কোথাও কেউ ভালো নেই
পর্ব ১০
বাড়িতে আসার পর থেকে পূরবীর মাথা ধরে রইলো।পূরবীর মনে হচ্ছে সব কিছু যেন ওর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সুরভীর পুরো শরীরে মারের দাগ।কালসিটে পড়ে গেছে। পূরবী পরম মমতা নিয়ে পেইন রিলিফ মলম লাগিয়ে দিলো বোনের সারা শরীরে। সুরভী বোনের কোলে মাথা রেখে নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে। একটু সময় পর সুরভী বললো,”বুবু,আমি আর বাড়িতে যাবো না।এবার ছোট মা’র হাতের মুঠোয় গেলে আমাকে জীবিত রাখবে না আর।”
পূরবী শক্ত করে বোনের হাত চেপে ধরে বললো, “কিচ্ছু হবে না তোর,তোকে আর যেতে হবে না ওই বাড়িতে। ওই বাড়িতে আমাদের কেউ নাই এখন আর।”
সুরভী আরো শক্ত করে বোনকে জড়িয়ে ধরলো। পূরবী দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে ভাবতে লাগলো, একটা মাত্র জীবন। অথচ সেই জীবনে কতো তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে ওর।বেঁচে থাকাটাই এখন বিস্ময়কর লাগছে পূরবীর কাছে।
মাথার উপর থেকে মা একজন চলে গেলে মানুষের জীবন কতো ছন্নছাড়া হয়ে যায় তা পূরবীর চাইতে ভালো আর কে জানে?
মাগরিবের কিছু সময় আগে তানভীর বের হলো বাজারের উদ্দেশ্যে। সুরভীর জন্য কিছু কেনাকাটা করবে।আগামীকাল সুরভীকে হোষ্টেলে দিয়ে আসবে।তাই টুকটাক যা লাগবে সব কিনে দিতে চাচ্ছে তানভীর।
মাগরিবের নামাজের পর বৃষ্টি শুরু হলো। শুধু বৃষ্টি না,সেই সাথে শুরু হলো তুমুল বজ্রপাত। বাতাসের তীব্রতায় গাছপালা ভেঙে পড়ছে।গাছের কাঁচা আম সব টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে বাতাসের দাপটে।বিদ্যুৎ চলে গেলো সাথেসাথে।
রুমের সোলারের লাইট অন করে পূরবী সুরভীকে জড়িয়ে ধরলো।
সুরভীর গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। পূরবীর ভীষণ ভয় করলো।তানভীর বাড়ীতে না থাকায় পূরবীর ভয় আরো বেড়ে গেলো। কাকে ডেকে বলবে সে সুরভীর জ্বরের কথা।আর এরা যেমন মানুষ কেউ এগিয়ে আসবে না।সুরভী জ্বরের ঘোরে আজেবাজে কথা বলতে শুরু করলো।
পূরবীকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বললো,”মা আসছে বুবু,মা ডাকছে আমাকে।বুবু,মা কি যে সুন্দর হয়ে গেছে।
ও মা,মা……
না না,কোনো কথা নাই তোমার সাথে তুমি কেনো আমাদের রেখে চলে গেলে এতো তাড়াতাড়ি?
আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দাও না মা।কতোদিন তোমার গায়ের গন্ধ পাই না আমি।”
পূরবী চিৎকার করে কাঁদলো এসব শুনে।সুরভী খামচে ধরলো পূরবীকে।পূরবী সুরভীকে ছেড়ে দিয়ে শাশুড়ীর রুমের দরজায় পাগলের মতো নক করতে লাগলো।
ঝড়ের শব্দে রেবেকা প্রথমে শুনতে পেলো না।কিছুক্ষণ পরে যখন শুনলো বাহিরে কেউ ডাকছে।
শীতল হাওয়ায় রেবেকার চোখে তন্দ্রা লেগে এলো।পূরবীর মা মা বলে ডাক রেবেকার কাছে যথেষ্ট বিরক্তিকর লাগলো।
যাকে দেখতে নারি,তার চলন বাঁকা।
তাই পূরবীর আকুল গলায় মা বলে ডাকা ও যেনো রেবেকার মন বিষিয়ে তুললো।আরামদায়ক উষ্ণতা ছেড়ে গিয়ে দরজা খুলে কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করলো,”কী সমস্যা,এতো চেঁচাচ্ছ কেনো এই সন্ধ্যায়?”
