Pearl Harbour means পার্ল হারবার! এই নামটি শুনলেই ইতিহাসপ্রেমী মানুষর খানিকট শিউরে ওঠেন ;চোখ বুজে কল্পনায় একটা যুদ্ধক্ষেত্র দেখতে পান।শুনতে পান যুদ্ধ বিমানেরকান কান ফাটানো সাইরন!ক্ষনেক্ষনে চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে আগুনে ঝলসে যাওয়া একটা দ্বিপের ছবি।
বলছি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সামরিক আক্রমনের কথা;দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধ যখন অনিবার্যই হয়ে গেল,তখন নিশ্চিত পরাজয় জেনেও জাপান তার সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে হাওয়াই দ্বিপপুঞ্জের পার্ল হারবারে অবস্থিত আমেরিকার সবচেয়ে সবচেয়ে বড় নৌ-ঘাটি ভেংগে-চুড়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেয়।যে যুদ্ধের মতো দামামা বিশ্ববাসি আর দ্বিতীয়টি দেখেনি।
সিনেমা প্রেমীরাও এই নামটির সাথে সুপরিচিত।পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত নির্মাণ হওয়া যতো সিনেমা রয়েছে তার মধ্যে এই ঘটনাকে উপজীব্য করে বানানো ‘’Pearl Harbor’’ নামক সিনেমাটিতেই ব্যবহার করা হয়েছে সবচাইতে বেশি পরিমাণ বিস্ফরক দ্রব্য!
আমাদের আজকের আলোচনা পার্ল হারবার নিয়ে,কেনো এবং কিভাবে জাপান এই মরণ কামড় দিয়েছিলো আমেরিকার বুকে।চলুন শুরু করা যাক
সাল ১৯৪১ ডিসেম্বর মাসের ৭তারিখ রোবিবার,যুক্তরাস্ট্রের হাওয়াই দিপপুঞ্জের পার্ল হারবারে সৈন্যদের জন্য সেদিন যুদ্ধের কোন প্রস্তুতই ছিলনা।সাপ্তাহিক ছুটির দিনে গা-এলিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল তারা।কেউই জানতো না ,আর খানিক্কাল পরে ঘটে যাবে ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতমো,হৃদয়বিদারক,আ্ক্রমনের ঘটনা।ঘোষণা ছাড়াই বেজে উঠবে যুদ্ধের দামামা।
৩৫৩টি জাপানি যুদ্ধ বিমান,বোমারু বিমান,টর্পেডো বিমানকে একযোগে আক্রমনের নির্দেশদেন জাপানি নেভির প্রধান সেনাপতির এডমিরাল ইউসুরুকু ইয়ামামাতু।পার্ল হারবার আক্রমণের মাস্টারমাইন্ডার এই ভদ্রলোকই।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের সম্মিলিত সামরিক বহরের কমান্ডার ইনচার্জ ছিলেন এই ভদ্রলকই।জেনে অবাক হবেন,তিনি কখনোই চাননি জাপান আমেরিকার সাথে যুদ্ধ লাগতে যাক।যুদ্ধের আগেই বলেছিলেন,জাপান যদি আমেরিকার সাথে লাগতে যায় তাহলে ৬মাস থেকে বড় জোড় একবছর চালকের আসনে থাকবে কিন্তু যুদ্ধ যদি দুই থেকে তিন বছর লম্বা হয়ে যায় তবে জাপানের আর কোন অস্থিত্ব থাকবে না।বাস্তবে তার পুরো অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়।
