ভালোবাসা রং বদলায়
পর্ব ১
মতিন সাহেব যখন বাজারের ব্যাগ নিয়ে ঘেমে নেয়ে বাসায় ফিরলেন, কলিংবেল টিপ দিয়ে খুবই আশ্চর্য হয়ে গেলেন।
উনি হঠাৎ করে আবিষ্কার করলেন তাদের সিঁড়িতে বসে জংলা প্রিন্টের শাড়ি পরা অতি রূপবতী এক কন্যা ফ্যাচর ফ্যাচর করে কান্না করছে। চোখের পানি নাকের পানিতে কাজল লেপ্টে একাকার অবস্থা, সেদিকে কোন খেয়াল নেই।
মতিন সাহেব বিব্রত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলেন, এই মেয়ে কে তুমি ? এখানে বসে কান্না করছো কেন?
দীপা হাতের তালুতে চোখের পানি মুছে হেঁচকি তুলতে তুলতে বললো, আমি দীপা।
বুঝলাম তুমি দীপা।
তা আর কোন জায়গা পাওনি, এখানে বসে কান্না করছো কেন?
কোথায় যাবো?
আমি তো ঢাকা শহরের কিছু চিনি না।
আপনার ব্যাটা বাদল তো আমাকে এখানে রেখে গেল ।
মেয়েটির সরলতায় উনি খুবই অবাক হয়ে বললেন, বুঝেছি।
ভেতরে আসো।
তারপর গলা ছেড়ে হাক দিয়ে ডাকলেন, বাদলের মা দেখো তোমার গুণধর পুত্রের কাহিনী দেখো। মেয়ে বিয়ে দিতে না দিতে ছেলে বউ এনে হাজির।
বাদলের মা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসে বললেন, আমার ছেলে কখনো এমন করতে পারে না। আমার ছেলেকে আমি চিনি। কখনো কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলেও তাকায় না । এটা আমি কখনোই বিশ্বাস করি না । বলেই মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কান্না।
আহা মেয়ে মানুষ গুলোকে নিয়ে এই এক সমস্যা, খালি কথায় কথায় কান্দন ।
এক গ্লাস পানি নিয়ে আসো মেয়েটার জন্য।
পানি পাওয়া মাত্র এক ঢোকে ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে গ্লাসটা রাখা মাত্র মতিন সাহেব বললেন,
এবার বলোতো দেখি ঘটনা কি?
আব্বা আপনার ব্যাটার সাথে কালকে আমার বিয়ে হয়েছে কাজী অফিসে। রাতের ট্রেনে আমরা রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসছি।
ও আমাকে এখানে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল ভিতরে যাও দীপা। আমি একটু কাজ সেরে আসতেছি ।
আমি সাথে সাথে ওর পাঞ্জাবী টেনে ধরলাম, আপনি আমাকে ভেতরে রেখে তারপর যান।
উনি বললেন, দীপা আমার খুব জরুরী একটা কাজ আছে। আমি যাবো আর আসবো।
আমি সেই এক ঘন্টা ধরে এখানে বসে আছি
ওর অপেক্ষায়। ও আসে না।
মতিন সাহেব শক্ত একটা ধমক দিয়ে বললেন, এই মেয়ে কান্না বন্ধ করো। হেঁচকির ঠেলায় তো কথা ও বলতে পারো না ঠিকমতো।
চাকরি বাকরি নাই, বাপের হোটেলে খায় আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বেড়ায়।
এই ছেলেকে তুমি বিয়ে করলে কেন?
দেশে কি ছেলের অভাব পড়েছে নাকি?
কালকে ও আমার হাত ধরেছে তাই।
হাহাহা ইন্টারেস্টিং তো।
হাত ধরেছো জন্য বিয়ে করে ফেললা?
বাদলের মা মাঝখান থেকে কথা বলে উঠলেন।
এই মাইয়ার কথা আপনি বিশ্বাস কইরেন না। এই মাইয়া কোন ফন্দি কইরা আমাগো ঘরে ঢুকতে চায়। নিশ্চয়ই কোন বদ মতলব আছে ।
তুমি চুপ করো তো বাদলের মা।
আমার চুল কি বাতাসে পাকছে।
প্রতিমাসে তোমার ছেলে রাজশাহী যায় কি চেহারা দেখাতে ? আমি কিছু বুঝি না।
দীপা কান্না করবে না একদম। তুমি প্রথম থেকে সবকিছু খুলে বলো। বাদলের সাথে তোমার পরিচয় কিভাবে?
