ট্রেনের কেবিনে ঢুকে আমার মনটা ভাল হয়ে গেল। কেবিনটা আশ্চর্য রকম ঝকঝক তকতকে। আমি ধরেই নিয়েছিলাম কেবিন থাকবে চরম অপরিষ্কার, মেঝে বাদামের খোসা দিয়ে ভর্তি, এখানে ওখানে পানির খালি বোতল পড়ে থাকতে দেখব আর যদি কপাল খারাপ হয় তাহলে দেখব কেউ একজন আমার সীটে চা ফেলে ভিজিয়ে রেখেছে। আমি ব্যাগে করে একটা এক্সট্রা চাদর নিয়েই এসেছি। স্লীপিং সীটে বিছিয়ে শুয়ে পড়ব ভেবে। এখন মনে হচ্ছে সেটা না আনলেও চলত। কোন ময়লা দূরে থাক কোথাও বাদামের একটা খোসা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কেউ এইমাত্র পরিষ্কার করে রেখে গেছে সব। চমৎকার ব্যাপার, বাংলাদেশ রেলের দেখা যাচ্ছে অনেক উন্নতি হয়েছে।
কেবিনে চার স্লীপিং সিটের দুইটা এখনো খালি। আমার মাথার উপর বার্থের যাত্রী এখনও আসেন নি। পাশের সিটে একজনকে দেখা যাচ্ছে। আমি সময় নিয়ে তার দিকে তাকালাম। কেবিনের যাত্রীদের চেহারা একটু ডিটেইলস দেখে রাখা ভালো, সারারাতের সঙ্গী, কার মনে কি আছে বলা মুস্কিল। চোর বাটপারে দেশ ভর্তি, হয়ত ভোরে উঠে দেখা গেল একজন অন্যদের মালপত্র নিয়ে কেটে পড়েছে। আমার অন্যপাশের সীটের লোকটা মধ্যবয়স্ক। বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশের আশেপাশে। মাথায় ছোট ছোট কাঁচাপাকা চুল। সাধারণ শার্ট প্যান্ট পরা। মজার ব্যাপার হচ্ছে লোকটাও এতক্ষণ আমার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে ছিল। মনে হচ্ছে সেও মাপছে আমাকে। আমি উপরের বার্থের দিকে তাকাতে সে বলল,
আর কেউ আসবে না, আজ আমরা দুইজনই যাত্রী।
আমি ঘড়ি দেখলাম, ট্রেন ছাড়তে এখনো মিনিট পনের বাকি। কাজেই আর কেউ আসবে না সেটা বলা হাস্যকর। কিন্তু লোকটাকে কিছু না বলে আমি চাদর বিছিয়ে আমার সীটে শুয়ে পড়লাম। শুধু শুধু কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। যাত্রা পথে এইরকম কথা বলে গল্প জুড়ে দেয়া লোকের অভাব নেই। এখন কিছু বললেই গল্প শুরু হবে। কিন্তু লোকটা ছাড়ল না। সে আবার বলল,
ভাইজান আজ কয় তারিখ?
নিঃসন্দেহে ফালতু প্রশ্ন। আজ কত তারিখ সেটা সব যাত্রীরই জানা। পকেটে সবার ট্রেনের টিকিট। তবু আমি ভদ্রতা করে বললাম, ‘আঠারোই মার্চ।’ বলেই চট করে ঘুরে গেলাম। লোকটার আর কোন প্রশ্নের জবাব দেয়ার ইচ্ছা নেই। এখনই সে গল্প শুরু করবে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আমার আজ রাতের জন্য অন্য প্ল্যান। আমি ব্যাগ থেকে হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের ‘ফিনিশড’ বইটা বের করে সেটাতে অনেকক্ষণের জন্য ডুবে গেলাম।
আলান কোয়ার্টারমেইনকে জুলু রাজা আটকে ফেলেছে, মেরে ফেলবে না বাঁচিয়ে রাখবে বোঝা যাচ্ছে না এমন টানটান উত্তেজনার মধ্যে আছি এইসময় পাশের সীটের লোকটা ডাকল,
ভাইজান ও ভাইজান।
আমি বই সরিয়ে তার দিকে তাকালাম। বিরক্ত লাগছে। লোকটা আমার বিরক্তি দেখে একটু মিইয়ে গেল। বলল, ভাইজান একটু পরে বেয়ারা চা দিয়ে যাবে, মুখে দেবেন না। ওই চায়ের কাপে একটা মরা মাছি ডুবানো আছে।
এই রকম অদ্ভুত কথা শুনে আমি একটু উঁচু হয়ে লোকটাকে ভালভাবে দেখলাম। সে তার সীটে চুপচাপ বসে আছে। একই রকম জুলজুল চোখে আমার দিকে তাকানো। বয়স আমার থেকে অন্তত পনের বছর বেশি হওয়ার পরও আমাকে কেন ভাইজান ভাইজান বলে ডাকছে সেটাও পরিষ্কার না। একটা কারন হতে পারে সে হয়ত একদম অজ পাড়াগাঁয়ের মানুষ, আমার বেশ ভূষা দেখে আমাকে উঁচু শ্রেনীর কেউ ভেবে বসে আছে। কিন্তু তার এই উদ্ভট কথা বলার মানে কি? বেয়ারা চা নিয়ে আসবে আর সেটাতে মাছি ডুবানো থাকবে এই রকম অর্থহীন কথার কারন কি?
