আমার প্রেমিকা নীলাকে পছন্দ করে বসেছিলো এক ডাক্তার।যেন তেন ডাক্তার নয়; এফসিপিএস ফার্ষ্ট পার্ট শেষ করা ডাক্তার। বাংলা বিভাগের ফাইনাল ইয়ারে পড়া আমি তখন একেবারে দিশেহারা হয়ে গেছিলাম।
অসম লড়াইয়ে অবতীর্ণ মানুষের একমাত্র হাতিয়ার হয় করুনা কিংবা দয়া। আমার আত্মসম্মানে বাধলেও নীলার অনুরোধে পিজি হাসপাতালে গিয়েছিলাম সেই ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে। সম্ভবত দয়া কিংবা করুনা লাভের ইচ্ছায়।
হবু বর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলেছিলো, “এরকম দু`চারটা প্রেম থাকতেই পারে এ বয়সে। এগুলোকে গুরুত্ব দেয়ার মতো বয়স আমার নেই। আপনি এখনও ছাত্র। তাও আবার বাংলায় পড়েন। আপনি এখন তো পারবেন না। ভবিষ্যতেও আমার মতো অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্ট্যাটাস তাকে দিতে পারবেন কি না সন্দেহ।
সো, এই প্রেম প্রেম খেলায় অন্যের জীবন নষ্ট করে লাভ কি ?”
সেদিন অনেক রাত অবধি আমি ফুটপাতে হেঁটেছিলাম।…
সেই ডাক্তার ভদ্রলোক আমার অযোগ্যতাকে এমন অশ্লীলভাবে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন যে, আমার নিজেকে বাজারে বিক্রির অযোগ্য পোঁচা দুর্গন্ধ যুক্ত মাছের মতো মনে হয়েছিলো।এ পৃথিবীতে এত বড় অযোগ্যতা নিয়ে বেচেঁ থাকার আদৌ কোন অধিকার মানুষের আছে কি না এই ভেবে ভেবে অনেকটা সময় পার করেছিলাম।
দুঃখ নাকি কখনও একা আসে না। ওরা আসে দল বেঁধে; হাতে হাত রেখে। আমার দুঃখরাও এসেছিলো দল বেঁধে।নীলার বিয়ের পর আরও একবছর ওর সঙ্গে আমাকে একই বিভাগে ক্লাস করতে হয়েছিলো। ওই একটা বছর ছিল যেন দীর্ঘ একটি যুগ। নষ্ট ঘড়ির কাঁটার মতো সময় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে টিপ টিপ করে নড়তো কিন্তু এগুতো না।
আমার প্রতিদিনই মনে হতো এটা যেন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিন হয়। মাথা নিচু করে পরীক্ষাগুলো দিয়েই ছুটতাম গুলিস্তানের দিকে। যেন আমি মহাব্যস্ত। আমার জন্য অনেক কাজ আটকে আছে।কিন্তু গুলিস্তানে গেলেই আমার গতি মন্থর হয়ে আসতো।সময় চড়ে বসতো বুড়ো গাধায় টানা গাড়ির পিঠে।
প্রায়ই একটা মোটরবাইকে করে এসে সেই ডাক্তার ভদ্রলোক নীলাকে নামিয়ে দিয়ে যেত। আবার পরীক্ষা বা ক্লাস শেষ হলে কোন আকাশ থেকে যেন উড়ে এসে ঈগলের মতো ছো মেরে নীলাকে তুলে নিয়ে যেত।
সে সময় আমি শুধু আড়াল খুঁজতাম। চারপাশে এত এত অট্রালিকা,প্রকান্ড গাছ কিন্ত আমাকে একটু আড়াল করার মতো কিছুই আমি খুঁজে পেতাম না।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা শেষ হল। কেন যেন এফসিপিএস পড়া শেষ না করেই ডাক্তার ভদ্রলোক নীলাকে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশে চলে গিয়েছিলো। যাওয়ার আগে খুব গোপনে একবার দুজনের দেখা হয়েছিলো শেষবারের মতো।
নীলা দুই চোখ ভাসিয়ে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো, “তুমি সবসময় আমার বুকের মধ্যেই আছ এবং থাকবে। আমি যতদূরেই থাকি না কেন তুমি আমার মনের ভিতর থাকবে। আমৃত্যু আমার মনের সংসারে তোমার সাথে বাস করব।“
আমি শুধু ভাবতাম কি করে নীলা আমাকে নিয়ে যাবে সাত সমুদ্র তের নদী পার করে মরুর দেশে ?
