#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_১৫(মায়াবতী, আমার তিক্ত বুকের প্রশান্তি)
দার্জিলিং পৌঁছানোর পরই পাহাড়ের যে রূপ তাদের চোখের সামনে ধরা দিলো তা এককথায় অভূতপূর্ব। দার্জিলিং-এর বিখ্যাত ম্যালে পৌঁছানোর পর চোখের সামনে রয়েছে অনবদ্য এক সৌন্দর্য্য। যা বর্ননায় প্রকাশ অসম্ভব। নিচে পাহাড়ের গা ঘেঁষে চলছে অপরূপ মেঘেদের খেলা। ম্যাল থেকে বেশ কিছু রাস্তা এঁকেবেঁকে নিচের দিকে নেমে গিয়েছে।
হোটেলে পৌঁছে দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে যে যার রুমে চলে যায়। পাশাপাশি দুটো রুম। একটাতে রাফিদ, নম্রমিতা আর অন্যটাতে তোহা। এতক্ষন টানা জার্নি করার অভ্যাস তোহার নেই। ফলস্বরূপ রুমে ঢুকেই ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতেই ঘুমে বুঁদ। নম্রমিতাও বেশ ক্লান্ত। কোনরকম রুমে ঢুকে ধুম করে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে বেডে। এভাবে অলস ভঙ্গিতে নম্রমিতাকে শুয়ে পড়তে দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকায় রাফিদ। অতঃপর টান দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয় নম্রমিতাকে। বিরক্ত হয় নম্রমিতা।
“আগে ফ্রেশ হও। এসব বিষয়ে নো আর্গুমেন্ট। জলদি যাও।”
রাফিদের কড়া শাসন সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করে আবারো শুয়ে পড়ে নম্রমিতা। সাথে ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলে ওঠে,
“একদম বিরক্ত করবে না আমাকে। রাতেও ঘুমাতে দাওনা ঠিকমতো, এখনও জ্বালাচ্ছ। ঘুমাবো আমি, ডিস্টার্ব করবে না একদম।”
নম্রমিতার বেখেয়ালি কথা শুনে ঠোঁট কামড়ে হাসে রাফিদ। হালকা ঝুঁকে পাঁজাকোলে তুলে নেয় নম্রমিতাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে যায় নম্রমিতা। পরিস্থিতি বোধগম্য হতেই একহাতে খামচে ধরে রাফিদের শার্ট। অতঃপর বিরক্তভরা কণ্ঠে বলে ওঠে,
“কেনো এমন করছো? ঘুমাবো তো একটু। নামাও প্লিজ।”
নম্রমিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই ঠান্ডা ঠান্ডা পানি আছড়ে পরে তার চোখে মুখে। হতবাক দৃষ্টিতে চোখ মেলে তাকায় নম্র। বাথরুমের শাওয়ারের নিচে দাড়িয়ে আছে তারা। নম্র চোখ পাকিয়ে তাকায় রাফিদের দিকে। তার এহেন কাজ যে একদমই পছন্দ করেছেনা নম্র, তা চোখেমুখে স্পষ্ট। শব্দ করে হেসে ওঠে রাফিদ। রাগে মুখ ফুলিয়ে রেখেছে নম্রমিতা। ব্যাপারটা বেশ এনজয় করছে রাফিদ। খানিকটা কাছে গিয়ে নাকের সাথে নক ঘষে ঠোঁট ছোঁয়ায় অধরে। উপর থেকে অবিরাম ধারায় আছড়ে পড়া পানির ঝর্ণার মাঝে অধরে অধর স্পর্শে মেতে ওঠে দুজনে। ভিজে চুপচুপে দুজনেই। রাফিদ একে একে আদুরে স্পর্শ এঁকে দেয় নম্রমিতার সারা মুখ হতে গলায়, ঘাড়ে। অনুভূতির তাড়নায় বন্ধ চোখে ঠকঠক করে কাঁপছে নম্রমিতা। একসময় জোরে জোরে নিঃশ্বাস টেনে জড়িয়ে ধরে তার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটাকে।
১৮.
