কোথাও কেউ ভালো নেই
পর্ব ৭
ঝড়ের বেগে এসে সুরভী পূরবীকে জড়িয়ে ধরলো। দুই বোনের গগনবিদারী হাহাকারে ভারী হয়ে উঠেছে পরিবেশ। সুরভীর মনে হলো লক্ষ কোটি বছর হলো বুবুকে দেখে না।
আর পূরবী!
সে-তো যেনো হারানো মানিক ফিরে পেয়েছে।নিজের অজান্তেই তানভীরের চোখ ভিজে গেলো। তবু নিনেকে সামলে নিয়ে দুই বোনকে সান্ত্বনা দিলো তানভীর।
তারিনের সাথে এলো তারিনের বড় খালা রাবেয়া।আগেই শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে তারিন খালাকে।
রাবেয়া এসে পূরবীর গহনাদি দেখে বললো,”এগুলো কি বউয়ের বাবার বাড়ি থেকে দিয়েছে নাকি বউ – মা? “
পূরবী এই প্রশ্ন শুনে কিছুটা বিব্রত হলো।তারিন কিছু বলার আগেই আনিকা বললো,”আরে না খালা,এগুলো সব তানভীরের আনা।পূরবীর বাবার বাড়ি থেকে একটা সুতা ও তো দেয় নি।আমাদের বাবার বাড়ির মতো কি সবার বাবার বাড়ি না-কি? “
তারিন ভীষণ খুশি হলো।জ্বালানো আগুন উসকে দিতে বললো,”রাজ কপাল এরেই বলে খালা।লোকে বলে না ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখতে নেই,পূর্ণ হয় না।এখন দেখো,কারো কারো হয়ে যায়।”
লজ্জায় পূরবীর ফর্সা মুখখানা কালো হয়ে গেলো। সালমাও কিছুটা দমে গেলো এদের বাক্যবাণে। সবার কথা শেষ হলে তানভীর খালাকে ডেকে বললো,”কি করবো বলেন খালা,আমার বউকে দেখেন আর আমার ভাইদের বউদের দেখেন।কোথায় রাজরানী আর কোথায়…বাকীটা আর বলবো না।হাটে বেচা যায় না কলা তো ঠাকুর ঘরে নিয়া ফালা বলে একটা কথা জানেন?
ভাবীদের ও সেইম অবস্থা। ওনাদের বাবা মা দেখছেন মেয়েদের বিয়ে দিতে পারছে না।না আছে রূপ,না আছে গুণ।থাকার মধ্যে আছে পেট ভর্তি শয়তানি আর হিংসে।তাদের কি দোষ? এরকম মেয়ে কেউ বিয়ে করবে নাকি?
এজন্য গহনাপত্র দিয়ে,টাকাপয়সা দিয়ে আমার ভাইদের কাছে গছিয়ে দিয়ে গেছে।
আর আমার বোন,তাকে তো আপনি ভালো করেই জানেন,এতো ভালো যে বিয়ের এতো বছর হয়েছে তবুও শ্বশুর বাড়ি গিয়ে থাকতে পারছে না নিজের সুমধুর ব্যবহারের জন্য।
এজন্য সবার বাবার বাড়ি থেকে মেয়েদের গুণের ঘাটতি পূরণ করতে এসব দেওয়া হয়েছে।
আমার বউ তো তেমন ফেলনা নয়,তাই তাকে যোগ্য সম্মান দিয়েই আমি এনেছি।আর খালা শুনেন,কোরআন,হাদিস কোথাও কিন্তু এই যৌতুকের অনুমতি নেই। আমি কেনো যৌতুক নিয়ে বিয়ে করবো?
আল্লাহ আমাকে যেটুকু সামর্থ্য দিয়েছে তাতে পূরবীর সব শখ আমি পূর্ণ করার জন্য যথেষ্ট।
শ্বশুর বাড়ির লোভ করলে তো আপনার মেয়ে লায়লাকেই বিয়ে করতাম।আমার ইনকাম দেখে আপনি ও তো কম ফাঁদ পাতেন নি আমার কাছে লায়লাকে বিয়ে দিতে তা কি ভুলে গেছেন না-কি ।”
পূরবী অবাক হয়ে তাকালো তানভীরের দিকে।সহজ সরল দেখতে ছেলেটা মহিলাদের মতো কেমন করে ঝগড়া করতে পারে!
