অভিমান ছোটগল্প সত্য ঘটনা অবলম্বনে
কিছুদিন আগে রাতের বেলা গিয়েছিলাম ডাঃ দেখাতে ৷
ডাঃ চেম্বারের বাইরে ওয়েটিং রুমে বসে অপেক্ষা করছি৷ তখন প্রায় ১১:০০ টা ছুই ছুই । হঠাৎ চোখ পড়লো ওয়েটিং রুমের এক কোনে মাঝবয়সী একটি মেয়ে মনমরা হয়ে চুপচাপ বসে আছে, তার আশে পাশে কাউকে দেখতে পেলাম না ৷ মেয়েটি বারবার মোবাইলের দিকে তাকাচ্ছে, কাউকে যেন কল করতে চাচ্ছে কিন্তু করছে না ৷ কি যেন এক আরষ্টতায় সে ফোন করতে পারছে না ৷
আবার কিছুক্ষণ পর পর ওড়না দিয়ে চোখ মুছতেছে ৷ না ঠিক মেয়ে ও বলা যায় না আবার মহিলা ও বলা যায় না ৷ যাই হোক আমি একটু কৌতূহল বশত মেয়েটির কাছে গিয়ে বসলাম ৷ মেয়েটি একটু মৃদু হাসি দিল আমায় দেখে ৷ যদিও হাসিটি মলিন ছিলো তবুও দেখতে ভালো লাগছিলো তাকে ৷ আমিও একটু হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ডাঃ এর কাছে কি একা এসেছেন ?
সে আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না,
আধভাঙ্গা গলায় মেয়েটি বললো জি আপু একাই এসেছি ৷ আমি আবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
বাসায় কেউ নেই ? এত রাতে একা ?
না আপু , আমার সাথে আসার মতো কেউ নেই ৷
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম ,কি সমস্যা নিয়ে এসেছেন ডাঃ এর কাছে ? মেয়েটি হেসে উত্তর দিলো হাতে ও পায়ের হাঁড়ে একটু সমস্যা হচ্ছে, কিছু দিন আগে একটা ছোট স্ট্রোক হয়েছিলো সেই থেকে
সমস্যা ৷ তাই ডাঃ এর কাছে এসেছি ৷
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না ৷
মেয়েটি নিজে থেকেই বলতে শুরু করলো ৷
হাজবেন্ড বান্ধবীদের সাথে একটা প্রোগ্রামে আছে ৷ ব্যস্ত,তাই আসতে পারে নাই৷ প্রোগ্রাময়ের তারিখটা আগে থেকেই ঠিক ছিলো তো তাই সেখানে গিয়েছে ৷ যাবার আগে ডঃ এর সিরিয়াল সে নিজেই দিয়ে গেছে ৷ আবার হেসে বললো যদিও ভিজিট দিতে ভুলে গেছে , প্রোগ্রামে গিয়ে মেসেজ দিয়েছে মাসের শেষ হাতে টাকা নেই তাই ডাঃ এর ভিজিট দিতে পারি নাই ,তুমি একটু ব্যবস্থা করে নিও ৷মেয়েটি আবার বলতে শুরু করলো তার জীবন গল্প আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না, শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম কিছু করেন চাকরি বাকরি? টাকা ম্যানেজ করতে বললো যে আপনার স্বামী?
