#ফাবিয়াহ্_মমো
পূর্বিকা এমন চোখে তাকিয়ে রইলো যেনো আগ্রার তাজমহল হেটে হেটে বাড়ি চলে এসেছে। পূর্বিকা একা আশ্চর্য হয়নি! সঙ্গে বাবা, মা, দাদা, ও দাদী রাতের খাবার ভুলে হুড়মুড়িয়ে ঢোকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে ছিলো! ধাম করে দরজা ধরাশায়ী করার মতো বিকট শব্দ হতেই পূর্বিকা সিউর বুঝলো কিছু একটা গন্ডগোল নিশ্চয়ই হয়েছে! নতুবা পূর্ব বউভাতের রীতি ছেড়ে পূর্ণতাকে একা ফেলে রাতেরবেলা ফিরে আসবে এমনটা কখনো হতে পারেনা। পূর্বিকা রুমে গিয়ে দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। পূর্ব বিছানায় বসে মাথা ফ্লোরের দিকে নুয়ে চুল আকড়ে স্তব্ধ হয়ে আছে। পূর্বিকা বিষ্ময় গলাতে ভ্রুঁ কুঁচকে বলে উঠলো,
– তোর কিছু হয়েছে পূর্ব? তুই ঠিক আছিস?
পূর্বের কোনো সাড়াশব্দ নেই। পূর্বিকা ওর পাশে বসে পিঠে হাত রেখে বললো,
– আমি জানি তুই আমাকে ভুলেও কোনো কিছু শেয়ার করবি না। অন্তত আজকে বল তোর কিছু হয়েছে? পূর্ণতা কোথায়?
পূর্ব অনেকক্ষন পর মাথা তুলে ঢোক গিলে বললো,
– ওই বাড়িতে। আনিনি আমি। ওখানে কিছুদিন থাকুক।
– তোর অবস্থা মোটেই শোচনীয় দেখাচ্ছেনা পূর্ব! আমাকে সত্যটা বলতে সমস্যা কি?
– কিসের সত্য? চেঁচাবি না প্লিজ। মাথাব্যথা করছে। যা!
পূর্বিকা আর ঠেলাঠেলি করলোনা প্রসঙ্গ জানার জন্য। যে কাজে এসেছিলো সেটা ওর বিছানায় রেখে চলে যেতে যেতে বললো,
– নিউ মোবাইলের কুরিয়ার এসেছে। ফোনটা দেখে নে। সিম লোড করাই আছে। না খেয়ে থাকলে খেতে আসিস। জোর করবো না।
পূর্বিকা চলে যাওয়ার পর আরো দশ মিনিট পূর্ব ওভাবেই স্থিরপানে বসে রইলো। চোখ বন্ধ করার সাহস পাচ্ছেনা একদম। ওই বিশ্রী নোংরা দৃশ্যটা চোখের প্লটে ভেসে উঠে নির্দ্বিধায়। হঠাৎ খেয়াল হলো পূর্ণতা ওকে না পেয়ে অবশ্যই এতোক্ষনে বাড়ি উঠিয়ে ফেলেছে। পূর্ব বিছানার উপর থেকে নিউ মডেলের সেটটা তুলে পূর্ণতাকে একটা টেক্সট করলো।
‘I’m at home now. Don’t be tensed. I’ll come tomorrow to pick you. Stay there.
ইংলিশ এ্যালফাবেট দ্বারা খুবই সুকৌশলে টেক্সটা লিখে সেন্ড করার পাচঁ মিনিটের মধ্যেই কল এলো। পূর্ব কল কেটে দিলো। এখন মোটেই কথা বলার মতো স্থিতিতে নেই। গলা দিয়ে ভুলভাল শব্দ বেরিয়ে গেলে পূর্ণতার মতো অত্যধিক ইমোশনাল মানুষটা কষ্ট পাবে। পূর্ব টেক্সট করলো,
‘I said somthing to you Purno. Please keep my words. I’ll definitely come tomorrow. Now go to bed.
সাথেসাথে পূর্ণতার মেসেজ,
‘ তুমি আমাকে একা ফেলে চলে গেছো কেন?আমাকে নিয়ে যাও প্লিজ। আমি কি ওয়াকিল ভাইকে বলে চলে আসবো? আমি একা থাকবো না!!আমি চলে আসবো।’
‘Tumi ki seriously ekta gadha? 8 bochor er baccha tumi? Kotha bolle kotha shono na keno?”
