- সেরা থ্রিলার গল্প দ্বন্দ পর্ব ১
- সেরা থ্রিলার গল্প দ্বন্দ পর্ব ২
- সেরা থ্রিলার গল্প দ্বন্দ পর্ব ৩
- সেরা থ্রিলার গল্প দ্বন্দ পর্ব ৪
- সেরা থ্রিলার গল্প দ্বন্দ পর্ব ৫
- সেরা থ্রিলার গল্প দ্বন্দ পর্ব ৬
সেরা থ্রিলার গল্প দ্বন্দ পর্ব ১
-আমার স্ত্রী মারা যায় অপঘাতে। রাত দুটোর সময় গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমার কয়েক সেকেন্ড বুঝে উঠতে সময় লাগছিল নীরা আগুনের ভেতর নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি কম্বল দিয়ে ওকে জাপ্টে ধরি। সিনথেটিক কামিজ পরনে ছিল। হসপিটালে নিতে নিতে সিক্সটি ফাইভ পার্সেন্ট বার্ন।দুদিন অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে নীরা মারা যায়। দুদিন ওর হসপিটালের বেডে ঢোকার সাহস নাই। করিডোর দাঁড়ালে জানালায় ওর ক্ষতবিক্ষত পোঁড়া শরীর….আমি সহ্য করতে পারছিলাম না।
বলতে বলতে সে দু’হাতে মুখ ঢাকল। ভদ্রলোকের বয়স কত ত্রিশ-বত্রিশ। স্ত্রীর বয়স নিশ্চয়ই আরো কয়েক বছরের ছোট হবে।ওইটুকু বয়সের একটা মেয়ে নিজের শরীরে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করে ফেলল। মৃত্যু কি আজকাল এতই সস্তা! আমি গত আটাশ বছর ধরে ডাক্তারি পেশায় থাকার পরেও খবরের কাগজে,নিউজফিডে রক্তারক্তির ছবি এড়িয়ে যাই আর সামনে বসা যুবক চোখের সামনে স্ত্রীকে একটু একটু পুঁড়ে যেতে দেখেছে। কতটা লোমহর্ষক! নেভিব্লু টির্শাট গায়ে ছেলেটাকে তুমি করেই সম্বোধন করলাম,
-এধরনের ঘটনায় সাধারণত ভিক্টিমের পরিবার মেয়ের শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা করে। তোমার ক্ষেত্রে ওরকম কিছু ফেইস করতে হয় নাই।
-না,নীরা মানে আমার স্ত্রী এর আগেও কয়েকবার সুইসাইড অ্যাটেম্প করেছিল। ওর বাবার বাড়ি থাকতে একবার এক পাতা ঘুমের ঔষুধ খেয়ে ফেলে। ভালোবাসা দিবসে দেখা করতে যাই নি বলে হাত পা কেটে রক্তাক্ত করে ফেলে।
-অটোফ্যাজিয়া ছিল সম্ভবত।
-মানে?
-এটা একধরনের মানসিক ডিজঅর্ডার। এরা নিজের শরীরকে আঘাত করে আনন্দ পায়।
-ও আনন্দ পেত কী না জানি না তবে ও জানত এতে আমি প্রচণ্ড কষ্ট পাই। আমাকে টর্চার করার সবচেয়ে মজবুত পন্থা হল ওর নিজের শরীরকে আঘাত করা। ওকে ভালোবাসি আমি।
এইবার আমি ভদ্রলোকের আপাদমস্তক আরেকবার নিরীক্ষণ করলাম। নাম রাজীব রহমান, বয়স বত্রিশ,তেত্রিশই হবে। ওকে পাঠিয়েছে সাবেক ছাত্র আফসারী।২০০৭ এর ব্যাচ, আমার অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র। কালকে চেম্বার থেকে বাড়ি ফিরে মেসেঞ্জারে ঢুকতেই টুং করে শব্দ হল,
-স্যার, আমার খুব কাছের বন্ধু কাল আপনার সাথে দেখা করতে যাবে। ওর স্ত্রী মারা যাবার পর ও খুব মানসিক অবসাদে ভুগছে আরো কিছু বোধহয় ওর ভেতর চলছে আমি সঠিক জানি না।
খুব ভরসায় আপনার ঠিকানা দিলাম, ওকে সাহায্য করবেন,প্লিজ।
নতুন রুগী এলে একজন সাইক্রিয়াটিস্ট হিসেবে প্রথমেই আমি তার বেশভূষা, চালচলন লক্ষ্য করি। আজ রাজীবকে দেখে কোনোমতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ইনিই ছাত্রের পাঠানো সেইজন। লম্বা, পেটানো শরীর। কালোবর্ণের কৃষ্ণের রুপে অসংখ্য গোপিকা প্রেমে মজে ছিল। এই ছেলেও শ্যাম তবে আট-দশজন বাঙালি পুরুষের তুলনায় বেশ সুঠাম দেহ। তীক্ষ্ণ নাক, মাথা নীচু করে কথা বলায় চোখদুটো দেখতে পারছিলাম না। তবে চেহারায় পুরুষালি জৌলুস অসামান্য। চোখের নীচে কালি, কালশিটে পরা টিঙটিঙে চেহারা নিয়ে অল্পবয়স্কা মানসিক রোগীরা চেম্বারে আসে। দেখলেই বোঝা যায়, এরা ঘুমায় কম, এক একটা হিস্টিরিয়া রোগীর মত সারারাত মোবাইল গুতায়, প্রেমে ছ্যাকা খায়,সিজিপিএ কমে-বাড়ে। পরিবারের লোকজনকে ভাবে শত্রুপক্ষ। জীবনে একটা ভালো চাকুরি আর ভালো বিয়ে করা আর কোনো লক্ষ্য নাই। শেষ পর্যন্ত আত্মমগ্ন থাকতে থাকতে মানসিক অবসাদে ভুগে৷ এদের সংখ্যার বাড়ছে,বিস্তর বাড়ছে। কিন্তু রাজীব পোশাকপরিচ্ছদে বেশ কেতাদুরস্ত। হাতের ফসিল ঘড়ি আর ব্রান্ডের সানগ্লাস দেখা বোঝা যায় পয়সাকড়ি আছে আবার বিলাসীও বটে। এবয়সী ছেলেরা বউকে নিয়ে মালদ্বীপে গিয়ে সমুদ্রস্নানের ছবি পোস্ট করে আর ও এসেছে স্ত্রীকে হারিয়ে মানসিক সমস্যার সমাধান করতে।ভবিষ্যৎকে আমরা যতটা সহজ করে ভাবি, ভবিষ্যৎ ততটাই গরল।
একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, ছেলেটা গত আধাঘণ্টায় নাম ছাড়া নিজের সম্বন্ধে একটা কথাও বলে নাই৷ ঘুরেফিরে সব কথা নীরাতে শেষ হয়। এত সহজ গলায় বলল,
-আমি নীরাকে ভালোবাসি।
অবাক হলাম।প্রেমিকেরা লক্ষবার উচ্চারণ করে,
-আমি তাকে ভালোবাসি কিন্তু এদেশের বিবাহিত পুরুষেরা স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা লুকিয়ে রাখে। পরিবার তো বটেই সমাজের কারো চোখেই যেন না পরে সে স্ত্রীতে আসক্ত। পাছে লোকে বউয়ের আঁচল ধরা ভেড়ুয়া না বলে! রাজীব ব্যতিক্রম।সাবলীল গলায় ভালোবাসার কথা স্বীকার করল। জিজ্ঞেস করলাম,
-প্রেমের বিয়ে?
-অনেকটা সেরকমই।
-তোমাদের গল্পটা বলো।
রাজীব কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে দুই ঢোকে পানির গ্লাস শেষ করে বলতে শুরু করল,
-আমি ছোট থেকে বেশ কষ্ট করে বড় হয়েছি, বলতে পারেন শৈশব থেকে নিজের অভিভাবক নিজেই। তবে কোনোমতে একটা ব্যবসা দাঁড় করানোর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নাই। পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য বিধায় সমস্ত দায়িত্ব আমার ঘাড়ে। যেই বয়সে ছেলেরা প্রেম করে,গার্লফ্রেন্ডের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খায় আর আমি টাকার পিছনে ছুটছি। আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ঠকে অনেক বাজে অভিজ্ঞতা হবার পর বুঝেছি দুনিয়ায় টাকা ছাড়া মানুষের কোনো মূল্য নাই।আমার স্ত্রী ব্রোকেনও ফ্যামিলির মেয়ে। বিয়ের আগে ওর সম্পর্কে আমি প্রায় কিছুই জানতাম না। ও দেখতে আহামরি তেমন কিছু নয় তবে আমার ভালো লাগত। ভালোবাসলে যা হয়৷ যখন ওর সাথে দেখা হয় আমার বয়স তখন ত্রিশ চলছে।পরিবার দেখে বিয়ের জন্য পাত্রী দেখছে। আমার ওকে দেখার পর মনে হচ্ছি গত ত্রিশ বছর পরিবার, আপনজনদের জন্যে গাধার মত খেটেছি নিজের কথা কোনোদিন ভাবি নাই। কিন্তু আমার এবার ওকে চাই। একটা মেয়ে নিতান্ত সাধারণ চেহারা কিন্তু ওকে দেখলে বুকের বামপাশটায় শান্তি লাগত আমি ওকে হারাতে চাই নাই। তাড়াহুড়োয় বিয়ে করলাম।
-তারপর,
-স্যার,আপনার স্ত্রীর সাথে যদি আপনার ভীষণ সদ্ভাব থাকে ঘরকেই বেহেশত মনে হবে। আমার কাছেও তাই মনে হত। বেলা দশটায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ১১ টায় ছুটে চলে আসতাম।বাড়ির সবাই মিটিমিটি হাসত, লজ্জা লাগত আবার নীরাকে না দেখে থাকতেও পারতাম না।
-বিয়ের পর প্রত্যেকেই নববধূর প্রেম খুব উপভোগ করে।আপনার স্ত্রীর অনুভূতি কেমন?
-স্যার,বিশ্বাস করেন নীরা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বোকা স্ত্রী ছিল। আমি যখনি বাড়িতে আসতাম ওর রান্নাঘরে কাজ থাকত বা গোসল করতে বাথরুমে ঢুকত।মানে ওর বর যে ওর জন্যে ছুটে বাড়ি চলে আসল তা বোঝার মত জ্ঞান ও ওর ছিল না। আমি প্রায়ই ওকে বলতাম,তুমি আরেকটু কম সুন্দর হলেও সমস্যা ছিল না যদি জ্ঞানবুদ্ধি একটু বেশি থাকত।
-এইযে একটু বললেন,আপনার স্ত্রী দেখতে সুন্দর ছিল না।তাহলে! ওর ছবি আছে?
-জ্বী না।
-আমার কিন্তু মনে হচ্ছে আপনার ফোনভর্তি নীরার ছবি।
রাজীব হাসল।
-ঠিক বলেছেন। তবে নীরাকে কেউ দেখুক আমার তা পছন্দ না।
এবার ভদ্রলোকের ভেতরটা কিছুট্ স্পষ্ট হতে শুরু করল। সে একরোখা, ভালোবাসার মানুষকে একান্ত গোপন করে রাখতে ভালোবাসে।
-আপনাদের সমস্যা শুরু কোথায়?
-আমাদর সমস্যা কখনই ছিল না। টুকটাক ঝগড়া হত। নীরা তা সিরিয়াস হিসেবে নিয়ে উদ্ভট কাণ্ডজ্ঞান করত। শেষবার ওকে বাঁচাতে পারলাম না আর তারপর থেকে…
-তারপর থেকে কি?
-আমি আমার মৃত স্ত্রীকে রোজ বিছানায় ঘুমন্ত দেখতে পাই।
-চলবে
গল্পঃদ্বন্দ
হাবিবা সরকার হিলা
সেরা থ্রিলার গল্প দ্বন্দ পর্ব ২
রাজীব মৃত স্ত্রীকে বিছানায় দেখতে পান শুনে অবাক হলাম না। এধরনের ভ্রান্তি ঘটনা অবিশ্বাস করার জন্যে মনোবিশারদ হবার প্রয়োজন নাই চোখকান খোলা রাখাই যথেষ্ট। আমার পিঠাপিঠি বোন বিন্তি আট বছর বয়সে পানিতে ডুবে মারা যায়। ওর মৃত্যুর পর রাতের বেলা বাথরুমে একা যেতে ভয় পেতাম।এমনকি জানালার পাশে ওর কথার গুণগুণ শুনতে পেতাম। রাজীব সাহেব আরো কিছু বলতেন কিন্তু উনাকে নিয়ে আড়াইঘণ্টা সময় ব্যয় করে ফেলেছি এবং পেটের ভেতর থেকে মূল বিষয়বস্তুই উদ্ধার করতে পারি নাই। আজকাল সাইক্রিয়াটিস্ট নাম শুনলেই লোকজনের চোখের সামনে মিসির আলির চেহারা ভাসতে থাকে। যা বিশেষজ্ঞদের ভীষণ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে। লোকজনের মনের গতির খবরাখবর নিয়ে আমাদের পেট চালাতে হয় এবং মিসির আলির মত যুক্তির উপর নির্ভর করে দিন চলে না মেডিসিনের উপরও ভরসা করতে হয়। যাই হোক, একটা প্যাড আর বলপ্যান ড্রয়ার থেকে বের করে দিয়ে রাজীবকে বললাম,
-তোমার কাজ হচ্ছে, আগামী সাতদিনে পুরো প্যাড লিখে ভরাট করে আনা।
-কি লিখব?