আমি চারপাশে তাকিয়ে বুঝলাম ট্রেন চলছে এবং এই কেবিনে আমরা মাত্র দুইজন যাত্রী। লোকটার কথাই ঠিক, আর কেউ ওঠেনি। তবে আজ সোমবার, উইক ডেইজ, এমন দিনে ঠাকুরগাঁয়ে যাওয়ার কেবিন যাত্রী কম থাকাই স্বাভাবিক। লোকটা হয়ত ঐ আন্দাজ থেকেই বলেছে।
ট্রেনের কেবিনের দরজায় নক হলো, আমি খুলে দিতেই এক বেয়ারা একটা চায়ের কাপ আমার হাতে দিয়ে বলল, স্যার আপনার চা।
আমি কাপ হাতে নিয়ে চিন্তিত হয়ে গেলাম। আমি কোন চায়ের অর্ডার দেই নি। সম্ভবত বেয়ারা ভুল করে অন্য কোন কেবিনের অর্ডার এখানে দিয়ে গেছে। কিন্তু ফেরত দেয়ার উপায় দেখছিনা, বেয়ারা চায়ের কাপ হাতে দিয়েই চলে গেছে। আমার চা খাওয়ার খুব একটা অভ্যাস নেই, তবু এই রকম চমৎকার একটা বই পড়ছি, সারারাত পড়ে শেষ করার প্ল্যানও আছে, কাজেই এক কাপ চা চলতে পারে।
আমি চায়ের কাপ মুখের কাছে নিতেই পাশের সীটের লোকটা বলল, ভাইজান চায়ের ভিতর মাছি ডুবানো আছে। খাইয়েন না।
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কি আজগুবি কথাবার্তা! আমি চায়ের কাপ নামিয়ে বললাম, আপনি কিভাবে জানেন চায়ের ভিতর মাছি ডোবানো?
লোকটা একটু মিইয়ে গেল। বলল, রাগ কইরেন না ভাইজান। আপনার ভালোর জন্য বললাম। আমি জানি, কারণ এর আগে কয়েকজন ওই চা খেয়ে পরে কাপের নীচে মাছি পাইছে। একজন তো বমিও করছে। বিশ্বাস না করেন আপনি চায়ের নীচে একটা কিছু দিয়ে নাড়া দিয়ে দেখতে পারেন।
কি উদ্ভট কথা রে ভাই! এই চা তো আমি খাচ্ছি, আবার অন্যরা খাবে কিভাবে? নিশ্চয়ই সে এই ট্রেনের অন্য চায়ের কথা বলতে চেয়েছে। অন্য চায়ে মাছি থাকলেই যে এই চায়ের কাপেও থাকবে তার কোন মানে নেই।
আমি চায়ের কাপ তুলে নিলাম চুমুক দেব। লোকটা বলল, ভাইজান আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না পরে কিন্তু নিজেই কষ্ট পাইবেন।
আমার এতো রাগ হলো। আমিকেবিনে রাখা ময়লা ফেলা বিনের মধ্যে চা ঢেলে দিলাম। কেউ যদি বলতে থাকে চায়ে মাছি আছে, মাছি থাক বা না থাক ওই চা আর খাওয়া যায় না, এমনিতেই গা গুলাতে থাকে। চা ঢেলে কাপটা টেবিলের উপর রাখলাম। কাপের দিকে তাকিয়ে দেখি নীচে নীল রঙয়ের একটা মাছি। চায়ের মধ্যে ডুবে ছিল। নিশ্চয়ই চিনিতে ছিল, বেয়ারা চিনি যখন চামচ দিয়ে ঢেলেছে খেয়াল করে নি চায়ের কাপের মধ্যে মরা মাছি চলে গেছে।
কিন্তু এই লোকটা সেটা জানল কিভাবে? এটাও কি আন্দাজ? কিন্তু সে এতো নিশ্চিতভাবে বলছিল যে আন্দাজ বলে মনে হয় না, মনে হয় সে দেখেছে। কিন্তু কিভাবে?
