কি জানে এখানে একজন ট্রেইন্ড পুলিশ অফিসার আছে?
তিনতলায় মোট পাঁচটা রুম। সবগুলোই খোলা। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। এই সময় পায়ের শব্দ পেয়ে দেখি মানিক্যা অর্থাৎ মানিক এসে দাঁড়িয়েছে । আমাদের দেখে বলল, জিল্লু দেখলাম আপনাদের খুব ভক্ত হইয়ে গেছে, আপনারা নাকি মানুষের চেহারা দেইখে তার সবকিছু বলে দিতে পারেন, ওইজন্যই সে শুভ ভাইজানরে কইয়া আপনাদের হাটা চলার ব্যবস্থা করছে। লাভ নাই এই জায়গা থেকে পালানো সম্ভব না।
আমরা কিছু বললাম না। মাইনক্যা অর্থাৎ মানিক জিল্লুর মতো সহজ লোক না, তাকে দেখেই মনে হচ্ছে সে বর্ন ক্রিমিনাল। বাঁকা হাসি হাসছে আর আমাদের সাথে ঘুরছে।
এক রুমে ঢুকে দেখি অসংখ্য রঙ্গীণ কাগজ, আর বেশ কিছু ফানুস রাখা।
মানিক বলল , বাগানবাড়িতে নববর্ষ পালন হইছে এইগুলা দিয়া। মাইনষে যে কিভাবে টাকা উড়ায়।
গুলজার আংকেল হঠাৎ বললেন, মানিক এই মানিক।
মানিক অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। প্রথমে সে গুলজার আংকেলের ডাক খেয়াল করল না, তারপর চমকে ঘুরে বলল, জ্বে?
গুলজার আংকেল অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বললেন, মানিক, একটু ছাদে ঘুরতে চাচ্ছিলাম, তোমার কাছে ছাদের চাবি আছে?
মানিক হাসল, ছাদে যাইয়া লাভ নাই। গাছপালার জন্য আশেপাশের কিছু দেখা যায় না। এখান থেকে পালানোর চেস্টা করেও লাভ নাই।
পালাবো না, ছাদে বসে গল্প করতাম আর কিছু না।
মানিক বলল, আপনি নাকি চেহারা দেখে অনেক কিছু বলতে পারেন, আমার চেহারা দেখে বলেন দেখি কিছু, আমি সন্তুষ্ট হইলে ছাদের দরজা খুলে দেব।
গুলজার আংকেল কিছুক্ষণ মানিকের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন,
মানিক তোমার আসল নাম না। সম্ভাবত এদের দলে এসে মানিক নাম নিয়েছ। তুমি অন্য দুইজনের মতো ইটের ভাটায় কাজ করো না, সম্ভবত এই বাগান বাড়ির মূল কেয়ারটেকার তুমি। তুমি এখন আমার কাছে এসেছ শুভ সত্যিই তোমাদের ভাগে কম দিয়ে টাকা মেরে দিচ্ছে কিনা সেটা জানতে। আমি ঠিক বলেছি?
মানিক অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে গুলজার আংকেলের সব কথাই ঠিক হয়েছে। সে সরে গিয়ে কোমড় থেকে চাবি বের করে ছাদের গেটের তালা খুলে দিল। তারপর হঠাৎ আমাদের দিকে ঘুরে বলল, শুভ আমাদের টাকা কম দিতেছে আপনি সেটা কিভাবে জানলেন?
গুলজার আংকেল শান্ত স্বরে বললেন, মানিক শুভর একটা ট্রাংক আছে না তার রুমে, সবসময় তালা দেয়া থাকে? ঐ ট্রাংকের ভিতর শুভ যে টাকা রাখছে ওইটা গুনলেই বুঝতে পারবা তোমরা কম পাচ্ছ।
মানিক একবার সতর্ক চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে নেমে গেল।
আমরা ছাদে একবার উঁকি দিলাম। মানিক ঠিকিই বলেছে, এই বিল্ডিঙের ছাদ থেকে আশে পাশে তেমন কিছুই দেখা যায় না, চারিদিকে বড় বড় গাছপালা । মজার ব্যপার হচ্ছে নীচ থেকেও ছাদে কে কি করছে সেটা দেখা যাবে না। তাতে অবশ্য লাভ হচ্ছে না, এই ছাদ থেকে পালানোর কোন উপায় নেই।
গুলজার আংকেল হঠাৎ বললেন, মেহেদী তুমি নীচে যাও। আমার ছোট একটা কাজ আছে, আমি আসছি।
আমি অনিচ্ছা নিয়ে নিচে নেমে এলাম। কি কাজ বাকি গুলজার আংকেলের? নিচে নামতে নামতে মিলির কথা মনে হল, কি করছে এখন মেয়েটা? ভাবতে ভাবতে আমার মাথা খারাপ হতে লাগল। একদল বদমাশ আমাদের এখানে আটকে রেখে টাকা চাইছে , এতোই সহজ? আমি চারিদিকে ভালো করে তাকালাম। মনে হলো কোন পাশের দেয়াল টপকে নিশ্চয়ই পালানো সম্ভব । আমি ছুটতে আরম্ভ করলাম দেয়াল ঘেঁষে। আশে পাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। দেয়ালের পাশ ঘেঁষে যাচ্ছি আর দেখছি কোন গাছ বেয়ে দেয়ালে ওঠা যায় কিনা। কিন্তু দেয়ালের সাথে লাগানো কোন গাছ নেই। ছুটতে ছুটতে উঁচু গেটের কাছে চলে এলাম। আশেপাশে না তাকিয়ে লাফিয়ে গেট বেয়ে উঠা শুরু করে দিলাম। কেবল গেটে হাত দিয়ে উঁচু হয়েছি কানের পাশে প্রচন্ড জোরে বাড়ি লাগল। অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
জ্ঞান ফিরে দেখি বিছানায় শুয়ে আছি। মুখের উপর গুলজার আংকেল ঝুঁকে আছেন।
তুমি ঠিক আছ মেহেদী?
