ভাবীর সংসার ৫১ তম পর্ব
পলি ডাক্তার দেখিয়ে ভাইয়ের বাসায় আসছে। কিছু টেস্ট করে এসেছে বাসায়, আগামী কাল রিপোর্ট দেখিয়ে চট্টগ্রাম যাবে। বাসায় আসতে সময় এক কেজী মিষ্টি আর এক পাতিল দই নিয়ে এসেছে। আবিদ কম আনতে চাইলেও, পলি ভালো ভাবেই আসতে চেষ্টা করে, যাতে ভাবী মনক্ষুন্ন না হোন।
শারমিন পলির আসা, খুব একটা পছন্দ করছেন না, এটা তার চেহারায় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। পলি আসার পরে, ভাবীকে রান্নাঘরে সাহায্য করতে করতে বললো ভাবী এসে আপনাদের কি বেশি ঝামেলায় ফেলে দিলাম?
– ঝামেলা আর কি! দুইটা বাচ্চা নিয়ে যে কি যন্ত্রণা! ইশ কি বলবো। এরাই যন্ত্রনা দে বেশি।
– বাচ্চা মানুষ তো! বুঝেই কি।
– একটা ছেলে-মেয়ে হোক, তখন বুঝবে। আচ্ছা ডাক্তার কি বললো?
– কয়েকটি টেস্ট দিয়েছেন।
– করেছ? নাকি কাল করবে?
– আজই করে এসেছি। কাল রিপোর্ট।
– দেখবে রিপোর্ট দেখে আবার টেস্ট দিবে। এটা তাদের অভ্যাস।
– না, আর হয়তো দিবেনা।
– না দিলেই ভালো।
পলি এর পরে আরো তিন বার ঢাকা গিয়েছে, কিন্তু ভাবীর বাসায় যায়নি। কারণ তিনি দরজাই খুলেন বিরক্ত হয়ে, রাতে সাঈদের সাথে ঝামেলা হয়, তা স্পষ্ট কানে আসে। এখন আর পলির আগের মতো ধৈর্য্য হয়না! তাই, পরের বার হোটেলে থেকে ডাক্তার দেখিয়েছে। অন্তত নিজের আত্ন সম্মান বজায় থাকে, হয়তো আবিদ এতো দামী হোটেলে থাকেনা, একেবারেই নরমাল খাওয়া দাওয়া করে, তবুও শান্তি লাগে।
জাহিদের বিয়ের জন্য যে মেয়ে ঠিক করা হয়েছে, সে এ বছর ডিগ্রি পরীক্ষা দিবে, তাহমিনা হাফিজ নাম। পাশের গ্রামের মেয়ে, বাবা হাই স্কুলে পড়ান। দুই ভাই-বোনের মধ্যে সে ছোট। দেখতে শ্যাম বর্ণের হলেও খুব মায়াবী চেহারা। মধ্যেবিত্ত পরিবারের বড় মেয়ে, শান্ত শিষ্ট ভদ্র মেয়ে। রাহেলা বেগম নিজে বিয়ে ঠিক করেছেন আগামী মাসের তিন তারিখ জাহিদের বিয়ে। সে খুব দুঃচিন্তায় করছে, তার বউ কি আবার ভাবীর মতো হবে কিনা!