আমি একবার হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের বইয়ের দিকে তাকালাম। বইটা টানছে, আলান কোয়ার্টার মেইনের কি হবে শেষ পর্যন্ত…… কিন্তু সামনে বসা এই লোকটার ব্যাপারটাও জানা দরকার।
বললাম, আপনি একটু খুলে বলেন তো ব্যাপারটা। চায়ের মাছি নিয়ে আপনি এতো ব্যস্ত হয়ে গেলেন কেন? এই ট্রেনের বেশীরভাগ চায়ের কাপেই মাছি থাকে- এই রকম কিছু?
লোকটা বলল, না ভাইজান। আমি এই কাপের ঘটনা আরও কয়েকবার দেখছি।আমি ভাইজান এই কেবিনে আটকা পইড়ে গেছি।
লোকটার কথা বুঝতে আমার খানিকটা সময় লাগল।
–আপনি কেবিনে আটকা পড়ছেন মানে? কে আপনাকে আটকে রেখেছে?
–জানি না ভাইজান। আঠারো দিন আগে ফেব্রুয়ারির ঊনত্রিশ তারিখে বাড়ি যাওয়ার জন্য এই ট্রেনে উঠছিলাম, এরপর ভাইজান আর বাহির হইতে পারি নাই। সবাই বের হয়ে যায় কিন্তু আমি পারি না।
একবার ভাবলাম, লোকটা মাথা নিশ্চয়ই নষ্ট। নাকি ফালতু কথা বলে গল্প গুজব জমানোর চেস্টা? কিন্তু এই লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে খুবই সাধাসিধে। আমি বললাম
বের হতে পারেন নাই মানে? দরজা খুলে বের হয়ে যান।
–পারি না ভাইজান। দরজা খুলে বের হতে গেলে আমি আবার এই কেবিনেই ঢুকে যাই।
আমি বিস্মিত হয়ে তাকালাম। লোকটা বলে কি! সে আবার বলল,
এই কেবিনে প্রথম যেদিন উঠছিলাম সেদিনও যাত্রী ছিল দুইজন। রাত্রে কয়েকবার কারেন্ট গেছে এছাড়া সবই ঠিকঠাক ছিল। পরদিন সকালে ঠাকুরগাঁয়ে এসে ওই যাত্রী কেবিন থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর আমি কেবিনের দরজা খুলে বের হয়ে দেখি আবার এই কেবিনে ঢুকে পড়েছি। ট্রেন আবার আগের জায়গা অর্থাৎ ঢাকার কমলাপুরে। ভাইজান গত আঠারো দিন ধরে একই ঘটনা। কমলাপুরে মাত্র একজন যাত্রী ওঠে, সকালে ট্রেন ঠাকুরগাঁও যায় ওই যাত্রী নেমে গেলে আমি কেবিনের দরজা খুলি এবং আবার এই কেবিনে এসে পড়ি। ততক্ষণে একদিন চলে গেছে। ভাইজান আমি কি কোন টাইম লুপের মধ্যে পড়ে গেছি?
আমি আবারও ভালো করে লোকটাকে দেখলাম। কোন ধান্দাবাজি আছে বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু এই গ্রামের লোকটা আবার টাইপ লুপ নিয়েও জানে দেখি।
বললাম, টাইম লুপ নিয়ে আপনি জানেন কিভাবে?
