ভ্রমণ কথন: ঢাকা থেকে কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনে প্রথম দিনে যাওয়া এবং ফেরা।
কক্সবাজার, “The Longest Sea Beach in The World” একটা অনুপ্রেরণার জায়গা, জুড়ে আছে সব বাংলাদেশীদের মনে। আর মনের এই অনুপ্রেরণাকে আরও কয়েকগুন বাড়িতে দিলো ঢাকা থেকে কক্সবাজারের মধ্যে সদ্য চালু হওয়া আন্তঃনগর কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনটি। ১ ডিসেম্বর ২০২৩ বাংলাদেশের ভ্রমণপিপাসু মানুষের জন্য একটা মহা আনন্দের দিন। এই দিনেই কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনটি তার প্রথম বানিজ্যিক যাত্রা শুরু করলো।
২২ নভেম্বর রাতে মোবাইল ঘাটতে ঘাতটে দেখি ২৩ তারিখ খেকে কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকেট বিক্রয় শুরু হচ্ছে। যাত্রার দিনটি শুক্রবার অর্থ্যাৎ ছুটির দিন হওয়ার কারণে মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। শুক্রবারে যদি ঢাকা থেকে ট্রেনটির ফার্স্ট ট্রিপে কক্সবাজার যাই আবার শনিবার ঐ ট্রেনেই যদি ঢাকায় ফিরে আসি তাহলে রবিবার অফিসে যেতে কোন সমস্যাই হবে না। এখন টিকেট পাওয়াটাই একটা চ্যলেঞ্জের বিষয়। মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে শুয়ে পড়লাম। সকাল ৭:৫৫ মিনিটে ঘুম থেকে উঠেই মোবাইল নিয়ে বসে পড়লাম টিকেট কাটার যুদ্ধে। সৌভাগ্য বশত: নিজের টিকেটটা পেয়ে গেলাম অনলাইন থেকেই। ঢাকা থেকে কক্সবাজারগামী এই ট্রেনে ঢাকা থেকে প্রথম যাত্রায় ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো।
যাত্রার দিন অর্থ্যাৎ ০১ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে রাত ৯:০০ টার দিকে চলে গেলাম কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে। কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে প্রবেশ করে রাত ৯:৩৯ মিনিটে। প্রয়োজনীয় ফর্মালিটিজ শেষে ট্রেনটি প্রথমবারের মতো ঢাকা থেকে কক্সবাজারের উেদ্দেশ্যে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে নির্ধারিত সময় রাত ১০:৩০ থেকে একটু দেরীতে ১০:৫৭ মিনিটে। প্রথম যাত্রা, তাই রেলওয় কতৃর্পক্ষের কিছু এক্সট্রা ফরমালিটিস করতেই ট্রেনটির একটু বিলম্ব হয়। কমলাপুর থেকে যাত্রা শুরু করে কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশনে পৌছায় রাত ১১:২১ মিনিটে।
এরপর আর কোথাও থামাথামি নেই সরাসরি ছুটে চলা বন্দরনগরী চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। চট্টগ্রামের পূর্বে আর কোথাও কোন যাত্রাবিরতী নেই এই ট্রেনটির। যেহেতু ঢাকা থেকে কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনের আজ প্রথম যাত্রা, তাই ট্রেনের সকল যাত্রীদের মধ্যেই ছিলো বাধভাঙ্গা আবেগ এবং অন্যরকম একটা ভালোলাগা। সবাই ছিলো চরম এক্সাইটেড। যাত্রীদের পাশাপাশি ট্রেনের কর্মচারী/কর্মকর্তাদের মাঝেও এক্সাইটমেন্টের কোন কমতি ছিল না? ট্রেনের ম্যাক্সিমাম কর্মকর্তা এবং এ্যাটেনডেন্টই ছিল ওয়েল সুটেড—বুটেড। তাছাড়া যাত্রীদের