-তোমার আর তোমার স্ত্রীর গল্প।
-আমি তো আপনাকে সবটা বললাম।
-কিছুই বলো নাই। যা বলেছ ছাড়া ছাড়া। তোমার স্ত্রী যতটুকু বুঝতে পেরেছি তোমার চরিত্র একভাগও নয়। পেসেন্ট তুমি,তোমার স্ত্রীর চেয়ে তোমার চরিত্র জানা বিশেষ প্রয়োজন।
রাজীব অনিচ্ছাসত্ত্বেও খাতা নিয়ে উঠল। আমার চিকিৎসাপদ্ধতি ওকে আশ্বাসিত করে নাই বুঝতেই পারছি। ভাবছে বেগাঢ় ভিজিটের দুই হাজার টাকা গচ্চা গেল।
রাজীব এর সপ্তাহেও এল না এবং তার পরের সপ্তাহেও না। স্বভাবতই আমি রাজীবকে ভুলে গেলাম। স্রেফ সুঠাম শরীরের কোনো পুরুষের সঙ্গে দেখা হলে আড়চোখে আরেকবার তাকাই,
-এমন কাকে যেন দেখছিলাম!
নাম করতে পারি না।আমার স্মতিশক্তি দূ্র্বল।।রাজীব প্রায় ছয়মাস পর। সেদিন আমি চেম্বারে ছিলাম না। বড় বোনের মেয়ের পানচিনির অনুষ্ঠান ছিল। পরের সোমবার অফিসে ঢুকতে অ্যাসিসেন্ট নোটখাতা এগিয়ে দিল।
-এটা একজন প্যাসেন্ট আপনাকে পড়ার জন্যে দিয়ে গেছে।
বেশ কয়েকজন ইন্ট্রোভার্ট রুগীই তাদের সমস্যার কথা আমাকে লিখে জানায়। তাদের একজনের মনে করে খাতা হাতে নিলাম। রাজীব রহমান নাম দেখে মনে পরল সেই সুদর্শন যুবককে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।
সেদিন রাতে বৃষ্টি ছিল। যথারীতি পুত্রদের মায়ের সাথে ঝগড়া লাগছে। তিনি পাশের ঘরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। আমি বড় এক মগ কফি আর রাজীবের নোটখাতা নিয়ে বারান্দায় বসলাম।
কিছুটা বাঁকানো হাতের লেখা স্পষ্ট অক্ষর কিন্তু লাইনগুলো বেঁকে আছে। বহুদিন কলম না ধরার ফল। ছেলেটার প্রস্তাবনা বেশ সুন্দর। প্রথম লাইনে মার্জিত ভাষায় ক্ষমা চেয়েছে যে ও আমার দেওয়া প্যাড, বলপ্যান দুটোই হারিয়ে ফেলেছে। এরপর আরো কিছু এলোমেলো লাইন আমাকে উদ্দেশ্য করে। ওসব কথা থাক, মূলগল্পে আসি-
আমার নাম রাজীব রহমান। নাইনে ফর্মফিলাপের আগে নাম ছিল ছোটু, ছোটু শেখ। নাইনে ফর্মফিলাপের সময় অঙ্কের শিক্ষক জাহাঙ্গীর স্যার কানে ধরে বলল,
-এ কেমন নাম রে! তোর বয়স আশি হবে আর লোকে তোকে ডাকবে ছোটু শেখ! এহয় না। তিনি পাল্টে নাম দিলেন রাজীব রহমান।
শৈশব থেকেই আমি কিছুটা একরোখা আমাদের অঞ্চলে একে বলে ঘোড়া রোগ। যেমন ধরেন, কোনো জিনিস একবার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলে তা না পাওয়ার পর্যন্ত চিৎকার করে হাত-পা ছুঁড়ে কান্না করতে থাকতাম।বাবা মারা যাবার আগপর্যন্ত জীবন সহজ ছিল না হয়ত সারাজীবন অবোধই থেকে যেতাম মাথার উপর বাবা নামক বটবৃক্ষের ছত্রছাত্রায় মানুষ হলে। আমি দূর্ভাগ্যবান, বাবা মারা যান সাত বছর বয়সে৷ এরপরের অংশটুকু লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না, আমি নিজেকে পৃথিবীর সুখী মানুষ ভাবতে ভালোবাসি তাই দুঃখগুলো চাপা থাক। তবে একটা কথা বলতে পারি, বাবার মৃত্যুর পর আত্মীয়স্বজন -ঘনিষ্ঠজনর কাছে থেকে যেই শিক্ষা পেয়েছি সেই শিক্ষা আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়ে যোজনগুণ বেশি কাজে দিয়েছে।। জীবন থেকো বহুবছর কেটে গেছে স্রেফ টাকার পিছনে ছুটেতে কেননা আমাদের সমাজের রীতি এমন টাকা থাকলেই সম্মান এসে ধরা দেয়। টাকা হল,সম্মান হল। পরিবারের মানুষজন যখন বিয়ের জন্য চেপে ধরেছে আমিও মুখে না না করি কিন্তু মনে মনে সত্যিই একটা মেয়েকে খুঁজি। সোশ্যাল মিডিয়ার কয়েকজনের সাথে পরিচয় হল আরো কয়েকজনের সাথে বহু আগে থেকেই কথা চলে তবে আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না।
গ্রীক বচনে আছে মানুষ ছিল প্রচণ্ড শক্তিশালী। তার চার হাত-চার পা, একই মুখমণ্ডলে দুই চেহারা।মানুষেন ক্ষমতা দেখে স্বয়ং দেবতা জিউস ভয় পেয়ে যান। তিনি মানুষকে দুই টুকরা করে পৃথিবীতে পাঠান আর মানুষের কাজ হয়ে যায় সারাজীবন অর্ধেক অংশকে খুঁজে বের করা। কেউ পায় কেউ পায় না। আমিও হন্যি হয়ে খুঁজি,যাদের পাই তাদের ছুঁয়ে তৃষ্ণা মিটে না। একদিন সিগারেট কিনতে গাড়ি থামিয়ে মুদি দোকানেন সামনে দাঁড়ালাম। এক কাপ চা হাতে নিয়ে সিগারেট ধরালাম, দেখি পাশে একটা মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। নিতান্ত সাধারণ সালোয়ারকামিজ পরনে, ভ্রু কুঁচকে বারবার ফোনের স্কিনে ঘড়ি দেখছে। খালি রিকশা আসতেই উঠে চড়ে গেল। সবমিলিয়ে বড়জোর দুই মিনিটের ব্যাপার হবে, বিশ্বাস করুন আমি চোখের পলক পর্যন্ত ফেলতে ভুলে গিয়েছিলাম।হাতে সিগারেটের ছ্যাকা খেয়ে হুশ ফিরল। মেয়েটা দেখতে কেমন, খাটো না লম্বা, চেহারা কেমন কিছুই আমার মনে নাই শুধু মনে হচ্ছিল এই সেই মেয়ে যে বহু আলোকবর্ষ দূরে লক্ষকোটি বছর আগে আমার দেহের অংশ ছিল। যার প্রতিটা নিশ্বাসের শব্দ আমার চেনা শুধু আপন করে নেবার অপেক্ষা। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে ওর সাথে কথোপকথন করা সহজ হল। নাম নীরা, ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। সহজ-সরল নিতান্ত মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। অহরহ মা কত এমন সম্বন্ধ দেখেছে কিন্তু এই মেয়েকেই বিয়ে করা দুরুহু হয়ে গেল। নীরা এমন যেন জলের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে হাত বাড়ালেই তলিয়ে যাচ্ছে। ওর এই টালমাটাল স্বভাব আমাকে ওর দিকে টেনে অসংখ্যবার। জল্পনাকল্পনা শেষে আমাদের বিয়ে হল একেবারে অনাড়ম্বর ভাবে। বিয়ের পরদিন কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করত,
-পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ কে?
চিৎকার করে বলতাম,
-আমি,এই আমি রাজীব রহমান।
আমাদের দেশে বিয়ের সময় মিল খুঁজে। চাকুরিজীবী বনাম চাকুরীজীবী,ধনী বনাম ধনী, ডাক্তার বনাম মহিলা ডাক্তার। যত্তসব বাজে ব্যাপার। চৌম্বকের যেমন উত্তর মেরু বনাম দক্ষিণ মেরু তেমনি আপনি সবচেয়ে আকৃষ্ট হবেন বিপরীত চরিত্রের মানুষকে ঘিরে।কেননা সৃষ্টিকর্তার লীলাখেলাই এমন,তিনি বৈচিত্র্য পছন্দ করেন। আমি গোছানো নীরা অগোছানো। পোশাক,ঘড়ি,সানগ্লাসে একটা ফ্যাসিনেশন কাজ করে নীরা সাদামাটা একটা গায়ে চড়ালেই হল। আশ্চর্য ওকে সবকিছুতে মানিয়েও যেত। সস্তা ডুরে শাড়ি গায়েও নীরা আমার কাছে অপরুপা। আমি দিনে ১০০ বাক্য উচ্চারণ করি কী না সন্দেহ, ও পাঁচ মিনিটে হড়বড় করো একশ কথা বলে ফেলে। রাতের পর রাত জেগে ডকুমেন্টারি দেখি,ওয়েবসিরিজ দেখি।নীরা ঘুমাতে পছন্দ করে। আমি আলসে,বোকা, বাচাল মেয়েটির প্রেমে পরে গেলাম। সে এক মধুরতম প্রেম। ও আধাঘণ্টা কথা না বললে হাসফাঁস শুরু হয়।
-এই তুমি কথা বলছ না কেন?
– কি বলব?
-প্রশ্ন করে আপনা থেকেই কথা শুরু করে।
বিয়ের পর প্রেমে পরার মত পবিত্রতম মুহূর্ত আর কিছু নেই।ভোরে ঘুম ভাঙার পাশের বালিশে শোওয়া একটা অগোছালো শরীর, বাসিগন্ধে মাখানো আধখোলা ঠোঁট আর এলোমেলো চুলের মানুষটা শুধুই আমার। তার জন্যে অপেক্ষায় কৈশোর কেটেছে,যৌবন এসেছে…এই অনুভূতি ঠিক লিখে প্রকাশ করা যাবে না।
এইটুকু পড়ে আমি নোটখাতা বন্ধ করলাম। রাত্রি তখন দুইটা। চট করে পাশের ঘর থেকে ছেলেদের মাকে ডেকে আসলাম। বুকের ভেতরটা কেমন স্নেহে ভরে গেছে। মধ্যবয়স্কা, গালে ভাজ পরা দুই বাচ্চার মা ইনিও তো শুধু আমার, হারিয়ে যাচ্ছে না। ইগোর বর্শবতী হয়ে রোজ যা করি না আজ তাই করলাম স্ত্রীর পাশে গিয়ে শুয়ে পরলাম। ও গভীর ঘুমে।আহা,বাচ্চাদের পিছনে বেচারীর কি খাটুনিই না খাটতে হয়।
পরদিন চেম্বারে ঢুকে দেখেই রাজীব হাজির। আজ তো ওর আসার কথা ছিল না। উদভ্রান্তের মত চেহারা,চোখের নীচে কালশিটে পরে গেছে। কালকে রাতে পড়া ওর গল্পের নায়কের সাথে ওকে মেলাতে পারছিলাম না। জিজ্ঞেস করলাম,
-কি হয়েছে?
-বিশ্বাস করুন, নীরা রাতে আমার কাছে আসে। কাল রাত চিৎকার করতে যেতেই পিঠে কামড়াতে শুরু করল।এই দেখুন..
রাজীব শার্টের একপাশ খুলে আমাকে দেখাল।
কাঁধের বামপাশে লাল ছোপছোপ তাজা ক্ষতচিহ্ন।
দ্বন্দ পর্ব ২
-চলবে
হাবিবা সরকার হিলা
সেরা থ্রিলার গল্প দ্বন্দ পর্ব ৩
-আপনার নেশা করার অভ্যাস আছে?
-মানেহ!
-বীয়ার খাই, সিগারেটের অভ্যাস আছে।
-এলএসডি, ইয়াবা?
-আরে না। তবে আমার স্ত্রীর পাল্লায় পরে সবকিছু একবার করে ট্রাই করেছিলাম। তাও বহুদিন আগের কথা। বিয়ের কিছুদিন পর ওর যখন নিত্যনতুন শখ জাগত, তখন।
আমি রাজীব সাহেবের পিঠের ক্ষতগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলাম।কিছুতেই মনে হচ্ছিল না কামড়ের দাগ। ধারালো ছুরি বা কাঁচির মাথা দিয়ে জোরে জোরে আঘাত করেছে। খামচির দাগও আছে।
-আপনার নখ দেখি।
ভদ্রলোকের নখ ছোট।
-আপনি বাড়িতে কুকুর বা বিড়াল পোষেন?
– না।
-তাহলে খামচির
–
দাগগুলো কীসের?
-আমি জানি না। তবে…
-নীরা আসে।
-কীভাবে বুঝেন ও আসে?
-এক ধরনের ঘ্রাণ পাই।ওর নাক আর ঠোঁটের মাঝখানে এক ধরনের সুগন্ধ থাকত, ও যখন রাতের বেলা ঘরে আসে সারাঘর সেই ঘ্রাণে একাকার হয়ে যায়…
-আপনার রাতে ঘুম হয়?
-জ্বী না।মাঝে মাঝে কয়েকরাত ঘুম আসে না। আবার কয়েকদিন পর্যন্ত চোখ মেলে তাকাতে পারি না।
আমি প্রেসক্রিপশনে ফটাফট “মাইলাম ৭.৫” লিখে দিয়ে বললাম,
-আপনি ঘুমাতে যাবার আধাঘণ্টা আগে খাবেন। তারআগে নয়। আর আপনার ডায়েরী শেষ করবার আগে অন্য কোনো মেডিসিন সাজেস্ট করতে পারছি না। আপনার ঘুম দরকার। বাড়িতে গিয়ে টানা রেস্ট নিন।আপনার দেশের বাড়ি কোথায়?