ভাইজান আমি গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে অংক করাই। টুকটাক বই পত্র পড়ার শখ। ওইখান থেকেই জানছি, সময়ের একটা নির্দিষ্ট লুপে আটকে গেলে বারবার একই ঘটনা ঘটতে থাকে।
আমি কিছু বললাম না। হাত ঘড়িতে এখন পৌনে দুইটা। হ্যাগার্ডের বইটা ব্যাগে ভরে লোকটার মুখোমুখি বসলাম। মাথা অল্প অল্প করে ঘুরছে। লোকটা যদি ফ্রড হয় তাহলে তার কোন ধান্দা আছে, সেটা আমার জন্য নিশ্চয়ই বিপদজনক। আমি প্রস্তুতি নিয়ে রাখলাম। আমার ব্যাগে একটা সুইস নাইফ আছে। নানা ধরনের টুকিটাকি কাজে জিনিসটা খুব কাজে লাগে ওইটা সন্তর্পনে হাতে নিয়ে বসে রইলাম।
লোকটা বলল, ভাইজান কয়টা বাজে?
পৌনে দুইটা।
ওহ! এখন টিটি আসে আপনাকে জিজ্ঞেস করবে টিকিট আছে কিনা।
বলতে বলতে দরজা নক হলো। আমি দরজা খুলে দেখি টিটি দাঁড়িয়ে আছে। বলল,
টিকিট আছে তো না?
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে ভিতরে ডাকতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু টিটি সরে গেল আর দরজা আটকে গেল একাই।
আমি এগিয়ে দরজা খুলতে যাচ্ছিলাম, লোকটা বলল, ভাইজান আপনি দরজা খুলতে পারবেন না। শুধু ট্রেন ঠাকুরগাঁয়ে পৌঁছানোর পরই আপনি দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে পারবেন। এরমধ্যে আমি ছাড়া আর কেউ দরজা খুলতে পারবে না।
আমি অবাক হলাম একটু তারপর দরজা খোলার জন্য জোরে ধাক্কা দিলাম। দরজা খুলল না। গাঁয়ের জোর দিয়ে ধাক্কা দিয়েও দরজা এক চুল নড়াতে না পেরে আমি হতভম্ব হয়ে এসে সীটের উপর বসলাম।
কি হচ্ছে আসলে? দরজা কি কেউ বাইরে থেকে আটকে রেখেছে? আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে দরজা যে এতো ধাক্কাচ্ছি কোন শব্দ পর্যন্ত হচ্ছে না। লোকটার টাইম লুপের আজগুবি গল্পও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আমি লোকটার দিকে তাকালাম, সে সীটের উপরে বসে আমাকে এতোক্ষণ দেখছিল, আমি তাকাতেই ব্যাকুল হয়ে বলল,
‘ভাইজান, আমি এখানে আটকা পড়ছি ভাইজান। আমারে বের করার ব্যবস্থা করেন ভাইজান।’
টাইমলুপ (প্রথম পর্ব)
লেখক খোন্দকার মেহেদী হাসান
© Khondokar Mahedi Hasan
.
সেরা থ্রিলার গল্প
টাইমলুপ (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)
আমি সীটের উপর বসে আছি। পাশে হেনরী রাইডার হ্যাগার্ডের দারুন বই ‘ফিনিশড’ আর টানছেনা এখন। হচ্ছে কি একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবার চেস্টা করছি। পারছি না। মাথায় নানা চিন্তা জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সামনের সীটে লোকটা পা ঝুলিয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার অস্বস্তি লাগছে। আমি ঘড়ি দেখলাম, রাত পৌনে তিনটা। ট্রেন ছুটে চলছে তীব্র গতিতে, জানালার বাইরে অন্ধকার আকাশ, ঘরবাড়ি, গাছপালা সবই সরে যাচ্ছে। লোকটা হঠাৎ বলল, ভাইজান একটা জিনিস দেখবেন?
আমি সরু চোখে তাকালাম। ব্যাটা আমাকে ভালই ধাঁধায় ফেলেছে সন্দেহ নাই। এখন আবার কি খেলা দেখাতে চাচ্ছে কে জানে!