সাথে তাদের আচরণও ছিল যথেষ্ট আন্তরিক। আমি টিকেট পেয়েছিলাম কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনের “ছ” বগিতে। ঐ কম্পার্টমেন্টের এ্যাটেন্ডেন্টের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে, বাংলাদেশ রেলওয়েতে চাকুরী জীবনে আজ তার প্রথম ডিউটি, তাও আবার এই কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনে। বিষয়টি নিয়ে তিনি চরমভাবে আবেগী ও উল্লোশিত ছিলেন। আমরা যাত্রীরাও ছিলাম চরম আবেগ আপ্লুত। ভালোলাগা আরো কয়েকগুন বেড়ে গেলো যখন প্রথম দিনের যাত্রী হিসেবে বাংলাদেশ রেলওয়ে আমাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নিলো। খুবই ভালো লাগছিলো তখন। ফুলের পাশাপাশি কক্সবাজারের একটি স্বনামধন্য হোটেলের পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে আরও একটা প্যাকেট দেয়া হলো সকল যাত্রীদের।
রাতের আঁধার চিরে মাথা উঁচু করে ছুটে চলছে আমাদের কক্সবাজার এক্সপ্রেস। নরসিংদী, ব্রাক্ষণবাড়ীয়া, কুমিল্লা, আখাউড়া এবং ফেনী স্টেশন ছাড়িয়ে আমাদের ট্রেনটি চট্টগ্রামে পৌছায় ঠিক রাত ৩:৫৯ মিনিটে। চট্টগ্রাম স্টেশনে যাত্রাবিরতীর নিধার্রিত সময় ছিল ২০ মিনিট। ইঞ্জিন পরিবর্তন শেষে ৪৬ মিনিট পর পুনরায় কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে ভোর ৪:৪৫ মিনিটে। যাত্রীদের মধ্যে আবার শুরু হয় উন্মাদনা। চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা শুরুর ২৩ মিনিট পরেই আমাদের ট্রেনটি অতিক্রম করে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কালুরঘাট ব্রিজ। কালুরঘাট ব্রিজটি সংস্কারের কাজ ইতোমধ্যে অনেকটাই সম্পন্ন হয়েছে। সংস্কারের বাঁকি কাজ এখনও চলছে পূর্ণ উদ্দোমে রয়েছে। ট্রেন যখন ২০ টি যাত্রীতে পরিপূর্ণ কম্পার্টমেন্ট এবং ইঞ্জিনসহ কালুরঘাট ব্রিজ পার হচ্ছিলো তখন অনেকটা ভয় হচ্ছিলো মনের ভেতর। ব্রিজটি অতিক্রম করার পর পর্যটন নগরী কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে আবার শুরু হয় আমাদের ঐতিহাসিক যাত্রা।
ট্রেনের ম্যাক্সিমাম যাত্রীরা প্রায় সারারাতই নির্ঘূম কাটিয়েছে। আর ঘুম আসবেই বা কিভাবে? ইতিহাসের সাক্ষী হতে যাচ্ছি আমরা সবাই, তাই পুরো যাত্রা উপভোগ না করলে কি আর হয়?
সকালের আলো মাত্র ফুটতে শুরু করেছে। যাত্রীরা সবাই কুয়াশাঢাকা সকালের স্নিগ্ধতা উপভোগ করছিলাম। যাত্রীদের পাশাপাশি ঐ এলাকার মানুষদের মধ্যেও উন্মাদণা ও আবেগের কোন কমতি ছিলো না। শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে বাচ্চা থেকে বুড়ো, পূরুষ—মহিলা সবাই যেন ছিলো রেল লাইনের পাশে, শুধু একবার আন্তঃনগর কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনের এই ঐতিহাসিক যাত্রা দেখার জন্য। অনেকেই আবার হাত নাড়িয়ে আমাদের ভালোবাসা জানাচ্ছিলো।
পাহাড় কেটে ট্রেন চলাচলের জন্য তৈরী রাস্তার যার মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছে আমাদের কক্সবাজার এক্সপ্রেস। দু—পাশের স্নিগ্ধ প্রকৃতি দেখে আপনাকে একবারের জন্য হলেও প্রকৃতির প্রেমে পড়তেই হবে।