আমি মাঝে মাঝে পাখির মতো উড়তে চাইতাম। ছুটে যেতে চাইতাম নীলার কাছে। কিন্তু নিজের অযোগ্যতার অনুভব নিয়ে এক সময় ক্ষান্ত দিলাম।
নীলা হয়ে গেল আমার জন্য কিছু সময় কাটিয়ে পেছনে ফেলে আসা ‘কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত।‘
আজ অনেকদিন পর জেগে ওঠে সেসব স্মৃতি আমার মনে। আমি অনেকদিন নীলার সঙ্গে মনে মনে কথা বলতাম। নিজের অযোগ্যতার কথা ভেবে কষ্ট পেতাম। মুখ থুবড়েপড়া স্বপ্নের লাশ নিয়ে মনে মনে বিলাপ করাতাম।
সেসব দিন পার করে এবার যখন সত্যিই উঠে দাঁড়ালাম; সংসারি হতে চাইলাম। তখন আবার সেই পুরনো গোলক ধাঁধার অন্য আরেক চরিত্রে নিজেকে আবিস্কার করে হতাশ হয়ে পড়ি।
খুব নরম গলায় ছেলেটিকে বলি, “চা, খাবেন ?”
সে যেন আমার অনেক দিনের চেনা। রাতজাগা লাল টকটকে চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকায় ছেলেটা।
আমি স্পষ্ট বুঝলাম সে নিজের সঙ্গে নিজে একটা বড় রকমের যুদ্ধে লিপ্ত। আমার মতো মোটা বেতনের চাকরি করা, গাড়ি হাঁকানো লোকের সঙ্গে লড়াই করার শক্তি বা সামর্থ্য কোনটাই বায়োজিদের নেই।
আমার সঙ্গে লড়াই করার একটা অস্ত্র ও যে তার হাতে নেই তা ভেবেই হয়তো সে
অসহায় বোধ করছে। চায়ের অপেক্ষা করতে করতে আমি এবার তার দিকে একটু ঝুঁকে বসি।
জানতে চাই, “সাদিয়া আর আপনার মধ্যে কি কোন সম্পর্ক আছে ?”
ছেলেটা দীর্ঘ ক্লান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়।
আমি বলি, “কত দিনের ?”
দুই বছর। —
আপনি যে এখানে এসেছেন সাদিয়া কি জানে ?
ছেলেটার চেহারায় একটা স্পষ্ট দ্বিধার ছাপ ফুটে ওঠে। কিন্ত সে কোন জবাব দেয় না।
প্রেমের দাবি নিয়ে হবু স্বামীর কাছে প্রেমিককে পাঠানোর ষড়যন্ত্রে প্রেমিকার ভূমিকাকে যেন একটু আড়ালে রাখতে চায় ছেলেটি।
আমার একবার মনে হয় মেয়েটি কিছুই জানে না। আবার মনে হয় মেয়েটিই ছেলেটিকে পাঠিয়েছে। টেবিলের ওপর রাখা ছেলেটির কম দামি চাইনিজ মোবাইলটা শব্দ করে কেঁপে উঠতেই ছেলেটি এবং আমি দু’জনে একসঙ্গে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে চোখ দেই। সেখানে দেখি, ওয়ান মেসেজ।
মেসেজ প্রেরকের নাম চোখে পড়লো, “মেরি জান।“
তরুন প্রজন্মের মানুষ না হলেও আমি জানি ‘মেরি জান’ কোন মানুষের নাম নয়।
এটি বায়োজিদের প্রেমিকার কোড নেম। সম্ভবত সাদিয়ারই নাম। মেয়েটির মোবাইলেও ছেলেটির নিশ্চয়ই কোড নেম সেভ করা আছে। ছেলেটি দ্রুত টেবিল থেকে মোবাইলটা আমার দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে যায়।
বার বার সাদিয়াকে আড়াল করার একটা প্রবনতা লক্ষ করি তারমধ্য। যেমন আমি আড়াল করতে চাইতাম নীলাকে।
আমি ১০ বছর আগের সেই ডাক্তারের অনুকরন করলাম।
আমি না হয় আপনার ভালোবাসাকে সম্মান জানালাম। কিন্ত আপনিই যে সাদিয়াকে পাবেন তার তো কোন নিশ্চয়তা নেই ?
আপনার নিজের পায়ে দাঁড়াতে সময় লাগবে কিন্ত অনেক? ছেলেটি আমার দিকে বিস্ময় নিয়ে একবার তাকিয়ে মুখ নামিয়ে নেয়।আমার কথার ভেতরে যে একটা প্রবল শক্ত যুক্তি আছে তা সে মেনেও নিল যেন।
তবু সে পানিতে তলিয়ে যেতে যেতে বলে, “চেষ্টা করায় দোষ কি ?
চেষ্টা করাটাও প্রেমিকের একটা মহৎ যোগ্যতা।“
আমি ৩৩ বছরের দীর্ঘ জীবন পার করে প্রেমিকের যোগ্যতার এক নতুন সংজ্ঞা পেলাম।
ছেলেটির নিজেকে প্রবোধ দিতে দিতে একটা মৌলিক যোগ্যতা আবিস্কারের ক্ষমতা দেখে আমি একই সঙ্গে মুগ্ধ এবং বিস্মিত হই। তবু নিজেকে সাদিয়ার জীবন থেকে সরিয়ে নেয়ার আগে নিশ্চিত হতে জানতে চাই, “আমি কি করে বুঝব সাদিয়া আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছে ?”