লোকটা তার হাতের ঘড়িতে সময় দেখল, ভাইজান ঠিক তিনটার সময় গাড়ি একটা স্টেশনের কাছে এসে স্লো হয়ে যাবে। এরপর জানালা দিয়ে তাকায় দেখবেন স্টেশনের উপর একজন মানুষ আরাকজনকে গুলি করে মেরে ফেলছে।
আমি বিশেষ উৎসাহ দেখালাম না। লোকটা যা বলছে ওইটাই ঘটবে সন্দেহ নাই। ব্যাটা কোনভাবে আমার চিন্তার উপর প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে। একধরনের হিপনোটাইজ নিশ্চয়ই। অবশ্য এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এইরকম একটা রাতের ট্রেনে কেবিনে মাত্র দুইটা মানুষ, উপরের বাল্বের আলোটাও কেমন মিইয়ে যাওয়া ম্লান, ট্রেন হালকা দুলছে। জানালার ওইপাশে গাঢ় অন্ধকার। এই রকম একটা পরিবেশে দক্ষ কেউ আরাকজনের মনের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। লোকটা সম্ভবত সেটাই করেছে, আমাকে ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। কিন্তু লোকটা এসব করছে কেন? আমার কাছে খুব বেশি টাকা পয়সা নেই। সেদিক থেকে তার লাভ হবে না।
ভাবতে ভাবতে দেখি ট্রেনটা স্লো হয়ে গেল। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি ট্রেনটা একটা ছোট স্টেশনের প্লাটফর্ম পার হচ্ছে। স্টেশনটা ঘুমিয়ে আছে। কোথায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। প্লাটফর্মটা পার হওয়ার সময় দেখলাম এক কোনায় তিনচারজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ এক লোক হাত উঁচু করে পিস্তল দিয়ে গুলি করল, সামনের লোকটাকে পড়ে যেতে দেখলাম। আর কিছু দেখতে পারলাম না। ট্রেন ততক্ষণে প্লাটফর্ম পার হয়ে গতি বাড়িয়ে দিয়েছে।
আমি উত্তেজনায় জানালার কাছে চলে গিয়েছিলাম। সরে এসে আবার সীটে বসলাম। মাথা গরম হয়ে গেছে। তাকিয়ে দেখি সামনের লোকটা জুল জুল করে আমাকে দেখছে। মনে হল ব্যাটা একটু কৌতুকের চোখে তাকিয়ে আছে এবার। আমার মেজাজ খারাপ হতে লাগল। এই অজ পাড়া গাঁয়ের লোকটা ভালই ভেলকি দেখাচ্ছে আমার সাথে।
আমি জোর করে সীটের উপর শুয়ে পড়লাম। তারপর ফিনিশড বইটা মুখের উপর তুলে ধরে পড়ার ভাণ করতে লাগলাম। সকাল হওয়া পর্যন্ত আমি এভাবেই শুয়ে থাকলাম। এক লাইনও বই পড়া হলো না, কিন্তু ভাব করলাম বইতে ডুবে আছি। ওই ব্যাটা গেঁয়োর জারিজুরিতে হেরে যাওয়ার মানে নেই।
সকালে ঠাকুরগাঁ স্টেশনে এসে পৌঁছল ট্রেন। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাইরে ঝকঝকে রোদ উঠেছে। সকালের আলো তেড়ছা হয়ে স্টেশনের উপর পড়ছে। আমার মন ভালো হয়ে গেল। রাতের অন্ধকারে লোকটার আজগুবি কথাবার্তা ভেবে হাসি লাগল। আমি একবার লোকটার দিকে হাসিমুখে তাকালাম। ভয় আর বিব্রতভাব কেটে যাওয়ার পর পরিস্থিতির উপর দখল চলে আসলে মানুষ যে হাসি হাসে সেটা। লোকটা একটু মিইয়ে গেল, বলল, ভাইজান আমার বাসা ঠাকুরগায়ের রানিশংকল গ্রাম। আমার নাম রকিব। মাস্টার বাড়ি, আমার বাড়িতে একটু খবর পাঠায় দিয়েন ভাইজান। আমারে যেন তারা উদ্ধারের ব্যবস্থা করে।
সকালের তীব্র আলো জানালা দিয়ে আসছে। আমার বুদ্ধিও খুলে গেছে। বললাম, মোবাইল নাই? আপনি নিজেই মোবাইলে ফোন দিচ্ছেন না কেন?