সালমা ভেবেছিলো তানভীরের সাথে সুরভীর ঝামেলা বাঁধিয়ে দুজনকে আলাদা করার প্ল্যান করবে কিন্তু তানভীরের কথা শুনে বুঝলো এই ছেলে অন্য ধাতুতে গড়া।একে এতো সহজে সে হাত করতে পারবে না।
খাওয়া দাওয়ার পর পূরবীদের বাড়ি গেলো তানভীরসহ।পূরবীর ইচ্ছে ছিলো না যাওয়ার। ওখানে গেলে তানভীরের জন্য কোনো আয়োজন করবে না সালমা তা পূরবীর চাইতে ভালো কে জানে!
এই মানুষটাকে অসম্মানিত করা হোক তা পূরবী চায় না।
কিন্তু দেখা গেলো তানভীরের আগ্রহ বেশি। দুরুদুরু বুকে বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো পূরবী।
বাড়ি ফিরে সালমা সালমার ঘরে ঢুকে গেলো। পূরবীদের দুই রুমের ছোট্ট ঘরটায় পূরবী সুরভী আর তানভীর গিয়ে বসলো।
ঘন্টা খানেক হয়ে গেলো কিন্তু সালমার বের হবার নাম নেই।লজ্জায় পূরবীর মাথা কাটা যাচ্ছে।যে মানুষটা তাকে সবার আক্রমণ থেকে রক্ষা করে আসছে বারেবারে তার সমাদর করার মতো কেউ নেই এই বাড়িতে।
নিজের স্বামীর এতো বড় অপমানে পূরবীর অন্তর দহন শুরু হলো।
তানভীর জিজ্ঞেস করলো,”এখানে খাবার হোটেল বা রেষ্টুরেন্ট কিছু নেই পূরবী? “
পূরবীর ভীষণ লজ্জা হলো।আহা বেচারা!
হয়তো ক্ষিধে পেয়েছে খুব তাই জিজ্ঞেস করছে।পূরবীর অশ্রু টলটলে চোখ তানভীরের নজর এড়ালো না।
মুচকি হেসে আবারও জিজ্ঞেস করলো।
পূরবী বললো,”বাড়ির বাম দিকে মসজিদের সামনে দেখবেন রিকশা আছে,রিক্সাকে বলবেন চাঁদমোহর বাজারে যাবেন।৩০ টাকা ভাড়া নিবে রিকশা। “
তানভীর চলে গেলে দুই বোন মোবাইল নিয়ে বসলো। একের পর এক ছবি তুলতে থাকলো দুজন মিলে।ছবি তুলতে তুলতে কখন দু’ঘন্টা সময় পেরিয়ে গেছে কেউ-ই টের পেলো না।
তানভীর ফিরলো একটা সিএনজি নিয়ে। উঠানে সিএনজির শব্দ শুনে দু’বোনের সময়-জ্ঞান এলো।তাড়াহুড়ো করে ছুটলো দুজন।গিয়ে দেখে তানভীর ফিরেছে অনেক কিছু নিয়ে।হাড়ি পাতিল,নতুন বিছানার চাদর,দুটো ফ্যান,একটা ডিনার সেট,হলুদ মরিচ মসলা রান্নাবান্নার সবকিছু,একটা মাদুর,অনেকগুলো মোমবাতি,মোমবাতি রাখার স্ট্যান্ড,গরুর মাংস,ইলিশ মাছ,পেয়াজ,রসুন,আদা,জিরা।
কি নেই আর?
পূরবী হতভম্ব হয়ে সামনে দাঁড়ানো ঘর্মাক্ত চেহারার যুবকটার দিকে তাকালো। কি এক পরম নির্ভরতা এই মানুষটির চোখে!