অবশেষে আমাদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো সকাল ৮:০০ টায়। আমাদের ট্রেন প্রবেশ করলো পর্যটন নগরী কক্সবাজারের আইকনিক রেলওয়ে স্টেশনে। মজার বিষয় হলো কক্সবাজার স্টেশনেও অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলো আমাদের বরণ করে নিতে। ট্রেন থেকে নেমেই চলে গেলাম সেই ইঞ্জিনটি একবার দেখতে, যেটা আমাদের সবাইকে প্রথমবারের মতো ঢাকা থেকে টেনে নিয়ে আসলো কক্সবাজার পর্যন্ত। আবেগ সামলাতে না পেরে অনেকের দেখা—দেখি তার গাড়েই উঠে পড়লাম একটা ছবি তোলার জন্য। আসলেই আমরা বাঙ্গালীরা একটু বেশীই আবেগী। কক্সবাজারের আইকনিক রেলওয়ে স্টেশনটাও অসম্ভব সুন্দর করে তৈরী করা হয়েছে।
পাশাপাশি কনষ্ট্রাকশন ও সৌন্দর্য বর্ধনের বাকি কাজও চলছে বিরামহীন গতিতে। স্টেশনের সৌন্দর্য দেখে আপনাকে একবার হলেও ‘ওয়াও’ বলতে হবেই। যাই হোক অবশেষে স্টেশন থেকে বের হলাম। যাই, এবার একটু সমূদ্র সৈকত থেকে একটু ঘুরে আসি। আজ আবার এই ট্রেনেই দুপুর ১২:৩০ মিনিটে আমি ঢাকায় ফিরবো। মাত্র চার ঘন্টা সময় আছে আমার হাতে। পুরো সময়টাই উপভোগ করতে চাই সমূদ্র সৈকতে। একটা সিএনজি ভাড়া করে চলে গেলাম সমূদ্র সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে। স্টেশন থেকে মাত্র ১৬ মিনিটেই পৌছে গেলাম সুগন্ধা বীচে। সকালের ঝলমলে আলোতে সমূদ্র যেন খিল খিল করে হাসছিলো আর তার পাড়ে খেলা করছিলো শতশত মানুষ। সকালের নাস্তা শেষে পুরো সময়টাই কাটালাম সমূদ্রের সাথে।
দুপুর ১২:০০ টার দিকে আবার রওনা হলাম স্টেশনের দিকে। এবার একটা ব্যটারী চালিত অটোরিক্সা নিয়ে লাবণী বীচ থেকে কক্সবাজার রেলওয়ে ষ্টেশনে পৌছাতে সময় লাগলো ২৪ মিনিট। দুপুর ১:০৪ মিনিটে কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনটি পূণরায় ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। দিনের আলোতে দু—পাশের পরিবেশ দারুনভাবে উপোভোগ করছিলাম সবাই। কক্সবাজার থেকে দোহাজারী পর্যন্ত বিভিন্ন রেল স্টেশন এবং রেল লাইনের কাজ এখনো চলমান। খুব শিগগিরই সব কাজ শেষ হবে বলে আশা করা যায়। ট্রেনটি বিকাল ৪:২৫ মিনিটে পৌছায় চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে। মাত্র ২০ মিনিট যাত্রা বিরতীর পর ঢাকার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ছেড়ে আসে বিকাল ৪:৪৫ মিনিটে। চট্টগ্রাম থেকে ছাড়ার পর ট্রেনটি সরাসরি ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশনে পৌছায় রাত ৯:৩০ মিনিটে। বিমানবন্দর ষ্টেশন থেকে আমার বাসা কাছে হওয়ায় আমি সেখানেই নেমে পড়লাম।
দুর্দান্ত এক্সাইটমেন্ট নিয়ে শুরু করা একটা ট্রিপ শেষ করলাম অসাধারণ আত্মতৃপ্তি নিয়ে। সবমিলিয়ে আমার জীবনের অনেক উল্লেখযোগ্য স্মৃতির মধ্যে কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনে ঢাকা থেকে প্রথম দিনে যাত্রা এবং পরেরদিন ফেরার স্মৃতিটা অন্যতম হয়ে থাকবে আজীবন।