বিশ বছর পর……
পলির অনেক চিকিৎসার পরে যময পুত্র হয়েছে। যময পুত্র দুইজন খুবই মেধাবী। একজন বুয়েটে ত্রিশ তম হয়েছে, অন্যজন মেডিকেলে নব্বই তম হয়েছে। বড় ছেলের নাম তামিম, ছোট জন তালহা। শিক্ষক বাবার মেধাবী সন্তান হয়েছে দুজন। বাবার স্বল্প বেতনের চাকরিতে তারা আনন্দে থেকেছে। কখনো অন্যায় আবদার করেনি।
পলির শ্বশুর ঢাকায় ছয় তলা বাড়ী করেছেন, প্রত্যেক ছেলেকে একেক ফ্ল্যাট দিয়ে, বাকি গুলি ভাড়া দিয়েছেন। পলির ফ্ল্যাট দক্ষিণ দিকে। তিন বেড বড় ফ্ল্যাট পলির। শ্বশুর নিজের জীবনের সব জমানো অর্থ, পেনশন আর পুরোনো সেই টিন শেডের বাসা বিক্রি করে এই বাড়ী করেছেন।
যদিও টাইলস করা নয়, এবং থাই গ্লাস লাগানো নয়। খুবই সাদামাটা একটা ছয়তলা বিল্ডিং করেছেন প্রফেসর শফিউল আলম। বড় ছেলের ঘরের নাতিও এবার ডাক্তারি পাশ করেছে। অনান্য নাতি-নাতনীরা ও পড়াশোনায় খুবই ভালো। শফিউল সাহেব নাতি-নাতনীদের সাথে গল্প করে বেশিরভাগ সময় কাটিয়ে দেন, আর বাকি সময় নামাযেই চলে যায়। বয়স প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই, তবুও পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে নামায পড়েন তিনি।
আবিদের চাকরী এখনো চট্টগ্রামে, কিন্তু পলি দুই ছেলে নিয়ে ঢাকায় থাকে কারণ দুইজনই ঢাকায় চান্স পেয়েছে। বড় ছেলে বুয়েটে, আর ছোট ছেলে সলিম উল্লাহ মেডিকেলে। এজন্য শফিউল সাহেব বলেছেন পলি, তুমি ঢাকার বাসায়, নিজের ফ্ল্যাটে উঠে যাও। যদিও ছোট ছেলেকে হলে থাকতে হয়, শুধু বৃহস্পতিবার বাসায় ফিরে সে। তবুও ঢাকায় ভালোই লাগে পলির, জা, দেবর সবাই নিয়ে আনন্দে থাকে।
সাঈদের দুই সন্তান বিদেশে পড়াশোনা করছে। সাঈদ এ বছর অবসরে গিয়েছে। শারমিন-সাঈদ ঢাকার পাশে নারায়ণ গঞ্জের দিকে একটা একতলা বাড়ী করেছে। বিশাল বাংলা প্যাটার্ন বাড়ী। কিন্তু মানুষ মাত্র দুইজন, আত্নীয়-স্বজন ভাই-বোন কেউ সাঈদের বাসায় যায়না। তাদের দুজনের সময় যায় একা একা গল্প করে করে।
কলি আর জুয়েলের একটা রাজকন্যা আছে। সে এবার ক্লাস টেনে উঠেছে। জুয়েলের পোস্টিং এখন রাজশাহীতে। মেয়ে নিয়ে বেশ আনন্দে কেটে যায় তাদের সংসার। প্রায়ই ঢাকায় পলির বাসায় এসে দুই বেন মিলে ঘুরাঘুরি করে।
জাহিদের এক ছেলে-এক মেয়ে। জাহিদের বউ তাহমিনা সবাই কে আদর করে, ভালবাসে। রাহেলা বেগম জাহিদের সাথেই থাকেন। বাড়ীতে এখন পাকা বাড়ী হয়েছে। তাদের অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। জাহিদ চাকরির পাশে পাশে ব্যবসা করে, বেশ উন্নতি করেছে।
জলিও তিন ছেলে মেয়ে ভালো আছে। জলির ছেলে, এলাকার কলেজে ডিগ্রি ৩য় বর্ষে পড়ছে। আগের চেয়ে রনির আর্থিক অবস্থা অনেক ভালো হয়েছে।
মাঝখান থেকে শাহিদ পড়াশোনা শেষ করিনি। ঢাকা থেকে ফিরে সে লাইব্রেরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। সবাই বলার পর ও আর সে পড়াশোনা শেষ করিনি। বাড়ীতে আলাদা হয়ে সংসার করছে শাহিদ। শাহিদের বউ মাঝারি ধরণের, চলে যাচ্ছে তাদের সংসার। জাহিদ আর নাহিদ সব সময় শাহিদ কে সাহায্য করে চালিয়ে নিচ্ছে। শাহিদের দুই মেয়ে, তারা স্কুলে পড়ছে। বাড়ীতে গেলে সবাই জাহিদের ঘরে উঠলেও শাহিদের বউ আদর আপ্যায়ন করে। রাহেলা বেগম সংসারের শান্তির জন্য আলাদা করে দিয়েছেন। দুই বউ আলাদা থাকলেও ভালো ভাবে যার যার সংসার করছে।
নাহিদ ভালো একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, এক পুত্র নিয়ে সুখে সংসার করছে। সময় পেলেই সবার সাথে দেখা করতে আসে। বাড়ীতে গেলে আগের অনেক স্মৃতি মনে করে দুই বোন, ভাইদের নিয়ে অনেক আনন্দ করে।
প্রায়ই পলিকে ফোন দেন শারমিন। আজ ও ফোন দিয়েছেন, এই পলি তুমি ঢাকায় থাকো, আর আমার বাসায় আসার সময় হয়না?