-টাঙ্গাইল। আমার মা থাকে বড় ভাইয়ের সাথে।
-সম্ভব হলে গ্রামে গিয়ে ঘুরে আসুন। আর এক সপ্তাহ পর আমার সাথে দেখা করবেন।
-আচ্ছা। একটা কথা…
-বলুন।
-প্রথমদিন আপনি আমাকে তুমি করে নাম ধরে ডাক ছিলেন আজ আপনি করে।
হাসলাম।
– আপনাকে প্রথমদিন দেখে মনে হয়েছিল সহজসরল স্বপ্নবাজ যুবক,স্ত্রী মারা যাবার পর বিষণ্নতায় ভুগছেন।ডায়েরী পড়ে ভুল ভাঙল, আপনার মানসিক পরিপক্বতা আমার বয়সের কাছেপিঠে।
রাজীব সুন্দর করে হাসল। ছেলেটার চোখের নীচে কালশিটে দাগ, উশকোখুশকো চুল হাসিটা মলিন করতে পারল না। আমি জানতাম,রাজীবের আরো কিছু কথা বাকি আছে কিন্তু ডায়েরীর মানুষটাকে না চিনে এলে শুধুই ওর বর্তমানকে নিয়ে ভাবতে গেলে এলোমেলো হয়ে যাবে। একটা গল্পকে যদি আমরা বটবৃক্ষ হিসেবে কল্পনা করি গল্পের সত্যমিথ্যা বর্ণনা হয় বটগাছের শাখাপ্রশাখার মত বিস্তর, বিষয়বস্তু মূল বৃক্ষ কমই জায়গা দখল করে, সূচনার ধারা হয় বটমূলের মত বিশাল। আমার সর্বপ্রথম সূচনা জানা প্রয়োজন।
অফিস থেকে বাড়ি ফেরে একটা ছোট্ট ঘুম সেরে ডায়েরী নিয়ে বসলাম। মিসেস সেজেগুজে ভাইয়ের ছেলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে বেরিয়ে গেল। আমি মাথা যন্ত্রনার উছিলা ধরে বাড়ি থেকে গেলাম । স্ত্রী আজ ছেলেদের নিয়ে রাতে বাড়ি ফিরবে না। বাপের বাড়ি হৈ-হুল্লোড় করবে। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে, ইলেকট্রিসিটি নেই, নিভু নিভু মোমবাতির আলোয় গরম গরম বেগুনি ভাজা নিয়ে রাজীবের খাতা খুলে বসলাম বলপয়েন্টে লেখা, ছাপার অক্ষরে হলে একটা উপন্যাস পড়বার ফিল হত। তবু মন্দ কি! যাহা জীবন তাহাই তো উপন্যাস।
পাঠক চলুন,আমরা রাজীবের খাতার ভেতর ডুব দেই,
নীরা, বাইশ বছর বয়সে আমার ঘর করতে এসেছে। বড় বড় চোখ করে যা দেখে তাই অবাক হয়৷ বিছানার কম্বল ভাজ করে দশ মিনিট সময় ধরে, চুলের জট খুলতে চিরুনি বুলাতে গিয়ে সব চুল ছিঁড়ে ফেলে। একদিন ডাল রান্না করেছিল, আমার জীবনের সবচেয়ে জঘন্যতম ডালের স্বাদ দেবার জন্য তাকে ধন্যবাদ। রান্না জানে না,সাজতে জানে না। ক্লাস টপকে ভার্সিটি উঠা ছাড়া মেয়েটার কোনো গুণ নাই। গায়েগতরে বড় হয়েছে নিজের শরীরটাকে যে ঢেকেঢুকে রাখব তারদিকেও নজর নাই। ওড়না ঠিক থাকে না, শাড়ি পরলে পিঠের একাংশ বেরিয়ে থাকে। আমার রাগ হয়, বেশকয়েকদিন চিৎকার চেঁচামেচি করেছি লাভ হয় নাই। ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত হলে ওর ওপর দোষারোপ করা যায়। যাই হোক,নীরা কিন্তু আমায় ভালোবাসে। ওর ভালোবাসা উগ্র, অদ্ভুত,হিংস্র। ধরুন, দূরে কোথাও আছি। কয়েকদিন বাড়ি ফিরব না। ও ফোন করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করত। বস্তির মেয়েরাও ওর গালি শুনলে লজ্জায় মুখ লুকাবে।বকতে বকতে একসময় হাঁপিয়ে উঠত তারপর কান্না। আর দশজন অবুঝ পুরুষের মত আমিও কিন্তু বুঝতে পারতাম না স্ত্রীর রাগের উৎস কি! অযথা বাজে ব্যবহার কেন! বহুদিন পর বুঝেছি ওর যত রাগ-ক্ষোভ, হতাশা সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ও আমাকে মিস করছে। পোষা বেড়াল যেমন মুনিবের আদর পাবার জন্য গরগর শব্দ করে অভিযোগ করে তেমনি আমার বউটা কাছে থাকার জন্যে চেঁচামেচি শুরু করে। আমি হয়ত এরআগেও বেশ কয়েকবার লিখেছি আবারও লিখছি আমি নীরাকে নিয়ে সুখী ছিলাড়ম।যতক্ষণ বাড়িতে থাকি ওর একটা হাত চেষ্টা করত সারাক্ষণ আমাকে ছুঁয়ে থাকার। সবাই যখন পাশে থাকত, ও আড়চোখে লক্ষ্য করে যেত। ঘন কালো চোখের মনি অব্যক্ত ভাষায় বলে যেত,
-ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি।
এত ভালোবাসা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে আমি কি অসুখী থাকতে পারি!
মানুষ যেন কখনই পরিপূর্ণ সুখী না পারে তারজন্যে সৃষ্টিকর্তা একটার পর একটা চাহিদা তৈরি করেন। যেমন,দু বছর পর থেকে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন প্রশ্ন করা শুরু করল,
-বাবা হচ্ছি কবে!
-তাই তো। এখনি তো বাচ্চা নেবার উত্তম সময়। নীরাও নিশ্চয়ই প্রশ্নের সম্মুখীন হত,আমার কাছে শেয়ার করত না।
একদিন জিজ্ঞেস করলাম,
-তোমার একা একা লাগছে না?
-কেন?
-আমাদের ছানাপোনা হলে বেশ হয়।
ভেবেছিলাম নীরা খুশি হবে। ওর মুখ অন্ধকার।
-এত তাড়াহুড়ার কি আছে?
-তাড়াহুড়ার কই করলাম! চাইলেই তো আর আসমান থেকে বাচ্চা আসছে না। কত মানুষ বছরের পর বছর চেষ্টা করে যাচ্ছে একটা সন্তানের আশায়। আমাদের ভাগ্যে কি আছে আল্লাহপাকই ভালো জানেন।
-হু!এব্যাপার নিয়ে পরেও আলোচনা করা যাবে।
-বলো, লক্ষ্য করেছ আজ অমাবস্যা!
মানুষ পূর্নিমা রাতে আহ্লাদ করে। অমাবস্যাকে নিয়ে মাতামাতির কি আছে!
এর আগেও লক্ষ্য করেছি নীরা তিথি,রাশিচক্র এসব খুব মানে।
-অমাবস্যা তো কি হল!
-ছাদে চলো।অন্ধকার দেখব।
-দুর।মাঝরাতে যত্তসব পাগলামি ঘুমাতে আসো।
আমি ঘুমিয়ে গেলাম। নীরা জানালা কাছে দাঁড়িয়ে অন্ধকার দেখছে। এতো অজপাড়াগাঁ নয় যে অমাবস্যায় ঘুটঘুটে অন্ধকারে চারপাশ তলিয়ে যাবে।শহরের সোডিয়ামের চোখধাঁধানো আলোয় জ্যোৎস্না,অন্ধকার সব দূরে পালায়।
পরদিন ঘুম ভাঙল খুব ভোরে।ফজরের আযান হচ্ছে। নীরা জানালার কাছ থেকে সরে এসে আমার ঘুম ভাঙাল।
-এত সকালে কেন উঠেছ? সারারাত ঘুমাও নাই?
-শুনছ,আমি বাচ্চা নিতে পারব।
-বাচ্চা নিতে পারবে মানে এটা কেমন কথা!
-কিছু না। তুমি ঘুমাও।
নীরা পিঠের কাছে গা ঘেষে লেপ্টে থাকল।
-জানো,আমার কোষ্ঠীতে আছে প্রথম সন্তান বাঁচবে না।
-নীরা,স্টপ ইট। রাত থেকে নাটক করছ, ভোরে ঘুম ভাঙিয়ে আবোলতাবোল কথা শুরু করেছ।মুসলমান ঘরের সন্তান কোষ্ঠী বিশ্বাস করে নাকি!
নীরা আর কিছু বলল না। শক্ত করে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-এপাশে ঘুরো। আমার ভয় করছে।
নীরার দিকে ঘুরতেই মনে হল,খোলা জানালার পিছনে দাঁড়িয়ে কেউ একজন আমাদের লক্ষ্য করে যাচ্ছে। অবশ্যই মনের ভুল। চারতলার উপর কে আসবে!
নীরা অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমাল। আমি সকালের নাস্তা বানিয়ে অফিসে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছি এমন সময় দরজায় চপোটাঘাতের শব্দ হল। কলিংবেল আছে তবু অসভ্যের মত থাপড়িয়ে যাচ্ছে।
-আসছি। আধ মিনিট দেরি সহ্য হয় না।
দরজা খুলে দুই কদম পিছিয়ে গেলাম।একটা মেয়ে। কোঁকড়া চুলের দশ-বারো বছরের একটা মেয়ে। কুচকুচে কালো রঙ। ওর চোখ,ঠোঁট এমনকি দাঁতগুলোও পর্যন্ত ধূসর কালো। সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর সব জীবকে পরম মমতায় জীবন দান করেছেন। তার সৃষ্ট কোনো মানুষকে কুৎসিত বলার অধিকার আমাদের দেন নাই। তবু বলছি,মেয়েটা ভীষণ কুৎসিত। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। ও শীতল গলায় বলল,
-আম্মা,আমাকে আসতে কইছে।
-আম্মা কে?
নীরা ততক্ষণে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
-ওকে চিনো তুমি?
নীরার চোখমুখেও আতঙ্ক। কোনোক্রমে মাথা নাড়াল।
-পদ্ম,তুই ভিতরে আয়। তোর সাথে জিনিসপত্র কিছু আছে!
পদ্ম ওর চেয়ে দ্বিগুণ ওজনের ট্রাঙ্ক টানতে টানতে ঘরে ঢুকল। টি-টেবিলের কাছে ওর বাক্সপেটরা রেখে নাক টানল,
-পোঁড়া গন্ধ পাই।চুলায় কিছু বসাইছেন!
সত্যি, চুলায় আলুভাজি বসিয়েছিলাম।ছুটে রান্নাঘরে গেলাম। ওখান থেকেই শুনতে পাচ্ছি ভয়ঙ্কর মেয়েটা বলছে,
-পোঁড়া গন্ধ আমার ভালোই লাগে।
গল্প দ্বন্দ(৩)
-চলবে
হাবিবা সরকার হিলা
সেরা থ্রিলার গল্প দ্বন্দ পর্ব ৪
আমি দেখলাম আমার স্ত্রী নীরা যার চুল থেকে পায়ের কড়ে আঙুল অবধি ক’খানা তিল আছে চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি। সে এমুহূর্তে কি ভাবছে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে অনুভব করতে পারি তাকে আমি চিনতে পারছি না। কিছু একটা লুকিয়ে যাচ্ছে।সে ভান করছে সবকিছু স্বাভাবিক। রোজকার মত ঘুম থেকে উঠে চোখমুখে জল ছিটিয়ে রান্নাঘরে রুটি বেলছে, পেঁয়াজ কাটছে। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম ওর হাত কাঁপছে। চোখে আতঙ্কের ছাপ।
-নীরা,মেয়েটা কে?
–
-কোন মেয়েটা! পদ্ম!
-হু। পদ্ম না ছাই তা তুমিই ভালো জানো। ও কেন এখানে এসেছে?
-মা গ্রামের বাড়ি থেকে যোগাড় করে পাঠিয়েছেন। অনেকদিন বলে মাকে বলেছিলাম আমার একজন হেল্পিংহ্যান্ড হলে ভালো হয়।
-তাই বলে কদাকার চেহারার এই মেয়েটাকে। ওকে আমার একটুও পছন্দ হয় নাই। এক্ষুণি বিদায় করো।
-আহা! মেয়েটা এতদূর থেকে এসেছে। আজকের দিনটা থাকুক৷ কাল সকালে তুমি ওকে গিয়ে বাসে উঠিয়ে দিয়ে এসো।
নীরার প্রতি কখনই আমি বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারি না। তবু আজ নীরার মায়ের কাণ্ডজ্ঞানহীনতা দেখে রাগ চরমে উঠল।কি করে একটা বিশ্রী চেহারার মেয়েকে এখানে পাঠায়। ফোন করব ভাবছিলাম কে যেন অসম্ভব মিষ্টি গলায় ডাকল,
-আপনে আম্মার উপর রাগ কইরেন না,আমি এখুনি চইলা যামু। আমি কালো দেইখা কেউ আমারে পছন্দ করে না। আমার আব্বা ছোটোবেলায় আমারে গলা টিপ্পা মাইরে ফেলতে চাইছিল।
ভীষণ পরিচিত কণ্ঠস্বর।মেয়েটির দিকে তাকালাম। ভীষণ কুদর্শনা মেয়েটি কথা বলছে মাথা নীচু করে, যেন ওর মুখ দেখতে না পাই।
-তুমি নীরাকে আগের থেকেই চিনো?