পূর্ব মেসেজটা প্রচণ্ড রেগেই করলো। এরপর আর কোনো মেসেজ এলো না ফোনে। সময়ের কাটা পেরিয়ে যাচ্ছে এখনো একটা রিপ্লায় আসছেনা এপাশে। পূর্ব বুঝতে পারলো এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির অনাচার মনটা খামোখা রাগ ঝাড়লো পূর্ণতার উপর। ডেফিনেটলি এই মেয়ে টেক্সটটা পড়েই কেদেঁ নাক মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে! নয়তো এতোক্ষনে রিপ্লায় এসে পরতো। পূর্ব শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে কল করলো। ওপাশ থেকে রিসিভ হলেও চাপা কান্নার আওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনা গেলো না। পূর্ব শার্টটা বিছানায় ছুড়ে বারান্দায় দাড়িয়ে পকেটে হাত গুঁজে অনেকটা শান্ত কন্ঠে বললো,
– কান্না থামলে আমি কিছু বলতে পারি?
পূর্ণতা মুখে কিছু চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টায় আছে কিন্তু ফলপ্রসু হয়নি। পূর্বের কানে এখনো কান্নার ফিসফাস শব্দ আসছে সেই সাথে পৌঁছেছে বিনা উত্তর। পূর্ব রাতের আকাশে নক্ষত্রালোকের দিকে ম্লান দৃষ্টি রেখে বললো,
– আমি বলেছি তো কাল এসে নিয়ে যাবো। কেন কাঁদছো? চুপ করো। এখনো বাঁধে বসে থাকলে এক্ষুনি রুমে যাও।
পূর্ণতা ফুপাতে ফুপাতে কান্না জড়িত গলায় বলে উঠলো,
– তুমি আমার উপর রাগ দেখিয়ে চলে গিয়েছো। আমি জানি কালও তুমি আমায় নিতে আসবেনা। এখানেই রেখে পার্টির অফিসে চলে যাবে।
– কি আবোলতাবোল বকছো? হুঁশ জ্ঞান নেই?
– তাহলে বলো, কেন তুমি অকারণে চলে গেলে? কেন সেসময় উদ্ভট আচরণ করলে? উত্তর আছে তোমার কাছে? নেই তো! তুমি তো জবাব দিয়ে আমায় ধণ্য করবেনা। আমি তো তোমার কাছে তুচ্ছ..
পূর্ব কথা শেষ করতে দেয়নি। ভারি নিশ্বাস ছেড়ে কান থেকে ফোন নামিয়ে কল কেটে দেয়। মোবাইলটা পকেটে রেখে রেলিংয়ে পিঠ লাগিয়ে ফ্লোরে বসে পরে। ঘুমের মধ্যে সেই আবছা রুমের আধো পোশাকের নারী, সেই অপ্রতিভ অশ্লীলতা, সোজাসাপ্টা ঠোঁটে ছোঁয়া বসিয়ে দেওয়া এসব নিয়ে ভাবলেই মাথাটা প্রকট ব্যথায় ঝিমিয়ে উঠে পূর্বের। এতোটা জঘণ্য আচরণ কোনো মেয়ে করতে পারে? নিজের ইজ্জত অন্য একটা ছেলের সামনে সুযোগ লুফে অশ্লীল কর্ম প্রদর্শন করতে পারে? নারীসঙ্গের প্রতি কষ্মিনকালেও দূর্বলতা ছিলো না পূর্বের। নিজের উপর যথেষ্ট কনফিডেন্স, কন্ট্রোল, কনসাইন্স আছে ওর। আনিশার সাথে বন্ধুর মতো বা তার চেয়ে বেশি থাকাকালেও অদ্ভুত ভাবে স্পর্শ করার চিন্তা স্বপ্নেও ভাবেনি পূর্ব। তবে পূর্ণতার হঠাৎ আগমনে পূর্ব কিছুটা বেঁকে গেলেও শেষ পরিণতি নিজের জায়েজ সম্পর্কের দিকেই এগোয়। একটা মেয়ে ওর বুকের উপর নিজের অর্ধবৃত্ত দেহ কিভাবে লুটানোর সাহস পায়? ওই মেয়ের লজ্জা না থাকুক কিন্তু ঘেন্নায় নিজের শরীর এখন দূষিত বস্তুর মতো লাগছে পূর্বের। পূর্ণতার মুখোমুখি কি করে