আর কোনো খোঁজ খবর না নিয়ে একেবারে বিয়ে করে ঢাকা চলে আসলে কেন?
দীপা চোখের পানি মুছে একটু নড়েচড়ে বসে বলা শুরু করলো।
পলি আর আমি একসাথে একই কলেজে পড়ি। আমাদের বাসাও পাশাপাশি। পলির বড় ভাই পলাশ ভাইয়া ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে। বাসায় আসে খুব কম।তাই আমি পলির সাথে বেশিরভাগ সময় ওদের বাসায় থাকি। একসাথে বসে পড়াশোনা করি, নোট করি।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও একসাথে বসে নোট করছিলাম আর আচার খাচ্ছিলাম। আমি জানতাম না পলাশ ভাইয়া ঢাকা থেকে আসছে আবার সাথে করে বন্ধু নিয়ে আসছে। আমাকে দেখে বাদল ভাইয়া নিজেই যেচে এসে কথা বলে, নাম জানতে চায়, কি পড়ি, বাবা কি করেন এইসব ।
আমি ও সহজ মনে সব প্রশ্নের উত্তর দেই।
পরের দিন আমি আর পলিদের বাসায় যাই না।
কিন্তু পলি এসে অনেক রিকুয়েস্ট করে আমাকে নিয়ে যায় ওদের বাসায়। বাদল ভাইয়া নাকি খুবই পাগলামি করতেছে আমার সাথে একটু কথা বলার জন্য । পরের দিন ভোরে তারা ঢাকা চলে যাবে, তাই আমার সাথে একটু কথা বলতে চায়।
ভাইয়া অনেক অনুনয় বিনয় করে আমার কাছ থেকে ফোন নাম্বার নেয়। এরপর প্রতিদিন ফোন করে কথা বলে। আমি যদি কথা বলতে না চাই বা ফোন অফ করে রাখি, তাহলে পলিকে ফোন করে ডিস্টার্ব করে। পলি এসে আবার আমাকে বোঝাতে থাকে। এভাবে প্রতিদিন কথা বলতে বলতে আমারও ভালো লাগে ভাইয়ার সাথে কথা বলতে। কথা বলাটা এক সময় আমার অভ্যাসে পরিনত হয়।
মাঝে মাঝে পলাশ ভাইয়ার সাথে বাদল ভাইয়া ও রাজশাহী আসে ।
শুধু মাত্র আমার সাথে দেখা করতে।
দেখা করে, কথা বলে, সব ঠিক ছিলো।
কিন্তু কালকে কথা বলতে বলতে আমার হাতটা চেপে ধরে বলে ,
আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না দীপা।
আমি একদম পড়াশোনা করতে পারছিনা।
বইটা খুললেই বইয়ের পাতায় তোমার মুখ ভেসে ওঠে।
আমি সাথে সাথে কান্না শুরু করলাম, আপনি আমার হাত ধরেছেন কেন?
এখন আমার কি হবে? আপনি আমাকে এখনি বিয়ে করবেন, তা না হলে আমাদের দুজনেরই অনেক পাপ হবে।
আব্বা আপনি বলেন, বিয়ে না করে কি একটা ছেলে একটা মেয়ের হাত ধরতে পারে?
আমরা গরিব হতি পারি, কিন্তু আমার বাবা একজন সম্মানিত মানুষ । গ্রামের একজন নামকরা শিক্ষক। আমরা তিন বোন, কোন ভাই নেই।
আমার আম্মা আমাদের কোথাও যেতে দেয় না। কেউ যেন কখনো আমাদের বোনদের নিয়ে কোন কথা বলতে না পারে আমরা সেভাবেই চলাফেরা করি ।
তা তোমার বাবা এখন টেনশন করবে না, তাকে না জানিয়ে বিয়ে করে এভাবে ঢাকা চলে আসলে?
পলির কাছে বিস্তারিত জানিয়ে একটা চিঠি লিখে এসেছি। আমরা চলে আসার পর পলি নিজের হাতে আমার মায়ের কাছে চিঠি দিয়ে আসবে।
আচ্ছা ঠিক আছে, তারপর বলো
তুমি কান্না করলে আর আমার গুণধর পুত্র তোমাকে বিয়ে করে ঢাকা নিয়ে চলে আসলো !