-হু। আমার নাম আছিল ইকুনি। আম্মা আমার নাম রাখছে পদ্ম।
-ও।
নাস্তার টেবিলে আবার নীরার মুখোমুখি হলাম।
-নীরা, সত্যি করে বলো তো মেয়েটা কে? ও তোমার এমন পেয়ারের মানুষ শখ করে নাম রেখেছ পদ্ম।
-তোমাকে কে বলল?
-পদ্মই বলল।
নীরা রুটি ছিঁড়ে মুখে দিল।
-ভাজিতে লবন বেশি দিয়ে ফেলেছ।
-নীরা, তুমি কাইন্ডলি আমাকে পদ্মর ঘটনা কি বলবে! আমি জাস্ট নিতে পারছি না।
নীরা বলতে লাগল,
-ওর বড় তিন বোন আছে। আইরিন, শিরিন ছোটটার নাম মনে নাই। জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি ওর মা আমাদের বাড়িতে কাজ করে আসছে। রোগাপাতলা মহিলা। কিছুদিন পরপরই অসুস্থ থাকে। ছোট অবস্থায় বুঝতাম না, দেখতাম পেট ফুলে উঠেছে। মা বলত মরিয়ম খালার বাচ্চা হবে। ওর বাবা পরের জমিতে কামলার কাজ করত, অলস পুরুষমানুষ একদিন কাজ করলে তিনদিন ঘরের বাহির হয় না। পুত্রের আশায় একটার পর একটা মেয়ের জন্ম দিচ্ছে। পদ্মের জন্মের পর ওই ব্যাটা ঘোষণা করল, মরিয়ম খালাকে তালাক দিবে। ওর গর্ভে পোলার বীজ নাই, নতুন বিয়ে করবে। আমি তখন সেভেনে পড়ি। মায়ের হাত ধরে মরিয়ম খালার বাড়ি গেলাম নতুন বাচ্চা দেখতে। খালার শারীরিক অবস্থাও তখন কাহিল। মুলির বেড়ার ছাউনি দিয়ে মাটির ঘর। বৃষ্টির দিন,ঘরের মেঝেতে মাটি খুঁড়ে কেঁচো বের হচ্ছে। এরমধ্যে ছেঁড়া খাতা বিছিয়ে তেল মাখিয়ে পদ্মকে শুইয়ে রেখেছে।
ওর বাবা মাকে বলল,
-দেখেন খালা, ঝিম কালা মাইয়া হইছে। আমার কপালই মন্দ, এই মাইয়ারে তো বিয়াই দিতে পারমু না।
তাকিয়ে দেখলাম কপালে বড় করে কালির টিপ আঁকা মায়াময় গোলগাল একটা মুখ আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কালো মেয়ে কিন্তু কি ভীষণ মায়া!
-তামাশা করছ? ওই মেয়ের চেহারায় মায়া।
-আহা। ছোটোবেলায় ছিল।তারপর শোনো, আমি ওর নাম দিলাম পদ্ম। আমার কান্নাকাটিতে মা ওর দায়িত্ব নিতে বাধ্য হল। সারাদিন মরিয়ম খালা আমাদের বাড়িতে কাজ করে। আর বারান্দায় মাদুর পেতে পদ্মকে শুইয়ে রাখে। ও হাতপা ছুঁড়ে খেলে। আমায় দেখলে বু বু করে ডাক পারে। আমি ওর মায়ায় জড়িয়ে গেলাম। টিফিন খরচ বাঁচিয়ে খেলনা কিনে নিয়ে আসতাম ওর জন্যে। যদিও মা ব্যাপারটা একদম পছন্দ করত না। মায়ের বেশিদিন সহ্য করতে হয়ও নাই, গ্রাম ঘুরতে এসে এক আধাইংরেজ দম্পতি ওকে অ্যাডপ্ট নিয়ে যায়। উনারা নিঃসন্তান চাকরিসূত্রে কলকাতায় বাস করে। পদ্মকে ভিনদেশে পাঠাতে ওর বাবামায়ের কারোরই আপত্তি ছিল না। আর এরমধ্যে দুইবার ওর বাবা ওকে গলাটিপে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল। প্রায় বছর দশেক পদ্মের কোনো খোঁজ ছিল না।ওর বাবা ততদিনে গত হয়েছেন, ওর মা অভাবের তাড়নায় বড় দুই মেয়ের কিশোরী অবস্থায় বিয়ে দিয়ে ফেলেছেন। তার ইকুনি নামের ছোট্ট একটা মেয়ে ছিল তাও বুঝি ভুলতে বসেছে তখন পদ্ম ফিরে এল। যশোরের একজন কাপড় ব্যবসায়ী যে কলকাতা থেকে কাপড় এনে সেল করে সে পদ্মকে নিয়ে এসেছে। জানা যায়, মাস তিনেক আগে আ্যাংলো ইন্ডিয়ান দম্পতি রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে।পদ্মকে দেখভালের কেউ নাই।ওর মা রোগোশোকে কাতর।পদ্মর ছোটোবোন আমাদের বাড়িতে এখন ফুটফরমাশ খাটে।কোনোমতে দিন চলে,ভাত যোগাড় হয় না। পদ্মর ফিরে আসার খবর শুনে আমিই মাকে ওকে ঢাকা পাঠাতে বললাম।
-বাহ।চমৎকার। তারমানে কিছুক্ষণ আগে তুমি আমাকে মিথ্যা বলছিলে! তাও তোমার মায়ের নামে!
-হু। সরি।
আধখাওয়া রুটি টেবিলে রেখেই উঠে দাঁড়ালাম।নীরা আমার মেজাজ গরম করে ফেলেছে। বাইরে যাবার জন্যে পা দিব কে যেন পিছন থেকে ডাকল। পদ্ম, মেয়েটা একঘণ্টা হয় নাই এবাড়িতে এসেছে কিন্তু খুব পরিচিত গলায়,
-আপনার ফোন রাইখা গেছেন।
ফোন নিয়ে তড়তড় করে সিড়ি দিয়ে নামছি কেন যেন এত মিষ্টি স্বরে কথা বলত। কে! কে!
ক্রিং ক্রিং করে ফোন প্যান্টের পকেটে ফোন বাজছে। মা নিয়মকরে সকাল দশটায় ফোন করে।
-মা,কেমন আছ?
-ভালো। তোরা কেমন আছিস? বউমার শরীর ভালো।
মায়ের কণ্ঠশুনে তড়াক করে মনে পরল,
-পদ্মর কণ্ঠ হুবুহু চৈতীর মত। চৈতী আমার পিঠাপিঠি চাচাতো বোন,খেলার সাথী। আট বছর বয়সে পুকুরে ডুবে মরে যায়।
-মা তোমার চৈতীর কথা মনে আছে?
-কোন চৈতী। সুমীর ননদ?
-আরে না। আজমল চাচার মেয়ে।
-ওইযে পানিতে ডুবে মারা গেছিল যে! ওর কথা কেন!
-কিছু না। তোমরা ভালো থাক।
পদ্ম স্থায়ীভাবে আমাদের বাসায় থাকতে শুরু করল।
নীরার সাথে টুকিটাকি কাজ করে। সকালের নাস্তা বানায়,ঘর ছাট দেয়। প্রথম দেখায় ওকে দেখে যতটা কুৎসিত লাগছিল পরে তেমনটা আর লাগে নাই। আসলে আমাদের চোখ সহজেই মানিয়ে নিতে শিখে যায়। দুজন থেকে আমাদের তিনজনের সংসারের বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটল না। শুধু আমার কুঁড়ে বউ আটটার জায়গায় দশটা বাজে ঘুম থেকে উঠে। হেলতে দুলতে নাস্তা করে। গল্পগুজব করে। পদ্মর খাবারে অনীহা। কোনো প্রকার মাছ খায় না। মাংস হলে দুই একপিস খায় তাও শুধু মুরগির মাংস। বারো বছরের ওইটুকু মেয়ে কিন্তু বেশ করিৎকর্মা। বেড়ালের মত পা ফেলে নিঃশব্দে কাজ করে। খুব পরিষ্কার থাকার বাতিক। হয়ত বহুদিন বিদেশি পরিবারে বাস করার ফলে রুটিনমাফিক চুপচাপ থেকে কাজ করতে শিখে গেছে। অবাঙ্গালি পরিবারে থেকে আমাদের মত মাছপ্রীতিও নেই।
ও আসার এক সপ্তাহ পর একটা জিনিস লক্ষ্য করে অবাক হলাম,পদ্ম অন্ধকারে দেখতে পায়।
ইলেকট্রিসিটি নাই। নীরা বলল,
-পদ্ম,কয়েল জ্বালা।
ও অন্ধকারে ম্যাচ,কয়েল যোগাড় করে মোম জ্বালাল,কয়েল ধরাল। বাসায় নতুন এসেছে এখনও কোনাগলিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠে নি তবু হোঁচট পর্যন্ত খেল না,শব্দও না। নীরাকে বলাতে ও উড়িয়ে দিয়েছিল,
-তোমার যত্তসব বাজে কথা।
পদ্ম অন্ধকার ভালোবাসে। প্রায়ই দেখেছি অন্ধকারে গুণগুণ করে কথা বলে।
-কীরে,কার সাথে কথা বলিস?
-আব্বা, গান গাই।
যেই মেয়ের মুখে সারাদিন টু শব্দ হয় না সে অন্ধকারে গান গাইছে,কেমন উদ্ভট না!
আরেকটা ঘটনা বলি,একদিন দুপুরবেলা নীরা ফোন করে আদুরে গলায় বলল,
-তোমার জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে।
-কিহ?
-আহা! লাঞ্চের টেবিলে পাবে।
-ঢং। করো নাতো। নতুন কি রান্না করেছ?
-কাচ্চি বিরিয়ানি৷ পদ্মকে দিয়ে তোমার অফিসে পাঠিয়েছি।
-নীরা তুমি পাগল হয়ে গেছ। ও ঢাকা শহরের কোনো রাস্তাঘাট চেনে না। মিরপুর থেকে সেগুনবাগিচা চাট্টিখানি রাস্তা!
-নীরা থতমত খেয়ে বলল,
-ওতো,বলল ও পারবে।
-দুর।
মেয়েটাকে খুঁজতে বের হব দেখি টিফিনক্যারিয়ার হাতে হাজির। খটকা লাগল, ও বড় হয়েছে কলকাতায় তারপর গ্রামে। ও ঢাকা শহর চিনে ফেলল!
-তুমি একা এসেছ?
-জ্বী।
-দারোয়ানকে দিয়ে ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। নীরার হাতে কাচ্চি গলা দিয়ে নামছে না, ভাবছিলাম পদ্ম কিছু একটা লুকিয়ে যাচ্ছে। ওইটুকু একা নেত্রকোণা থেকে ট্রেনে চেপে আমার বাসায় উঠে এসেছিল এখনও ঢাকার রাস্তায় একা চলাচল করেছে। ও কিছুএকটা লুকিয়ে যাচ্ছে। চুরিডাকাতির মতলবে বাড়িতে ঢোকা ওর লক্ষ্য হতে পারে।
বাড়ি ফিরে নীরাকে বলব পদ্মকে বিদায় করে দিতে কিন্তু বাড়ি ফিরে আরো বড় সারপ্রাইজ আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল।নীরা প্রচণ্ড বমি করছে, ওর শরীরে জ্বর। ডাক্তার এসে ঘোষণা করল,
-ও কনসিভ করেছে।
ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। প্রচণ্ড খুশি হয়েছি।নীরার আমার বুকের ভেতর কাঠ হয়ে শুয়ে রইল। ও কাঁদছে।
-কি হয়েছে?
-আমার খুব ভয় করছে।
-কেন?
-বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে, কে যেন আমায় লক্ষ্য করছে।
-দুর বোকা।
দরজায় খটাখট শব্দ হল,পদ্ম দাঁড়িয়ে।
-আম্মা,আপনের ওষুধ।
পদ্ম, তোর আম্মারে যত্ন করিস। তোর আম্মার বাচ্চা হবে।
পদ্ম ঘাড় কাৎ করে হাসল।ওর হাসিতে এমন কিছু ছিল আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হলাম।
নীরার শারীরিক অবস্থা পরিবর্তন হতে লাগল খুব দ্রুত। সারাক্ষণ মাথা ঘোরায়, গলায় চোরা ঢেকুরের অস্বস্তি। প্রায় রাতেই হাত দিয়ে দেখি ওর গায়ে জ্বর জ্বর ভাব। রাতে ঘুমের মাঝে আৎকে উঠে।
-আমি খুব বাজে স্বপ্নে দেখেছি।
-কি স্বপ্ন?
-দেখি আমার গর্ভে বেবির সাথে একটা সাপ বড় হচ্ছে।
-নীরা গর্ভবতী মহিলারা কমন সমস্যা দুঃস্বপ্ন দেখা।
-স্বপ্নের মধ্যে পদ্মকেও দেখলাম।ও হাত বাড়িয়ে সাপটা ধরতে চাইছে।
-নীরা, স্টপ ইট।তুমি কোনো কারণে পদ্মকে পছন্দ করছ না। ওকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিব?