মোবাইলে চার্জ ফুরায় গেছে ভাইজান। তাছাড়া এই কেবিনে মোবাইল কাজ করে না। আমি বাঁকা হেসে মোবাইল বের করলাম। তাকিয়ে দেখি সত্যিই নেটওয়ার্ক নাই কোন। ভাবলাম হতেই পারে, ট্রেনে কেবিনের ভেতর বলে কথা। নেটওয়ার্ক নাও থাকতে পারে, এতে এত আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
মনে মনে বললাম, চান্দু তুমি আমাকে আর বোকা বানাতে পারবা না।
হেসে আমি আমার ব্যাগ নিয়ে দরজা খুলে একবার পেছনে তাকালাম। লোকটা ঠিক আমার পেছনে গাঁ ঘেষে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধের উপর দিয়ে দরজার ওইপাশে উঁকি দেখছে। আচমকা তাকে পেছনে দেখে আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল। আমি দরজার এই পাশে বের হয়ে এলাম। পেছন থেকে লোকটা কাতর কন্ঠে বলল, আমার কথা ভুইলেন না ভাইজান, আমারে উদ্ধার করেন এইখান থেইকা।
স্টেশনে পা দিয়ে বিস্মিত হয়ে গেলাম। চারিদিকে অন্ধকার। তীব্র বৃষ্টি হচ্ছে। চারপাশে দেখে মনে হলো এই বৃষ্টি অন্তত আধাঘন্টা ধরে তো হচ্ছেই। রেল লাইনের উপর দিয়ে বৃষ্টির পানি বয়ে যাচ্ছে। অথচ একটু আগেই জানালা দিয়ে দেখলাম বাইরে ঝকঝকে আকাশ আর সকালের চমৎকার রোদ। তাহলে কি দেখলাম ওইটা?
আমি আবার দ্রুত রেলগাড়িতে উঠলাম, আমার একটু আগে ছেড়ে আসা কেবিনের দরজা খুলে ঢুকে দেখি তিনজনের এক পরিবার তাদের ব্যাগ বোচকা গোছাচ্ছে। আমাকে দেখে বয়স্ক একজন ভুরু কুঁচকে তাকালো। কি চাই?
আমি বললাম, একটু আগে এই কেবিনে যে লোকটা ছিল সে কোথায় গেল?
বয়স্ক লোকটার ভুরু আরোও কুঁচকে গেল। একটু আগে এখানে কেউ ছিল না আমরা ছাড়া, দেখতেই পাচ্ছেন কেবল ঘুম থেকে উঠেছি আমরা। এখন নেমে যাব ট্রেন থেকে।
আমি তাড়াতাড়ি বের হয়ে কেবিনের নম্বর দেখলাম। দরজার উপর লেখা কেবিন নয় ৬, সীট নং ২২৫-২২৮ । আমার পকেট থেকে টিকিট বের করে মিলিয়ে দেখলাম, এটাই সেই কেবিন। তাহলে? লোকটা কোথায় গেল? সেই কেবিনই বা কোথায়?
এই সময় আমার পকেটের মোবাইল বাজল। আমাদের অফিসের ঠাকুরগাঁর ইনচার্জ ফোন দিয়েছে।
“রানা ভাই, কি ব্যাপার? স্টেশনে পৌঁছেছেন? সারা রাত আপনার মোবাইল বন্ধ ছিল কেনো? আমি স্টেশনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। চলে আসেন। “
আমি বললাম, হু জামাল ভাই স্টেশনে পৌছে গেছি। কই রাতে তো মোবাইল বন্ধ ছিল না আমার।
বললাম বটে কিন্তু আমার মনে হলো সারা রাত মোবাইলের দিকে তাকান হয় নি আমার। আমি বৃষ্টি মাথায় করে ট্রেন থেকে নেমে এলাম।
দুপুর পর্যন্ত অফিসের কাজে ভীষন ব্যাস্ত সময় কাটল। ঠাকুরগায়ে আমাদের অফিসে হিসাবে গোলমাল হয়েছে, আমি ঢাকা থেকে এসেছি সেটা অডিট করতে। দুপুরের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে গেল।
দুপুরে খাওয়ার পর হঠাৎ ট্রেনের ঘটনাটা মনে পড়ল। কানে বাজল লোকটার ব্যকুল কন্ঠ।
‘ভাইজান আমার বাসার সবাই চিন্তা করতেছে, একটু খবর পাঠায় দিয়েন।‘
আমি জামিল ভাইকে বললাম, ভাই আশে পাশে রানি শংকল নামে কোন গ্রাম আছে নাকি?
জামিল ভাই বলল, হু আছে। কাছেই । কেনো? যাবেন?