জ্বি আংকেল, মাথার পেছনে একটু ব্যথা। কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম?
আধাঘন্টার মতো। ওইভাবে দৌড়ান ঠিক হয় নি, এরা গুলি করে বসতে পারত। খুন খারাবি এদের কাছে কিছু না।
স্যারি আংকেল, মাথা ঠিক ছিল না। আমি উঠে বসলাম। আমাদের রুমের ভিতর আবার আটকে রাখা হয়েছে মনে হল। সে-ই রুমেই শুয়ে আছি আর বাইরে থেকে দরজা আটকানো।
হতাশ হয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। মিলি কি করছে কে জানে! আজ বিশ লাখ টাকা সন্ধ্যের মধ্যে দিতে হবে। সে কি পারবে?
বললাম, আচ্ছা আংকেল আপনি ওদের সম্পর্কে এতো কিছু বললেন কিভাবে?
গুলজার আংকেলকে বেশ নির্ভার লাগছে। একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, ওহ এই ব্যাপার। কিছু অবজার্ভেশন আর কিছু দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। যেমন ধর শুভ লোকটার গলায় একটা লকেটে শুভ নাম খোদাই করা আছে, লকেটটা বহু পুরান, তারমানে এই নামটা তারই, তার বাচ্চার না। সে অন্যদের বখরার টাকা কম দিচ্ছে এটা একটা সহজ অনুমান। এইধরনের লোকজনের ক্ষেত্রে ওইরকমই হয়, চোর বদমাশরা পরস্পরের প্রতি অবিশ্বস্ত হয়। আর তাছাড়া যদি সে টাকা কম নাও দেয় একটা সন্দেহ তৈরি হয়ে থাকল অন্যদের মনে, এই টিমে গ্যাঞ্জাম লাগলে আমাদের লাভ।
এবার জিল্লুর কথায় আস। তার পকেটে একটা প্রেস্ক্রিপশন আছে। পকেট থেকে একবার রুমের ভিতর পড়ে গিয়েছিল সেটা, সে কুড়িয়ে ভাজ করে আবার পকেটে রেখেছে। ওই প্রেসক্রিপশনেই তার মেয়ের নাম আর বয়স চোখে পড়েছে আমার সঙ্গে রোগের বর্ননা। তাছাড়া তারমধ্যে এক ধরনের সরলতা আছে যেটা অন্য দুইজনের মধ্যে নাই। বোঝা যায় এই পেশায় সে বেশিদিন হয়নি তাহলে ওই সারল্য থাকত না। এদের দুইজনের হাত আর পায়ের দিকে খেয়াল করলে পোড়া আর কালশিটে দাগ দেখতে পেতে, ইটের ভাঁটায় কাজ করা শ্রমিকদের হাত পায়ে ওইরকম দাগ হয়। যেটা মানিকের নাই, আবার মানিকের সঙ্গে অনেকগুলো চাবি থেকে সে একটা চাবি বের করে ছাদের গেট খুলে দিল, এই বাড়ির কেয়ার টেকার ছাড়া আর কার কাছে এই চাবিগুলো থাকবে?
ওহ ভালো কথা, মানিককে যতবারই তার নাম ধরে ডেকেছি সে রেসপন্স করেছে দেরীতে। খুব সূক্ষন ভাবে তুমি লক্ষ্য করলে বুঝতে নাম ধরে ডাকার পর সেটা বুঝতে সে সময় নিচ্ছে, বোঝাই যাচ্ছে সে এই নামে খুব একটা অভ্যস্ত না।
আমি বললাম, কিন্তু শুভর যে একটা ট্রাঙ্ক আছে সেই ট্রাঙ্কে সে টাকা রাখে সেটা কিভাবে বুঝলেন?