ছেলেটি একটু বিব্রতবোধ করে। অনেকটা নিরুপায় হয়ে বুক পকেট থেকে একটা
ভিজিটিং কার্ড বের করে অন্যদিকে তাকিয়ে সেটা তুলে দেয় আমার হাতে। আমি ভিজিটিং কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখি আমারই ভিজিটিং কার্ড। রেস্টূরেন্টে সাদিয়াকে দেখতে যেয়ে দিয়েছিলাম।কার্ডের এক কোনায় এখনও চিকেন ফ্রাইয়ের তেলর দাগ লেগে আছে। যদিও এই ক’দিনেই অনেকটা ম্লান হয়ে গেছে।
আমি ইচ্ছা করলে সাদিয়া আর বায়েজিদের ভালোবাসাকে অগ্রহ্য করতে পারি। সময় সব ভুলিয়ে দেবে ভেবে সাদিয়াকে ঘরে তুলে আনতে পারি। কিন্তু
আমার মন বাধা দেয়। আমার কাছে সাদিয়া হয়ে যায় নীলা।
মনে হয় আমার বাসরের আগের দিন তারা গোপনে কোথাও দেখা করবে। দুই জনের সে বিচ্ছেদপূর্ব বেদনা আমাকে তাড়িত করে। নীলার মতো সাদিয়াও
বায়েজিদকে বলবে, ‘আমার সাথে তুমি চিরদিন থাকবে।
অদেখা কাউকে নিয়ে কল্পনার হাত প্রসারিত করা যায় না। কিন্ত সাদিয়াকে আর একা ভাবতে পারিনা। সাদিয়া আর বায়েজিদ হয়ে যায় এক ফ্রেমে বন্দি দুটি মানুষের ছবি।
আমি কল্পনায় চৌ-রাস্তায় সাদিয়ার হাত ধরে হাঁটতে গিয়ে ছেলেটার ছায়া দেখি। আমাদের পাশ দিয়েই দু’ট ছায়া হাঁটছ। কল্পনায় বারান্দায় বসে চাঁদ
দেখতে দেখতে রকিং চেয়ারে দোল খেতে গিয়ে দেখি সাদিয়ার চেয়ারটা সে নিজে দোলাচ্ছে না। চেয়ারটা দোলাচ্ছে একটা লিকলিকে লম্বা ছায়া।
বুঝলা মুগ্ধতার যে ছায়া সাদিয়ার চোখে তা আমার উপস্থির জন্য নয়।বায়েজিদের কাল্পনিক উপস্থিতির জন্য।
১০ বছর পর আমি বুঝি আমাকে নীলা কি করে মরুর দেশে নিয়ে গেছে। নীলার বলা কথাগুলো আজ আর আমার কাছে সান্ত্বনামূলক কতগুলো বাক্য মনে হয়না। মনে হয়, মনের গভীর থেকে উঠে আসা কতগুলো দৈব বানী।
আমি বুঝি, ছেলেটা সাদিয়ার সঙ্গে আমার ঘরে এসে উঠবে। সাদিয়ার এক পাশটা আগলে ধরে রাখবে সর্বক্ষন। আমি নিশ্চিত বুঝি সাদিয়াকে নিয়ে আমি সুখি হতে পারবো না। কারন সে সংসার করবে পথ ভ্রষ্টা নারীর মতো। তার মন পড়ে থাকবে বায়েজিদের কাছে অথচ সংসার করবে আমার। ভ্রষ্টা নারীর সুখীর অভিনয় করা সংসারের সুখ আমি চাই না।
বিদায়ের সময় ছেলেটিকে নতুন আরেকটা ভিজিটিং কার্ড দেই। সাদিয়াকে দেয়া পুরনোটা ছিড়ে নর্দমায় ফেলে দেই। বায়েজিদের পিঠে হাত রেখে বলি, “আপনাদের প্রেমের সাফল্য কামনা করি।”
ছেলেটা একটু মিষ্টি হেসে আমার হাত অনেকক্ষন চেপে ধরে চোখ মুছতে মুছতে পথে নামে।
সে ফুটপাত ধরে এমনভাবে হাঁটতে থাকে যে আমার মনে হয় বর্ষার আগমনি বার্তা পেয়ে ময়ূর নৃত্য করছে। আনন্দে আমার দু’চোখ ভিজে যায় ।
১২ বছর ধরে যে পরাজয়ের জ্বালা বুকে নিয়ে বেড়াতাম আজ তা জুড়াল বলে মনে হতে থাকে। পিজি হাসপাতালের গেটে দাঁড়িয়ে আমার প্রেমকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা নীলার স্বামী নিশ্চয় এতদিনে জেনে গেছে প্রেমিকা না চাইলে প্রেমিকের কখনও মৃত্যু হয় না; কোন প্রেমিকের পরাজয় হয় না।
গাড়িতে ওঠে এসি ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছে ফেলি।গাড়িতে বাজতে থাকে জেমসের চিৎকার করা গান “হামারি আধুরি কাহানী।”
প্রেমিকা ও প্রেমে ভুল নিয়ে গল্প।