হু এদিকের কাজ শেষ। একটু ঘুরে আসতাম।
ঠিক আছে চলেন।
রানি শংকল গ্রামে গিয়ে মাস্টার বাড়িটা খুঁজে পেতে সমস্যা হলো না। বাড়িতে গিয়ে চমকে যেতে হলো। ওই বাড়ির মানুষজন জানালো তাদের বাড়ির বড় ছেলে রাকিব একমাস আগে ২৮শে মার্চ ট্রেনে ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁ আসার পথে হারিয়ে গেছে। রাকিবের স্ত্রী তার ছবি এনে দেখাল। ট্রেনে দেখা রাকিবের সাথে হুবহু মিলে গেল।
আমি দারুন বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। এই রাকিব একমাস আগে ট্রেনে উঠেছে অথচ তাকে আমি গতরাতেই ট্রেনে দেখলাম। আমি তাড়াতাড়ি ওখান থেকে চলে এলাম।
জামিল ভাই বললেন, রানা ভাই কোন সমস্যা?
আমি মাথা নাড়লাম। না ভাই। আজ রাতেই ঢাকা ফিরতে চাই।
পরদিন সকালে ঢাকা ফিরে এলাম। সারারাত ভেবেছি ঘটনাটা নিয়ে। কূল কিনারা করা যাচ্ছে না আসলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমাদের ডিপার্টমেন্টে কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়াতেন রায়হান স্যার। মনে হলো স্যারকে একবার সবকিছু খুলে বলি।
স্যার সবকিছু খুব আগ্রহ নিয়ে শুনলেন। তারপর ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবলেন। আমাকে বললেন, তুমি যাও, আমি পুরা ব্যাপারটা ভেবে দেখি কি ব্যখ্যা দাঁড় করানো যায়।
বিকেলের দিকে স্যার ফোন দিলেন।
রানা। আমি কিছু অদ্ভুত ব্যাপার খোজ খবর করে জানতে পারলাম। গত ২৮শে মার্চ রাতে চন্দ্রগঞ্জ স্টেশনে একটা খুন হয়েছে, গুলি করে একজনকে স্টেশনে ফেলে রেখেছিল কয়েকজন। তারা সবাই পরে ধরা পড়েছে। ২৯শে মার্চ সকালে ঠাকুরগাঁয়ে কোন বৃষ্টি হয় নি, ঝকঝকে রোদ ছিল। কিন্তু তুমি যেদিন ঠাকুরগাঁ গিয়েছ অর্থাৎ ২৯শে এপ্রিল ওইদিন রাত থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল, সকালে রোদ ওঠেনি। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে তুমি সম্ভবত ওইদিন রাতে একটা টাইম লুপের ভিতর চলে গিয়ে ২৮শে মার্চে ঘুরে এসেছ। ওই লোক রকিব মনে হচ্ছে কোন কারনে সেখানে ওই টাইম লুপে আটকা পড়েছে। তুমি এক কাজ করতে পারবা? আজ রাতেই আবার ওই ট্রেনের ওই কেবিনের টিকিট পাও কিনা দেখ, তাহলে আবার হয়ত ওই লুপে ঢুকে পড়তে পারবে। আমার আরোও কিছু তথ্য দরকার, ওই লোকের কাছ থেকে কিছু তথ্য পেলে জানতে পারতাম সে কিভাবে আটকা পড়ল, হয়ত তাকে বের করতে সাহায্য করতে পারব।
আমি গাই গুই করছিলাম। কি দরকার আবার ওই টাইম লুপের ভেজালে ঢোকা, যদি সত্যিই সেটা থাকে থাকুক না।
প্রফেসর টের পেলেন। বললেন, আমিই যেতাম কিন্তু আমার হাতে সময় নেই, আজ রাতেই আমার সিংগাপুরের ফ্লাইট আছে, ওখানে একটা ইউনিভার্সিটিতে সেমিনার আছে, আমি চেস্টা করব দুই দিনের মধ্যে ব্যাক করতে। প্লিজ তুমি আজ যাও, প্রয়োজনে তোমার সাথে আমি আরাকদিন যাব।
অগত্যা টিকিট কাটতে গেলাম। আশা ছিল টিকিট পাব না। অন্তত প্রফেসরকে বলতে পারব যে টিকিট পাই নি । কিন্তু টিকিট পেয়ে গেলাম।
সেদিন রাতে আমি ওই কেবিনের দরজা খুলে ঢুকতেই রকিব চোখ বড় বড় করে তাকাল। ভাইজান আপনি আবার আসছেন?