হবে? পূর্ব অস্থিরতায় উন্মুখ হয়ে বাথরুম থেকে পাক্কা তিনঘন্টার গোসল নেয়। রয়েল ব্লু রঙের ট্রাউজার পরে বারান্দায় ফিরলেও গলায় ঝুলানো টাওয়েল দিয়ে ঠোঁট ঘষতে থাকে। এ নিয়ে টানা ষোলবার হলো পূর্ব নিজের ঠোঁটে সেই দুষ্কৃতির স্শর্প ভুলার জন্য ঘষাঘষি করছে। তাও মনে হচ্ছে সেই অপকীর্তির রেশ ঠোঁটে রয়ে গেছে। বিছানার উপর থেকে ফোনটা নিয়ে স্ক্রিন অন করলো পূর্ব। নোটিফিকেশনে ’22 new massages’ ভেসে উঠেছে। পূর্ব সব নোটিফিকেশন ক্লিন করে, বর্তমানে পূর্ণতার মেসেজ দেখার মতো মাথা ঠিক নেই। দুহাতের ডোরে বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্যে অনেকক্ষন ধরে তীব্র মেজাজে কিছু টাইপ শেষ করে বিছানায় শুয়ে পরলো সে। এসময় মৃত্যুটা হলে কি খুব খারাপ হতো? না হতো না। অন্তত পূর্ণতার সামনে ওই দৃশ্যবিবরণী বলার মতো সুযোগ তার কখনোই হতো না। যন্ত্রণা ভোগের চেয়ে মৃত্যু গ্রহণ করাটা সহজ।
.
গাছের গুড়িতে বসে হাঁটুতে কপাল লাগিয়ে কেদেঁ যাচ্ছে পূর্ণতা। একটাবার পূর্ব বলে গেলো না, সেধে গেলো না, ইশারাও করলো না ‘চলো পূর্ণ যাবে’। পূর্ণতার কি দোষ ছিলো? মা যদি ধরেবেঁধে শত ‘ না না’ করা সত্ত্বেও ওকে জোর করে মৃত্যুশয্যার নিয়ামুল কাকার বাড়িতে নিয়ে যায় এতে পূর্ণতার কি দোষ? পূর্ণতা তো ইচ্ছে করে যেতে চায়নি, দুপুরের পর ঘুমন্ত পূর্বের পাশেও ছিলো পূর্ণতা। কিন্তু মায়ের তাড়নায়, একজন পরিচিত কাকার অসুস্থতার খবর শুনে উৎকট পরিস্থিতির আক্ষেপে ফেসে, না গিয়ে উপায় ছিলো না। সামান্য এটুকু সময়ের মধ্যে পূর্বের সাথে কি হয়েছে পূর্ণতা সেটা কোনোক্রমেই বের করতে পারছেনা। পূর্ণতার খোঁজে বাড়ির প্রতিটি সদস্য হন্যে হয়ে এদিকওদিক ছুটে গেলে শেষে আয়মান ওকে আবিস্কার করে বাঁধে। আয়মান স্বল্প আলোতে কালো অন্ধকারে স্পষ্ট শুনতে পেলো ওর কান্নাধ্বনি। দৌড়ে হন্তদন্তে পৌছে বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
– তুই এখানে? তোরে কই কই পাগলের মতো খুজছি জানোস? শালীর ঘরে শালী! এদিকে একলা একলা ভ্যা ভ্যা করোস কেন? কি হইছে?
পূর্ণতা নাক টেনে ফোলা চোখ মেলে আয়মানের দিকে তাকাতেই আবারো ফুপিয়ে কেদেঁ দেয়। আয়মান সিরিয়াস হয়ে কপাল কুঁচকে তীব্র কৌতুহলে বলে উঠলো,
– তুই কিছু বলবি বইন? তোর কান্না তো আমার কাছে ভালো কিছুর আভাস দিতাছেনা। ঝেড়ে বলবি?
পূর্ণতা আঁচলে মুখ ঢেকে হেঁচকির সুরে বলে উঠলো,
– পূর্ব একা চলে গেছে দোস্ত। আমাকে নিয়ে যায়নি।
– মানে কি?একলা যাইবো কেন?
– জানিনা…বড়বাড়ি থেকে মামী ডেকে এনে বললো পূর্ব কেমন জানি করছে। আমি দৌড়ে এসে দেখি…
– হুর ছেড়ি! কথা কমপ্লিট কর!
– উনি অদ্ভুত আচরণ করছে। আমি…আমি উনাকে নিয়ে এখানে আসি। পানি আনতে গিয়ে ফিরে এসে দেখি উনি নেই। চলে গেছে।
– তুই কিভাবে জানলি ভাই চলে গেছে?
