বিশ্বাস করেন স্যার আমাদের ঘরের মেঝের(underground) নীচে কয়জন মানুষ থাকে । সারাদিন ঘুমায়।রাইত হইলেই মেঝেতে ধাক্কাধাক্কি করে। উপরে উঠতে চায়। তুই না বললি তুই ছাপড়া ঘরে থাকিস। ছাপড়া ঘরের নীচে কী আবার গ্রাউন্ড(underground) ফ্লোর থাকে নাকি?
ফ্লোর না , স্যার। মাটির নিচে(underground) থাকে ওরা। যেইখান থিকা বের হওয়ার দরজা-জানালা কিছু নাই। মাটি খুইরা বের করা লাগবে ওগো। নাইলে ঐ ঘরে থাকন যাব না।যেই থাকুক না কেন প্রতি রাইতে ভয় দেখাব।আর ওপরে উঠার লাইগা চিৎকার-চেঁচামেচি আর মেঝের নিচ থিকা ধাক্কাধাক্কি কইরবো।
তোর কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে! কী আবোল-তাবোল বলিস? তুই কী কাজ করিস ?
রিক্সা চালাই। তুই থানায় কিসের জন্য এসেছিস? কী চাস তুই ?
ঢালাই করা মেঝে ওই ঘরে।বাড়িওয়ালা আমারে মেঝে খুইরা ওদের বের করে আনতে দেবে না। আপনাদের সাহায্য লাগবে। ওরা বের হইতে চায়।
থানার অফিসার প্রথমে লুঙ্গি-শার্ট পরা এই লোকটাকে ‘ আপনি’ সম্বন্ধ করছিল। লোকটার কথার ধরন আর নিজের সময় নষ্ট হচ্ছে বুঝতে পেরে ‘তুই’ এ নেমে এলেন। কনস্টেবলকে ডেকে বললেন , কোনো মামলা ফাইল করবেনা।আজাইরা কীসব বকছে।যতসব পাগল ছাগল! চোখের সামনে থেকে দুর কর এইটারে।
ফিল্ডে অনেক কাজ পড়ে আছে অফিসারের । আজ সারাদিন অনেক জায়গায় যেতে হবে। সে সব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই থানা থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
সারাদিন ছুটোছুটির পর রাইত ৮ টায় থানায় ফিরলেন।
তখনো সেই লোকটাকে বসে থাকতে দেখে বিস্মিত হলেন। তাকে দেখেই লোকটা দাঁড়িয়ে একটা সালাম দিয়ে আবার বেঞ্চে বসে পড়লো। বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকিয়েই অফিসার ভেতরে ঢুকলেন।। কনস্টেবলকে বললেন;
ওর সমস্যা কী, এখনো যায়নি কেন ?
আজ আমাদের না নিয়ে বাড়ি ফিরবে না। আমাদের ছাড়া বাড়িতে ফিরলেই নাকি বউ আর বাচ্চাকে ওরা খুন করে ফেলবে।
কারা ?
ওর ঘরের মেঝের তলায়(underground) যেসব মানুষ থাকে তারা।
স্টূপিড! ওর মানসিক ট্রিটমেন্ট দরকার।
আমি আর বেশি ঘাটাইনি স্যার।
ওকে পাঠিয়ে দাও এখানে।
লোকটা কাচুমাজু হয়ে অফিসারের সামনে দাঁড়াল।অনুমতি পেয়ে চেয়ারে বসলো। অফিসার বিরোক্তিভরা কণ্ঠে বললেন;
“তোকে ৫ মিনিট সময় দিলাম।পুরো ঘটনা খুলে বল। উল্টাপাল্টা কিছু বলছিস তো সোজা লোহার পেছনে।“
রিক্সা চালক লোকটা ভীত স্বন্তস্ত্র গলায় বলা শুরু করলো।আমি,আমার বউ আর মাইয়া তিনমাস হয় এই বাড়িতে উঠছি। প্রথম দিকে সব ঠিকই ছিল। কিন্তু ১ মাস যাওনের পর……
এক রাইতে আমার মাইয়া আমারে আর ওর মারে ঘুম থিকা ডাইকা উঠাইল। মাইয়া আমার কয় মেঝে কেন কাপতেছে।
আর মাটির নিচে (underground) থিকা কেডা বলে তার নাম ধইরা ডাকতেছে।
আমরা কিছুই বুঝলাম না, কিছুই শুনলাম না। ভাবলাম মাইয়া স্বপ্ন দেখছে। দোয়া-দরুদ পইড়া ঘুম পাড়ায়া দিল ওর মা।
তার কয়দিন পরে আরেক রাইতে ওর মা আর ওয় কাঁপতে কাঁপতে আমারে ডাইকা ঘুম থিকা উঠাইলো। বউ ও মেয়ের মত এক কথাই কইলো,মেঝে নাকি কাপতেছে । মাটির তলা(underground) থেকে কারা নাকি ওপরে ওঠার লাইগা ধাক্কা-ধাক্কি চেঁচামেচি করতেছে। তার নাম ধইরা ডাকতেছে। আমি দিলাম বকা। স্বপ্ন দেইখা এমন করা লাগে!