ভয়ার্ত গলায় পূরবী বললো,”আমার বোনটার ভীষণ জ্বর উঠেছে মা,ও প্রলাপ বকছে।আমি কী করবো এখন?
আপনি একটু কিছু করুন না মা।আমাকে বলে দিন আমি কি করবো এখন।”
রেবেকার রাগ তুঙ্গে উঠে গেলো। কথায় সেই রাগ লুকানোর চেষ্টা না করেই যথেষ্ট রাগী গলায় রেবেকা বললো,”আমি কি ডাক্তার না-কি?
আমার কাছে কোনো ঔষধ নাই,বৃষ্টি থামলে দেখা যাবে তখন।”
পূরবী আর কথা বলার সুযোগ পেল না।রেবেকা দরজা বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে পড়লো। পূরবী কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।তারপর হঠাৎ করেই মনে পড়লো লেবু সিদ্ধ পানি খাওয়ানোর কথা। পূরবীর মা বেঁচে থাকতে জ্বর জলে লেবু সিদ্ধ করে পানি খাওয়াতো,এতে বেশ উপকার পাওয়া যায় জ্বরে।
পূরবী ছুটলো তখন রান্নাঘরের দিকে।অন্ধকার রান্নাঘরে ঢুকে পূরবী খেই হারিয়ে ফেললো। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় পূরবী কোনো কিছু খুঁজে পেলো না।রান্নাঘরে সোলারের লাইট না থাকায় পূরবীর জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে গেলো সব কিছু খুঁজে পাওয়া।হাতড়ে হাতড়ে ফ্রিজ খুঁজে বের করলো। লেবু দুটো বের করে বটি অথবা চুরি খুঁজলো হাতড়ে হাতড়ে।
ভাগ্য বিরূপ হলো পূরবীর। খাঁড়া করিয়ে রাখা বটি অন্ধকারে পূরবী দেখলো না।পায়ে লেগে গেলো বটির তীক্ষ্ণ ফলা।মুহুর্তেই রক্তারক্তি শুরু হয়ে গেলো।
পূরবীর সেসব খেয়ল নেই,আগে সুরভীর কথা ভাবতে হবে তার।সেই বটি তুলে নিয়ে সিংকে ধুয়ে লেবু টুকরো করে নিলো।তারপর সিংকের উপর থেকে একটা ছোট পাতিল নিয়ে লেবু সিদ্ধ করলো।চুলার আগুনের আলোয় দেখলো পা থেকে রক্ত বেরুচ্ছে।
একটা কাপে লেবুর পানি নিয়ে বের হলো নিজের রুমের দিকে।
রুমের সামনে যেতেই শুনলো সদর দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে।তানভীর এসেছে ভেবে গিয়ে দরজা খুললো পূরবী। দরজা খুলে দেখে বাহিরে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। সাথে সালমা দাঁড়িয়ে আছে।
ভয়ে পূরবীর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। তানভীর বাড়িতে নেই,তমিজ মিয়া ও বাড়িতে নেই।চাঁদমোহর থানার ওসি সালমার খালাতো ভাই। সালমা থানায় গিয়ে লিখিত অভিযোগ করেছে তানভীরের বিরুদ্ধে।
পূরবীকে দেখে সালমার মুখ থেকে একটা নোংরা গালি বের হয়ে এলো। সুরভী না থাকলে ঘরের সব কাজ সালমার করতে হবে,আজকালকার দিনে কাজের মেয়ে পাওয়া গুপ্তধন পাওয়ার চাইতেও দূরুহ কাজ।সেই হাতের লক্ষ্মীকে সালমা কিভাবে পায়ে ঠেলবে?
সুরভীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাই সালমা এতো দূর এগিয়েছে।
ওসি কামরুল ইসলাম পূরবীর দিকে তাকালো লোভাতুর দৃষ্টিতে। সন্ধ্যা বেলার ঘরের এই হালকা আলোয় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুতি শাড়ি পরা মেয়েটিকে মনে হচ্ছে অপ্সরা।চোখের জলে দুচোখের কাজল লেপ্টে আছে,ফোলা ফোলা চোখ দুটো,এলোমেলো চুলের খোঁপা,শাড়ির ফাঁকে বের হয়ে থাকা বাঁকা কোমর কোনোটাই কামরুলের দৃষ্টি এড়ালো না।
ফিসফিস করে সালমাকে বললো,”এরকম তাজা একটা ফুল তোর বাড়িতে ছিলো আমাকে জানালি মা তুই?”
সালমা চিমটি কেটে বললো,”ছোটটাও বড়টার মতোই,ছোট বলে এখনো নজরে পড়ছে না।”
পূরবী থরথর করে কেঁপে উঠে বললো,”ছোট মা,আপনি….? “
কামরুল বললো,”মিসেস সালমা আহমেদ আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন ওনার ছোট মেয়েকে আপনারা জোর পূর্বক তুলে এনেছেন ওনার বাড়ি থেকে।সেই সাথে আপনার স্বামী তানভীর হোসেন ওনার বাড়িতে ভাঙচুর করেছে,খুন করার হুমকি দিয়েছে।আমরা তানভীর সাহেবকে এরেস্ট করতে এসেছি এবং সুরভীকে নিয়ে যেতে এসেছি।”
পূরবীর মনে হলো একে একে সাত আসমান যেনো ওর মাথায় ভেঙে পড়ছে।
কি সব কথা বলছে এই লোকটা?কামরুল সবাইকে নিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেলো পূরবীর অনুমতি না নিয়েই।তারপর পূরবীর রুম থেকে গিয়ে সুরভীকে তুলে নিলো কামরুল।
পূরবী ছুটে গিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করে দিলো।পাগলের মতো চিৎকার করে বললো,”আমার বোনকে কোথাও নিবেন না।ও আমার প্রাণ।ওকে উনি খুন করে ফেলবে।”
কামরুল হেসে বললো,”ম্যাডাম,আমাদের কাছে অভিযোগ আছে।সুরভীর অভিভাবক আপনি না।সুতরাং আপনার কোনো অধিকার নেই ওকে আটকে রাখার এখানে।তানভীর সাহেবকে তো আজ পেলাম না,আমরা আগামীকাল আবার আসবো।”
হতভম্ব পূরবীকে সেখানে রেখেই সালমা পুলিশসহ চলে গেলো সুরভীকে নিয়ে। অচেতন সুরভী জানতেও পারলো না কোথায় যাচ্ছে এখন,কে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।
তুমুল ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে সুরভীকে নিয়ে চলে গেলো। পূরবী তখনো মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তারপর কখন যেনো পূরবী জ্ঞান হারালো তা পূরবী নিজেও জানতে পারলো না।হাত থেকে কাঁচের কাপ পড়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হলো।
পা থেকে রক্ত বের হয়ে রক্তে ভেসে গেলো পূরবীর পরনের শাড়ি।এতোগুলা মানুষ একটা ঘরে থাকার পরেও কেউ জানলো না কি হয়ে গেলো।
তানভীর বারবার কল দিতে লাগলো পূরবীকে।সুরভীর আজুতার সাইজ কতো তা জানার জন্য। কিন্তু পূরবী কল রিসিভ করলো না।বৃষ্টি থামলো রাত নয়টার দিকে। তানভীর বাড়িতে এসে দেখে সদর দরজা হাট করে খোলা,পূরবী দরজার সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। পাশেই ভাঙা কাঁচের টুকরো।
কেটে যাওয়া পা থেকে রক্ত বের হয়ে হলুদ শাড়ি এখন খয়েরী রঙের হয়ে গেছে।
বারকয়েক সুরভীকে ডাকলো তানভীর কিন্তু সাড়া পেলো না।প্রকৃতির ঝড় থেমে গেলেও সুরভীর জীবনে যে ঝড় উঠেছে তা যে থামে নি তা কি তানভীরের ধারণা ছিলো!
কখনো কি ভেবেছে কেউ!
চলবে…….
জাহান আরা