– ফোফোনে মেসেজ…
আয়মান এতোটা অতল বিষ্ময়ে কখনো ডুবেনি আজ যতোটা বিষ্মিত হয়েছে। পূর্ব অদ্ভুত আচরণ করবে? অসম্ভব ব্যাপার! পূর্ণতাকে একা ফেলে যাওয়ার মতো পাব্লিক পূর্ব না! প্রচণ্ড খটকার মধ্যেই আয়মান পরিস্থিতি সামাল দিয়ে পূর্ণতাকে ঠান্ডা করে ঘুমাতে যেতে বললো। বাইরে এসে সবাইকে একটা মিথ্যা গ্রহণযোগ্য কারণ দর্শিয়ে আয়মান সবটা কন্ট্রোলে আনলো। আপাতত পূর্বের কি হয়েছে সেটা জানা অতীব জরুরী কিন্তু পূর্ব কি কিছু বলবে?
.
রাত যখন তিনটার কাটাতে ছুইছুই তখন নিঃশব্দে দরজা ঠেলে অন্ধকার রুমে ঢুকলো কেউ। বিছানায় শোয়া ঘুমন্ত পূর্বের দিকে একপলক তাকিয়ে বিছানার উপর থেকে শার্ট সরিয়ে টেবিলে রাখলো। অন্ধকারে চোখ সয়ে কিছু একটা খুঁজতেই পূর্বের মাথার কাছে বস্তুটা পেয়ে ওর দিকে একটু ঝুঁকে ফটাফট বস্তুটা তুলে বারান্দায় চলে গেলো। স্ক্রিনে ডাবল ট্যাপ করে ফোন অন করতেই পূর্বিকা পিছু ফিরে পূর্বের দিকে একনজর আবার দেখলো। এরপর তাড়াতাড়ি ফোনের গ্যালারি চেক করলো, না কিছুই নেই যা থেকে জানা যাবে পূর্বের সাথে কি হয়েছে। পূর্বিকা ‘আল্লাহ্ আল্লাহ্’ করতে করতে ফোনের সব অ্যাপস স্ক্রল করতেই একটা ব্যতিক্রম আইকনের দিকে চোখ আটকে গেলো, নাম ‘Notebook’। পূর্বিকা খুব দ্রুত ক্লিক করে রেলিংয়ে পিঠ দিয়ে সরু চোখে পড়তে লাগলো। ক্রমান্বয়ে পূর্বিকার চোখ সরু থেকে আরো সরু হতে লাগলো। বুক ধড়ফড় করছে তালে তালে। গলায় খুবই আস্তে ঢোক ফেলছে যেন গলায় বিশাল কাঁটা আটকে আছে ওর। শুধু শেষ লাইনটা বিনা শব্দে ঠোঁটে নাড়িয়ে পড়তেই হাপড়ের মতো নিশ্বাস আটকে এলো,
‘ I’m dying…Can’t take it more.’
পূর্বিকার চোখে শ্রাবণের মতো জমা হওয়া পানি কয়েক মিনিট নিরবে পরলো। স্তব্ধ হয়ে দৃষ্টিলব্ধ করে মোবাইলের স্ক্রিনটা কখন যে ভিজে গেলো খেয়াল নেই। পূর্বিকা ওড়নায় স্ক্রিনটা মুছে পূর্বের পাশে এসে দাড়ালো। চোখ মুছতে খেয়াল নেই। সকালেও তো ফুরফুরে খুশিতে খুব আমোদিত ছিলো ও। কি সুন্দর হাসি দিয়ে বললো, ‘তোর বাচ্চাকাচ্চার আগে আমার গুলো এসে পরবে দেখিস! তোকে তো আমার বাচ্চার চাকরানী বানাবো। নো বেতন! খালি খাটবি!’ সেই উৎফুল্ল মেজাজের রাগচটা মানুষটা এতো মিষ্টি হাসি দিয়েছিলো যে পূর্বিকা এখন সেটাই অঘোরে কল্পনা করছে। পূর্বের কপালে চুল সরিয়ে দিয়ে নিজের চোখটা তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলে চেপে হন্তদন্তে রুম থেকে বেরিয়ে যায় পূর্বিকা। একটা পাথরের কাছ থেকে যেমন উত্তর পাওয়া যায়না পূর্বের পেট থেকে কখনো গোপন কথা বের হয়না। কিন্তু নোটবুকে যা পড়লো তা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে পূর্বিকা। বিছানায় শুতেই ইচ্ছে করলো পূর্ণতাকে অকথ্য ভাষায় কিছুক্ষণ গালিগালাজ করতে! ওই মেয়ে কোথায় ছিলো যখন পূর্ব একা ঘুমালো? কিসের এতো কাজ ছিলো ওর? পূর্বিকা ঠিক করলো সকাল হতেই সে পূর্ণতার বাড়ি গিয়ে খুব কঠিন কথা শোনাবে! খুবই কঠিন যা এ পযর্ন্ত পূর্ণতা সেটা কল্পনাও করেনি!