প্রশ্ন উঠে তিনি তাহলে তিনি পার্ল হারবার আক্রমনে গেলেন কেনো?এর কারণ জাপানের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব।পশ্চিমা দেশগুলকে মোটেও তারা বিশ্বাস করতো না।আমেরিকায় পড়াশোনা করার কারণে ইয়ামামাতুর পশ্চিমাদের সম্পর্কে একটু সফট কর্ণার ছিল।এজন্য কলিগদের কাছে আমারিকার দালাল, পশ্চিমাদের দালাল ট্যাগ খেয়েছিল।
যুদ্ধ যখন অনিবার্যই হয়ে গেল তখন হারবেন জেনেও সর্বোচ্চটা দিতে চাইলেন।তিনি দেখলেন প্যাসিফিক এরিয়াতে প্রভাব বিস্তার করতে হলে সবার আগে হাওয়াই দ্বিপপুঞ্জের পার্ল হারবারে আমেরিকার নৌ-ঘাটি লণ্ডভণ্ড করে দিতে হবে।বাকিটা ইতিহাস।তার পরিকল্পনা অনুয়ায়ি ছয়টি বিমানবাহী জাহাজ থেকে চালানো হয় এই আকস্মিক আক্রমন।আক্রমনের আকস্মিকতায় শুরুতেই হতোভম্ব হয়ে পরে মার্কিন সেনারা।আক্রমনের জন্য নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার আগেই ডুবে যায় তাদের চার চারটি যুদ্ধ জাহাজ।মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাকি চারটি।জাপানিদের এমন বুদ্ধি দিপ্ত আকস্মিক হামলায় মার্কিনদের ১৮৮টি বিমান ধ্বংস হয়ে যায় পুরোপুরি ভাবে।আক্রমনটি মার্কিন দের আহমিকায় দাগ কেটে যায় একেবারে।যার ফল স্বরুপ পার্ল হারবার আক্রমনের পরের দিনই আমেরিকা প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করে জাপানের বিরুদ্ধে।
পার্ল হারবার আক্রমন আজও সামরিক ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে।এই আক্রমনের পরে আমেরিকার মোস্ট ওয়ানটেড ব্যক্তিতে পরিণত হয় ইয়ামামাতু।পরবর্তীতে অ্যামেরিকানদের এক বিমান হামলায় ১৯৪৩ সালে মারা যান তিনি।
চলুন এবার দেখে নেয়া যাক জাপানের এই আক্রমনে কেমন ক্ষতি হয়ে ছিল সত্যিকার অর্থে।অপ্রস্তুত মার্কিন বাহিনিদের উপর জাপানিদের পরিকল্পিত আক্রমণে মার্কিনরাই যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সে কথা বলায় বাহুল্য।পার্ল হারবারের সেদিনের আক্রমনে খানিকেই নিভে যায় ২৪০২ জন মার্কিনির জীবন প্রদিপ।এদের মধ্য ৫৭জন ছিল বেসামরিক নাগরিক।এছাড়া আরো আহত হয় ১২৪৭ জন মার্কিন নাগরিক।চারটি যুদ্ধ জাহাজ ১৮৮টি বিমান ছাড়াও সেদিন আরো ধ্বংস হয় তিনটি ক্রুজার,দুইটি ডেস্ট্রয়ার এবং একটি সাধারণ জাহাজ।
অপরদিকে মার্কিনদের ক্ষতির তুলনায় জাপানিদের ক্ষতির পরিমাণ ছিল যৎসামান্য চারটি ছোট ডুবো জাহাজ ও ২৯টি বিমান ধ্বংস হয় তাদের।মৃত্যু বরণকরে ৬৪ জন জাপানি সেনা।বস্তুগতো ক্ষতির হিসাব আলাদা করে রেখে মানসিক ক্ষতির হিসাব কষলে দেখা যায় সেদিন মার্কিনদের মনোবল একদম গুরিয়ে দিয়েছিল জাপান।তুলে নিয়েছিল তাৎক্ষণিক যুদ্ধ জয়ের প্রশান্তি।
