#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_১৯(কে সে!)
“তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নারীর দিকে চোখ তুলে তাকালে আমার এ চোখ ধ্বংস হোক।”
ছলছল দৃষ্টিতে তাকালো নম্রমিতা। তারও খুব করে ইচ্ছে করে বিশ্বাস করতে রফিদকে। কিন্তু পরক্ষনেই গুলিয়ে যায় সবকিছু। সাক্ষ্য প্রমাণ সবই তার বিপরীতে ইঙ্গিত দিচ্ছে! সেও তো মানুষ, আর কতো আঘাত সহ্য করবে! আজকাল যেনো নিজে থেকে ভাবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। কেমন একটা ছন্নছাড়া ভাব। তপ্ত শ্বাস ফেলে রাফিদ মুখোমুখি হয় নম্রমিতার। দুইহাতের আজলায় ভরে নেয় নম্রমিতার কোমল মায়াবী মুখখানি। অতঃপর চোখে চোখে রেখে বলতে শুরু করে।
“আজ প্রতিটা কথা হবে আঁখিতে আঁখি মিলিয়ে। মুখের ভাষা পিচ্ছিল। হাজারো মিথ্যে বলতে তার বুক কাঁপেনা। কিন্তু চোখ! সে বলেনা একচুল পরিমাণ মিথ্যে। তাই আজ চোখে চোখে রেখে প্রতিটা সত্যি প্রথম থেকে উপস্থাপন করবো তোমার সামনে। অনেকতো হলো লুকোচুরি, আজ নাহয় খোলাসা হয়ে যাক সব। হয় মিটে যাক দূরত্ব নয়তো…”
গলা কাঁপছে রাফিদের। নয়তোর পরের শব্দ আর উচ্চারিত হচ্ছেনা কণ্ঠে থেকে।
“তারিন আমার ব্যাচমেট ছিলো। কলেজের বেশ খানিকটা কাছের ফ্রেন্ড যাকে বলে। ফ্রেন্ড সার্কেলের খুব অল্প মানুষ জানতো তোমার আমার কথা। তার মধ্যে তারিন একজন। হয়তো একটু বেশিই জানতো। মেয়ে হওয়াতে তাকে ভরসা করতে খুব একটা সমস্যা হতোনা। একারণেই মেয়েলি জিনিসে খানিকটা মতামতও নিতাম ওর থেকে। যেদিন তোমার বিয়ের খবর পেলাম, বিশ্বাস করো নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো এই দুনিয়ায় অক্সিজেনের অভাবে মারা যাবো আমি। এই বুঝি আমার প্রাণটা ছটফট করতে করতে দেহত্যাগ করলো। সেদিন আস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তারিন। বন্ধুর মতো সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখতো। বিধায় উল্টোপাল্টা কিছু না করে বসি।”
“বাড়িতে তোড়জোড় করে চলতে থাকা বধূবরণের অনুষ্ঠানের মাঝে খালি হাতে বিধ্বস্ত দশায় ফিরেছিলাম। তখনও মন বলছিলো, তুমি ফিরবে। তুমি আসবে আমার ঘরে বউ সেজে। কিন্তু সমস্ত জল্পনা কল্পনা মিথ্যে করে দিয়ে তুমি বেঈমানের মতো বসলে বিয়ের পিড়িতে। পিছু ফিরে একবারও দেখলেনা, তুমিহীনা এই দুনিয়ায় এক পাগল মারা যাবে। তোমার প্রেমে উন্মাদ সেই পাগল ছেলেটা যে নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যাবে! ভাবলে না একবারও। আত্মীয়স্বজনদের কাছেও বেশ অপমানিত হয়েছিল পুরো পরিবার। কতোগুলো দিন যে পাগলের হালে কাটিয়েছি, তার একমাত্র সাক্ষী আমার পরিবার। নির্ঘুম কেটেছে অজস্র রাত। আম্মা কাঁদতো প্রতিদিন লুকিয়ে। হয়তো ক্ষুব্ধও হয়েছিলো অনেকটা তোমার প্রতি। ঠিক সেই সময় পাশে দাঁড়ায় তারিন। মানসিক ভরসার জায়গা হয়। আমিও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করি। একদিন কলেজের ক্যান্টিনে আড্ডার মাঝে হুট করে সজীবের থেকে জানতে পারি, তুমি নাকি আমার খোঁজ করেছো! প্রতিশোধপরায়ণ মন খুব করে জ্বলে উঠেছিলো সেইদিন। তোমাকেও আমার মতো প্রতি মূহুর্তে কষ্টের অনলে পোড়াতে চেয়েছিলাম।”