অভিজ্ঞতা থেকে অনুমান। এই ধরনের অপরাধীরা দেখা গেছে টাকা নিজের সঙ্গে রাখতে পছন্দ করে। স্টিল বা টিনের ট্রাঙ্ক হচ্ছে এমন একটা জিনিস যেটা না ভেঙ্গে কোন কিছু নেয়া যায় না আবার চুরি করে পালানোও কঠিন। এই লেভেলের মানুষের সিন্দুকের মতো কাজ করে এটা। তবে শুভর ক্ষেত্রে আমার আন্দাজ নাও মিলতে পারে। ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা সেভেন্টি পার্সেন্ট। তবুও বলেছি কারন এতে একটা জিনিস হবে মানিকের মনে সন্দেহ ঢুকে যাবে। সেটা আমাদের কাজে লাগতে পারে।
একটু পরেই বাইরে একটা হৈচৈ এর শব্দ শুনলাম। আমাদের দরজা খুলে গেল। জিল্লু বাইরে দাঁড়িয়ে। সে বলল, শুভ আর মানিক্যার বিরাট ঝগড়া শুরু হয়েছে। এই ঝগড়া খুব খারাপ দিকে যাচ্ছে। শুভ আমাদের নিয়ে যেতে বলেছে।
রুম থেকে বাইরে বের হয়ে দেখি দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। সামনের ছোট ফুলের বাগানের মাঝখানে একটা বসার ছাউনি , সেখানে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করছে শুভ আর মানিক। আমরা পৌঁছাতেই শুভ হুমকির গলায় বলল, আমার ট্রাঙ্কে টাকা আছে নাকি বলেছেন আপনি?
গুলজার আংকেল শান্ত ভঙ্গিতে বললেন হু আছে তো । তুমি ঐ ট্রাঙ্কে যে টাকা রেখেছ সেটার ভাগ এদের দুইজনেরও।
শুভ আচমকা পিস্তল বের করে গুলজার আংকেলের মাথায় ঠেকাল। আপনি মিয়া খুব চালাকি করতেছেন, ভাবছেন আমগো মধ্যে গ্যাঞ্জাম লাগায় দিয়া বাঁচবার পারবেন। পারবেন না। ফুটা কইরা এসিড দিয়ে পুড়ায় ফেল্মু। বহু পুড়াইছি আগে। মাইনক্যা শোন, আগে এই ঝামেলাটা শেষ করি টাকা হাতে পাই, তারপর তোদের সবকিছু বুঝায় দিতেছি।
মাইনকা ওরফে মানিক বলল, না, তুমি তোমার ট্রাঙ্ক দেখাও, যদি সেখানে হিসাব মতো টাকা থাকে তাইলে অসুবিধা কি? তোমার টাকা তোমার। তুমি তো আসলে আমগো ঠকাইতেছ। পার্টির কাছ থেকে পুরা টাকা নিতেছ আর আমাদের বলতেছ টাকা কম দিছে পার্টি। কিছুদিন ধইরেই আমি এইরকম সন্দেহ করতেছিলাম।
আমি দেখলাম, আরোও চারপাচজন জড়ো হয়েছে এখানে। সবগুলো গার্ডই বোধহয় এই ঝামেলা দেখতে চলে এসেছে। এবং একটা জিনিস বুঝলাম এই সশস্র গার্ডগুলোর উপর শুভর চেয়ে মানিকের প্রভাব বেশী।
দুইজন ধরাধরি করে শুভর ট্রাঙ্ক নিয়ে এলো। বড়সড় ট্রাঙ্ক। শুভ বেজার মুখে ট্রাঙ্ক খুলে দিল। ট্রাঙ্ক ভরতি একহাজার টাকা নোটের বান্ডিল। আমার হিসাবে এক কোটি টাকার উপর আছে ট্রাঙ্কে।
দেখে মানিক শীষ দিয়ে উঠল। ঘটনা তাইলে সত্যি! শুভ তুমি আমাগো ঠকাইছ। এইটাকার ভাগ আমগোও। এই টাকা আবার ভাগ হইব। ওই দুপুরের খাবার খাইয়ে এই টাকা নিয়ে বসমু আমরা।
আমরা দুপুরের খাবার খেতে রুমে এলাম। জিল্লু খবর আনল আমার বাসা থেকে ফোন এসেছে, টাকা জোগাড় করে ফেলেছে আমার স্ত্রী। আমি বিস্মিত হলাম, মেয়েটা এতো টাকা কোথায় পেল? মিলি কতখানি বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু বিশ লাখ হয়ত সে ধার টার করেছে, পঞ্চাশ লাখ সে পারবে না। এতো টাকা আমাদের আত্মিয় স্বজনের কাছেও নেই। এরপর গুলজার আংকেল শুভকে রাগিয়ে দিয়েছেন, ওদের ঝামেলা মিটে গেলে শুভ শিওর আমাদের এসিডে পুড়িয়ে ফেলার ব্যবস্থা করবে।
