হাউজ ওয়াইফ বনাম চাকুরীজীবি
নীলা অফিস থেকে বাসায় ফিরে সন্ধ্যায়, আজ রাস্তায় জ্যাম কম আর একটু আগেই বের হয়েছে অফিস থেকে। বাসায় তাড়াতাড়ি আসতে পেরে খুশি খুশি লাগছে। নিজের মত করে কিছুটা সময় কাটানো যাবে। কলিং বেলের শব্দে বিরক্ত হয়ে যায়, পাশের ফ্ল্যাটের সোমা আপা!
আজ বাসায় তাড়াতাড়ি এসেছে নীলা, এটা দেখে সোমা এসেছে গল্প করতে। নীলা খুব সাবধানে চোখমুখে বিরক্তি লুকিয়ে হাসি মুখে আসে সোমার সামনে যেন সোমাকে দেখে অনেক খুশি!!
বিপদ আপদে এই সোমাই নীলাকে অনেক হেল্প করে। একবার নীলার কাজের বুয়া বাড়ি যেয়ে আসতে দেরি করে তখন সোমার কাছেই মিতুলকে রেখে অফিসে যায় নীলা। সোমা হাউজ ওয়াইফ হওয়াই এই হেল্পটুকু করতে পারে।
সোমা: আপা আপনার তাও কাজের লোক আছে,
সব কিছু রেডি করে রাখে, রান্না করতে আর ভালো লাগে না, সংসার থেকে কোন ছুটি নাই, শরীর যত খারাপই হোক সংসারের কাজ করতেই হয়… আপনারা অসুস্থ হলে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তাও বাসায় থাকতে পারেন।
নীলা কম কথা বলা মানুষ, কিন্তু এ কথা শুনে আর চুপ থাকতে পারলো না।
– প্রতিদিন টাইমলি অফিস যাওয়ার যে কি প্যারা, একটু দেরি করে গেলে বসের চোখ রাংগানি, কাজের চাপ তো আছেই। আর ছুটি!! ওটা তো কত সাধনার ফল! একটু অসুস্থ হলেই ছুটি নেয়া যায় এমন তো না!
– আর প্রতিনিয়ত কাজের লোকের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়।এই কষ্ট যার নেই সে বুঝবে না।
– হ্যা তা ঠিক, এই নির্ভরশীলতা অবশ্য নেই, কিন্তু প্রতিদিন একঘেয়েমি লাগে। আর আপনার ভাইকে ও ঘরের কোন কাজ করতে বলতে সংকোচ লাগে, ও ভাবে কিনা সারাদিন বাসায় থাকে, আর আমি অফিস করি তারপরও আমাকে কাজ দেয়। ও অবশ্য হেল্প করে। আমারই সংকোচ লাগে।
– একটু পর নীলার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে নতুন চুড়ি। আপা এটা কি স্বর্ণের? সুন্দর তো! নতুন বানিয়েছেন?
– হ্যা
– সোমা আবার ও শুরু করে… চাকরি করলে কত মজা! নিজের টাকা ইচ্ছামত খরচ করা যায়, সবাই কে গিফট করা যায়।বাবা মা ,ভাই বোন কে কত কিছু দেয়া যায়! একজনের ইনকাম, চাইলে ও অনেক কিছু পারিনা। ফ্ল্যাটের লোন আছে এর উপর।
নীলা: সোমার কানের দুল ইশারা করে হাসতে হাসতে বলে আর এটা যে আপনাকে ভাইয়া এনিভারসারী তে গিফট করল .. আমি শিওর আপনি চাকরি করলে আর এটা পেতেননা, ভাবত বৌ এর নিজেরই তো অনেক টাকা। আমি সার্ভিস করার আগে অনেকের কাছে অনেক গিফট পেতাম, এখন ঈদে ও অনেক সময় ও ভুলে যায় যে আমাকে কিছু দিতে হবে।
– না আপা , তারপরও, আপনারা কি সুন্দর প্রতিবছর ঘুরতে যান, কক্সবাজার থেকে বেড়িয়ে আসলেন, আর আমার দৌড় ওই মায়ের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে দুরে যেতে, টাকা গোছানো শেষ হয় আর এমন কিছু ইনসিডেন্ট আসে সব টাকা ওইটার পিছনে যায়।