হেঁসে বলল না কিছু করি না ৷ মা পাঠিয়েছেন কিছু টাকা ৷
নিজের অজান্তেই চোখের কোনে জল চলে এলো আমার ৷ শুধু চুপ করে শুনতে লাগলাম মেয়েটির গুমোট আর্তচিৎকার ৷
মেয়েটি বলতে লাগলো তাঁর বর তাকে খুব ভালোবাসে,তারা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো ৷ বাবার বাড়ীর কেউ রাজি ছিলো না তাই খুব একটা আসেও না তাকে দেখতে ৷ কিন্তু মা সকলের অলক্ষ্যে প্রতি মাসেই কিছু টাকা পাঠায় হাত খরচের জন্য ,বাবাকে না জানিয়ে ৷ অসুস্থতার খবর শুনেও বেশ কিছু টাকা পাঠিয়েছে ৷ তা দিয়েই চিকিৎসা করাচ্ছি ৷ হঠাৎ মেয়েটির ফোন বেজে উঠলো ৷ সাউন্ড কোয়ালিটি একটু বেশি থাকায় অপর প্রান্তের কথাগুলো আমি স্পষ্টই শুনতে পেলাম ৷
মেয়েটির বর বলতে লাগলো
কোথায় তুমি? এখনো বাসায় এলে না ? খাবার বেড়ে দিবে কে? এতো রাত হয়ে গেলো ,আজ থাক ডাঃ দেখানো লাগবে না,বাসায় চলে আসো ৷
মেয়েটি বলতে লাগলো টেবিলে খাবার ঢেকে রেখেছি প্লেট ও রেখে এসেছি টেবিলে একটু কষ্ট করে নিয়ে নাও প্লিজ । নয়তো মাকে বলো খাবার বেড়ে দিতে ৷
তারপর ফোন রেখে চুপ করে বসে রইলো ৷ আমিও আর কিছু বলে বিব্রত করতে চাই নাই৷
১২:০০টার সময় মেয়েটির ডাক এলো, মেয়েটি ডাঃ চেম্বারে ঢুকে গেল ৷
মেয়েটি যখন চেম্বার থেকে বের হলো দেখে তার স্বামী দাঁড়িয়ে আছে, মেয়েটি খুব খুশি হয়ে বলল চলো বাইরে থেকে খেয়ে যাই ৷
মেয়েটির স্বামী বলতে লাগলো
যা টাকা ছিলো সব বান্ধবীদের আইসক্রীম খাওয়াতে শেষ হয়ে গেছে ৷
মেয়েটির হাসিমুখটা মলিন হয়ে গেল ৷
তারপরও বললো আমিই খাওয়াবো চলো ৷
তারপর দুজনে বের হয়ে গেল ৷
আমিও ডাঃ দেখিয়ে বাসায় ফিরে এলাম ৷
সে রাতে আমি একটুও ঘুমাতে পারিনি , শুধু মেয়েটির মুখটা ভেসে ওঠছিলো ৷
বেশ কিছুদিন ধরেই বাইরে বের হলে মেয়েটিকে মনে মনে খুঁজি সেদিন হঠাৎ দেখা হয়ে গেল রাস্তায় ৷ আমিই নিজে থেকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছেন?
মেয়েটি খুব মিষ্টি করে হেসে বললো ভালো আছি আপু আপনি কেমন আছেন?
-ভালো আছি, তারপর তোমার শরীরের কি অবস্থা? এখন কেমন আছো ?
-আলহামদুলিল্লাহ আপু ভালো আছি ৷
-তা কোথায় গিয়েছিলে ? ঔষধ কিনতে?
– না আপু, গিয়েছিলাম কাফনের কাপড় কিনতে?
– মানে? (আমার বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে
উঠলো) কে মারা গেছে?
– মেয়েটি ম্লান হেসে বললো কেউ মারা যায়নি৷
– তাহলে কাফনের কাপড় কেন?
– অ তাই জিজ্ঞেস করলেন ? আসলে আমার কাফনের কাপড় কিনে রাখলাম ৷ কখন মারা যাই তা তো বলা যায় না, তখন যদি আবার আমার বরের হাতে টাকা না থাকে তাই কাফনের কাপড়টি কিনে রাখলাম ৷
আমি খুব ভালোবাসি আমার বরকে,তাকে কষ্ট দিতে চাইনা কখনো, মরে গিয়েও নয়। কাফনের কাপড়ের সাথে আমার দাফনের যা খরচ হবে তাও একসাথে রেখে দিব। আচ্ছা আপু যাই তবে দেরি হয়ে যাচ্ছে ৷
মেয়েটি চলে গেল ৷ আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ৷
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম মনে নেই।
মেয়েটির অভিমান আমাকে বড্ড এলোমেলো করে
দিয়ে গেল, শুধু প্রশ্ন জাগে তার বর কি আদৌ এই অভিমানের মূল্য দিবে?
ভালোবাসার তীব্রতায় কাউকে আপন করে নেয়া
যায়, স্বপ্নের রাজ্যে ঘুরে বেড়ানো যায় ৷ নিঃসঙ্গতার প্রহরগুলো পার করা যায় অনায়াশে৷ কিন্তু হুট করে প্রিয় মানুষের অবহেলা ভালোবাসার ঘাটতি দেখা দিলে কষ্টটা মেনে নিতে না পেরে অনেকেই হতাশায় আক্রান্ত হয়ে বিষণ্নতায় ভোগে। অভিমান মনে পোষে রেখে এক সময় নিশ্চিহৃ হয়ে যায়।
#মারজিয়া_পপি