কোথাও কেউ ভালো নেই
১৫ ও শেষ পর্ব
পৌষের এক কুয়াশাজড়ানো সকাল।কুয়াশার ঘন আস্তরনের জন্য এক হাত দূরের জিনিস ও দেখা যায় না।উত্তরের বাতাসে সকলের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে।
হিমেল বাতাস দোল খেয়ে যায় কুয়াশা মাখা সরষে ক্ষেতে।টুপটুপ করে কুয়াশা ঝরে পড়ছে।
সূর্য উঠার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।বাড়ির সবাই আরামদায়ক ঘুমে তলিয়ে আছে।ঘুম নেই রাহেলা আর পূরবীর। রাহেলা উঠে বাসি বাসন ধুঁতে বসে গেলো।
পূরবী বের হলো ঝাড়ু নিয়ে।গত ৫-৬ মাস ধরে রেবেকার কড়া নির্দেশ পূরবীকে সকালে উঠে সব কাজ করতে হয় রাহেলার সাথে।
এক নিরব অভিমানে পূরবী তানভীরকেও কিছু জানালো না এসব নিয়ে।
পূরবী মেনে নিলো তার ভাগ্যটাই এরকম।এই পোড়া কপালে কি আর সুখ সইবে নাকি!
পূরবীর ঝাড়ু দেয়ার মধ্যেই একটা রিকশা এসে থামলো উঠোনে। মাথায় উড়না টেনে দিয়ে পূরবী জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে তাকালো রিকশার দিকে।
তারপর!
তারপর কি হলো পূরবী জানে না।পূরবীর মনে হলো সে যেনো স্বপ্ন দেখছে।মাথায় টুপি,গায়ে ব্ল্যাক হুডি,পিঠে ব্যাগ।
তানভীর দাঁড়িয়ে আছে উঠোনে। পূরবী কি করবে বুঝতে পারছে না। সে কি সামনে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিবে নাকি সবাইকে ডাকবে।
পূরবীর মনে হলো সে যেনো পাথরের মতো জমে গেছে। এক পা সামনে এগুনোর শক্তি ও নেই।
তানভীর এগিয়ে এলো। এসে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো পূরবীকে। শক্ত হাতের বন্ধনে পূরবীর মনে হলো দম বন্ধ হয়ে যাবে।পূরবী মনে মনে প্রার্থনা করলো,”এই আলিঙ্গনেই যেনো তার মৃত্যু হয়।এর চাইতে সুখকর মৃত্যু আর কিছু হবে না”
তানভীর ঘাড়ে একটা চুমু খেলো পূরবীর।শিউরে উঠলো পূরবী শিহরণে। তানভীর রিকশা ভাড়া মিটিয়ে রিকশা বিদায় করলো।নিজের লাগেজ দুটো নামিয়ে পূরবীর হাত থেকে ঝাড়ু ফেলে দিয়ে পূরবীকে নিয়ে ঘরে গেলো।
রেবেকার কাঁচা ঘুম ভেঙে গেলো চিৎকার শুনে।তানভীরের গলার স্বর শুনে রেবেকার মনে হলো স্বপ্ন দেখছে কিন্তু স্বপ্ন না বাস্তব বুঝতে পারলো যখন রাহেলা এসে বললো,”তানভীর ভাইজান আসছে খালাম্মা। “
রেবেকা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো বিছানায়।তানভীর আসছে?
তানভীর কই থেকে আসবে এই সাতসকালে?
আর মালয়েশিয়া থেকে তানভীর আসলে রেবেকাকে বলতো না আগে?
কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে চলে এলো কিভাবে তানভীর?
রেবেকার রাগ আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো। সব পূরবীর চক্রান্ত বলে রেবেকার মনে হলো। রেবেকা উঠে গেলো বাহিরের দিকে।ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আনিকা,মিম,তারিন,তারেক,তুহিন,তৌসিফ,রাহেলা সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তানভীর মা’কে সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। রাগে রেবেকা সরে দাড়ালেন।তারপর বললেন,”এভাবে চলে এলি,একবার জানানোর ও প্রয়োজন মনে করলি না আমাদের কাউকে?”
নামাজ পড়ে তমিজ মিয়া বাড়ি ফিরলেন।ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শুনলো রেবেকার কথা।তানভীরের জবাবের আগে তমিজ মিয়া বললো,”তানভীর আমাকে বলে এসেছে।আমি জানতাম আজকে যে আমার ছেলে আসবে।”
বাবার কথা শুনে তানভীর গিয়ে জড়িয়ে ধরলো বাবাকে।তমিজ মিয়া ছেলেকে বুকে পেয়ে খুব আনন্দে আটখানা হলেন। রেবেকার মুখ ভার হয়ে রইলো।
তৌসিফ এগিয়ে এসে মা’কে ইশারা দিলো।রেবেকা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করএন,”তো এমন জরুরি চলে এলি কেনো?