তবে আপনারা যারা এই ট্রেনে ভ্রমণ করবেন, যাত্রাপথে অপৃতিকর কোন পরিস্থিতি এড়াতে কিছু বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকবেনঃ
১। জানালার বাহিরে হাত বা শরীরের কোন অঙ্গ বের করা থেকে বিরত থাকুন বা সাবধান থাকুন। বাইরে থেকে পাথর নিক্ষেপে যে কোন সময় আঘাত পেতে পারেন।
২। মোবাইল ফোনে ভিডিও করার সময় সতর্ক থাকুন। যে কোন সময় আপনার মোবাইল ফোন ছিন্তাই হতে পারে। ঢাকা থেকে কক্সবাজার যাবার সময় আমার এবং পাশের কম্পার্টমেন্ট থেকেই ৩টি মোবাইল ছিন্তাই হয়েছে।
৩। ট্রেন স্টেশনে দাঁড়ানো অবস্থায় বাইরে যাওয়ার সময় সাবধান থাকবেন। একটু অসাবধান হলেই আপনার লাগেজ চুরি হয়ে যেতে পারে। যা ঘটেছিল আমার এক সহযাত্রীর সাথে।
৪। যাত্রার পূর্বে কিছু শুকনো খাবার সাথে নিন। কক্সবাজার থেকে ঢাকা ফেরার সময় লাঞ্চ—এর আইটেম শেষ হয়ে যাওয়ায় যথেষ্ট কষ্ট করেছেন অনেক যাত্রী। ট্রেনে যাত্রীদের তুলনায় খাবারের আয়োজন কম থাকার কারণে এমন সমস্যার সম্মুখিন হতে পারেন।
৫। কক্সবাজার স্টেশনে নামার পর সিএনজি বা অটোরিক্সা অনেক বেশী ভাড়া দাবি করবে। সম্ভব হলে জাস্ট ২ মিনিট হেঁটে মেইন রোডে গেলেই শেয়ারিং অটোরিক্সায় বা রিজার্ভ করেও ন্যায্য ভাড়ায় আপনার গন্তব্যে যেতে পারবেন।
৬। যেহেতু এটি একটি নন—স্টপ আন্তঃনগর ট্রেন এবং প্রতিটি কম্পার্টমেন্টে অটোমেটিক গেট লাগানো, তাই একটু কষ্ট হলেও দুর্ঘটনা এড়াতে ট্রেনের ভেতরে ধুমপান করা থেকে বিরত থাকুন।
ধন্যবাদ
কক্সবাজার থেকে ইনানী যাওয়ার রাস্তাটা একসময় মনে হত পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা; যার একপাশে সমুদ্র, একপাশে পাহাড়। নিউইয়র্ক এসে জানলাম এমন এক জায়গার কথা যেখানে সমুদ্রের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে পাহাড়ের বুকে। লোভী মন তখন থেকেই সুযোগের সন্ধানে ছিল, সুযোগ মিলেও গেল। ৩১আগস্ট সকাল সকাল রওয়ানা হলাম মেইনের উদ্দেশ্যে। হাইওয়ের দু’পাশের ঘন সবুজে হালকা হলুদ রঙের আভা; ফল কালার আর শীতের আগমনী ঘোষনা করছে যেন।
আমাদের প্রথম গন্তব্য কেপ এলজাবেথ, মেইনে অবস্থিত পোর্টল্যান্ড হেড লাইট হাউস। ফোর্ট উইলিয়াম ন্যাশনাল পার্কে ঢুকে দেখি প্রচুর লোকজনের সমাগম, লেবার ডে উইক এন্ডের ৩ দিন ছুটি কেউ ঘরে বসে কাটাচ্ছে না, সবাই বেরিয়ে পড়েছে শখের জায়গা গুলোতে। ১৭৮৭ সালে জর্জ ওয়াশিংটন এর নির্দেশে এই ঐতিহাসিক দূর্গ আর বন্দর নির্মিত হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল। বেশিরভাগ পর্যটক ক্লিফ ট্রেইল ধরে এখানে আসেন, আমরা অবশ্য পার্কে গাড়ি রেখে সমুদ্র পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছি। বড় বড় পাথর শিলা পার হয়ে আটলান্টিকের ঠান্ডা জলে পা ভেজালাম। অদূরে মেইনের সবচেয়ে পুরানো আলোকস্তম্ভ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