– আপনি তো তাও ইচ্ছামত মায়ের বাড়ি বেড়িয়ে আসতে পারেন, মাঝে মাঝে আমারো মার কাছে যেতে ইচ্ছা করে, কিন্তু ওই ছুটি নেয়ার জবাবদিহিতা কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর মতো, কতশত ফিরিস্তি!! আবার ছুটি শেষ হয়ে গেলে যদি কোন বিপদে পড়ি .. তাই সাবধানে ছুটি নিতে হয়।
২ জনের তর্কাতর্কির মাঝে মিতুল এসে মাকে জড়িয়ে ধরে, ওর একটাই অভিযোগ আয়ানের মা ( সোমা) সারাদিন বাসায় থাকে, ওকে খাওয়ায় ,পড়ায় , ওর সাথে খেলে , কিন্তু ওর মা বাসায় থাকে না, যেদিন থাকে ও সেদিন কত কাজ মার।
সোমার মায়া লাগে ছোট্ট মিতুলের মুখে এসব শুনে। আসলেই তো মায়ের আদর কি আর কেউ দিতে পারে! নীলা যদি ও বাসায় এসে মিতুলকে সর্বোচ্চ সময় দেয়ার চেষ্টা করে।
সোমা কেক নিয়ে এসেছিল , নিজেই বানিয়েছে।
ছোট্ট মিতুলের মুখে এটা শুনে ও নীলার মনখারাপ হয়ে যায় মা তো আমাদের জন্য এগুলো বানানোর সময়ই পায়না।
নীলার অনেক ইচ্ছা হয় নতুন নতুন রেসিপি দেখে রান্না করবে কিন্তু অফিস থেকে বাসায় আসার পর এমন ক্লান্ত লাগে আর কিছু করার এনার্জি থাকে না।
বাচ্চা বাবা মার কাছে থেকে তো মনুষ্যত্ব শিখবে, তাই সময়টা বাচ্চার সাথেই কাটায় নীলা।
২ দিন পর মিতুলের স্কুল পার্টি।বাবা মা কেউ যাবেনা। ওর মন খারাপ। ও বুয়ার সাথে যাবেনা, সোমা আন্টির সাথে যাবে, ওরা ২ জন এক ই স্কুলে পড়ে।
নীলা: বাচ্চাদের স্কুলে অনেক সময় যেতে পারিনা, আয়ান কে আপনি সব সময় দেখে রাখতে পারেন। স্কুলে নিয়ে যান, বাচ্চার প্রগ্রেস বুঝতে পারেন। অনেক গার্ডিয়ান থাকে, তাদের সাথে মতবিনিময় করতে পারেন।
– সোমা বলে, কিন্তু আপনার একটা সামাজিক মর্যাদা আছে, নিজের পরিচয় আছে। স্কুলের সবাইকে আপনাকে অনেক সম্মান করতে দেখেছি। আমার পরিচয় হাউজ ওয়াইফ দিতে আমি গর্বিত কিন্তু তখন ই সবাই বলে ওর বাবা কি করেন? মনে হয় চাকরি কি এটাই আসল পরিচয়! আমি তো আর যেচে বলতে পারি না যে চাকরি না করলেও আমি একজন গ্রাজুয়েট।আর স্কুলে গল্পই বেশি হয় , অনেক গার্ডিয়ান অনেক হাইপার এক্টিভ থাকে, বাচ্চা একটা দাড়ি ,কমা উল্টাপাল্টা করলে তাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়।এসব আমার ভাল লাগে না। আপনি যেহেতু রোজ স্কুলে যান না, এই টক্সিক অবস্থা আপনার দেখতে হয়না।
নীলা মনে মনে হাসে। প্রতিদিন অফিসে যায়, সংসারের পিছুটান থাকে, মনে হয় কখন বাসায় যাবে। মিতুলকে ছেড়ে থাকার কষ্ট, দুশ্চিন্তা অপরাধবোধ ওকে তাড়া করে বেড়ায়। কতবার যে ভেবেছে চাকরি ছেড়ে দিবে বিশেষ করে মিতুল অসুস্থ হলে।
২ জনের তর্ক বিতর্কে কে জয়ী আমার জানা নেই।
তবে এটা জানি….
নদীর একুল কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারে সকল সুখ আছে বিশ্বাস।
লাবিবা হোসাইনী হানি