কি হয়েছে?সামনের মাসে তৌসিফের বিয়ে,কতো টাকাপয়সার দরকার,ওর বউয়ের জন্য গহনা গড়ার টাকাও দিলি না। “
তানভীর হেসে বললো,”আমার কপাল খারাপ যে মা,তাই আসতে হয়েছে। এসেছি পূরবীর বিচার করতে।একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছি এবার মা।”
রেবেকা বুঝতে পারলো না। পূরবীর গলা শুকিয়ে গেলো তানভীরের কথা শুনে।
তানভীর সোফায় বসে বললো,”মা,এখানে তোমরা সবাই আছো,সবার সামনেই আমি এখনই সব কথা সেরে নিতে চাই।”
তানভীরের কথা শুনে সবাই বুঝলো,যে কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। পূরবীর হাত পা কাঁপতে লাগলো। পূরবী খুঁজে পেলো না সে কোথায় কোন অপরাধ করেছে সে।তবে কিসের বিচার হবে।ভাগ্য কি তাকে স্বামীর সংসার ও করতে দিবে না!
তানভীর ফোন থেকে কয়েকটা ছবি বের করলো। তারপর সবাইকে দেখিয়ে বললো,”এই ছবিগুলো আমাকে আমার ছোট ভাই তৌসিফ পাঠিয়েছে। পাঠিয়ে বলেছে ভাই,ভাবী তো কলেজে যাওয়ার নাম করে এই ছেলেটার সাথে ঘুরতে যায়।
মা,আমার ভাই ভুলে গেছে আমি দূর দেশে থাকলেও দেশের সব খবর আমি রাখি।এই ছেলেটা সজীব,আমাদের সজীব। আমি নিজেই ওকে বলে গিয়েছি পূরবীকে যাতে কলেজে আনা নেওয়া করে। আমি নিজেই টাকা দিই ওকে ওর বাইকের তেলের জন্য।
আমার নিজের ও ভাই আছে,তবুও কেনো আমি আমার চাচাতো ভাইকে বলেছি আমার বউকে আনা নেওয়া করতে জানেন?
কারণ আমি জানি,আমার ভাইয়ের কাছেও আমার পূরবী নিরাপদ না।সজীব সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য। আমার ভাই ভেবেছে সজীবের মাথায় হেলমেট থাকায় আমি বুঝবো না এই ছেলে যে আমাদের সজীব।
তৌসিফ আমাকে পূরবীর কলেজের কয়েকটা ছবি দিয়েছে,সেখানে পূরবী একটা ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে কলেজের মেহগনি গাছের তলায়।
সেই ছেলেটি আমার ক্লাসমেট রিপার ভাই,আমি পূরবীকে বলেছি ওই ছেলের কাছ থেকে রিপার ফোন নাম্বার নিতে,স্কুলের অনেক বন্ধুদের কথাই মনে পড়ে,সবার সাথে যোগাযোগ করার জন্য।
কিন্তু তৌসিফ আমাকে বললো,পূরবী ক্লাস না করে সবসময় এই ছেলের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটায়।
মা,আমি না থাকার সুযোগে তুমি পূরবীকে দিয়ে ঘরের সব কাজ করানোর শুরু করেছ।পূরবী কিন্তু আমাকে আজ পর্যন্ত কিছু বলে নি। আমি পূরবীকে ফোনে না পেলে যখন আপাকে কল দিতাম,ভাবীদের কল দিয়ে জিজ্ঞেস করতাম পূরবী কোথায়,ওনারা বলতেন পূরবী ঘরে নেই।ও কোথায় কেউ বলতে পারতো না।সবাই বলতো এই সময় হলেই পূরবী নাকি সবাই ঘুমে থাকার সুযোগে বের হয়ে যায়।
আমি পূরবীকে কিছু জিজ্ঞেস করি নি এ নিয়ে,তবে আমি জানতাম সেই সময় পূরবী ব্যস্ত থাকতো রান্নার কাজে অথবা ঘরের কাজে।
কেননা আমি আপা,ভাবীদের জিজ্ঞেস করার পর রাহেলা আপাকে ভিডিও কল দিতাম।রাহেলা আপা কল রিসিভ করে ফোনটা রেখে দিতো এক পাশে।আমি দেখতাম ঘামে জবজবে হয়ে ও পূরবী কাজ করে যেতো।
কিন্তু একটা দিন ও পূরবীর মুখ থেকে একটা অভিযোগ শুনি নি।মা,আমার বাবা আমার জন্য খাঁটি সোনা এনেছে।সেই সোনা আমি চিনেছি,তোমরা চিনলে না।
আমি বুঝে গেছি যতোদিন আমি বিদেশে আছি বাড়ি থেকে কল দিয়ে বিভিন্নভাবে সবাই পূরবীর নামে অপবাদ দিবে আমার কাছে। পূরবীকে আমি সিংহের খাঁচায় রেখে গেছি।পূরবী বুঝতে পারে নি আমার পরিবারের লোকজন কি পরিমাণ বিষাক্ত কিন্তু এই কয়দিনে বাড়ি থেকে তোমাদের সবার কল,ছবি পেয়ে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবার মতো অবস্থা হলো।
এই কয়মাসে আমি এটুকু বুঝে গেছি,তোমাদের কাছে পূরবীকে রাখা যাবে না।তাই আমি এসেছি পূরবীকে নিয়ে যাবার জন্য।বাবার সাথে আমার কথা হয়েছে,বাবা সব কাগজপত্র রেডি করে রেখেছে। বয়স বাড়িয়ে দিয়ে পূরবীর পাসপোর্ট করতে দিবো আজকেই।১ মাসের ভিতর আমি পূরবীকে নিয়ে চলে যাবো। “
রেবেকা থমথমে মুখে বললেন,”সব সিদ্ধান্ত তো তুই নিয়েই এসেছিস তবে আর আমাকে বলার কি দরকার ছিলো?”