পরদিনের গন্তব্য একাডিয়া ন্যাশনাল পার্ক; মাউন্ট ডেজার্ট আইল্যান্ডের কেডিলাক পাহাড়ে সূর্যোদয় দেখা। নর্থ আটলান্টিক সী বোর্ড এর সর্বোচ্চ পয়েন্ট এটা, যেখানে ইউ,এস,এ র প্রথম সূর্যোদয় হয় অক্টোবর এর ৭ থেকে মার্চ এর ৬ অবধি। একটু দূরের হোটেলে থাকায় রাত ৪ টায় বের হলাম রুম থেকে। ঘুটঘুটে অন্ধকার, হঠাৎ হঠাৎ একটা দু’টা বাড়ি চোখে পড়ে। দু’পাশে ঘন জঙ্গল, রাস্তার ধারে আলোর নাচন, মাঝে মাঝে দু একটা আলো ছুটে যাচ্ছে এপাশ থেকে ওপাশে।
গাড়ির হেড লাইটের আলোয় আবিস্কার হল আলোর উৎস; বিড়ালের মত কিছু বন্য প্রাণীর জ্বলজ্বলে চোখ। একটু পর ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলো। অন্ধকার জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে তখন পরিষ্কার হতে থাকা আকাশ, তাতে লাল কমলা রঙের ছোঁয়া.. বিশাল ক্যানভাসে রং তুলি দিয়ে যেন কেউ যত্ন করে এঁকে দিয়েছে সূর্যোদয়ের মহেন্দ্রক্ষণ। পাহাড় আর সমুদ্রের এক অপূর্ব মেলবন্ধনের পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম সেই অবাক সূর্যোদয়। হু হু করা ঠান্ডা বাতাস, অতলান্ত সমুদ্র, অপার জলরাশির ভেতর থেকে উঠে আসা সূর্য; বহু বছরের অগ্নুৎপাত আর হিমবাহের সাক্ষী এই পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখার জন্য কেন মানুষ ছুটে আসে তখন বুঝতে পারলাম।
এরপর গেলাম থান্ডার হোল, সমুদ্রের গর্জন শোনার সবচেয়ে ভালো পয়েন্ট। পাহাড়ের কোলে গর্তের মত সৃষ্টি হয়েছে, সমুদ্রের বিশাল ঢেউ সেই গর্তে এসে প্রচন্ড শব্দে ঘুরপাক খায়, বিশেষ করে জোয়ারের সময়। সেখান থেকে বাস হারবার, সবাই সূর্যাস্ত দেখতে যায় যেখানে। সময় স্বল্পতার জন্য আমাদের যেতে হয়েছে দুপুরবেলায়।
সর্বশেষ জায়গা ছিল জর্ডান পন্ড। টলটলে দীঘির জল, মোটামুটি ৪০ ফিট গভীরতাও খালি চোখে দেখা যায়। সর্বশেষ হিমবাহের আইস শিট থেকে এই দীঘির উৎপত্তি। সীল হারবার গ্রামের সুপেয় পানির উৎস এই দীঘি। একপাশে দুটো পাহাড়ের চূড়া উঠে গেছে, অনেকটাই বুদবুদের পাশাপাশি দুই ফেনার মত..এজন্য একে বাবল পন্ড ও বলে অনেকে। দীঘির পাড়ে পাথর খন্ডে বসে জিরিয়ে নিলাম কিছুক্ষন; বিশাল দেহী গাছের ছায়া আর ঠান্ডা জলো হওয়ায় সারাদিনের ক্লান্তি মূহুর্তে মিলিয়ে গেল।
এবার হোটেলে ফেরার পালা। কিন্তু লবস্টার এর দেশে এসে এই জিনিস না খেয়ে গেলে হয়! ১.৫-২ পাউন্ড ওজনের আস্ত স্টিমড লবস্টার নিলাম, যদিও এরা এর চেয়ে অনেক বিশাল আয়তনের হয়ে থাকে। লবস্টার খাওয়াও একটা শিল্প; সী ফুড ফর্ক, নাট ক্র্যাকার, নাইফ- কত কিছুই না লাগে ওর শেল ভেঙে ভেতরের জিনিস বের করে আনতে।
হোটেল থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে একটু নামলাম, যে রাস্তার দু’পাশে সমুদ্র, একপাশে জঙ্গল। আপেল গাছ ঝুঁকিয়ে আপেল এসেছে সেখানে। রাস্তার ধারে ছোট্ট কাঁচের বাক্সে বেশ কিছু বই রাখা, কেউ চাইলে বই নিয়ে আয়েশ করে খানিক সময় কাটাতে পারবে। কেউ কেউ দেখলাম বই কোলে, হেডফোন কানে, অল্প কিছু খাবার আর পানীয় নিয়ে সমুদ্রের পাড়ে বসে আয়েশি সূর্যাস্ত দেখছে।
সূর্যাস্তের সাথে আমাদের একটি দিনের অবসান হল, আর রয়ে গেল সারাজীবনের বহু আকাঙ্ক্ষিত কিছু স্মৃতি। যে স্মৃতি সামনে রেখে বলাই যায় – ‘ আবার আসিব ফিরে’…………