অভিনয়
————
আমি বোধ হয় সত্যি সত্যি খুব বোকা ছিলাম। শুধু আমি নিজে সেটা বুঝতাম না । আসিফ কে আমি প্রচুর ভালোবাসতাম। আমার ধারণা ছিল, আসিফ ও আমাকে তেমনি ভালোবাসে। আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে মনে হয়, ভালোবাসার বয়স যত বেশি হয়, ভালোবাসা ও তত গাঢ় হয়। কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তা নয়। বউদের বয়স যত বেশি হয়, স্বামীদের কাছে বউ কে ততই মূল্যহীন মনে হয়। কথাটা আমার নয়, আমার এক সিনিয়র কলিগের। কথাটা আমি বিশ্বাস করিনি। বলেছি, কি যে বলেন আপু! আমার আসিফ এমন না। আপু হাসতে হাসতে বলেছিল, হয়তো আসিফ ভাইয়া খারাপ হওয়ার তেমন সুযোগ পায়নি। তাই ভালো আছেন। আমি বলেছিলাম, আপু, আমি যদি আমার সামনে ও দেখি, আসিফ কোন মেয়ের প্রতি দূর্বল হয়েছে, আমি বিশ্বাস করবো না ।
এখনো মনে হয়, কেন যে বলেছিলাম কথাটা ! কারন তার মাত্র মাস দুয়েক পরেই একদিন কানে আসলো, আসিফের সাথে তার নতুন IMO নীরার খুব বেশি দহরম মহরম চলছে। ব্যাপারটা আমি বিশ্বাস করিনি। আমার স্বামী নামকরা মেডিসিনের ডাক্তার । তার অনেক ভক্ত থাকতেই পারে । কিন্তু সে নিজে কখনোই অন্য কারো প্রতি অনুরক্ত হবে না। আর কিভাবেই বা হবে ? আমাদের মেয়ে ক্লাস সেভেনে পড়ে। ছেলেটা পড়ে ক্লাস টুতে। ছেলেমেয়েগুলো আসিফের জান। আমি গাইনী কনসালটেন্ট। কিন্তু প্রাকটিস করি না। আসলে আসিফের এত প্রাকটিস, যে আমি কখনো প্রাকটিসের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি । বরং সংসারে সময় দিয়েছি। আমাদের সুখের সংসার । শুধু মাঝে মাঝে ঝগড়া করি আসিফের সাথে, এত প্রাকটিসের কি দরকার? এত টাকা দিয়ে কি হবে ? আসিফ বলে, তোমাদের জন্যই তো করি। ভাবি, তাইতো, আমাদের জন্যই তো সবকিছু করে।শুধু বুঝতে পারিনি, আমাদের জন্য ফ্ল্যাট, জমি, টাকা জমিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কোন সময় যেন আমাদের থেকে দূরে চলে গেছে । তাইতো এখন গভীর রাতে বাড়ি ফিরে বাচ্চাগুলো ঘুমিয়ে গেছে দেখে ও আর মন খারাপ করে না । অথচ ব্যাপারটা আমার নজরেই পড়েনি।
তো যেটা বলছিলাম । প্রথম প্রথম সবাই indirect আমাকে বোঝাতে চাইলো। বুঝলাম না দেখে, পরে সরাসরিই বলতে আরম্ভ করলো, নীতু তুমি এত বোকা কেন ? পুরা শহর জুড়ে এখনকার টপ নিউজ, বিখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ আসিফ তার IMO এর প্রেমে পড়েছে। আমি আস্তে আস্তে ফুসতে লাগলাম। আসিফ কে সরাসরি চার্জ করি। কিন্তু আসিফ অস্বীকার করে । দুজনের প্রায় প্রায়ই ঝগড়া হতে থাকে । এখনো সেসব দিনের কথা ভাবলে লজ্জা লাগে । কি পাগলামিই না তখন করেছি। প্রায় প্রায় চলে যেতাম আসিফ এর ওয়ার্ডে । রেজিস্ট্রার, সহকারী রেজিস্ট্রার, ইন্টার্নী যাকেই পেতাম, তাকেই জিজ্ঞাসা করতাম, তোমার স্যার নাকি ঘন্টার পর ঘন্টা ঐ শাকচুন্নিটার সাথে রুমে বসে আড্ডা দেয়, ঘটনা কি সত্যি? আমি জানতাম ওরা স্যারের against এ কিছুই বলবে না। কিন্তু ওদের মাথা নিচু করে থাকা, অনেক কিছু বলে দিত আমাকে। রাতে বাসায় দুজনের ভিতরে প্রচুর ঝগড়া হতো। আসিফ ক্ষেপে যেয়ে বলতো, তুমি হাসপাতালে আমার প্রেস্টিজ নষ্ট করছো। আমি বলতাম, শুধু প্রেস্টিজ নষ্ট করা ? আমার তো ইচ্ছা করে, তোমাকে খুন করে ফেলি। একদিন ঐ মেয়ের কাছে গেলাম। বললাম, তোমার বয়স মাত্র ছাব্বিশ আর আসিফের বয়স পয়তাল্লিশ। বাপের বয়সি একজনের সাথে প্রেম করতে তোমার লজ্জা করে না ? মেয়েটা আমার দিকে অবজ্ঞার চোখে তাকালো। বললো, আপনি গাইনীর কনসালটেন্ট । কিন্তু আজ আপনার জন্য আমার করুনা হচ্ছে । হঠাৎ করেই আমি বুঝতে পারলাম, আসিফ মেয়েটার কাছে আমাকে অনেক ছোট করে ফেলেছে। তাই তো আজ মেয়েটা আমাকে এতটা ছোট করতে সাহস করলো। একটা প্রচন্ড ধাক্কা খেলাম । আসিফ আমাকে ভালোবাসতে না পারে, কিন্তু কারো কাছে আমাকে এতটা ছোট করবে, চিন্তা ও করতে পারিনি। হঠাৎ করেই মনের ভিতরে যে ঝড়টা উঠেছিল, সেটা শান্ত হয়ে গেল । আসিফ কে তখন ঘৃনা করতেও আমার ঘৃনা হচ্ছিল । এর কিছুদিন পরেই আসিফ আমাকে ডিভোর্স দিল। তার মাস খানেক পর আসিফের সাথে নীরার বিয়ে হয়ে গেল ।