এরপর বউ – মাইয়া দুইজনেই বলল , এই বাড়ি ছাইড়া চইলা যাইতে। মাঝ রাইত হলেই নাকি তারা দুজনে এই শব্দ শোনে। আমি আবার দিলাম বকা। এত ঘনঘন বাড়ি পাল্টান যায়! কিন্তু স্যার, গত ১ মাস হয় আমিও ওগো মতো রাইতে ঐ শব্দ হুনতে পাই।
রাইত গাঢ় হইলেই মাটির নিচ থিকা তারা নড়া-চড়া শুরু করে।
দুইটা বাচ্চা পোলাপানের কান্নার শব্দ,হাসির শব্দ,বেটা-বেটির ঝগড়ার শব্দ। এইগুলো মাটির নিচ থিকা(underground) গায়েবী ভাবে ভাইসা আসে। সারা রাইত ঘুমাইতে পারতাম না তিনজনে ভয়ে।
আর এই কথা বাইরেও বলার মতো না। এক রাইতে শুনলাম সেই ধাক্কাধাক্কির শব্দ। সাহস কইরা নীচে নাইমা মেঝেতে কান পাতলাম। মেঝেতে কান পাততেই চেঁচা-মেচি বন্ধ হয়ে গেল। আমার বুক ধকধক করে উঠলো। হঠাৎ একটা মাঝবয়সি বেটা লোকের কন্ঠ ভাইসা আইলো মাটির নিচে(underground) থিকা।
কেমন আছেন , অলি ভাই ?
আমি ভয় পাইয়া বললাম , ভালো।
ভয় পাইয়েন না, অলি ভাই। ভাই বইল্যা ডাকছি। আমরা কী আপনাগো ডিস্টার্ব করতেছি ?
জ্বী।
দুঃখের কথা আর কইয়েন না মিঞা ভাই। বাচ্চা মাইয়া দুইটা মরার পরেও ভালো হইলো না। যে দুষ্টামি করে! আর আপনার ভাবি তো এখনো কথায় কথায় বাপের বাড়ির খোটা দেয়। তাই একটু আধটু ঝগড়া হয়।
ও!
মাঝেমধ্যে বাইর হইতে মন চায় , অলি ভাই। মাটির তলে থাকতে কি ভালো লাগে বলেন! কতো বছর ধইরা বন্দি আছি। আপনি থাকতে পারবেন ?
না! আপনারা কারা ?
মাটির তলে (HADES) কী করেন ?
অবশ্য খারাপও না জায়গাটা। ক্ষিধা লাগে না , গরম-ঠাণ্ডা লাগে না। অবশ্য আমরাতো ইচ্ছা কইরা আর মাটির নিচে(hades) আসি নাই , আলী ভাই। আমাদের মারার পর এইখানে পুইতা গেছে। লম্বা স্টোরি। শুনবেন ?
জ্বী।
এই ঘর , পাশের বাড়ি সব জমির মালিক কিন্তু আমি। অনেক শখের জায়গা ছিল মিঞা ভাই। পোলা,মাইয়া আর বউ নিয়া সুখেই আছিলাম। চালাইতাম ফলের আড়ৎ। আয় ছিল ভাই বহুত। ঈদে গেলাম গ্রামের বাড়িতে। এক সৎ ভাই আছিল সেখানে শুধু। বাপ-মা গত। ভাইয়ের অবস্থা খুবই করুণ। পোলা-মাইয়া আর বউ নিয়া ঋনের দায়ে গলায় দড়ি দেওয়ার অবস্থা।
বউয়ের অনুমতি নিয়া তাদের শহরে নিয়া আসলাম। আপনার ভাইয়ের মতোই দেখতাম। ভাইরে কাজ খুইজা দিলাম, থাকার জায়গা দিলাম। আমাগো লগেই সবকিছু। ভালোই তো দিন কাটতেছিল। সন্দেহ করার মতো কিছুই নাই।
এক রাইতে সে ভাই আর ভাবি আমাদের খাওনের দাওয়াত দিল। এর আগেও প্রায়ই দিতো। কিন্তু সেদিন খাওনের খাওয়ার পর মাথাডা কেমন ভনভন করতেছিল। দ্রুত ঘরে আইসা শুইয়া পড়লাম।
এরপর হঠাৎ লোকটা কথা বলা থামাই দিল।
আমি জিগাইলাম , পরে ?
