ভালোবাসা রং বদলায়
পর্ব ৩
রোকেয়া পপি
দীপা রান্না শেষ করে গোসল সেরে নামাজ পড়তে বসেছে। সালাম ফিরিয়ে দেখে তার শাশুড়ি মা চিন্তিত মুখে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
দীপাকে সালাম ফেরাতে দেখেই উদ্বিগ্ন স্বরে বললো, দীপা কংকা তো এখনো আসলো না মা।
ফোন দেই, রিং হয়, ধরেও না।
মা আপনি টেনশন কইরেন না, এখনই হয়তো চলে আসবে। বলতে না বলতে কলিং বেল। ওই যে আসছে মনে হয় মা, দরজা খোলেন যান।
এতো দেরী করলি কেন মা? বলেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্না।
আহ্ কি করছো মা!
আগে ভেতরে ঢুকতে দাও। বসতে দাও।
ড্রাইভারের হাত থেকে জিনিসপত্রগুলো নাও।
ছয় মাস পর তুই আসলি, আমার কি তোকে দেখতে ইচ্ছা করে না ?
জামাই বাবাজি কোথায়? তুই একা কেন?
ওর সময় নেই মা।
আজকে জরুরী মিটিং আছে। ও আসতে পারবেনা। আমি ওর সাথে একসাথেই বেরিয়েছি সকালে।
যমুনা ফিউচার পার্কে গেছিলাম।
শপিং করলাম তোমাদের বৌমার জন্য। তাই দেরি হয়ে গেল। কোই ভাবি কোথায়? ভাবিকে ডাকো।
দীপা হালকা করে মাথায় কাপড় দিয়ে এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে সামনে আসলো।
দীপাকে দেখে কঙ্কার চোখ ছানাবড়া।
সে তার বিস্ময় গোপন না করেই বললো,ওমা! কি সুন্দর!
ভাইয়ার তোর পছন্দ আছে দেখছি।
এসো দীপা বসো, আমার পাশে বসো।
শরবতে চুমুক দিয়ে মায়ের দিকে ফিরে কঙ্কা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলো, কেমন আছো মা?
আর থাকা।
এই বয়সে সবাই যেমন থাকে তেমনি আছি।
মতিন সাহেব মেয়ের কন্ঠ শুনে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন।
কেমন আছিস মা?
কঙ্কা উঠে বাবাকে সালাম করল। ভালো আছি বাবা। তুমি কেমন আছো?
আছি আলহামদুলিল্লাহ ভালো ।
বয়সকালে আর কেমন থাকবো ?
বেলা তো অনেক হয়েছে। চলো খেতে চলো।খাওয়া-দাওয়া করে তারপর গল্প করবা।
কঙ্কা তৃপ্তি করে খেতে খেতে বললো, সবগুলো আইটেম খুব মজা হয়েছে। নিশ্চয়ই দীপার রান্না?
দীপার মা মৃদু হেসে বললেন, রোস্টটা শুধু আমি করছি ।
বাকি সব আইটেম দীপাই করছে।
মা তোমার তো আর চিন্তা নাই। মনের মত একটা বউ পাইছো, এখন থেকে পায়ের উপর পা তুলে আরাম করবা।
**************************
খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই ড্রয়িং রুমে বসেছে।
দীপা সেই ফাঁকে সবার জন্য চা করে আনছে।
কঙৃকা ব্যাগ থেকে থ্রিপিস গুলো বের করে দীপার হাতে দিলো।
থ্রিপিস গুলো দেখোতো তোমার পছন্দ হয় কিনা?
দীপা আনন্দে ঝলমল করে বললো, সব গুলো খুব সুন্দর হয়েছে। কিন্তু এতগুলো থ্রিপিচ কেন আনছেন?
এতগুলো দেখলে কোথায়?
মাত্র ছয়টা।।
ভাইয়া এই স্লিপটা রাখ। স্লিপটার মধ্যে ঠিকানা দেওয়া আছে। এখানে আমি সবসময় বানাই ।
নিউ মার্কেটের এই দোকানটা খুব ভালো বানায়।
আমি বিল ও পে করে রাখছি। তুই শুধু ভাবিকে নিয়ে যেয়ে মাপটা দিয়ে আসবি।
প্রথমে শাড়ি কিনতে চাইছিলাম, পরে চিন্তা করলাম থ্রিপিচ টাই তোমার কাজে লাগবে বেশি।
পরে কোন অকেশনে না হয় সুন্দর দেখে শাড়ি দিব।
তারপর দীপাকে কাছে ডেকে বললো, দেখি এদিকে আসো, কাছে আসো। এগুলো সবসময় কানে কানে গলায় পরে থাকবে, কখনো খুলবে না।
দীপা চুড়ান্ত রকমের অবাক হয়ে বললো, এগুলো কি করতেছেন!