জাপান থেকে প্রায় চার হাজার মেইল দূরে অবস্থিত আমেরিকার হাওয়াই দ্বিপপুঞ্জের নৌ-ঘাটি পার্ল হারবারের উপর এমন আক্রমণ হতে পারে তা যুক্তরাজ্যের কল্পনাতেও ছিলনা।পার্ল হারবার আক্রমনে তৎক্ষণাৎ বিজয় তুলে নিলেও এর জন্য কড়া মাশুল গুনতে হয়েছিল জাপানিদের।১৯৪১ সালের পার্ল হারবার আক্রমনের পূর্ব পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে উদাসিন ছিল যুক্তরাজ্য। কিন্তু এই হামলার পরে তারা সরাসরি যোগদেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।
সাময়িক ভাবে জয় লাভ করা জাপানিরা কল্পনাও করেনি এই আক্রমনের মাধ্যমে তারা মার্কিনদের মনো যে বিষ বৃক্ষ রোপন করেছে তার শিকড় এতো সুদুর প্রসারি হবে।নিজেদের এলাকায় জাপানিদের আক্রমনের ক্ষতো ধিরে ধিরে ক্ষোভে রূপান্তরিত হয় মার্কিন বাহিনিদের মনে।
এই ক্ষোভের তারনায়,১৯৪৫ সালের ৬ এবং ৯ অগাস্ট , জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির বুকে তারা গেথে দেয় বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালি পারমানবিক বোমা লিটল বয় ও ফ্যাট ম্যান।নিমিষেই প্রাণ হারায় প্রায় দুই লক্ষ চোদ্দা হাজার মানুষ।এর অধিকাংশই ছিল বেসামরিক,যাদের প্রার্থনাতে যুদ্ধ থাকত না,থাকতো কেবলই শান্তি।তবে এটাও সত্য যে ওই সময়ের জাপানের কথা চিন্তা করতেই অবাক লাগে এখন।কোরিয়া আর চিনের কিছু অংশ আগেই দখলে ছিল তাদের।এরপর একে একে হংকং,ফিলিপাইন,থাইল্যাণ্ড,বার্মা, সিংগাপুর দখল করে ফেলে তারা;এমনকি ভারত ও অস্ট্রেলিয়া দখলের পরিকল্পনাও ছিল তাদের।পরে অবশ্য আমেরিকার পারমাণবিক খেয়ে লাইনে আসতে বাধ্য হয় তারা।শেষ হয় পৃথিবীর ইতিহাসে এক ভয়ানক সাম্রাজ্যবাদের
সে জাপান আর আজকের জাপান ভাবতেই গা সেউরে ওঠে।
পার্ল হারবার এর কাহিনীকে পূজি করে ২০০১ সালে বিখ্যাত মার্কিন পরিচালক মাইকেল বে নির্মণ করেছিলেন বিশ্ব খ্যাত War Movie পার্ল হারবার।সত্য অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমা সমালোচনার জন্ম দিলেও দেশে বিদেশে প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছে।পার্ল হারবার সিনেমা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে জাপানি ভয়াবহতা কতো প্রকার ও কি কি।আপনাদের মধ্য যারা সিনেমা প্রেমি আছেন তার অবশ্যি এই সিনেমা মিস করবেন না।পুরোপুরি টানটান উত্তেজনার এই সিনেমা তো বটেই;সে সঙ্গে ইতিহাসের ও এক জ্বলন্ত দলিল।
সর্বপরি পার্ল হারবার আক্রমণ ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়।ইতিহাস কখনো চায়না তার বুকে এতো রক্তারক্তি হোক,খুনোখুনি হোক,ধ্বংস যোগ্য চলুক।তবুও তাকে বুক পেতে নিতে হয় উষ্ণ রক্তের অনূভুতি।প্রতিটি যুদ্ধে প্রাণ যায় লাখো মানুষের।সবায় চায় পৃথিবীর বুকে প্রতিটি দিন নির্ভয়ে কাটাবে,কখনোই যুদ্ধের দামামা বাজবে না।আচমকা যম দূতের মতো বোমা খসে পড়ে নিয়ে যাবেনা লাখো মানুষের প্রাণ।পৃথিবীর বুকে কোন যুদ্ধ বিমান সাইরন বাজিয়ে উড়ে বেড়াবেনা আর।উড়বে শুধু শান্তির সফেদ পতাকা।