.
সন্ধ্যা সাতটা থেকে পরদিন সকাল আটটা পযর্ন্ত চোখের পাতা ভুলেও লাগেনি পূর্ণতার। ফ্লোরে বসে রুমের পেছনের দরজা খুলে পুরোটা সময় কাটিয়ে ফেলেছে সে ভাবতে ভাবতে পূর্বের আসলে কি হয়েছে। উত্তর পায়নি। সকালে কলপাড়ে হাতমুখ ধুতে গেলে আনিশা দাঁত ব্রাশ করতে করতে বলে,
– পূর্ব কাল চলে গেলো কেনো?
পূর্ণতা পায়ে পানি ঢেলে চলে যেতে যেতে বলে,
– জানিনা।
নাস্তার টেবিলে পূর্ণতাকে খেতে না দেখে খোদেজা মেয়েকে জিজ্ঞেস করে বসলেন,
– আচ্ছা তোদের জামাই বউয়ের মধ্যে কি ঝামেলা হয়েছে? বিয়ে না করতেই আলাদা? তুই খুলে বলবি পূর্ণতা?
– আমাদের ঝগড়া হয়নি। উনার শরীরটা খুব খারাপ তাই বাড়ি চলে গিয়েছেন। উনি তো খুব শুচিবায়ু মা। এখানে এতোসব গোজামিল উনার পছন্দ না।
সকাল এগারোটার দিকে পূর্ণতার অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে গাড়ি দিয়ে এলো পূর্বিকা, শ্বশুর, শ্বাশুরি ও দাদী। পূর্ব সঙ্গে নেই। পূর্ণতার মন খারাপ আরো তীব্র মাত্রায় যুক্ত হলো। আড়ালে যেয়ে চোখের পানি ফেলতে পারলে শান্তি লাগতো। পূর্বিকা কটমট দৃষ্টিতে পূর্ণতার বির্মষ মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাসিবিহীন ঠোঁটে বলে উঠলো,
– পূর্ণতা? তুমি কি এখন আমার সাথে যাবে? নাকি আম্মু ও দাদীর সাথে সন্ধ্যায় যাবে? বাড়িতে কেউ নেই। আসলে পূর্বের প্রচণ্ডরূপে মাথাব্যথা। এজন্য চলে যেতে চাচ্ছি। রুমে সেই যে শুয়েছে আর উঠেনি। তবে, তুমি চাইলে কিছুদিন থাকতে পারো। পূর্বের আপত্তি নেই।
পূর্ণতা এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে বলে উঠলো,
– আপু, আমি এখনি যেতে চাই। আম্মা, দাদী নাহয় সন্ধ্যায় আসুক।
– বেশ। চলো তাহলে। আমি অটো ঠিক করি। গাড়িটা এখানে থাক। মিথুনরা পিকনিক থেকে ঘুরে এলে উনাদের পিক করে নিয়ে যাবে।
রাস্তায় পূর্বিকা চুপটি থাকলেও বাড়িতে ফিরতেই মুখের ভঙ্গিমা পাল্টে রূঢ়রূপে ক্ষেপে পূর্ণতার হাত চেপে পূর্বের রুমে ঢুকলো। পূর্ণতা আশ্চর্য হয়ে হাত ছাড়ানোর জন্য অনুনয় করে বারবার জিজ্ঞেস করলো, আপু কি হয়েছে, আপনি এমন করছেন কেন, আপু বলুন না। পূর্বিকা পূর্বের বিছানার কাছে হালকা ধাক্কা মারতেই পূর্বের দিকে তর্জনী তুলে বলে উঠলো,
– এটা কে শুয়ে আছে জানো? আমার ভাই! আমার একমাত্র ভাই! ও কি করেছে শুনতে চাও? তিনটা ঘুমের ট্যাবলেট গিলে মরার মতো ঘুমিয়ে আছে! ওর সাথে কি হয়েছে সেটাও তো জানোনা! জানবে কি করে? বাপের বাড়ি গেলেই তো স্বামীর কদর শেষ! আমার ভাইকে তুমি বেহালে ফেলে…
পূর্বিকা প্রচুর রেগে ফোসফোস করছে। পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে আবারও বলে উঠে,
স্বামী একা ফেলে মায়ের আচঁল ধরে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বড়বাড়ি ঘুরতে যাও লজ্জা করেনা? শুনে রাখো পূর্ণতা, আমি পূর্বিকা আমার ভাইয়ের সাথে কোনো হেনতেন অবস্থা দেখার জন্য বসে নই! আমি কি জিনিস তা বুঝাতে যেন না হয় আমার! মাথার নর্দমা ঝেড়ে আমার সব কথা ওই ছোট্ট মস্তিষ্কে ভালোভাবে ঢুকাও !