-নাহ।
নীরা আৎকে উঠে। ওকে যেতে দিব না।
-আচ্ছা । তবে ঘুমাও।
দিন কাটছে। প্রথম সন্তান স্ত্রীর গর্ভে এলে বাবারা যেমন সুখী সুখী চেহারায় ঘুরে বেড়ায়,সন্তানের নাম ঠিক করে আমি তা পারছিলাম না। নীরার চোখের নীচে কালি,কোনোকিছুই খেতে পারছে না।
একদিন বাড়ি এসে দেখলাম পদ্মকে খুব বকাঝকা করছে।
-কি হয়েছে।
-দেখো,আমার নতুন কামিজ বারান্দায় রোদে দিয়েছিলাম এখন দেখি ছেঁড়া। ও বলছে,টান দিয়ে নিয়ে আসার সময় ছিঁড়ে গেছে।
দেখলাম সত্যি কামিজের ঠিক পেটের কাছে অনেকখানি ছেঁড়া। তবে তারকাঁটায় বেঁধে ছিঁড়েছে বলে মনে হচ্ছে না, কাঁচি দিয়ে ইচ্ছাকৃত কেটে ফেলা হয়েছে।
এইরকম প্রায়ই হতে লাগল। নীরার সালোয়ার,কামিজ প্রায়ই দেখতাম কাটা একেবারে পেটের কাছে।পদ্মকে প্রশ্ন করে সদুত্তর পেতাম না।
দুই মাস পর নীরাও কেমন অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করল।মাছ-মাংস যাই মুখে দেয় গন্ধ লাগে। এমনকি আমাকে পর্যন্ত বলল,
-আমি তোমার সাথে ঘুমাব না।
-কেন?
-তোমার গায়ে রসুনের গন্ধ।
মানে?
-হু। তুমি ডিভানে ঘুমাবে।
-আচ্ছা।
নীরাকে পদ্মকে নিয়ে বেডরুমে ঘুমাতে শুরু করল। আমি বসার ঘরে। মাঝরাতে ওদের ঘরে উঁকি দেই। নীরা হাতপা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে।মেঝেতে বিছানা পেতে পদ্ম ঘুমায়। ওর চোখ বন্ধ,নিশ্বাস উঠানামা করছে তবু কেন জানি মনে হয় ও ঘুমায় না।নিঃশব্দে অন্ধকারে আমাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে।
আমার আগে বাড়ি ফিরতে রাত হত। এখন সন্ধ্যা না গড়াতেই বাড়ি ফিরি।নীরাকে একা রাখতে ভয় হয়। রোববার প্রচুর কাজ থাকে, লাঞ্চ আওয়ারে পদ্ম ফোন দিল,
আব্বা, আম্মায় খুব কানতাছে।
-কি হয়েছে?
-জানি না। বলে হাতে খুব ব্যথা।
দ্রুত বাড়ি ফিরলাম। নীরা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।ওর বা’হাত ফুলে ঢোল হয়ে গেছে।
-হাতের ভেতর কাটা কাটা কি যেন! আমি! আমি! সহ্য করতে পারছি না। উহু!
দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ও ওটিতে নিয়ে যাওয়া হল। সার্জন ওর হাত খুঁচিয়ে যা বের করল দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম।আমার মত পুরো হসপিটালের লোকজনও ভীষণ অবাক।বাহুর মাংস
পেশীতে গেঁথে আছে কয়েকটা সোনামুখী সুঁই।
বিস্ফারিত কণ্ঠে বললাম,
-নীরা, এটা কিভাবে হল?
-আমি জানি না।সত্যি জানি না।
#গল্পঃদ্বন্দ-৪
হাবিবা সরকার হিলা
-চলবে
সেরা থ্রিলার গল্প দ্বন্দ পর্ব ৫
বলছিলাম আমার স্ত্রী এর আগেও দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে। একবার একগাদা ঘুমের ঔষুধ খেয়ে আরেকবার সবজি কাটার ধারালো ছুরি দিয়ে বা’হাতের শিরা কেটে ফেলে। তাই হয়ত ওর হাত সুঁচ ফুটানো দেখে তত বেশি অবাক হই নাই।নীরা কনসিভ করার পর ওর সাথে আমার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না৷ নিজের শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করে কাছের মানুষকে মেন্টালি টর্চারে রাখা ওর একধরনের মানসিক রোগে পরিণত হয়েছে।
তবু ওর প্রতি বিতৃষ্ণায় মন ভরে উঠল।
-ওর গর্ভে আমাদের বাচ্চা। কেমন মেয়ে ও সন্তানের কথা ভাবে নাই!
দু’দিন পর হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে এলাম। আত্মীয়-স্বজনেরা দেখতে হল।আমার মা এল গ্রাম থেকে তাবিজ আর পানি পড়া নিয়ে।
-বউকে দু’বেলা নিয়ম করে পানি খাওয়াবি আর এটা গলায় বেঁধে দিবি।
নীরা আপত্তি করল না। শুধু তাবিজ হাতে নিয়ে করুণ চোখে তাকাল,
-তুমি বিশ্বাস করো আমি ইচ্ছাকৃত সুঁচ ফোটাই নি।
-নীরা, তাবিজটা পরে নাও।
-আমার উপর জ্বীন-ভূতের আছর এটা মনে করছ!
অনেকদিন পর নীরার পাশে বসলাম।
-নীরা তুমি অসুস্থ। গর্ভে সন্তান এলে হরমোনের পরির্বতনের কারণে অনেক মায়েদের মানসিক ডিজঅর্ডারের মত দেখা যায় অনেকটা সিজোফ্রেনিয়ার মত। এটা খুব কমন সমস্যা। এটাকেই আগের যুগের মানুষেরা বাতাস লাগা, কুদৃষ্টির প্রভাব ইত্যাদি বলে মনে করে!
-আমি সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছি কে বলছে তোমাকে তোমার জ্ঞানী বন্ধু, আফসারী।
-প্লিজ!
নীরা ফুসতে ফুসতে বলল,
-ওই ছাগল নিজে পাঁচ বছর ধরে লিভ ইনে আছে মেয়েটাকে বিয়ে করছে না আর তোমাকে বউয়ের কিভাবে যত্ন নিতে হয় শেখাতে আসছে! তুমি আমার সামনে থেকে দূর হও। আর পদ্মকে বলবে চিনি কম দিয়ে কাগজি লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে আসতে। আমি এখন ঘুমাব।
আমি নীরার ঘর থেকে বেরিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম নীরাকে ডাক্তার দেখাব। মানসিক রোগের চিকিৎসক। আফসারীর দেওয়া আপনার ভিজিটিং কার্ড তখন আমার পকেটে। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস নীরাকে আসতে হল না আমিই এসে উপস্থিত হলাম।
আরো কয়েক পৃষ্ঠা গোটা গোটা অক্ষরের লেখা। ভোর সাড়ে চারটা বাজে। আর পড়ার রিস্ক নিলাম না। সকালে চেম্বারে বসতে হবে। ফজরের নামাজ শেষ করে কয়েকঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতে হবে নতুবা অফিসে ঝিমুনি আসবে।
ঘুম থেকেই প্রথমে যা করলাম তা হচ্ছে আফসারীকে ফোন করা। ও সকাল সকাল আমার ফোন পেয়ে চমকে উঠল।
-স্যার, কোনো দুঃসংবাদ?
-না। তোমার বন্ধু রাজীব রহমানের বাড়ির অ্যাড্রেস ম্যাসেঞ্জারে পাঠাতে পারবে?
-অবশ্যই।
-ওর স্ত্রী মারা গেছে কতদিন হল?
-প্রায় সাত-আটমাস তো হবেই।
-ওদের বাড়ির কোনো পরিচারিকাকে দেখেছ? অল্পবয়স্ক, কালোমতন!
-পদ্ম!
-হ্যা।পদ্ম। ও এখন কোথায়?
-জানি না। ভাবী মারা যাবার পর জানাজার দিন দেখেছিলাম। এক কোণায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। বিকট দর্শন বলেই এখনও মনে আছে। কেন বলুন তো?
-পরে জানাচ্ছি।
বিকেলে ঝরঝর বৃষ্টি। আমার ক্ষেত্রেই এমন হয় প্রকৃতি অবিচার করে বসে৷ দু’চারটা রোগী দেখে সারাদিন অবসর কাটালাম যেন মাথা ঝরঝরে থাকে। রাজীব রহমানের নামের হাঁটুর বয়সী একটা ছেলে আমার সাথে গেমস খেলছে। এরকমই হয় ভীষণ বুদ্ধিমান মানুষ বুদ্ধিমত্তা শো করতে গিয়ে আচমকা ভুল করে ফেলে। আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে রাজীব রহমান তার স্ত্রীর আত্মহত্যার পিছনে প্রধান কালপ্রিট। পদ্ম, ফদ্ম এসব বাজে কথা। একটা কিশোরী মেয়ের উপর অযথা দোষ চাপানো হচ্ছে।
সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তারপর উবার ডেকে রওনা হলাম। বাড়ি চিনি না, কয়েকব্লক ঘুরতে হবে।মিটারের টাকা কিছু বেশি উঠবে। উপায় নাই। এই জৈষ্ঠ্য মাসের অবেলার বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি লাগানোর কোনো ইচ্ছা আমার নেই।
রাজীব রহমান বাড়িতেই ছিলেন। টাউজার আর গেঞ্জি গায়ে বারান্দায় বৃষ্টি দেখছিলেন
আমায় দেখে চমকাল না। হাসল।
-স্যার,আসুন। আমি জানতাম আপনি আসবেন।
-কিজন্যে আসব তা জানতেন?
-জানি। আপনি পুরো ভিজে গেছেন। দাঁড়ান তোয়ালে নিয়ে আসছি।
আমি ভদ্রলোকের ঘরবাড়ি দেখতে গেলাম। পরিপাটি বসার ঘর,মধ্যবিত্তের রুচির ছাপ আছে। ভদ্রলোক বা তার স্ত্রীর কোনো ছবি ফ্রেমে বন্দী নাই। দেয়ালে নতুন রঙ করা হয়েছে। বড্ড বেশি সাদা,চোখে লাগে। রাজীব কাঁধে তোয়ালে আর ধোঁয়া উঠা দুইকাপ কফি হাতে।
-আমার জন্য বানিয়েছিলাম আপনি আসাতে অতিথি অ্যাপায়নও হয়ে গেল।
রাজীব বসল। ছোট ছোট চুমুক দিয়ে কফি পান করছে।কোটরগত চোখ,মাইলাম ৭.৫ গ্রহন করছে বোঝা যাচ্ছে না।
-রাজীব সাহেব,
-বলুন।
-আপনাকে কিছু কথা বলব।
নিরদ্বিধায় শুরু করেন।
-আপনি প্যাড খাতা হারিয়ে ফেলেন নাই, বহুদিন আগে থেকেই আপনার লেখালেখির অভ্যাস ছিল আমি চাওয়াতে ডায়েরির পাতা কিছু যোগবিয়োগ করে আমার চেম্বারে নিয়ে এসেছেন। কলমের কালির হেরফেরের কারণে এটা ধরার জন্যে সাইকিয়াট্রিস্ট হবার প্রয়োজন নাই সাধারণ মানুষই যথেষ্ট। বোঝাতে পেরেছি।
-জ্বী। তারপর।
-প্রথম থেকে শুরু করি, আমি লিখতে বলেছিলাম আপনার কথা কিন্তু আপনি কোনোক্রমে শৈশবের স্মৃতিমন্থন করে হুট করে বিয়েতে চলে গেছেন। কেন? বাহানা হিসেবে উপস্থিত করেছেন যৌবনের শুরুর সময়টা আপনি জীবনগঠনে ব্যস্তসময় পাড় করেছেন। ডাহা মিথ্যা কথা। বুয়েট,মেডিকেল কলেজে পড়ুয়া ছেলেমেয়েও প্রথম জীবনে প্রেম করে, এলএসডির নেশা শুরু করে, গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে কক্সবাজার ঘুরে আসে ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনার জীবনে মাঝখানের দশ বছর এরকম কোনো স্মৃতি নেই! কেন? জানেন তো, আমরা সেই অতীতকে একেবারে গভীর থেকে মুছে ফেলি যা নিয়ে আমরা ভেতর থেকে লজ্জিত। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করতে গিয়েও বুক কাঁপে। আপনার কি ওইরকম কোনো স্মৃতি আছে?
রাজীব চুপ হয়ে আছে।
-আপনি আমার সব প্রশ্নের উত্তর একেবারে দিবেন,আশা করছি। আপনি বাচ্চা চাইছেন শুনে আপনার স্ত্রী চুপসে গেল কেন? ওর কি এনিয়ে কোনো দুর্বিষহ স্মৃতি আছে? আপনার লেখার কোথাও প্রথম সন্তান কনসিভ করলে স্বামী-স্ত্রী দুজনের যে গভীর আনন্দ অনু্ভূত হয় তা একবারও প্রকাশ করেন নাই অথচ বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে প্রচুর আহ্লাদ করেছেন। আর নীরা কনসিভ করার পর আপনাকে সহ্য করতে পারত না। সম্ভবত ওর প্রথম বেবি গর্ভে নষ্ট হয় এবং সেটা আপনার ইচ্ছায়। আপনার স্ত্রী বারবার আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল তাতেও আপনার দায় ছিল। নতুন দম্পতির কিচিরমিচির ঝগড়ায় হয় সুমধুর এতে সম্পর্ক আরো মজবুত করে। আপনাদের এত প্রেম আবার ঝগড়ার উৎস কি?ব্যবসায়িক কাজে বছরের বেশিরভাগ দেশের বাইরে কাটান,আপনার ধারণা ছিল নীরা গোপনে পরকীয়া করছে এবং সেই জের ধরেই ঝগড়া হত। নীরার কনসিভ করেছে শুনে বিশ্বাস করতে পারেন নাই বাচ্চাটা আপনার। তাই গর্ভপাত করিয়েছিলেন।আমি কিছু ভুল বললাম?