থামে রাফিদ। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নম্রমিতা। কেমন মায়া মায়া চোখ। গভীর চুমু আঁকে রাফিদ নম্রমিতার ললাটে। অতঃপর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে আবারো বলে ওঠে,
“তারিনের সাথে কিছু পিক তুলি। অনেকটা কাছাকাছি আর এমন অ্যাঙ্গেল থেকে যেনো তুমি জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাও। এক একটা দিন, এক একটা মুহূর্ত ছবিগুলো দেখে আফসোস করো। একটুও সুখে না থাকতে পারো, সেই ব্যবস্থা করতেই মিথ্যে অভিনয় করে কিছু ছবি তুলি। প্রতিটা পিক সজীব নিজেই তুলে দিয়েছিলো। এরপর সেগুলো পাঠানো হয় তোমাকে। সেইসাথে সজীব আমার আর তারিনের মিথ্যে সম্পর্কের কথাও জানায় তোমাকে। কিন্ত বিশ্বাস করো নম্র সেসব মিথ্যে ছিলো। তাকাও আমার চোখের দিকে। এই চোখে কী তোমার জন্য ভালোবাসাবিহীন কিছু খুঁজে পাও? আমি ভীষণ ক্লান্ত। ক্লান্ত নিজেকে প্রমাণ করতে করতে। এটুকু বিশ্বাসের যোগ্য কী আমি নই?”
“আমি তোমাকে আগেও বিশ্বাস করতাম। আজও বিশ্বাস করি। কিন্তু কিছু ঘটনা আর জীবনের দেওয়া একের পর এক ধাক্কায় সব গুলিয়ে ফেলছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, তুমি বোধহয় শুধুমাত্র প্রতিশোধের নেশায় আমাকে বিয়ে করেছ। কিন্তু সজীব ভাইয়া তো আমাকে কোনো ছবি দেয়নি সেদিন। শুধুমাত্র তোমার নতুন সম্পর্কের কথা জানিয়েছিল।”
“তবে তুমি তারিনের কথা কিভাবে জানলে? তারিন কি তোমাকেও কিছু বলেছে?”
রাফিদকে ছেড়ে উঠে দাড়ায় নম্রমিতা। এদিক ওদিক হাতড়ে হাতে নেয় ফোনটা। সেদিনের আসা সেই নম্বর আর পিকগুলো দেখায় রাফিদকে। বিস্ময়ে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে রাফিদ একবার ফোনের দিকে তো নম্রমিতার দিকে তাকায়। ঘটনা খানিকটা আঁচ সে আগেই করেছিলো। এসবের পিছনে তবে তারিন নেই। অন্য কেউ একজন সৃষ্টি করেছে তুমুল ঝামেলা তাদের তিনজনের মাঝে। ফাটল ধরাতে চেয়েছে প্রতিটা সম্পর্কের। কিন্তু কে সে!
২১.
রুমের মধ্যে অস্থিরতায় পায়চারি করছে তোহা। ঠিক অস্থিরতা নাকি রাগ বোঝা দায়। অচেনা এক নম্বর থেকে ফোন আসছে বারবার। কণ্ঠস্বরও অপরিচিত। ফোন দিচ্ছে অথচ কোনো কথা বলছেনা। অযথা বিরক্ত করা একদমই পছন্দ নয় তোহার। আবার কীসব লাগামহীন কথাবার্তা তার! রাগে গিজগিজ করতে করতে ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বেডে শুয়ে পড়ে সে। মাথা পর্যন্ত কম্বল টেনে বন্ধ করে চোখের পাতা। তৎক্ষণাৎ দরজায় ঠক ঠক শব্দ। এবার রাগটা সপ্তম আকাশে উঠে যায়। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে দরজা খুলে সামনের মানুষটাকে দেখে চেতে উঠলো আরো খানিকটা। মুখের উপর দরজা লাগানোর আগেই জোরপূর্বক রুমে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দেয় সে। আহাম্মক বনে যায় তোহা। রনককে এই মুহূর্তে একদমই সহ্য হচ্ছে না তার।
“দরজা লাগালেন কেনো?”