তানভীর সব বের করে রুমে এনে রাখলো।সালমা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো সব।
সমস্ত মালামাল ঘরে নিয়ে রেখে এবার খাবারের প্যাকেট বের করলো তানভীর।
নিজ হাতে উঠানে একটা মাদুর বিছালো।তারপর বাজার থেকে আনা কাচ্চির প্যাকেট,বোরহানি,সেভেন আপ,মুরগির কষা মাংস সব প্লেটে সাজিয়ে উঠানে রাখলো।মোমদানিতে মোম সাজিয়ে উঠানে বৈদ্যুতিক বাতি বন্ধ করে পূরবী সুরভী দুজনকে নিয়ে বসালো।
এতোক্ষণে পূরবী দেখতে পেলো বাহিরে কি উথলে পড়া জোছনা।চাঁদের আলোয় যেনো থইথই করছে পুরো আঙিনা।থেকে থেকে গাছের পাতা নড়ে উঠছে।একটা স্বর্গীয় মুহূর্ত যেনো।
আকাশের দিকে তাকালো পূরবী। চাঁদটা দেখে পূরবীর মনে হলো চাঁদের বুক থেকে ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে পড়ছে যেনো মায়া।যেই মায়াতে সবাই বিভ্রান্ত হয়ে যায়।সুরভীর গানের গলা ভীষণ ভালো। সুরভী গুনগুন করে গান ধরলো,
“চাঁদনী পসরে কে আমারে স্মরণ করে
কে আইসা দাড়াইসে গো আমার দুয়ারে।
তাহারে চিনিনা আমি সে আমারে চিনে।।
বাহিরে চাঁন্দের আলো ঘর অন্ধকার
খুলিয়া দিয়াছি ঘরের সকল দুয়ার।
তবু কেন সে আমার ঘরে আসেনা
সে আমারে চিনে কিন্তু আমি চিনিনা।
সে আমারে ঠারে ঠারে ইশারায় কয়
এই চাঁদনী রাইতে তোমার হইছে গো সময়।
ঘর ছাড়িয়া বাহির হও ধরো আমার হাত
তোমার জন্য আনছি গো আইজ চাঁন্দেরও দাওয়াত।
চাঁদনী পসরে কে আমারে স্মরণ করে
কে আইসা দাড়াইসে গো আমার দুয়ারে।”
নিজের অজান্তেই পূরবী তানভীরের কাঁধে মাথা রাখলো।পরম মমতায় নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো তানভীর পূরবীকে।
পূরবী কাঁদবে না বলে ঠিক করেছে।পূরবীর মনে পড়লো সুরভী ঠিক মায়ের মতো গানের গলা পেয়েছে।মা যেমন শুয়ে শুয়ে বাহিরের চাঁদের দিকে তাকিয়ে এভাবে গান গাইতেন,তেমন করেই আজে সুরভী গান গাইলো যেনো।
আহা,আজ যদি মা বেঁচে থাকতো!
গান শেষে সুরভী চোখ মুছল।কেনো জানি মনে হচ্ছে এতো বছর ধরে পাওয়া অবহেলা,অনাদর ঘুছিয়ে দিতে আল্লাহ যেনো তানভীর ভাইকে পাঠিয়েছেন।
এই মানুষটি যেভাবে আজ আপার পক্ষ নিয়ে কথা বলেছে সুরভীর মনে হয়েছে এই পৃথিবীতে এই একটা মানুষই আছে যার ছায়ায় নির্ভয়ে আশ্রয় নিতে পারবে তারা দুই বোন।
হালকা কথাবার্তা বলতে বলতে খেতে লাগলো তিনজনে। সালমা জানালা দিয়ে দেখলো সুরভী মুরগির রানে তৃপ্তি নিয়ে কামড় বসাচ্ছে।বোরহানির গ্লাস যেনো সালমাকে হাতছানি দিয়ে বলছে,”আয় সালমা আয়।”
রাগ হলো ভীষণ সালমার।তাকে কেউ ডাকলো না একবার?
এই না-কি নতুন জামাই!
দিন দিন মানুষের মন থেকে শ্রদ্ধা,সহবত,সম্মান সব উঠে যাচ্ছে।ঘোর কলিযুগের লক্ষণ যেনো।
তানভীরের এই বেয়াদবি সালমা মেনে নিতে পারলো না।
আপনমনে বিড়বিড় করে বললো,”ছি ছি!”
চলবে…..
জাহান আরা