আমরা খাবার খেয়ে আবার সেই ফুল বাগানের মাঝে গিয়ে বসেছি। এখানে সবাই এসে ভীড় করেছে। গেটের দারোয়ান পর্যন্ত চলে এসেছে।
ট্রাংকের টাকা গুনা শুরু হলো। শুভ বারবার ক্রুদ্ধ চোখে দেখছে আমাদের। আজ তার হাত থেকে নিস্তার নেই। আমার ধারনা টাকা পেলেও কোন একটা অজুহাতে শুভ আমাদের মেরে ফেলবে, অন্যরা খুব একটা আপত্তি করবে বলে মনে হয় না। আমি দিশাহারা বোধ করতে লাগলাম। গুলজার আংকেলকে দেখলাম শান্ত ভঙ্গীতে বসে আছেন।
সবাই টাকা গোনার দিকে নজর করে ছিল।
আচমকা কেউ একজন বলল, হ্যান্ডস আপ।
শুনে চমকে চারিদিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম। চারপাশে র্যাবের কালো পোশাক পরা লোকজন। কখন দেয়াল টপকে ঢুকে র্যাব ঘিরে ফেলেছে আমাদের।
র্যাবের কমান্ডার এসে গুলজার আংকেলকে সালাম দিল। স্যার আপনি নিশ্চয়ই গুলজার হোসেন। আপনার মেসেজ পেয়ে চলে এলাম স্যার। ঢাকা থেকে অবশ্য আগেই এলার্ট করা হয়েছিল, জানানো হয়েছিল আপনারা মিসিং।
আমি ভীষণ অবাক। গুলজার আংকেল মেসেজ দিলো কখন?
র্যাব অফিসার তার হাতে ধরা একটা ফানুস দেখাল। ফানুসের গাঁয়ে লেখা , এসও এস, গুলজার, পিবি আই। এটা যে পাবে পুলিশের কাছে নিয়ে গেলে পুরুস্কার পাবে।
গুলজার আংকেল তখন ছাদ থেকে আমাকে নামিয়ে দিয়ে মেসেজ লিখে লিখে সমস্ত ফানুস উড়িয়ে দিয়েছিলেন। নীচে গাছপালা থাকায় বুঝতে পারে নি এরা। তাছাড়া শুভ আর মানিকের মধ্যে ঝগড়া নিয়েও ব্যস্ত ছিলো সবাই। উপরে যে ফানুস উড়ে যাচ্ছে খেয়াল করে নি কেউ। বেশ কয়েকটা ফানুসই গ্রামের লোকজনের হাতে পড়েছে, একজন সেটা র্যাবে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে।
শুভ জিল্লু আর মানিক তাদের আরোও পাঁচজন সহযোগী সহ গ্রেফতার হয়ে গেল। এই বাগান বাড়ির মালিক বিদেশে থাকেন। মানিকের হাতে দায়িত্ব ছিল দেখাশোনা করা। ওহ তার আসল নাম আরমান। সে আসলে জেল খাটা আসামি ছিল, ওইখানেই শুভর সাথে পরিচয় হয়, তারপর বছর দুই ধরে এই ভয়ংকর অপরাধী চক্র তৈরি করেছিল।
সেই রাতে বাসায় ফিরে মিলিকে দেখে ভীষণ মায়া হলো। একদিনে শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে বেচারি। কার কার কাছ থেকে সে টাকা ধার করেছে আমাকে বলল। জীবন আসলে এমনই , মহাবিপদ আপনাকে প্রিয়জন চিনিয়ে দিয়ে যায়। আমি মিলিকে বললাম, মিলি টাকা তো বিশ লাখ তুমি প্রায় জোগাড় করেই ফেলেছ, এখান থেকে আমি লাখ দুয়েক নেব।
কাকে দেবে?
ছোট একটা মেয়েকে, সে লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত। তার বাবা তার জন্য রক্ত জোগাড় করতে গিয়ে ভুল পথে চলে গিয়েছিল, বছর কয়েক সে আর তার মেয়েকে রক্ত কিনে দিতে পারবে না।
মিলি কিছু বলল না। জীবন কত জটিল সে গত একদিনেই ভালোমত টের পেয়ে গিয়েছে।
(শেষ)
লেখক ঃ খোন্দকার মেহেদী হাসান
©mahdihasan