“তুমি নিজেই তো দরজা দিয়ে দিতে চাইছিলে, আমি তো শুধু হেল্প করলাম।”
“আমি আপনাকে বাইরে রেখে দরজা দিতে চাইছিলাম।”
“ইশ! টুনটুনি পাখিটা রেগে আছে অনেক।”
আঙ্গুল উঁচিয়ে রনকের বুকে তাক করে দূরে ঠেলে তোহা। অতঃপর কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আপনি এখানে কী করছেন? আমার রুমে আপনার কাজ কী? আপনার ভীষণ কাছের মানুষ আছে না! একদম বের হন রুম থেকে। সেখানেই যান।”
“চুমু খেতে এসেছি। দেবে?”
“ছিঃ! অসভ্য পুরুষ।”
“অসভ্য যখন বলেই ফেলেছ, একটু অসভ্যতামি করাটা দোষের হবেনা তবে!”
কথা শেষ করে একটু একটু করে এগিয়ে আসে রনক তোহার কাছে। তোহা সরে যেতে গেলে রনক একহাতে আঁকড়ে ধরে কোমর। অতঃপর ঠোট গোল গোল করে ফু দিতে থাকে তোহার সারা মুখে। আচানক আক্রমনে ভিমরী খায় তোহা। শত চেষ্টা করেও স্পষ্টভাবে চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। তা দেখে শব্দ করে হেসে ওঠে রনক।
“স্যার!”
“হুস, কে স্যার! টিচার প্রফেশন আমি সেদিনই ছেড়ে দিয়েছি, যেদিন বুঝলাম টিচার হয়ে একজন স্টুডেন্টকে ভালোবেসেছি। এই বিষয়টা ঠিক যতটা সহজ ততটাই কঠিন। কোনোদিন তাকে পাবো কিনা জানতাম না। তবে এই প্রফেশনে থাকলে তাকে পাওয়ার সম্ভবনা জিরো। তাইতো তাকে ভালোবেসে, শুধু তাকেই ভালোবেসে আমি বদলি নেওয়ার নামে প্রফেশন ছেড়েছিলাম।”
“তো সেই ভালোবাসার মানুষটাকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন না স্যাএএএর!”
তোহার টেনে টেনে স্যার বলা দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় রনক। ফিচেল কণ্ঠে বলে ওঠে,
“শুধু পরিচয় কেনো আমার ভালোবাসার চিহ্নও দেখাবো তোমাকে।”
গলার ঠিক বামপাশে থাকা ছোট্টো কালো কুচকুচে তিলে হাত বুলাতে বুলাতে নেশাময় কণ্ঠে বলে রনক। কণ্ঠ খানিকটা কাঁপলোও বোধহয়! প্রথমবারের মতো কোনো পুরুষালি ছোঁয়ায় শিউরে ওঠে তোহা। দ্রুত হলো নিঃশ্বাস। খানিকটা ডানদিকে হেলেও গেলো বোধহয় ঘাড়। অস্ফুটস্বরে কিছু বলার আগেই রনকের দাঁত পিষ্ট করলো তোহার নরম ফর্সা ত্বক। শেষে গাঢ় এক চুম্বনে আবদ্ধ করে সেই ছোট্ট তিলটাকে।
তোহা চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে রনকের দিকে। রনক মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছে তোহার দিকে। মুখে তার দুষ্টু হাসি। আয়নার সামনে দাড়িয়ে তোহা বারবার ডলে যাচ্ছে কামড়ের জায়গাটা। কেমন যেনো লাল হয়ে আছে। বারবার ঘষার ফলে আরো লালা হয়ে যাচ্ছে জায়গাটা। জ্বলছেও বেশ। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে তোহা।
“এই মেয়ে বুদ্ধি কি সব বেচে খেয়ে ফেলেছ নাকি! কাটা জায়গা এভাবে কেউ ঘষাঘষি করে? ইশ কেমন লাল হয়ে গেছে দেখো!”
“একদম ফালতু কেয়ার দেখাতে আসবেন না। নিজে ব্যাথা দিয়ে আবার নিজেই আসছে দরদ দেখাতে।”
“তো অন্য কেউ আসবে নাকি!”
মুখ বাঁকায় তোহা।
“শোনো মেয়ে, ব্যাথা যেমন আমি দেবো আবার সেই ব্যাথায় আদরও আমিই করবো। হুটহাট মাঝরাতে কাঁদাবো যেমন আমি, একটুকরো সুখের ভুবন তোমার কদমে লুটিয়েও দেবো আমি। যদি বলো শুধু ভালোবাসা চাও, তবে এসোনা এ বুকে। নীলচে ব্যথার ভালোবাসা সইতে জানলে ঝাঁপিয়ে পোড়ো, দুই বাহুতে আগলে নেবো।”
#চলবে!