প্রথমে তো বিয়ে করতে চায়নি আব্বা।
বারবার সরি বলছিলো।
বলছিলো, দীপা আমার ভুল হয়ে গেছে, আমি ভুল করে তোমার হাতটা ধরে ফেলেছি ,মাফ করে দাও প্লিজ। আর কখনো আমার এমন ভুল হবে না।
আর কোনদিন ভুল করেও আমি তোমার হাত ধরবো না ।
কিন্তু আমি এমন কান্না শুরু করলাম ।
সেই কান্না দেখে বাদল ভাই দিশেহারা হয়ে গেলো।
এক হাজার এক টাকা কাবিনে আমাকে বিয়ে করে। বিয়ে করার পর বলে দিপা আমি তো তোমাকে বিয়ে করেছি তাই না ?
এখন পলির সাথে বাসায় চলে যাও।
আব্বা আপনি বলেন এটা কেমন কথা!
বিয়ে করে বউকে কয় বাবার বাড়ি যাও।
আমিতো নাছোড়বান্দা আমি কিছুতেই আর আমাদের বাসায় যাবো না ।
আমি বললাম আমি আপনার বিয়ে করা বৌ। এখোন থেকে আমি আপনাদের বাসায় থাকবো। আপনার সাথে ঢাকা যাবো।
আব্বা আপনি বলেন, বাসায় আমার ছোট দুটো বোন আছে। আমি কিভাবে বাসায় যাই ?
এদিকে বাদল ভাই খালি নিজের মাথার চুল টানে আর বলে পলাশ একটু বোঝা দোস্ত ।
আমি কোন পাগলের পাল্লায় পরলাম ।
আব্বা তো আমাকে জবাই করে ফেলবে, মেরে তক্তা বানিয়ে ঘর থেকে বাহির করে দিবে।
মতিন সাহেব শব্দ করে হেসে উঠলেন, হা হা হা।
আব্বা আপনি হাসতেছেন কেন?
আমি কি ভুল করছি।
না না তুমি একদম ঠিক কাজটাই করেছো।
বাদলের মা এবার যদি তোমার গাধাটা মানুষ হয়।
তোমার খিদা লাগছে কিছু খাবা ?
জ্বী আব্বা, খুব খিদা লাগছে।
হা হা হা ।
ওকে কিছু খেতে দাও বাদলের মা।
তারপর বাজার গুলো গোছাও।
আর ওকে বাদলের রুমটাও দেখিয়ে দিও।
দীপা খেতে খেতে বলে উঠলো, আলু ভাজিটা খুব মজা হয়েছেআম্মা।
রুটির সাথে আলু ভাজি আমার খুব পছন্দের খাবার।
এই মেয়ে খবরদার আমাকে আম্মা ডাকবে না।
আগে আমার ছেলে বাসায় আসুক। ও যদি স্বীকার করে তবে আমাকে মা ডাকবা।
মতিন সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, তোমার ছেলে আজকে সারাদিনে আর চেহারাও দেখাবে না বলে রাখলাম। ওর আশা ছেড়ে দিয়ে মজা করে দুই কাপ চা বানাও আমার আর দীপার জন্য।
এখন আবার চা খেতে হবে!
এতগুলো বাজার আনছেন, মাছটাও কেটে আনেননি।কখন মাছ কাটবো আর কখন এগুলো গোছাবো? এগুলো গুছিয়ে রান্না বসাতে বসাতে আজকে দিন শেষ হবে। তার ওপরে সাতসকালে এই মেয়ে এসে শুরু করেছে আরেক নাটক।
এখন আবার চা খেতে চায়! আমি কখন কি করবো,
একটু বলো?
এই শুরু হলো কচকচানি। থাক চা বানাতে হবে না।
আম্মা আপনি চিন্তা করবেন না। আমার খাওয়া শেষ। আমাকে সবকিছু দেখিয়ে দেন ।
আমি করে ফেলব সবকিছু ।
আপনি শুধু এই চেয়ারটায় বসে বসে দেখেন ।
এখন চায়ের সরঞ্জাম কোথায় কি আছে একটু দেখিয়ে দেন, আমি ঝটপট চা টা বানিয়ে দেই।
বাদলের মা রান্না ঘরে ঢুকে হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিল, এখানে সবকিছু আছে।
এই নাও তোমার চা পাতা, দুধ, চিনি আর ওই সেলফে কাপ পিরিচ আছে।
দীপা ঝটপট চা বানিয়ে প্রথমে তার শাশুড়ি মায়ের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিলো
আমাকে আবার দিচ্ছো কেন?