তানভীর হেসে বললো,”মা,এই পরিস্থিতির জন্য কে দায়ী তুমি নিজেই যদি ঠান্ডা মাথায় একবার ভাবো তাহলে উত্তর পেয়ে যাবে।তুমি যদি আর সবার মতো আমার বাবা মা হারা বউটাকে একবার কাছে টেনে নিতে,তবে আজ এই পরিস্থিতি হতো না।কেউ সুযোগ পেতো না আমার বউকে নিয়ে এভাবে অপমান করার।আমার ও আর্জেন্ট ছুটি নিয়ে এভাবে দেশে ফিরে আসতে হতো না।
শুধু পূরবীর বাবা মা নেই,এটাই ছিলো পূরবীর অপরাধ।
মা,তুমি তো আমার মা,আমার তো মা আছে,আমার কি উপকার হলো মা থেকে বলতে পারবে তুমি?”
রেবেকা কথা বললো না আর।সবার মুখ বন্ধ হয়ে গেলো।তৌসিফ এগিয়ে এসে ভাইয়ের হাত চেপে ধরে বললো,”আমাকে ক্ষমা করে দাও ভাই,আমাকে মা বলেছে ভাবীর পিছনে এভাবে গোয়ান্দাগিরি করতে।আমি ও ভাবলাম ভাবীকে যদি বাড়ি থেকে বের করতে পারি তবে তুমি আবার আগের মতো হবে।যখন যা চাইবো তাই পাবো।”
তানভীর হাসলো। রেবেকা মাথা নিচু করে রইলো।লজ্জায় কারো দিকে তাকাতে পারছেন না।
তানভীর হেসে বললো,”মা,একটু ভেবে বলো তো,এই যে এভাবে পূরবীকে তুমি অপমান করতে এক পায়ে খাড়া হয়ে ছিলে,তুমি কি তাতে ভালো ছিলে?
আমি কি ভালো ছিলাম তোমাদের ছেড়ে যোজন যোজন দূরত্বে থেকে?
আমার প্রাণ রেখে গেলাম বাড়িতে,সে ও ভালো ছিলো না।মা,কোথাও কেউ ভালো থাকে না মনে এরকম হিংসা,ঘৃণা পুষে রেখে।আমি তো আমার বউ নিয়ে চলেই যাবো।যাকে নিয়ে সবার এতো সমস্যা ছিলো তাকে নিয়ে যাবো।তারপর তোমরা সবাই ভালো থেকো।”
সত্যি সত্যি তানভীর এক মাসের মাথায় পূরবীকে নিয়ে চলে গেলো। রাহেলা ও এই বাড়ির কাজ ছেড়ে দিলো।সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খাটতে হয় বলে রাহেলার ও কাজের ইচ্ছে চলে গেলো।
রেবেকা সংসারে সবার আসল রূপ দেখতে শুরু করলো আস্তে আস্তে। তানভীর আর আগের মতো লাখ লাখ টাকা দেয় না মায়ের হাতে।মাসে ২০ হাজার টাকা পাঠায় রেবেকাকে। সেই টাকা রেবেকার কখন খরচ হয়ে যায় হিসেব থাকে না।লজ্জায় ছেলের কাছে চাইতেও পারেন না।
তমিন মিয়ার কাছে আলাদা টাকা পাঠায় তানভীর সেটা রেবেকা জানে না।সংসার বউদের হাতে চলে যাবার পর রেবেকা বুঝতে পারলো,যাদের সে এতোদিন আপন ভেবেছে তারাই তার সবচেয়ে পর।
তারিন নিজের শ্বশুর বাড়ি চলে গেলো। আনিকা মিম কেউই রেবেকাকে পাত্তা দেয় না।এমনকি শখ করে নিজের ভাইয়ের মেয়ে এনেছেন ছোট ছেলের বউ করে,সেও দাম দেয় না।
তমিজ মিয়ার সাথে আজকাল বউদের কথআ বঅলার চেষ্টা করেন তিনি,কিন্তু ত্মিন মিয়া পাত্তা দেয় না।বরং বিরক্ত হয়ে বলে,”যে খারাপ ছিলো তারে তো সামনে থেকে সরিয়ে দিয়েছি,এখন তোমার ভালো বউদের ব্যাপার তুমি জানো আমাকে এসব বলে লাভ নেই।”
আজকাল রেবেকা কোথাও পাত্তা পায় না।মাঝেমধ্যে তাই তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে,”আমি ভালো নেই,একটুও ভালো নেই।”
(সমাপ্ত)