দার্জিলিং ভ্রমণপিপাসু বাঙালির কাছে সবচেয়ে প্রিয় এক দর্শনীয় স্থান। এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিসগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো চা বাগানগুলো। দ্বিতীয় দিনে তেমনই একটা ব্রিটিশ আমলের চা বাগান দেখতে গেলো নম্রমিতারা। কাল জার্নির ফলে সকলেই বেশ ক্লান্ত ছিলো। তাই আর কোথাও বের হওয়া হয়নি। পুরোটা দিন হোটেলের আশেপাশে ঘুরেই কাটিয়েছে তারা। পুরনো আমলের সেই চা বাগানে পৌছে তারা জানতে পারলো অ্যাডাম নামে এক ব্রিটিশ সাহেব উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এই চা বাগানটি তৈরি করেন। সেই থেকেই এর নাম হয়েছে অ্যাডাম সাহেবের চা বাগান। কী সুনিপুণ দক্ষতার সঙ্গে পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে এখানকার অধিবাসীরা চা চাষ করেন। কারো দৃষ্টিতে অবাকত্বের রেশ ফেলে দেওয়ার জন্য যা যথেষ্ট। রীতিমত অবাক চাহনীতে তাকিয়ে আছে সকলে। হঠাৎ নম্রমিতার চোখে পড়ল চা বাগানের মাঝে মাঝে ছোট ছোট চা গাছগুলিকে ছায়াদানের উদ্দেশ্যে লাগানো কিছু কিছু বড় পাতাযুক্ত ঝাঁকড়া লম্বা গাছ। কি যে নান্দনিক সৌন্দর্য্য নিহীত রয়েছে সেখানে, যা বর্ণনার ভাষা মেলা দায়।
দার্জিলিংয়ের এই চা তার অতুলনীয় স্বাদ ও গন্ধের কারণে ভারতবর্ষে তো বটেই ভারতের বাইরেও বিশেষ আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে। সেই চা বাগানের গুদাম থেকে খুব কিছু চা কিনে নেয় তারাও। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় এখানের অধিবাসীদের জীবনযাত্রা। চা গাছ থেকে পাতা সংগ্রহের জন্য মূলত মেয়েদের প্রয়োজন হয়। সরু সরু আঙ্গুলের মাঝে কচি পাতা ছাঁটাই করা সহজ হওয়ায় দলবদ্ধভাবে কাজ করছে মেয়েরা। এদের জীবিকা নির্বাহনের একমাত্র পদ্ধতি এই চা বাগান। অথচ দেশ বিদেশে খ্যাত এই চা বাগানের শ্রমিকদের জীবন অতীব দুর্বিষহ। কাজের ফাঁকে তারা এক বিশেষ ধরনের খাবার খেয়ে থাকেন। কচি চা পাতার সাথে বিভিন্ন ধরনের মশলা, আলু, চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে খেয়ে পার করেন দিনের বেশিরভাগ সময়টা। মেয়েরা প্রত্যেকে নিজেদের বাড়ি থেকে কিছু কিছু জিনিস এনে বানায় এই খাবার। কেউ দুটো আলু তো কেউ মুড়ি, আবার কেউ নিয়ে আসে অল্প কিছু চানাচুর। এভাবেই সমবেতভাবে তারা এই খাদ্য বানিয়ে তা খেয়ে দিন পার করে।
সারাদিন ঘোরাঘুরি করে বিকালের দিকে রুমে ফেরে রাফিদ, নম্রমিতা আর তোহা। দুপুরের খাবারটা বাইরেই সেরে নিয়েছে। ঘোরাঘুরি শেষে ফুরফুরে মেজাজে রুমে ঢোকা নম্রমিতা। দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই রীতিমত হা হয়ে যায়। রুমের মাঝে লাল আর সাদা গোলাপের পাপড়ি বেছানো। দরজা হতে বেড পর্যন্ত সরু রাস্তা করে এই পাপড়িগুলো সাজানো। পুরো রুম জুড়ে দারুন এক সাজসজ্জা। ছোটো ছোটো হ্যারিকেন আকৃতির লাইট। হলদে আলোয় আলোকিত রুমের চারিপাশ। বেডের মাঝে সুন্দর করে লেখা,
” তিক্ত বুকের প্রশান্তি, আমার মায়াবতীকে স্বাগতম এ হৃদপিঞ্জরে।”