– কাকে নিয়ে আসবো ভাবী। দুই ছেলে ব্যস্ত, আর আবিদ ছুটি পেলে আসে।
– এখন তো তুমি বড়লোক মানুষ, ঢাকায় ফ্ল্যাট পেয়েছো।
– এটা তো আমার শ্বশুরের বাসা তিনি দিয়েছেন, তাই থাকছি। আমি বড়লোক হলাম কবে?
– আমরা তো আর ঢাকায় ফ্ল্যাট করতে পারলাম না। দুই জনের পড়ার কত খরচ ছিল! তাই ঢাকার বাইরে থাকি। মন পড়ে থাকে ঢাকায়।
– কত্ত বড় বাড়ী করেছো!
– ঢাকায় তো আর পারিনি।এখন দুই ছেলে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার তোমার আলাদা ভাব, তাই গরীবের বাসায় আসো না।
– না, ভাবী কি যে বলো। আসবো, তোমরা আসো।
– হ্যা আসবো। কবে আসবে বলিও আমি তোমার পছন্দ মতো জিনিস রান্না করবো।
– আচ্ছা! আসবো এক সময়।
পলি ছয় তলার ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। ফোনে কথা বলা শেষ করে, দীর্ঘশ্বাস ফেলছে! আহারে এক দিন ভাবীর বাসায় থেকে পড়াশোনা করা সম্ভব হয়নি, এমনকি ডাক্তার দেখাতে যেতে পারেনি। আজ অবস্থার উন্নতি, আর ছেলেদের চান্স পাওয়ার পর ভাবী দাওয়াত দেন। দুই সন্তান প্রতিষ্টিত অথচ একাকিত্ব এখন দুজনের উপর ভর করেছে প্রবল ভাবে।
এক সময় ভাবী আলাদা থেকেছেন এখন কেউ তার বাসায় যেতে চায়না!
শারমিনের পুরোনো অভ্যাস এখনো আছে। তিনি পলি,কলি আর নাহিদ কে দাওয়াত দিলেও এখনো শাহিদ আর জলিকে কখনোই ফোন দেন না, কারণ তারা আর্থিক দিক থেকে দূর্বল। জাহিদ কে মাঝে মাঝে ফোন দেন দরকারে। জাহিদ অবশ্যই কাজ করে দ্রুত ফিরে, কারণ সে জানে ভাবীর সংসারে তাদের জায়গা এখনো হয়নি, আর হবেনা। এটা ভসবীর একান্তই নিজের সংসার।
পলি ভাবছে, ভাবী কি একা থেকেও মানুষ নিয়ে, আত্নীয়-স্বজন নিয়ে ভালো থাকার চিন্তা করবেন না! নাকি চিরকাল এভাবেই থাকবেন।
রাহেলা বেগমের এখন কোন চিন্তা নেই, বিভিন্ন ধরনের অসুখ বাসা করেছে শরীরে। কিন্তু নাতি নাতনীদের সাথে গল্প চলমান। সব সময় বলেন তোমরা মানুষ বড় হও, দেখবা সবাই দাম দিবে। নয়তো কখন হারিয়ে যাবে, বুঝবেনা। তালহা-তামিমের মতো হও, তারা যেমন পড়াশোনায় ভালো, মানুষ হিসেবে ভালো। সব দিক দিয়ে ভালো হও, দেখবে সবাই কাছে ডাকবে আদর করবে। পড়াশোনা করে আবার নিজের মানুষ কে ভুলে যেওনা, তবে কখনোই শান্তি পাবেনা। পড়াশোনার ডিগ্রির সাথে ভালো মানুষ হওয়ার ডিগ্রি নিতে হবে, এটা মনে রাখবে….
সমাপ্ত।
শেষ পর্ব।
আন্নামা চৌধুরী।
৩০.০৩.২০২২
বি.দ্রঃ প্রিয় পাঠক, আপনাদের ভালবাসায়, এই গল্প একান্ন পর্ব পর্যন্ত লেখার সাহস করেছি। আপনাদের এতো এতো ভালবাসায় আমি মুগ্ধ। অনেক সময় নানা কারণে দেরী করেছি এজন্য দুঃখিত। সবাই পাশে থাকবেন। আবারও শীঘ্রই নতুন কোন গল্প নিয়ে হাজির হবো, ভালো থাকুন সবাই।
অরোনী তোমার জন্য গল্পের লিংক
https://kobitor.com/category/uponas/aroni/
নীলার শাশুড়ী গল্পের লিংক
https://kobitor.com/category/uponas/nila/
উইল ইউ ম্যারি মি