আবছা অন্ধকারে আমি ওর মুখের অভিব্যক্তি বুঝতে পারছিলাম না। আস্তে করে বলল,
না।
-এখানে আপনার কাহিনী ইতি ঘটতে পারত। স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দের কারণে নীরা আত্মহত্যা করেছে।আমাদের দেশে এখনও নারীর সবচেয়ে দূর্বলতম জায়গা তার সতীত্ব এবং আপনি সেখানেই আঘাত করত। নীরা ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে বলেই সংসার করে গেছে নতুবা অন্যের বাচ্চা ভেবে ভ্রুণহত্যা করবার পর কোনো মা সহ্য করত না। আপনাকে ওর ত্যাগ করা উচিত ছিল। আপনি আমার লজিকে সম্পূর্ণ ওলটপালট করে ফেলেছেন পদ্মকে নিয়ে এসে। মেয়েটা কে? কি তার পরিচয় ওসব বাদ দিন।আমি প্রথমে ভেবেছি পদ্ম একটা রুপকথা। তারপর আফসারীর কথা শুনে শিউর হলাম।আপনি বা নীরা কেউই পদ্মকে পছন্দ করেন না। পদ্মর আচরণ সন্দেহজনক তবু ও আপনি ওকে বাড়ি থেকে বের করলেন না। কেন? কারণ আপনি চেয়েছিলেন নীরা কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকুক আর সেটা পদ্ম।
পদ্ম আপনার স্ত্রীর কাপড় ছিঁড়েছে, এমনও হতে পারে ওই নীরার শরীরে সুঁচ ফুটিয়েছে জানার পরও আপনি চুপ থেকে গেছেন। পদ্মকে গালিগালাজ করেন নাই কেন? কারণ পদ্ম আপনার সম্পর্কে এমন কিছু জেনে গেছিল যা আপনার স্ত্রী জানে না।তাই আপনি পদ্মকে ভয় পেতে শুরু করেন। রাজীব সাহেব বাকি ঘটনা আমি আপনার মুখে শুনতে চাই।
রাজীব সাহেব ততক্ষণে ঘামতে শুরু করেছেন। আমি অপেক্ষা করছিলাম একজন মানুষ তার বহুবছরের পুরানো পাপ নতিস্বীকার করবে। ঠিক যেমন সাজাপ্রাপ্ত আসামীকে ফাসির মঞ্চে প্রবেশ করবার আগে তওবা পড়ানো হয় ঠিক তেমন।
রাজীব সাহেব বলতে লাগলেন,
-এইচএসসি পড়ার সময় আমার সাথে এক মেয়ের প্রেম হয়। মাধবী মজুমদার৷ আমি ফার্স্ট ইয়ার ও সেকেন্ড ইয়ার। প্রথম ভালোবাসা,মেয়েটাকে পছন্দ করতাম খুব।দুজনেরই কাঁচা বয়স, ও হিন্দু আমি মুসলমান। কিছুতেই এসম্পর্ক পরিবার মেনে নিবে না বুঝতে পেরে আমরা চিটাগাং পালিয়ে গেলাম। সেখানকার এক সস্তা হোটেলে স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে ঘর নিলাম। ইচ্ছা ছিল পরদিন সকালে বিয়ে করব। রাত দুইটার দিকে দরজায় চপোটাঘাত। মাধবী ভয়ে আমার বুকে লুটিয়ে পরল,ও ভেবেছিল হোটেল রেড করতে পুলিশ এসেছে। আমাদের কাছে কাবিননামা বা বিয়ের কোনো পরিচয় নাই ধরা পরে যাব। না! পুলিশ আসে নাই ঘরে ঢুকল একদল হায়েনা। আমাদের অল্পবয়স আর আমতা আমতা কথা শুনে হোটেল ম্যানেজার বুঝতে পেরেছিল পালিয়ে এসেছি। তিনি সুযোগ বুঝে বাজে পাড়ায় বিক্রি দিয়ে নিয়ে এসেছে এবং টাকার বিনিময়ে মাধবীকে বিক্রি করে দিয়েছে।ওরা ছিল চার-পাঁচজন।ওদের পা ধরেও আমরা রক্ষা পাই নাই। আমাকে লাথিগুঁতা জুতার আঘাতে মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলল আর সারারাত ধরে চোখের সামনে মাধবীকে রেপ করল। সকালে জ্ঞান ফিরে দেখি ফুটপাতে শুয়ে আছি,মাধবী নেই। ওকে ওরা তুলে নিয়ে গেছে। সকালে কোনোরকমে আধমরা হয়ে ঢাকা ফিরলাম। কেউ জানত না,মাধবী আমার সাথে পালিয়েছে তাই কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় নাই৷ কিন্তু আমার জন্যে মাধবী নরক যন্ত্রণা ভোগ করছে এই পাপবোধ সারাজীবন তাড়া করে বেরিয়েছে। অনেক অনেক বছর আমি নারী সঙ্গ বিবর্জিত। তার কারণ ছিল মাধবী। ওকে ভুলতে পারি নাই।বহু বছর পর নীরাকে দেখার পর সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। আপনাকে আমি মিথ্যা বলেছিলাম, আমার স্ত্রী সুন্দরী। চোখে পরার মতই সুন্দরী তারজন্যে আমি সবসময় আতঙ্কে থাকতাম৷ একে তো ওর শরীর সম্পর্কে উদাসীন,দ্বিতীয়ত মাধবীর ঘটনার পর আমার কাছে সব পুরুষকে একরকমই লাগত। মনে হত সবাই নীরাকে কামনার দৃষ্টিতে দেখছে। নীরা প্রচুর ছেলে বন্ধু ছিল,আত্মীয়স্বজন কাজিনেরও অভাব নাই। আমি ওদের সাথে নীরার মেলামেশা একেবারেই পছন্দ করতাম না। আমাকে লুকিয়ে প্রায়ই কথা বলত, টেক্সট করত। ওর এই স্বভাবের জন্য প্রচুর ঝগড়া হয়েছে,গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছি। লাভ হয় নাই।ও যখন কনসিভ করে মাসের কুড়িদিন আমি ব্যবসায়িক কাজে সিলেট থাকতাম। ওর বন্ধুবান্ধব বাড়িতে এলেও আমার জানার কথা না। যাই হোক, বলছি না বাচ্চাটা অন্য কারো ছিল। কিন্তু জোর করে মিসক্যারেজ করানো ছিল ওর জন্যে একটা শাস্তিস্বরূপ। পাখি বেশি উড়লে যেমন পাখা ভেঙে দিতে হয় অনেকটা তেমন।আপনি আমাকে খুনী ভাবছেন কিন্তু নীরাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারতাম না আবার ওর অবাধ আচরণ বরদাস্ত ও করতে পারতাম না। তাই এটা ছিল ওকে ঘরে বন্দী করার একমাত্র মেডিসিন।
রাজীব সাহেব ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেল। আমি কিছু বললাম না। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলতে লাগল,
-সবে আড়াইমাস ওর গর্ভে সন্তান ছিল। খুব তো বেশি তো নয় বলুন! আমি দেখতাম নীরা হাসত,কাঁদত বাচ্চার সাথে কথা বলত। ওর প্রথম মা হওয়া, রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পেট দেখত কতটা পাগলামি! আমরা ছেলেরা বাবা হই সন্তান বাবা বলে ডাক দিলে মেয়েরা তো পুতুল খেলার বয়স থেকেই মা হবার স্বপ্নে বিভোর থাকে। পুতুলের মা হয়,পুতুল হারিয়ে গেলে কেঁদেকেটে অস্থির হয়। আর সেই মেয়ের বাচ্চা হারানোর পর অনুভূতি কেমন ছিল,জানেন? অধিক শোকে মানুষ যেমন পাথর হয় অনেকটা তেমন। ও আমার সাথে হাসছে, খেলছে গল্প করছে কিন্তু মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলি আমার স্ত্রী পাশে নাই। জায়নামাজে বসে অঝোরে কাঁদছে। ও প্রার্থনায় আল্লাহপাকের কাছে আবার সন্তান চাইত না ওর চাওয়া ছিল একটাই,
–
-হে পরম করুণাময় পরকাল বলে যদি কিছু থাকে আমি যেন আমার সন্তানকে একটিবারের জন্যে হলেও দেখতে পাই।
নীরা পবিত্র ছিল তাই ওর সেই আকাঙ্খা আল্লাহপাক খুব দ্রুতই পূরণ করে ফেলেছেন।
রাজীব সাহেব কাঁদছে। ফোটা ফোটা চোখের জল গড়াচ্ছে। তিনি কান্না লুকানোর কোনো চেষ্টা করছে না।
আমারও চোখের কোণায় অশ্রু জমতে শুরু করল। একটা অজানা অচেনা মেয়ের জন্যে যাকে কোনোদিন দেখি নাই তার জন্যে বুকের ভেতরটা কেমন খচখচ করে উঠছে।
রাজীব সাহেবকে ধাতস্থ হতে সময় দিলাম। তিনি চোখের জল মুছে মুখ ধুয়ে এলেন,
পরেরবার নীরা কনসিভ করল আমার ইচ্ছায়,বলতে পারেন আমাকে খুশি করতে। আর আমারো মনে হচ্ছিল একটা বাচ্চা না হলে নীরা স্বাভাবিক হবে না। সেই সময়ে পদ্মর আগমন। পদ্মকে আমার প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয় নাই। ওর মাঝে অদৃশ্য কিছুর কালো ছায়া দেখতে পারতাম।মেয়েটা দাঁত বের করে হায়েনার মত হাসত। পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত হাসি। আমার শরীরের শিরায় শিরায় ভয়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিত। ওকে প্রথম দিনই আমি বের করে দিতাম৷ আমি সেদিন অফিসে যাবার সময় ও নীচু গলায় বলল,
-আপনের কাছে আজকা মাধবী দি আইব।
-কিহ?
-তুমি! তুমি মাধবীকে চিনো কি করে?
-হেয় আমারে চিনে না কিন্তু আমি তারে ঠিকই চিনি। হের পোলার খুব অসুখ আপনের কাছে টাকা চাইতে আইব।
-তুমি এসব কিভাবে জানো?
-আমি না আমার লগে যে আছে হেয় দুনিয়ার ভূত+ভবিষ্যৎ সবই জানে। আপনেরটা কমু?
সেদিন কাঁপতে কাঁপতে অফিসে গেলাম। সত্যি মাধবী এসেছিল। ও ততদিনে আগাগোড়া কলগার্ল। নিজের পরিচয় পাল্টে ফেলেছে, নাম রেখেছে মিস চুমকি। ওর একটা ছেলেও আছে৷ হার্টের অসুখে ভুগছে। বহুকষ্টে আমার অফিসের ঠিকানা যোগাড় করে চলে এসেছে। যদি পুরানো পরিচয়ের কথা ভেবে আমি কিছু সাহায্য করি।ওর দুই লক্ষ টাকা দরকার পাঁচ লক্ষ টাকার চেইক লিখে দিলাম। হাতজোড় করে পুরানো পাপের জন্যে ক্ষমা চাইলাম,
-আর যেন কোনোদিন না আসে।
যাবার সময় ওকে প্রশ্ন করলাম,
-তুমি পদ্ম নামের কোনো মেয়েকে চিনো?
মাধবী হাসতে হাসতে জবাব দিল,
-আমি মেয়েছেলের খবর রাখি না তবে পুরুষ মানুষ হইলে ভিন্ন কথা। তোমার কাছে কাস্টমার থাকলে খবর পাঠাইও। একবার খালি চুমকি কইয়া ডাক দিবা,
-বান্দা সরি বান্দী হাজির।
#দ্বন্দ্বঃ৫
-চলবে
হাবিবা সরকার হিলা
সেরা থ্রিলার গল্প দ্বন্দ পর্ব ৬
-স্যার,আপনি কি ভাবছেন আমি আমার স্ত্রীকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছি?এতটা নিষ্ঠুর আমি!
-আপনার সাবেক প্রেমিকা এখন কলগার্ল৷ পতিতালয়ে পচে মরছে। ওর জন্যে আপনার চোখে বিন্দুমাত্র মায়াও দেখলাম না। মানুষকে দ্বারা অবিশ্বাস্য বলতে কিছু নাই।
-ও আর সেই আগের মাধবী নেই। পরিচয় না দিলে চিনতেও পারতাম না। রঙচঙে চেহারা, উদ্ভট সাজপোশাক। ওকে মিস চুমকি নামে মানিয়ে গেছে।
-আর আপনার স্ত্রী যে আগুনে পুঁড়ে আত্মহত্যা করেছে তার জন্যে মায়া হয়?
রাজীব সাহেব চমকে তাকাল।
-আপনি একটু বসুন প্লিজ।
ভদ্রলোক চলে গেলেন।দুই মিনিট পর ফিরলেন। হাতে নীল মখমলের কাপড়ে মোড়া অ্যালবাম।
-বিয়ের পর বন্ধুবান্ধবকে বাড়ির ত্রিসীমানায় আনতাম না। আত্মীয়স্বজন খুব কম আসত। কেন যেন,নীরাকে লোকচক্ষুর মুখোমুখি করতে ভয় হত খুব। লোকে যেমন সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন সিন্দুকে লুকিয়ে রাখে তেমনি নীরাকে আড়ালে রাখতাম। ওর সমস্ত ছবি পেনড্রাইভে ছিল, ওর মৃত্যুর পর অ্যালবামে সাজিয়ে রেখেছি। আমাদের ব্যক্তিগত অ্যালবাম,আপনাকে প্রথম দেখাচ্ছি।
দেখলাম, রাজীব সাহেবের গলা ধরে টুকটকে লাল বেনারসি গায়ে একটা মেয়ে মিটিমিটি হাসছে। তীক্ষ্ণ নাক, বাঁকা ভ্রুর নীচে আল্পনায় আঁকা চোখ। আমি দেখলাম যুবতী বয়সের শ্যারন স্টোনকে। এমন সুন্দরী স্ত্রীকে লুকিয়ে রাখতে চাওয়া অসঙ্গত কিছু নয়। মুগ্ধ হয়ে বললাম,
-আপনাদের দুজনকে চমৎকার মানিয়েছে,রাজযোটক।
-আপনি পরের ছবিগুলোও দেখুন।
অ্যালবামের পাতা উল্টালাম। নবদম্পতি মেঘালয় ঘুরতে গেছে, কাশ্মীর তারপর বেনারস। রঙবেরঙের ছবি। দুজনের প্রেমময় মুহূর্ত। তারুণ্যের সবচেয়ে বড় উপহার প্রাণপ্রাচুর্যময় হাসি। আমি উপভোগ করছিলাম। পিছনের ছবিতে নীরা একা। পেটে হাত। মুখে সলাজ হাসি।
রাজীব সাহেবের দিকে তাকালাম,
-জ্বী। ওর কনসিভ করার পর তোলা।ফটোগ্রাফার আমি।
-আচ্ছা।
-পরের ছবিগুলোতে নীরার মুখ মলিন। চোখের নীচে কালি। শরীর শুকিয়ে গেছে। কয়েকটা ছবি হাসপাতালের নীল পোশাক। চোখমুখে আতঙ্ক। কেমন গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে।
রাজীব অধোমুখে বলল,
-ওর অসুস্থতার সময় তুলে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, বাচ্চা বড় হলে ছবি দেখিয়ে বলব,দেখ বাবা, তোর মা তোকে জন্ম দিতে গিয়ে কতটা কষ্ট করেছে। সৌভাগ্য হল না।
-নীরা আত্মহত্যার সময় ওর গর্ভে বাচ্চা ছিল?