আমার যখন Assistant prof হিসেবে প্রমোশন হলো, তখন আমি সরকারি চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। কারন একই অফিসে চাকরি করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না । আমি প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে জয়েন করলাম। ভাবতে অবাক লাগে, সতের বছর আমরা দুজন দুজনকে দেখিনি। এটা সম্ভব হয়েছে, কারণ যে যে জায়গাতে ওর যাওয়া সম্ভব, সেই সেই জায়গা গুলোতে আমি কখনো যাইনি । না কোন কলিগের ছেলেমেয়ের বিয়েতে, না BMA কোন প্রোগ্রামে , না একসাথে পড়তে পারে এমন কোন ওয়ার্কশপে। কোন শপিং সেন্টারে ও হঠাৎ করে দেখা হয়নি। তার কারন হয়তো, ও আগে থেকেই শপিং করা পছন্দ করে না । আর হয়তো সে ও সেই সব জায়গা গুলো avoid করে, যে জায়গা গুলোতে আমার যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে ।
আমার মেয়েটা যখন 2nd year এ, তখনই ওকে বিয়ে দিয়ে দিলাম । আসলে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিলাম, কারণ সবাই বলতো, পরে বিয়ে হতে সমস্যা হতে পারে । অনেকেই broken ফ্যামিলির মেয়ে কে বিয়ে করতে চায় না। আমার ও তাই মনে হলো। মেয়েটাও আপত্তি করলো না । বিয়ের দিন আমার খুব মন খারাপ ছিল । বারবার মনে হচ্ছিলো, আজ বিখ্যাত প্রফেসর ডাঃ আসিফের মেয়ের কত ধুমধাম করে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল ।অথচ ওকে একেবারেই ঘরোয়া পরিবেশে বিয়ে দিলাম । মেয়েটা আমার একবার ও অনুযোগ করলো না । বরং বললো, মাম্মা, তুমি তো প্রাকটিস করো না। কাজেই এত টাকা কোথায় পাবা ? দোয়া করো যেন সুখী হই।
বছর খানেক পরে আমার মেয়ে অর্পার একটা ফুটফুটে মেয়ে হলো। নাম রাখলো, রূপকথা । রূপকথাই এখন আমাদের সব। অর্পা বাচ্চা নিয়ে খুব কষ্ট করে MBBS পাশ করলো প্রাইভেট মেডিকেল থেকে । আমি যতদূর পারি সাহায্য করি। অবশেষে অর্পার যখন BCS হলো, তখন শান্তি পেলাম ।
আমি এখন ফুল প্রফেসর হয়েছি। রূপকথা ক্লাস থ্রী তে পড়ে। একদিন আমাকে বললো, নানু, কাল আমাদের মিসের বিয়ে । স্কুলের সবাই প্যারেন্টস নিয়ে যাবে । পাপাতো ঢাকা গেছে। কাজেই তুমি কাল আমাদের সাথে যাবে। আমি বললাম, কিন্তু আমি তো কারো বিয়েতে যাই না নানু। রূপকথা খুব জোরাজুরি করলো। তাই শেষে রাজি হলাম।
অনেক দিন পরে বিয়ে বাড়িতে এসে ভালো লাগছে । মনে হচ্ছে, আমি ও মানুষ । এতদিন নিজেকে ভিন গ্রহের প্রাণী মনে করতাম । হঠাৎ দেখি রূপকথা টানতে টানতে একটা সুন্দর মেয়ে কে নিয়ে আসছে আর বলছে, আপু আসো না, তোমাকে আমার মাম্মা আর নানুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। এরপর আমাদের কাছে এসে বললো, নানু, মাম্মা, এ হচ্ছে, আমার স্কুলের সিনিয়র আপু , নাম লিসা। আমি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম । কিন্তু অর্পা দেখি চোখমুখ শক্ত করে ফেলেছে । ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেছে । সবচেয়ে বেশি লাল হয়েছে চোখটা। মনে হচ্ছে, খুব কষ্ট করে কান্না ঠেকিয়ে রেখেছে । এরপর খুব কাটা কাটা ভাবে বললো, She is not your sister. She is your aunt.