তারপর আর কী , উইঠা দেখি আমরা ৪ জনেই মাটির নিচে(abyss)। ওপরে দেয়াল , নিচে দেয়াল , পাশে দেয়াল। নড়ার জায়গা নাই। বাইর হওয়ার কত চেষ্টা করলাম পারলাম না।হারামজাদা ঘুমের ভিতরেই আমাগো জিন্দা কবরে শুয়াই দিছে। তখন তো এইদিকে এত বসতি আছিলোনা।কতো চিল্লাপাল্লা করলাম। কেউ শুনলো না। বছরখানেক হয় চিল্লাপাল্লার শব্দ মাটির ওপর ওঠে।
তারপর ?
তারপর আমাগো উপরে এই ছাপড়া ঘর তুইল্যা জায়গাট বেইচ্যা চইলা গেছে। এইটা এখন অন্য মালিকের জায়গা।
Limbo: মাটির তলা থিকা;
আপনে বুঝলেন কেমনে যে বেইচা দিছে ?
এই যে আপনার নাম জানলাম যেমনে। আমরা অনেক কিছুই এখন জানতে পারি। মারার আগে যে আমার টিপ সই নিছে একটা কাগজে তাও জানি।
কয় বছর আগে ?
সময়ের হিসাব নাই। তয় এখনো পর্যন্ত কেউ এই জায়গার মাটি খুঁড়ে নাই। খুঁড়লেই আমরা বাইর হইতে পারি। এই খুকি আর ভাবি ভয় পাইয়েন না। আমরা কারো ক্ষতি করতে পারি না।
আপনারাতো মারা গেছেন ?
জ্বী আলী ভাই। আপনি আমাদের ছাইড়া যায়েন না। এই ঘরে প্রথম দিকে যারা থাকতো ভয়ে আমরা কোনো শব্দ করতাম না। কিন্তু এখন অসহ্য লাগে বইলা বাহির হইতে মন চায়। তাই চিল্লাচিল্লি ধাক্কাধাক্কি না করলে মনে শান্তি আসেনা। আপনার আগে এই ঘরে অনেকে ভাড়া থাকছে। তারা সবাই আমাগো কন্ঠ শুইনা ভয়ে পলাই গেছে।
ওয়!
ডিস্টার্ব করলাম আলী ভাই। ঘুমায়া পড়েন। রাইত অনেক হয়েছে
বিশ্বাস করেন স্যার এরপরে অনেকদিন
Underground: মাটির নিচে থিকা তাগো সাড়া পাই নাই।
তারপরে হঠাৎ এক রাইতে আবার চিল্লাপাল্লার শব্দ। মেঝেতে কান পাততেই ওই বেটা কন্ঠ,
মাটি খুইরা আমাগো বাইর করেন, আলী ভাই । আর যে সহ্য হয় না। মাটির নিচে(underground) থাকা খুব কষ্ট।
আমি পরেরদিন বাড়ির মালিকরে মেঝে ভাঙার কথা বললাম।শুনেই তিনি গালাগালি শুরু করলো। বলল; ‘’গাঁজা কম খা।ঘরের মেঝেতে কোদাল,হাতুরার একটা দাগ যদি পড়ে।জিন্দা মাটিতে পুইতা ফেলমু।‘’
পরের রাইতে ওই মাটির তলের লোকটারে একথা বলতেই সে বললো, তুমি পুলিশের কাছে যাও। সব কথা খুইল্যা বলো। পুলিশ আসলেই আমাদের বেড় করতে পারবো।
আমার লোকটার ওপর মায়া লাগে স্যার। গত দুইদিন তাই থানায় আইসা ওই স্যাররে সব বললাম। উনি কানেই নিল না।
গতরাতে এই কথা ওই লোকটারে কইলাম। সে বলছে ,আইজ রাইতের মধ্য আপনাগো না নিয়া গেলে আমার বউ-বাচ্চারেও ওরা মাটির নিচে নিয়ে নিবে।
পুলিশ অফিসার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন তার সামনে বসে থাকা লুঙ্গি-শার্ট পরা লোকটার দিকে। এইরকম আজগুবি – গাঁজাখুরি গল্প এতটা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এর আগে কাউকে বলতে শুনেননি তিনি। বাঙালিরা আর যাই করুক, পুলিশের সঙ্গে মশকরা করতে থানায় আসবে না। লোকটাকে দেখেও পাগল মনে হচ্ছে না। বানিয়ে কথা বলার মাস্টারমাইন্ড ও না। আশ্চর্যই বলা চলে।অফিসার,এই লোকটার কথায় বেশ প্রভাবিত হলেন। ওই রাতেই কনস্টেবলকে গাড়ি বের করতে বললেন। তীব্র কৌতুহল তাকে পেয়ে বসেছে।
বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলে, কিছুটা আশাহত হলেন অফিসার। তিনি জানালেন, আলী মিয়া তিন মাস হলো বাড়ি ভাড়া দেয় না। তাই বাড়ি-ভাড়া থেকে বাঁচতে এই মিথ্যা গল্প ফেঁদেছে।
অবশ্য আশেপাশের মানুষ জনের সঙ্গে কথা বলে কিছু সুরহা হলো।জানা গেল, এইরকম কথা বলে এর আগের ২-৩ টা পরিবারও এই ঘর ছেড়ে চলে গেছে।আর অবাক করার বিষয় বাড়িওয়ালা স্বীকার করলেন এখানে ৮ বছর আগে ফলের আড়তে ব্যবসায়ী থাকতো। হঠাৎ করে তিনি গ্রামে চলে যান। তার খবর জানতে প্রথম প্রথম কিছু লোক প্রায়ই আসতো। তিনি বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন শুনে অবাক হয়ে ফিরে যেতেন। আর ঋনের দায়ে ফলের আড়তের শেয়ারও নাকি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বাড়িটা অবশ্য একটা এন.জি.ও এর সাহায্যে কিনেছিলেন তিনি লোকটার সৎ ভাইয়ের কাছ থেকে।
এবার অফিসার পুরোপুরি আত্মবিশ্বাস পেলেন। অলি মিঞার কথার যুক্তি পেলেন। মাটি কাঁটার কিছু লোক জোগাড় করে খোঁড়া কাজ শুরু করে দিলেন।তার আগের রাইতে অবশ্য
তিনি অনেকক্ষণ ঘরের মেঝেতে(underground) কান পেতে ছিলেন
আসলেই মাটির নিচে(underground) থেকে কোনো শব্দ বের হয় নাকি দেখার জন্য। প্রায় আধ-ঘন্টা খোঁড়াখুঁড়ি চলে। এরমধ্যে লোকজনের ভিড় হয়ে গেছে। একটা টেলিভিশন সাংবাদিক চলে এসেছেন।
অফিসার অনেক কিছু টের পেলেন। ক্ষমতার ব্যবহার করে তিনি মাটি খোঁড়া শুরু করেছেন। এখন যদি কিছু না পাওয়া যায়?
বাড়িওয়ালার অভিযোগে বিপদে পড়তে হবে তাকে।
প্রথম কঙ্কালের মাথার খুলি দেখতে পেয়েই চেঁচিয়ে ওঠে এক লোক। বিস্ময়ের ঝটকা লেগেছে সবাইকে।এরপর একে একে দুইটা বড় এবং দুইটা ছোট কঙ্কাল উদ্ধার করলো পুলিশ।
মানে সব সত্যি!
রাতারাতি টেলিভিশন,ইন্টারনেটের মাধ্যমে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়লো ঘটনাটা। আলী মিয়া ক্যামেরার সামনে রাইত এর সমস্ত ঘটনা খুলে বলছেন। যেমন টা পুলিশ অফিসারকে শুনিয়েছিল।
লোকটার সৎ ভাইয়ের পরিবার নিখোঁজ।দরজায় তালা ঝুলছে।বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে তারা।তবে দেরিতে হলেও খুঁজে পেতে সমস্যা হলো না পুলিশের। খুনি নিশ্চিত ছিল কেউ কোনোদিন তাদের পাপের কথা জানতে পারবে না। এমনই নিখুঁত ভাবে গুম করেছিল মজনু এবং তার পরিবারকে। তাছাড়া মজনু আর তার স্ত্রী দুজনেই পিতৃ-মাতৃহীন। তাই এত বছর কেউ জোর দিয়ে খোঁজ-খবর নেয়নি।
পুলিশি জিজ্ঞাসায় সব দোষ স্বীকার করে মজনুর সৎ ভাই। আলী মিয়া নতুন বাসায় গিয়ে ওঠে। পুলিশ অফিসার জাহাঙ্গীর এইরকম আশ্চর্য ঘটনা এর আগে কখনো দেখেনি।