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে সব খুলে বললাম। তার বাসার কথা প্রফেসরের কথা। বললাম, তোমাকে স্যার বের করার চেস্টা করবেন। এখন আমি তোমার কাছ থেকে নোট নেব স্যারের জন্য। স্যার বলছেন প্রত্যেক টাইম লুপই হচ্ছে একটা বাবলের মতো, নির্দিষ্ট একটা প্যাটার্ন থাকে, ওইটা বদলে দিতে পারলেই লুপ ভেংগে যাবে।
রকিবের চোখ দেখলাম জ্বল জ্বল করছে। বলল, সেটা কি রকম ভাইজান?
বললাম, এই ধর এই কেবিন একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্নে আটকা পড়েছে। একটা নির্দিষ্ট সময় দুইজন কেবিনে থাকতে পারছে আবার সেই সময় পার হওয়ার পর দরজাখুলে একজন বের হয়ে গেলে সে আটকাচ্ছে না, আটকাচ্ছে শুধু একজনকে।
রাকিব বলল, হু ভাইজান ঠিকিই বলছেন।
সেরাতে আমি রাকিবের সাথে অনেক গল্প করলাম, নোট নিলাম কিছু। তারপর সকালে ঠাকুরগাঁ ট্রেন থামলে দরজা খুলে রাকিবকে বিদায় বলার জন্য ঘুরলাম। রাকিব ঠিক আমার পেছনেই দাঁড়ানো ছিল। দরজা খুলতেই সে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। এরপর দরজা আটকে গেল, আমি ধাক্কা দিয়ে দেখি দরজা খোলে না।
কি ভয়ংকর! রাকিব আমাকে আটকে দিয়ে বের হয়ে গেছে। টাইমের এই লুপে একজন থাকলেই চলে সেটা কাল তাকে বলা মোটেই উচিৎ হয় নি। আমি হতাশ হয়ে এসে সীটে বসে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে লাগলাম এখন আমি করব। একটু চিন্তা করেই অবশ্য কি করতে হবে বুঝে গেলাম। ট্রেন একটু পরেই আবার ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করবে তখন কোন একজন যাত্রী উঠবে, সকালে সে যখন ট্রেন থেকে নামার জন্য দরজা খুলবে তখন রাকিবের মতোই আমাকেও তাকে সরিয়ে দিয়ে বের হয়ে যেতে হবে। এরপর প্রয়োজনে স্যারের সাথে পরামর্শ করে তাকে এই লুপ থেকে বের করা যাবে। কিন্তু আগে আমাকে বের হতেই হবে, অন্যের জন্য মায়া করলে চলবে না।
একটু পরেই টের পেলাম ট্রেন কমলাপুর রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। জানালা দিয়ে স্টেশনের বহু পরিচিত অবকাঠামো দেখা যাচ্ছে এখন। আশ্চর্য লাগল! একটু আগেই ঠাকুরগাঁ ছিলাম। টাইম লুপ তাহলে সত্যিই আছে।
ট্রেনের দরজা খুলে গেল। একটা বিশ একুশ বছরের তরুণী দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। আমাকে দেখে সে পেছন ঘুরে বলল, আব্বা তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়, পিছিয়ে পড়লে কেন?
কিন্তু ততক্ষণে তার পেছনে কেবিনের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। মেয়েটা আমার সাথে আটকা পড়ে গেছে এই কেবিনের টাইম লুপে। আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটার মুখে এখনো কৈশোর পেরুনো নিখাদ তারুন্যের সরলতা। অপূর্ব সুন্দর মুখ সৌন্দর্যের ডালা খুলে বসেছে। কিন্তু আমাকে কোন মায়ায় জড়ালে চলবে না। আগামীকাল ঠিকঠাক এই মেয়েকে দরজা থেকে সরিয়ে দিয়ে বের হয়ে যেতে হবে। সেটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম।
(গল্পটা এখানেই শেষ। ছোটগল্প কখনও সম্পূর্ন হয় না। সেজন্যই প্রকাশক অনুরোধ করেছেন এই গল্পটা নিয়ে উপন্যাস দাঁড় করাতে। সেখানে এই গল্প আরোও বিস্তৃত হবে, সামনে এগিয়ে যাবে। উপন্যাস হয়ত ছাপা হয়ে যাবে কয়েকমাসের মধ্যেই। ধন্যবাদ)
লেখক ঃ খোন্দকার মেহেদী হাসান
© Khondokar Mahedi Hasan