রূপকথা আর লিসার সাথে সাথে আমি ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম অর্পার দিকে। রূপকথা বললো, Are you crazy mumma ?
এর পরপরই অর্পা ব্যস্ত হয়ে গেল বাসায় ফেরার জন্য । রূপকথা বললো, মাম্মা আর কিছুক্ষণ থাকি? অর্পা বললো, না আর এক মুহূর্ত ও নয়। একটু পরেই কারনটা বুঝতে পারলাম । লিসার বাবা মা এসে দাঁড়িয়েছে লিসার পাশে। অর্পার সাথে সাথে আমার শরীর থেকে ও কে জানি রক্ত চুষে নিলো। আসিফ খুব করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে আমাকে আর অর্পাকে।
আমরা খুব দ্রুত বের হয়ে আসলাম । বাসায় পৌঁছানোর পর অর্পা বললো, মাম্মা আমি এখনই আমার বাসায় চলে যাবো। আমি বললাম, আজ না আমার এখানে থাকতে চেয়েছিলি ? ও বললো, না মাম্মা, ভালো লাগছে না। অর্পা তড়িঘড়ি করে চলে গেল রূপকথা কে নিয়ে । আমার মেয়ে সতের বছর ধরে তার ক্ষতগুলো লুকিয়ে রেখেছে আমার কাছ থেকে । পাছে আমার ক্ষতগুলো আরো গভীর হয়ে যায় , এই ভয়ে । আজ ধরা পড়ে যেয়ে সে বিব্রত । আমি আসলেই খুব বোকা ছিলাম । আমার মেয়ের অভিনয়গুলো আমি ধরতে পারিনি । আমার ছেলেটা অনেক ছোট ছিল। তাই তেমন কোন প্রভাব তার উপর পড়েনি। বুয়েট থেকে পাশ করেছে। কিন্তু অর্পা যে এই আঘাত সহ্য করতে পারে নি, এটা আমাকে বুঝতে দেয়নি সে। উল্টা সে আমার মায়ের ভুমিকায় অভিনয় করেছে এতদিন । আর আমি মাঝে মাঝেই বিরক্ত হতাম ওর উপরে । ভাবতাম, প্রতিদিনই তো রাত জেগে পড়ে, তাহলে কেন ভালো রেজাল্ট করে না? একবার ও মাথায় আসেনি, আমার ঘুম নিশ্চিত করে তারপর সে ঘুমাতে যায়। পাছে তার কান্না দুখিনী মা দেখে ফেলে, তাই কান্নাগুলো জমিয়ে রাখে গভীর রাতের জন্য । মনে পড়ে গেল, ক্লাস ফোরে থাকতে একবার ওর নামে স্কুল থেকে নালিশ এসেছিল। ও নাকি কোন মেয়ের চুল ধরে খুব জোরে টেনেছে। আমি তো অবাক! আমার শান্ত শিষ্ট মেয়েটা কি করে এটা করলো। জিজ্ঞাসা করলে বললো,
– ও বলছিল, ওর পাপা বেস্ট ।
– বলতেই পারে ।
– কখনোই না । আমার পাপা world’s best. এই পৃথিবীতে কারো পাপাই আমার পাপার মত best হতে পারে না । আমার পাপা সুপার হিরো।
– তাই বলে আর একজন কে মারবা তুমি?
– হ্যা । কেউ যদি আমার সামনে কোনদিন বলে, তার পাপা বেস্ট, তাহলে আমি অবশ্যই মারবো। কারন সে মিথ্যা বলছে।
আজ আমি খুব অনুতপ্ত হচ্ছি। কারন সেই সময়ে আমি এতটাই আপসেট ছিলাম যে, আমার মেয়েটার সুপার হিরোর এই আচরণ, তার উপর কি প্রভাব ফেলছে, আমি তা অনুভব করতে পারিনি। বরং উল্টো সেই আমার মায়ের ভুমিকায় অভিনয় করেছে। সে তার পাপার সব খবর রাখতো, অথচ আমি কষ্ট পাবো বলে, কোনদিন বলেনি। কিন্তু আজ সব অভিনয় শেষ হয়ে গেছে ।
আজ আমার অর্পার আমাকে খুব প্রয়োজন । আমি অর্পার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । আমি জানি, আমার মেয়েটা আজ সারারাত ঘুমাবে না । আজ আর দুজন দুজনকে লুকিয়ে কাঁদবো না । আজ মা, মেয়ে দুজন একসাথে কাঁদবো।