তোমরা বউ শশুর মিলে খাও।
আমার লাগবে না, আমি সকালে একবার চা খেয়েছি।
মতিন সাহেব চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন, কিছু হবে না খাও খাও বাদলের মা, মজা হয়েছে।
তাছাড়া মেয়েটা শখ করে বানিয়েছে।
সব সময় তো নিজে কষ্ট করো । এমন হাতে তুলে তোমাকে কেউ খাওয়াবেনা বুঝছো।
বাদলের মা চা খেতে খেতে অবাক হয়ে দেখল, বাচ্চা মেয়ে টা চা খেতে খেতে সুন্দর করে ঝটপট বাজারগুলো গুছিয়ে ফেললো। চা শেষ করে বসে পরলো মাছ কাটতে।
উনি হায় হায় করে উঠলেন।
এই মেয়ে এত বড় রুই মাছটা নষ্ট করবে নাকি? সরো সরো আমি কাটছি। তোমাকে কাটতে হবে না ।
শেষে পুরো মাছটাই নষ্ট হবে ।
আম্মা আপনি শুধু দেখিয়ে দেন পিচগুলো কেমন হবে। আমি কাটতে পারব।
বাহ্ মেয়ের তো দেখি বেশ গুন আছে। ঝটপট কতো সুন্দর করে এত বড় মাছটা কেটে ফেললো!
মুখে কিছু না বললেও মনে মনে খুশি হলেন বাদলের মা।
উনি দেখলেন, একহাতে সব কেটে ধুয়ে রান্নাও বসিয়ে দিলো।
দুই চুলায় ভাত আর ডাল বসিয়ে, মাছে হলুদ, মরিচ, লবণ মাখিয়ে রেখে, সুন্দর করে পটল গুলো কেটে ফেলল। আবার দেখি সুন্দর করে চিকন চিকন করে পটল গুলো কেঁচতেছে।
এই মেয়ে পটল এমন কুচিকুচি করে কেঁচো কেন?
আম্মা আপনি শুধু দেখেন আমি কিভাবে করি। এভাবে পটল ভাজা খুব মজা হয়।
দীপার শাশুড়ি চুপচাপ বসে বসে দেখতে লাগলো মেয়েটার কাণ্ডকারখানা।
আম্মা আমার তো রান্না প্রায় শেষ পর্যায়ে, আপনি গোসল করে নামাজটা পড়ে ফেলেন। আমি রান্না শেষ করে টেবিলে খাবার গুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখে গোসল করতে যাবো।
ঠিক আছে আমি গোসল করতে গেলাম তাহলে।
তুমি গোসল করে পরবা কি?
আসছো তো এক কাপড়ে।
দীপা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো।
আচ্ছা ঠিক আছে আমি কঙ্কার জামা বের করে বাদল রুমে রেখে যাচ্ছি, তুমি রান্না শেষ করে কংকার জামা পরো।
ঠিক আছে আম্মা।
গোসল নামাজ শেষ করে খেতে বসে দীপার শশুর শাশুড়ি পুরাই সারপ্রাইজ। এতো অল্প সময়ে পটল ভাজা,মাছ ভূনা,ঘনো ডাল আর ঝরঝরে সাদা ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত।
অনেক সুন্দর করে টেবিলের সব খাবার সাজিয়ে রেখেছে। দেখতে বেশ ভালো লাগছে।
মতিন সাহেব হাক ছেড়ে ডাকলেন। কোই গো দীপা মা, তোমার হয়েছে?
আসো খেতে আসো। খিদা লাগছে অনেক ।
বাবা এই তো আমি আসছি। আপনারা বসেন, আমি তুলে দেই। আপনার ব্যাটা আসলে পরে আমরা একসাথে খাবো।
আমরা তুলে নিয়ে খেতে পারি। তুমিও আমাদের সাথে বসো, একসাথে খাই।
ঐ গাধার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। ও আজকে আর সহজে ঘরে ঢুকবে না।
বাদলের মা দেখছো পটল ভাজা টা কত মজা হয়েছে। এভাবে তো আগে কখনো খাইনি। বাহ্ মাছটাও খুব মজা হয়েছে। অনেকদিন পর এমন তৃপ্তি করে ভাত খেলাম।
দীপার শাশুড়ি এমন একটা তাকান্তি দিলো।
তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, কি বললা? আবার বলো!
তারমানে এতদিন তুমি কষ্ট করে খেতা।
আমার রান্নায় তোমার তৃপ্তি মেটে না?
মতিন সাহেব গোগ্রাসে গলাধঃকরণ করতে করতে মনে মনে বললেন, এই সেরেছে!
আজ মনে হয় ঘরে আগুন লাগলো!
চলবে….
ভালোবাসা রং বদলায় গল্পের সবগুলো পর্ব একসাথে