-না। তার কয়েকদিন আগেই মিসক্যারেজ হয়ে যায়। প্রথমবার আমার দোষ ছিল বলে পরেরবার যথাসাধ্য যত্ন নিয়েছিলাম। কিন্তু বাথরুমের পিচ্ছিল মেঝে আমাদের সর্বনাশ করে। নীরার খুব পরিষ্কার থাকার বাতিক ছিল , বাথরুমের মেঝেতে চুল মাখার তেল কিভাবে পরল কে জানে! কপালে দূর্ভাগ্য লেখা থাকলে যা হয়।
রাজীব সাহেবের স্ত্রীর করুণ কাহিনীর চেয়ে একটা ছবি বেশি আকর্ষণ করছিল। একটা ছবি, নীরা সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। শরীর শুকিয়ে কঙ্কালটপ্রায়। হাড় ক’টা গোণা যায়। নাক আর ঠোঁটের মাঝখানে বেশ ব লালচে ঘা। ছবিতেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। পিছনে একটা ভয়ঙ্কর কালো মুখ৷ বিষাক্ত সরীসৃপ দেখলে যেমন শরীর হাত পা রি রি করে তেমন অনুভূত হচ্ছিল।
-এটাই পদ্ম?
-হু।
-পদ্মর কোথায় আছে কোনো খোঁজ আছে আপনার কাছে?
-জ্বী না।নীরার মৃত্যুর পর ওকে গ্রামে দিয়ে আসি। শুনেছি সেখান থেকেই নিঁখোজ হয়। থানায় জিডি করতে ওর পরিবার সম্মত হয় নাই। পদ্ম দীর্ঘদীন বাড়ির বাইরে থাকায় পরিবারের কেউ ওকে আপন ভাবে না। ওর খোঁজ পাওয়া মানে একটা বাড়তি মানুষের অন্ন যোগান দেওয়া।
-ওর ব্যবহৃত জিনিসপত্র!
-কিছুই নাই। আমার ধারণা ও হারিয়ে যায় নাই সব নিয়ে ভেগেছে। এছবিটা হঠাৎ ফোনের ক্যামেরায় পদ্মর অগোচরে তোলা। পদ্ম ছবি তুলতে চাইত না।
এই একটা ছাড়া ওর আর কোনো ছবি নাই।
-আপনার স্ত্রীর ঘরটা দেখানো সম্ভব হবে?
-জ্বী।অবশ্যই আসুন।
বসার ঘরের পর গেস্টরুম। লম্বা করিডোর পাড় করে উনাদের শোবার ঘর। দরজা ভেজানো। রাজীব রহমান বললেন,
-দেখবেন, দরজা খুললেই কি অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ। নীরার গায়ের ঘ্রাণ সারা ঘরে জড়িয়ে আছে।
দরজা খুলে রুমে ঢুকে রাজীব সত্যি নাক টেনে সুবাস নিল। আমি কোনো ঘ্রাণ পেলাম না। মেয়েলি হাতে পরিপাটি সাজানো ঘর। একটা দেয়াল দুজনের বিয়ের বিশাল ছবি ফটোবন্দী হয়ে অতীতে আটকে আছে। ড্রেসিংটেবিলের পাশে বেডটেবিলে কয়েকটা রঙিন কাঁচের জার থেকে কৌতুহল লাগল।
-এগুলো কি?
-ওহ! নীরার শখের জিনিস। এর ভেতর বকুল ফুল,কাঠগোলাপ মমি করে রেখেছে। ফুলের মমি। ফুলগুলো পদ্ম সংগ্রহ করে এনে দিয়েছে।
কাছে গিয়ে হাতে নিলাম। ফুল বলেই গন্ধ শুঁকলাম।
সন্দেহ দানা বেঁধে উঠল। ছিপি খুলে ঝাঁকি দিতে সাদা পাউডারের মত বস্তু মেঝেতে ছড়িয়ে পরল। ছাব্বিশ বছর ধরে মানসিক রুগী নিয়ে আদিনক্ষত্র বিচার করায় এবস্তু সাথে সাথে চিনে ফেললাম।বেনজয়েলমিথাইলএকজোনিন।কিছুটা অদলবদল করে যাকে আমরা চিনি কোকেইন নামে।
ব্যাপারটা স্রেফ চেপে গেলাম।
-নীরা মেডিসিন নিত?
-হ্যা।
-দেখি।
গর্ভবতী মায়েদের ফলিক এসিড, ভিটামিন ট্যাবলেটের পাশে অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ।
-ওর শ্বাসকষ্টের রোগ ছিল বা এলার্জি?
-না। তবে মাইগ্রেনের ব্যথা ছিল।
-রাজীব সাহেব, আপনি আমার সাথে এক সপ্তাহ পর দেখা করুন। ততদিন দয়া করে আপনি এঘরে ঘুমাবেন না।পদ্ম নামের মেয়েটা আপনার স্ত্রীকে কোকেইনের নেশা করতে সাহায্য করত। ব্যাপারটা আপনার স্ত্রী জানে নাকি সম্পূর্ণই পদ্ম দায়ী বুঝতে পারছি না। ফুলের ভেতর পাউডার। আরো কয়েক জায়গায় পাউডার লুকানো আছে নির্ঘাত। নীরার নাকের কাছে ঘা দেখে তখনই সন্দেহ হয়েছিল। আপনি যে এঘরে স্ত্রীর ঘ্রাণ পান তা আসলে কোকেইনের বাষ্প। আপনারও নেশা হচ্ছে। সুতরাং এই ঘর আজ থেকে তালাবদ্ধ।
রাজীব সাহেবের চোখ বিস্ময়ে কোটর থেকে বেরিয়ে
আসছে। আরো কিছু প্রশ্ন করত। সুযোগ দিলাম না। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসলাম। একটার পর একটা রহস্য আমারই মাথা ঘোরাচ্ছে।
…
পদ্মর একমাত্র ছবি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম রাত বারোটায়। ছেলের মা না খেয়ে অপেক্ষা করে আছে। রাতে খাবার মুড ছিল না কিন্তু ও অপেক্ষারত চেহারা দেখে না করতে পারলাম না। ভুলে গিয়েছিলাম, আজ আমাদের বাইশতম বিবাহবার্ষিকী। টেবিলে সাজানো চিংড়ি মাছ দিয়ে পুঁই শাক চচ্চড়ি, বেগুন ভর্তা, দেশী মুরগির ঝোল, লইট্টা শুটঁকি ভুনা আর মাষকলাইয়ের ডালের আয়োজন দেখে মনটা আনচান করে উঠল। কাজের চাপে নিজেদের ব্যক্তিগত উৎসবগুলো প্রায়ই ভুলে যাই। সন্তানের মা তাই আশাও করেন নাই আমি উপহার নিয়ে আসব কিন্তু স্বামীর পছন্দমত খাবারের আয়োজন করেছেন। খেতে বসতেই কড়কড়ে ভাজা ইলিশ মাছ আর এক চামচ ঘি আগুন গরম ভাতে ঢেলে দিল।
-লতা, তোমার জন্যে একটা গোলাপ ফুলের তোড়া কিনেছিলাম।। সিএনজিতে ভুলে ফেলে এসেছি।
লতা সুন্দর করে হাসল,
-কেন মিথ্যা বলছ? ঝড়বাদলের দিনে রাত বারোটায় ফুলের দোকান খোলা থাকে না। আমার উপহার কালকে দিলেও চলবে।
মাথা নীচু করে খাচ্ছি। আমি পেশায় সাইকিয়াট্রিস্ট আর লতা ডিগ্রিধারী না হয়েও মনের অলিগলির সত্যমিথ্যা ঠিকই টের পেয়ে ফেলে।
-আজ রাতে তোমাকে একটা গল্প বলব। সত্যি বলব, মনোযোগ দিয়ে শুনবে। এত সুন্দর রান্না করে খাওয়ালে তাই এটা তোমার রির্টান গিফ্ট।
-আচ্ছা। আগে খাওয়া শেষ করো।
বেলকুনিতে দুজনে বেতের চেয়ারে আরাম করে বসেছি। বৃষ্টি নেই,দূরে কোথাও থেকে হাওয়া আসছে। কাঁথা মুড়ি দিয়ে আরাম করে ঘুমানোর আবহাওয়া। কাল সকালে অফিস। তবু বসলাম লতাকে সময় দেওয়া হয় না বহুদিন৷ লতা আমার পাশে থেকে ভালো শ্রোতা হয়ে গেছে। মনোযোগ দিয়ে সম্পূর্ণ ঘটনা শুনল।মন্তব্য করল,
-তুমি শিউর,মেয়েটার হাতের মাংসের ভেতর সোনামুখি সুঁই পাওয়া গেছিল?
-হ্যা। রাজীব সাহেবের ডায়েরিতে তাই লেখা।
লতা কয়েক মুহূর্ত চুপ।
-আমার মনে হচ্ছে ব্লাকম্যাজিক। বেশ কিছুদিন আগে পত্রিকায় পড়ছিলাম,আমেরিকায় একজন সৎ বাবা তার দুই বছরের ছেলের সারা শরীর সুঁচে বিদ্ধ করেছিল। পরে পুলিশের জেরার মুখে স্বীকার করে তিনি ব্লাক ম্যাজিকের চর্চা করেন। আর ছেলেটাকে মিডিয়াম হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।
-আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
– নয়ত পদ্ম মেয়েটা কেন নীরার ক্ষতি করবে? বাথরুমে তেল ছিটিয়ে রাখবে? ওর পরনের কামিজ ছিঁড়ে ফেলবে? ওকে ড্রাগের নেশায় পাগল করে ছাড়বে? তুমি নিজেই বলো।
উত্তর নেই। লতা আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ঘুমিয়ে গেল। আমি ল্যাপটপ নিয়ে আসলাম। সাথে রাজীব সাহেবের খাতা। আমার একজন বন্ধু আছে জুলহাস কবীর, অতিপ্রাকৃত বিষয়ে ওর আগ্রহ প্রচুর ওকেও নক করলাম। প্রায় আধাঘণ্টা ঘাটাঘাটির পর চমকপ্রদ তথ্য পেলাম।
ব্লাক ম্যাজিক এমনই এক নিষিদ্ধ চর্চা ওই কমিউনিটির লোকজন যতটুকু প্রকাশ করতে চায় ততটুকুই আমরা জানি। ওরা বস্তুত লুসিফার নামের শয়তানের পূজা করে এবং শয়তানের সাথে যোগাযোগের মিডিয়াম হিসেবে কিছু সাধারণ মানুষকে বেছে নেয়। এরা স্কপোলামিন, এসএসডি, গাজা বিভিন্ন ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্যের সাহায্যে মিডিয়ামের হ্যালোসিনেশন ঘটায়। আর তন্দ্রাচ্ছন্ন মিডিয়াম তখন পরাবাস্তব জগৎ চোখের সামনে দেখতে পায় এবং তাদের বিশ্বাসমতে সাক্ষাৎ শয়তান মিডিয়ামের দেহে এসে ভর করে। শিউরে উঠার তথ্য হল, এইসব মিডিয়াম কাজ করে অনেকটা দম দেওয়া পুতুলের মত। নিজের দেহকে ক্ষতবিক্ষত করা, সন্তানদের গলা টিপে ধরা এমনকি কাছের মানুষকে হত্যা করার মতও তথ্যও রয়েছে। এরা যতই নিকৃষ্ট কাছে ধাবিত হয় লাভ হয় ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ানদের। এমনও উদাহরণ আছে,একজন সুস্থ সবল কানাডিয়ান মা তার স্বামী-সন্তানদের নিয়ে সুখে জীবনযাপন করছে। হুট করে একদিন ছোট ছেলের শরীর সবজি কাটার ছুরি দিয়ে চার টুকরো করে ফেলে। পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়,সাইকিয়াট্রিস্ট এসে ঘোষণা দেয় ভদ্রমহিলা সাইকো। মাথায় সমস্যা আছে।ঘুণাক্ষরেও কেউ কল্পনা করতে পারে না তিনি হয়ত মনের অজান্তে ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ানের খপ্পরে পরে মিডিয়ামের কাজ করে যাচ্ছেন। বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়ে পত্রপত্রিকায় দু’চারদিন লেখালেখি হয়,তারপর নিশ্চুপ।উপরন্তু মহাপ্রভুকে সন্তুষ্টি করার উদ্দেশ্য প্রিয়বস্তুকে বলি দেবার চর্চা আদিমকাল থেকে হয়ে এসেছে। পশ্চিমা দেশে পোষ্য প্রাণীকে ভালোবাসা হয় সন্তানতুল্য। তাই পোষা কুকুর,বিড়ালকেও বলি হিসেবে ধরা হয়।
-আর আমাদের দেশে! আমি যদি আদিম ভারতীয় সভ্যতার বিষকন্যাদের এখনও লালন করা হয়। পত্রিকার পাতা খুললে দেখতে পান গৃহকর্মী দুই বছরের শিশুকে হত্যা করে আলমারি লুট করে টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়েছে। বিবেচনা করে দেখেছেন কি,
-বাবামা দুজনেই চাকুরীজীবী। দুধের শিশুকে আয়ার ভরসায় রেখে গেছে। দুই বছরের বাচ্চা সাক্ষী দিতে পারবে না। তবে স্বর্ণগহনা হাতিয়ে নেবার সময় বাচ্চাটাকে খুন করবার কি দরকার ছিল!