আমর এগুলো লাগবে না। এতকিছু কেন দিচ্ছেন ?
হালকা একটা ছোট্ট চেইন আর কানের টবটাও ছোট। আমার একমাত্র ভাই বৌ কে আমি দিবোনা!
অনুষ্ঠান করে বিয়ে হলে তো অনেক ভারি সেট দিতাম।
এখন যাও, আমার জন্য খুব ভালো করে আরেক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসো। এতো ভালো চা এক কাপে পোষায় না। চা খেয়ে বিদায় হবো।
দীপার শাশুড়ি মা প্লেট ভরে মিষ্টি নিয়ে আসলেন। মিষ্টি দেখেই কঙ্কা নাক কুঁচকে বললো,
মিষ্টি খাবো না মা।
শুধু চা খাবো। পেট একদম ভরা।
মিষ্টি খাবি না, তাহলে এত মিষ্টি আনছিস কেন? কে খাবে এত মিষ্টি ?
ফিরনি টা খেয়ে দেখ, দীপা শখ করে রান্না করছে। ফিরনি টা খুব মজা ও হয়েছে।
হুম চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব মজা হয়েছে।
অল্প করে দাও তাহলে।
দীপা তোমার ফিরনি রান্না খুব ভালো হয়েছে।
চা টাও খুব ভালো বানিয়েছো। আরেকদিন আসবোনি তোমার হাতের চা খেতে।
আজকে তাহলে আসি মা।
তোমরা ভালো থেকো।
কঙ্কার যাওয়ার সময় ওর মা একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিলো মেয়ের হাতে।
কঙ্কা অবাক হয়ে বললো, আরে এগুলো কি করছো! বক্স এর ভিতরে কি?
জামাইয়ের জন্য সবকিছু দিয়ে দিলাম একটু একটু করে।
লাগবে না মা। বাসায় বাবুর্চি আছে। সারাদিন কতো আইটেম রান্না হয়। আমার শাশুড়ি এগুলো দেখলে নাক সিটকাবে।
কষ্ট করে টেনে নিয়ে যাবো, আবার কথা ও শুনবো।
সব ফ্রিজে ঢুকাও । কালকে সারাদিন রান্নাবান্না করার কোন দরকার নেই। শুধু ভাত রান্না করলেই হবে।
সব গরম করে খাবে।
আর ভাইয়া শোন। কাল সারাদিনের জন্য ভাবি কে নিয়ে মার্কেটে ঘুরবি। ভাবির নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস যা যা দরকার সব কেনাকাটা করে নিয়ে আসবি।
কাল সারাদিন বাইরে খাবি, ঘুরবি, মুভি দেখবি। তোর হাতে টাকা পয়সা আছে কিছু?
বাদলের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ব্যাগের চেন খুলে একটা খাম বের করে সামনে ধরলো।
এই টাকাটা রাখ।
বাদল অপ্রস্তুত হয়ে বললো, না না লাগবেনা।
আমার কাছে টাকা আছে। আমি দুইটা টিউশনি করাই না?
তবুও রাখ, দুজন মিলে প্রথম বাইরে যাবি, মজা করিস। ভাবির যা যা পছন্দ হয় সব কিনে দিস।
আসি আল্লাহ হাফেজ। তোমরা সুযোগ পেলে যেও আমাদের বাসায়।
কঙ্কার গলা ব্যাথায় বুজে আসছে। চোখ ভিজে উঠতে চাইছে। কিন্তু সে কিছুতেই এ পানি কাউকে দেখাতে চায় না।
সে মাথা নিচু করে দ্রুত বের হয়ে গেল।
***************************************
এক সপ্তাহ পরের ঘটনা। দুপুর বারোটার দিকে হঠাৎ দীপার বাবা এসে হাজির। এভাবে হঠাৎ বাবাকে পেয়ে দীপা কিছুক্ষণের জন্য স্ট্যাচু হয়ে গেল।
তারপর বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না! বাবা মেয়ের কান্নাকাটি পর্ব শেষ হলে এক গ্লাস লেবুর শরবত আর কঙ্কার আনা মিষ্টি দিলো বাবাকে খেতে।
ওর মা বেশ কয়েক রকম পিঠা বানিয়ে দিয়েছে। সেগুলো গোছাতে গোছাতে শুনলো
ওর শাশুড়ি মা বলছে, তারপর এতদিন পর কি মনে করে বেয়াই সাহেব ?