সিলিং হতে ঝোলানো রঙিন বেলুন। বেলুনের শেষপ্রান্তে রংবেরংয়ের ফিতের বাহার। প্রতিটা ফিতের মাঝে আঁটকানো একটা করে চিরকুট। আবেগে আপ্লুত হয়ে পিছন ফিরে তাকায় নম্রমিতা। নাহ, কোথাও রাফিদ নেই। কৌতূহলবশত সে এগিয়ে যায় গোলাপের পাপড়ি বেছানো সে রাস্তা দিয়ে। রাস্তার শেষ একেবারে বেডের কাছে। সাদা বেডশিটের উপর গোলাপের লাল পাপড়ি দিয়ে লেখা কথাটা বার কয়েক মনে মনে আওড়ায় নম্রমিতা। পাশে রাখা কালো রঙের একটা শাড়ি। সাথে একটা চিরকুট। প্রফুল্লচিত্তে চিরকুটটা হাতে উঠিয়ে নেয় নম্রমিতা।
“শুভ্র পছন্দ করা মেয়েটাকে কালোতে এতো বেশি কেনো মানায় বলতে পারো! সবাই তো লাল গোলাপ হয়, তুমি নাহয় আমার কালো গোলাপ হলে! যা রীতিমত দুর্লভ।”
অদ্ভুত এক প্রশান্তি ছেয়ে যায় নম্রমিতার হৃদয়ে। কাল কি হবে সে জানেনা। আদৌ কি সারাজীবন পাশে পাবে রাফিদকে! নাকি অচিরেই ঝরে পড়বে তাদের প্রেমের গাথা! এসবের কোনো উত্তর জানা নেই। শুধু এটুকু জানে, কাল কি হবে তা ভেবে আজকের সময়টা নষ্ট করতে নেই। যদি এই অনুভূতিগুলো মিথ্যেও হয়, তবুও সে এই মিথ্যেই চায়। থাক না কিছু সময় নীরবে মিথ্যে সয়ে নেওয়ার মতো। এতে ক্ষতি তো কিছু নেই। বরং স্মৃতির পাতায় জমা হবে আরো কিছু ঘটনা। সাক্ষী রবে আরো কিছু ভালোবাসাময় মুহূর্তের।
তোহার রুম থেকে শাওয়ার নিয়ে কালো একটা পাঞ্জাবী পরে বের হয় রাফিদ। বেডের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে ফোন দেখছিলো তোহা। ওয়াশরুমের দরজার আওয়াজ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় সে। অতঃপর ঝট করে উঠে বসে চোখ বড়ো করে তাকায় সে।
“কি রে পেত্নী, এভাবে তাকাচ্ছিস কেনো? আমার মতো সুইট, হ্যান্ডসাম ছেলের দিকে একদম নজর দিবি না। তাহলে দেখা যাবে তোর মতো শেওড়া গাছের ভূত হয়ে যাবো কোনদিন।”
মেজাজ তিরিক্ষে রেখে আঙ্গুল উঁচিয়ে তেড়ে আসে তোহা। এরপর কোমরে দুই হাত গুঁজে বলে ওঠে,
“তুই আমাকে শেওড়া গাছের পেত্নী বললি তাইনা? দাড়া তোর ভাবীকে ইমপ্রেস করা ঘোচাচ্ছি আমি। ওই ওই ওইযে ওই মেয়েটার কথা মনে আছে?”
“কোন মেয়ে আবার। দেখ, এসব নিয়ে জিন্দেগীতে ব্ল্যাকমেইল করতে পারবি না আমাকে। কারন নম্র ছাড়া কারোর দিকে চোখ তুলেও তাকাইনি আমি, ওকে!”
পাঞ্জাবীর কলার ঠিক করতে করতে একটু ভাব নিয়ে বলা রাফিদের কথায় হা হা করে হেঁসে ওঠে তোহা। এরপর নিজেও একটু ভাব নিয়ে আয়েশ করে বসে বেডে।
“তারিন বলে মেয়েটার কথা ভুলে গেলি ভাইয়া! আহা কি প্রেম দুজনের!”
“তোহা, এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে। তারিন আমার কিচ্ছু লাগেনা। ওটা শুধুমাত্র একটা নাটক ছিলো। নম্রকে জেলাসি ফিল করানোর জন্য।”
“সেটা তো তুই জানিস, আমি জানি। কিন্তু ভাবি!”
“নম্র সম্ভবত এসবের কিছু জানেনা। নাহলে এতদিনে নিশ্চয়ই এই নিয়ে কিছু বলতো বা জিজ্ঞাসা করতো।”
“দুই হাজার টাকা দে।”
তোহার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকায় রাফিদ। হুট করে কি হলো কিছুই বুঝতে পারছে না সে।
“কি হলো দে জলদি।”
“কিসের জন্য?”
“তোর সিক্রেট লকারে রাখার জন্য। এখন যদি আমি ভাবিকে তারিনের কথা বলি, কি হবে বুঝতে পারছিস তো!”
তোহার হাই তুলতে তুলতে ঢং করে বলা কথা শুনে অসহায় চোখে তাকায় রাফিদ। যার অর্থ ঝোপ বুঝে ঠিক কোপ মারলি তাইতো! সময় আমারও আসবে। অতঃপর দাঁত কটমট করে গুনে গুনে দুই হাজার টাকা তোহার হাতে দিয়ে বিদায় নেয় রুম থেকে। গন্তব্য তার প্রতীক্ষায় রয়েছেন যিনি, প্রিয়সীনি।
#চলবে!
গল্পের রিচ কমে যাচ্ছে কেনো দিন দিন! ভালো লাগছেনা আর বুঝি!