-উত্তর নেই।
আমরা কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাই না। এড়িয়ে যাই।
রাতে ঘুম হল না। সকালে চেম্বারের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েও ক্লিনিকে ঢোকা হল না। মাইকো ভাড়া করে জুলহাসকে নিয়ে চলে গেলাম সোজা নেত্রকোণা। কেন্দুয়া থানার সরিষাহাটি গ্রাম। নীরার দাদারবাড়ি খুঁজে পেতে দশ মিনিটও লাগল না। গ্রামের বাড়ি এই এক সুবিধা, সবাই সবাইকে চিনে। তারা মেয়ের শ্বশুরবাড়ির পক্ষ শুনে যথেষ্ট আদরযত্ন করল। চা-নাস্তা খাবার পর পদ্মর মায়ের খোঁজ করলাম।
জীর্ণ শাড়ি পরা বয়স্কা একজন বৃদ্ধা মহিলা লাঠি ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাজির হল। বয়স পঞ্চাশ হয়েছে কি হয় নাই রোগেশোকে ষাটোর্ধ্ব দেখায়।এসেই মরাকান্না জুড়ে দিল। নীরাকে তিনি নিজের সন্তানের মত ভালোবাসতেন। ফুলের মত মেয়েটার প্রাণ অকালে ঝরে গেল। কান্নার রেশ কিছুটা কমতে কথা বললাম,
-আপনের মেয়ে পদ্ম ওকেও তো খুঁজে পাওয়া যায় না।
-কে? ওই কালিবেটি আমার পদ্ম না।
-কি বলছেন?
-হ। পদ্মর পিঠে রাজহাঁসের ডিমের লাহান এত্তবড় জন্মদাগ আছিল।এই মাইয়ার কিছু নাই।
-একথা নীরা জানত?
-ওগো বাড়ির কেউই জানত না। আমিই নীরার চল্লিশার দিা কলপাড়ে ওরে উদাম গোসল করতে দেইখা প্রথম দেখলাম। চুলের মুঠি ধইরা টাইন্না কইছি ওই বেটি তুই কেডা?
কিছু কয় না। খালি কান্দে। হেইদিন রাইতেই দেখি মাগী উধাও। আর আহে নাই।
টলতে টলতে গাড়িতে উঠলাম। পদ্ম আসলে পদ্ম নয়। যেই মেয়েটা পদ্মর পরিচয়ে নীরার ফ্ল্যাটে এসে উঠেছিল সে তাহলে কে? কেনই বা গর্ভে বাচ্চা নষ্টের মত এতবড় ক্ষতি করে যাবে মাথায় ঢুকছিল না। গাড়িতে বসে রাজীব সাহেবের খাতার শেষ কয়েকটা পৃষ্ঠা পড়তে শুরু করলাম,
নীরা হসপিটাল ফিরে এল ট্রমাটাইজ হয়ে। যা মুখে দেয় তাই বমি করে ফেলে দেয়। হা করে নিশ্বাস নেয়। শোবার ঘর থেকে বের হলেই ওর প্রাণ হাঁসফাঁস করে। যখনি ওর কাছে যাই দেখি ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। দরজা -জানালা বন্ধ। ধুনুচির মত ছোট্ট মাটির হাড়িতে ধূপ জ্বলছে। আবদ্ধ ঘরে ধূপের গন্ধ আর ধোঁয়া মিলে অশরীরী অবয়ব তৈরি করে। আমার নিজেরই কেমন ভয় ভয় করত। নীরা নির্বাক। ওর ধূপের গন্ধ এক প্রকার নেশা হয়ে গেছে। শ্বাস টেনে ঘ্রাণ নেয়।
-স্বামী, স্বামী! কাছে আসো।
কাছে গেলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
-ভালোবাসো?
-খু্ব।
-আমিও তোমায় ভালোবাসি। আমার বাচ্চাটাকে ওকে আরো বেশি ভালোবাসি। ওতো বাঁচবে নাগো।
-ছি! নীরা। এসব কি বলছ?
-সত্যি বলছি।
-নীরা ঢুকরে কেঁদে উঠে।
-পেটের ভেতর কালসাপ বড় হচ্ছে। ও সুযোগ পেলেই আমার বাবুটাকে ছোবল মারবে।
-নীরা,এসব কে বলেছে তোমাকে?
-আমি স্বপ্নে দেখেছি,বিশ্বাস করো মিথ্যা স্বপ্ন নয়। হাত বাড়িয়ে বাবুটার আঙুল ছুঁয়ে দেখছিলাম।
বলতে বলতে নীরা কান্নায় ভেঙে পরে। দরজার পাশে পদ্ম এসে দাঁড়ায়। নীরা চুপ।দ্রুত আমার আলিঙ্গন মুক্ত হয়।
-তুমি যাও,এখন আমি ঘুমাব।পদ্ম আয়,আমার মাথা টিপে দে।
ওর মিসক্যারেজ হয় শুক্রবার। আমি সেদিন বাড়িতেই ছিলাম। নীরার অভ্যাস ছিল গোসল সেরে বাথরুমের ভেতর থেকেই চুল আঁচড়ে বাহিরে আসা। প্রেগন্যান্সির পর থেকে ভীষণ চুল উঠছে। । সারাবাড়ি ওর বড় বড় চুলে মাখামাখি হয়ে থাকত,ঝাড়ু দিতেও ঝামেলা হয়। বাথরুমে চুল আঁচড়ালে নাকি ঘর নোংরা কম হয়। তাই ওর যাবতীয় প্রসাধনীর সাথে নারিকেল তেলের বোতলও বাথরুমে থাকত। অসতর্কতা বশত সেদিন তেলযুক্ত পিচ্ছিল মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পরে। একটা আর্তনাদ বাথরুম থেকে ভেসে আসলে দৌঁড়ে যাই।।বাথরুমের দরজা খোলা।নীরার শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এত রক্ত আমি জীবনে কখনও দেখি নাই। ওকে হসপিটালে নিয়ে ছুটোছুটি করতে গিয়ে দেখি আমার কোমরের নীচ থেকে পা অবধি অবশ হয়ে যাচ্ছে। শক্তি পাচ্ছি না। একবারও মাথায় আসে নাই নীরাকে মাথায় তেল দিয়ে দিত পদ্ম, ওই জাহান্নামি মেয়েটাকে কি তেল ছিটিয়ে রেখেছে! নীরা আত্মহত্যা করে তার এক সপ্তাহের মাথায়। গাইনোকোলজিস্টের কাছ থেকে রির্পোট নিয়ে ড্রয়ারে লুকিয়ে রেখেছিলাম। নীরাকে দেখাই নি ওর গর্ভে টুইন বেবি বড় হচ্ছিল, যার একটার অবশিষ্টাংশ এখনও রয়ে গেছে। আবার ডিএনসি করাতে হবে।
নীরার শরীরে তখন প্রবল জ্বর। ব্লিডিং চলছে। শূন্য দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। খেতে দিলে খায়,ঘুমাতে বললে ঘুমায়।চোখ দিয়ে পানি জমে না, এক প্রকার পাথর হয়ে গেছে। ওর মাথায় হাত রেখে ধীরে ধীরে বললাম,
-নীরা,আমাদের আরেবার হসপিটালে যেতে হবে।
নীরা হাসছে। ওর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে।তবু ঠোঁটে হাসি।
-কেমন মা আমি সন্তানকে রক্ষা করতে পারলাম না।
-আমাদের আবার সন্তান হবে নীরা। তুমি মা হবে।
–
-মা হব! প্রথম বেবি তুমি নষ্ট করেছ আমি রক্ষা করতে পারি নাই। এরপরের একজন পেটের ভেতর মরেই গেল অন্যজন তো বেঁচে আছে। তুমি বলো?
-তুমি রির্পোট দেখেছ?
-হু।
-নীরা। সামান্য একটু মাংসপিণ্ড রয়ে গেছে। যা তোমার জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর। ডাক্তার আজকে গেলে সিদ্ধান্ত নিবেন ঔষুধের মাধ্যমেই ক্লিয়ার হবে নাকি ডিএনসি…
নীরা আমার কথা শেষ করতে দেয় না।
-তুই একটা অমানুষ। মাংসপিণ্ড বলার তুই কে রে? এটাই আমার সন্তান।
ওর চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে ওর মা আমার মা ছুটে আসে। ও তখন মৃগী রুগীর মত হাতপা ছুঁড়ছে। পরদিন রাতেও নীরাকে বোঝাই। ও অবুঝ শিশুর মত পাগলামি শুরু করে কিছুতেই আর হসপিটালে যাবে না। তারপরের রাতেই দূর্ঘটনা। হাসতে হাসতে শরীরে কেরোসিন ঢেলে দেয়।কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার তিন বছরের সাজানো সংসার ছিন্নভিন্ন। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই নীরার চুল পুঁড়ছে,শরীর পুঁড়ছে আমি জাপ্টে ধরে আছি।নীরা হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে,
-স্বামী,মাফ করে দাও। আমার বাচ্চাগুলো আর মা ছাড়া থাকতে চাইছে না…
#পরিশিষ্ট
রাজীব সাহেবের সাথে আর কোনোদিন আমার দেখা হয় নি। তাকে সাতদিন পর চেম্বারে দেখা করতে বলেছিলাম।তার বদলে চিরকুট আসে,
-স্যার,ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়ে চলে যাচ্ছি। নীরাকে ছেড়ে পৃথিবীর কোনো কোণায় আমি শান্তি পাব না তবু যেতে হবে। কোকেইন খেয়ে নেশা করবার মত মেয়ে আমার স্ত্রী ছিল না।ধূপের ধোঁয়া বলে পদ্ম নামের ডাইনীটা ওকে নেশা করতে বাধ্য করেছে। জানি না, কোন অপরাধে একটা ছোট মেয়ে আমাদের সংসার ধ্বংস করে দিল। প্রতিজ্ঞা করেছি, ওকে কোনোদিন চোখের সামনে পেলে খুন করব আমি। ও মানুষ নয় পিশাচ।আপনি ভালো থাকবেন
-রাজীব রহমান।
–
পদ্ম মানুষ নাকি পিশাচ সেই ভাবনা বহুরাত আমাকে ঘুমাতে দেয় নাই। রাজীব রহমান উনার স্ত্রী নীরা সবাইকে আমি ভুলে গেছি কিন্তু পদ্মকে নয়। ওর ছবি এখনও আমার ডায়েরি পাতায় ট্যাপ দিয়ে আটকানো। কালোমতন অল্পবয়স্ক মেয়ে হলেই চেয়ে দেখি পদ্ম নয়ত!পাঁচ বছর পর কল্যাণপুর বাস কাউন্টারে বসে আছি। উদ্দেশ্য সিলেটগামী গ্রীন লাইন পরিবহনের টিকেট কেনা।একজন সুন্দরী মহিলা পাশে এসে বসল।ভদ্রমহিলার সাথে স্কার্ট পরা আরেকজন কিশোরী।হাতে পানির বোতল। ভদ্রমহিলা বলছে,
-রিয়া,পানি বসে খেতে হয়। গলায় পানি আটকাবে। বসে খাও।
আমার স্মৃতিশক্তি কখনই বিশ্বাসঘাতকতা করে না। একেবারে চোখের দেখাই বলছে রিয়া নামের মেয়েটিই আমার ছবিতে দেখা পদ্ম। কুচকুচে কালো রঙ, কোঁকড়ানো চুল। চোখের নীচে তিলটা পর্যন্ত ঠিক আছে। পাঁচ বছরে মেয়েটা লম্বায় অনেকখানি বেড়ে উঠেছে।পদ্ম মানে রিয়া আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। মেরুদণ্ড বেয়ে ঠাণ্ডা কিছুর স্রোত অনুভব করলাম।কথা বলতে গিয়ে গলায় আটকে গেছে, আমতা আমতা করে ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-এ আপনার মেয়ে?
– হ্যা। আমি চুমকি আমার মেয়ে রিয়া।
আরেকবার ঢোক গিললাম,
-আপনি চুমকি! কিছু মনে করবেন না আপনার চেহারার সাথে মেয়ের চেহারার একটুও মিল নাই।
চুমকি হি হি করে হেসে উঠল,
-সবাই একই প্রশ্ন করে। শুনতে শুনতে কান পচে গেল। ও দেখতে ওর বাবার মত হয়েছে।
-ওর বাবার নাম..
-রাজীব রহমান।
দুই সেকেন্ড দাঁড়াই নাই। সেদিন আর সিলেট যাওয়া হল না। বাড়ি ফিরলাম।লতা বলল,
-এমন ঘামছ কেন? কি হয়েছে?
-মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল,পদ্ম…পদ্ম রাজীবকে ডাকত আব্বা বলে আর নীরাকে আম্মা।
-পদ্মটা আবার কে?
-কেউ না। পাপ বাপকেও ছাড়ে না।
দ্বন্দ্বঃশেষপর্ব
হাবিবা সরকার হিলা