একদিনো তো ফোন করে মেয়ের খোঁজ নিলেন না। মেয়েটা না হয় ভুল করছে, তাই বলে আপনারা খোঁজখবর নিবেন না?
কোথায় আছে কি করছে জানবেন না!
দীপার বাবা লজ্জায় হেট হয়ে মাথা নিচু করে ফেললো।
নিচু স্বরে বললো।
বেয়াইন সাহেবা, মেয়েটা যে এমন করবে, তা কখনোই বুঝিনি।
আমরা অনেক কষ্ট পাইছি।
যাক বাদ দেন, যা হবার হয়েছে। দীপার মা তো দীপা দীপা করতে করতে বিছানায় পড়ছে। তার এক কথা মেয়েটা কোথায় আছে নিজের চোখে দেখে আসেন। পলাশের কাছ থেকে বাসার ঠিকানা নিয়ে আসলাম দেখতে।
ঠিক আছে আপনি হাতমুখ ধুয়ে রেস্ট করেন। বাদল তো ভার্সিটিতে গেছে, চলে আসবে দুপুরে। আর ওর বাবাও একটু কাজে বের হয়েছে। বিকাল হবে হয়তো আসতে। দীপা তোমার বাবাকে গেস্ট রুমে নিয়ে যাও।
আম্মা কি রান্না করবো দুপুরে?
কি রান্না করবা, ফ্রিজে দেখো একটা ফার্মের মুরগি আছে। ওটা ভিজাও। আর ডাল করো। অর্ডার দিয়ে উনি তার রুমে চলে গেলো।
দীআর মনটা প্রচন্ড রকম খারাপ হয়ে গেলো। সে জানে তার আব্বা কখনো ফার্মের মুরগি খায়না। কিন্তু সে সাহস করে কিছুই বলতে পারলো না।
ফ্রিজে কতবড়ো রুই মাছ আর মাছের মাথা আছে। দীপার খুব ইচ্ছা করছে রুই মাছ রান্না করতে। তার আব্বা বড়ো মাছ, মাছের মাথা খুব পছন্দ করে।
ওদের বাসায় সহজে বড় মাছ আনা হতো না।ওরা নিয়োমিত ছোট মাছ খেতো। যেদিন ওদের আব্বা বাজার থেকে বড় মাছ নিয়ে আসতো, সেদিন ওদের খুব আনন্দ হতো। ওদের তিনবোনের নজর থাকতো মাছের বড় মাথাটার দিকে।
কিন্তু ভাত খেতে বসে ওদের আম্মা যখন মাছের মাথাটা ওদের আব্বার পাতে তুলে দিতো, আব্বা তখন মাথাটা ভেঙে ওদের তিন বোনকে ভাগ করে দিতো।
দীপার হৈ হৈ করে উঠতো।
আরে কি করেন, কি করেন , আপনি খান তো ।
সব সময় খালি মেয়েদের আদর করে খাওয়ান। আপনারও খাওয়া দরকার আছে।
আব্বা তখন হাসতে হাসতে বলতেন,
খাক, আমার মা জননীরা খাইলেই আমার পেট ভরবে। আমি যখন আমার মা জননীদের শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে যাবো। তখন আমার মা জননীরা আমাকে বড় মাছের মাথা খাওয়াবে । কি খাওয়াবা না মা জননীরা?
ওরা তিন বোন তখন হেসে গড়াগড়ি খেতো আর বলতো খাওয়াবো আব্বা, সবচেয়ে বড় মাছের মাথাটা এনে আপনাকে খাওয়াবো।
দীপার চোখে কষ্টের নোনা জল জমতে শুরু করেছে।যেনো এখনই বৃষ্টি হয়ে নেমে পড়বে!
চলবে…..