পূর্ণতার অশ্রান্ত চোখদুটো ছলছল করে গাল বেয়ে বর্ষন হতে লাগলো। কি নিয়ে এতো কটু কথার স্বীকার হচ্ছে? পূর্ণতা হাতের উল্টে পিঠে চোখ মুছে পূর্বের দিকে দৃষ্টি দিতেই হতবাক হয়ে যায়! চোখের সেই স্নিগ্ধ চাহনি আর নেই এখন ম্লান নয়নে পরিণত হয়েছে, ঠোঁটের একপাশ রক্ত জমে লালবর্ণে ফুলে আছে, কি হয়েছে ওর? পূর্ণতা বিছানায় বসে। পূর্ব বুক থেকে পা পযর্ন্ত সাদা কাথায় গা ঢেকে শুয়ে আছে। পূর্ণতা কাছে ঝুঁকে কপালে শক্ত করে ঠোঁট ছুয়িয়ে দিতেই পূর্বের গালে হাত রেখে বলে উঠে,
– ঘুম থেকে উঠো পূর্ব। চোখ খুলো। এই দেখো আমি এসেছি। পূর্ব উঠো।
পূর্ব চোখ খুলতে না পেরে আবার ঘুমের গহীনে তলিয়ে যায়। পূর্ণতা আলতো করে ঠোঁটে ঠোঁট ছুয়িয়ে দিতেই টেবিলের উপর ট্যাবলেটের পাতা দেখে। আশ্চর্য দৃষ্টিতে চোখ দীর্ঘ করে পূর্বের দিকে তাকিয়ে নিষ্প্রভ হয়ে যায়। তিন তিনটা ঘুমের ট্যাবলেট নেই? পূর্ণতা এখন কি করবে? এমন উপায়ন্তর পরিস্থিতিতে কাঁদার স্থিতিটুকু হারিয়ে ফেলেছে ও। ট্যাবলেটের পাতা রেখে পূর্বের মুখের দিকে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ পূর্বিকা নক করে বলে উঠলো,
– এইযে ম্যাডাম! স্বামীকে উঠানোর ব্যবস্থা করুন! সে ভালো নেই! আর হ্যাঁ ওর কি হয়েছে তা জানতে চাইলে ওর মোবাইলের নোটবুক অ্যাপসে ঢুকে জেনে নিতে পারেন।
পূর্বিকা দরজা চাপিয়ে চলে যেতেই পূর্ণতা বালিশের কাছ থেকে পূর্বের ফোনটা নেয়। ফোনটা যে নতুন কালই যে এসেছে তা বোঝা শেষ। পূর্ণতা কথামতো নোটবুক অ্যাপসে ঢুকতেই বলে উঠে, অবাক কান্ড তো! এটা তো পার্সনাল ডায়েরীর মতো। পূর্ব কি আপুকে ফোন চেক করতে দেয়? আমাকেই তো ফোন ধরতে দেয়না। আমি কি করে ওর অনুমতি ছাড়া ডায়েরী পড়বো? পড়া ঠিক হবে? নানা গোজামিল চিন্তাপ্রবণের মধ্যেও পূর্ণতা সিদ্ধান্ত নেয় যদি সত্য জানতে হয় তবে ডায়েরি পড়াই সঠিক। দ্বিধান্বিত মন নিয়ে পূর্ণতা নোটবুক এ্যাপসে ঢুকে পূর্বের টাইপিং লেখা পড়তে থাকে। ধীরে ধীরে পূর্ণতার হৃৎস্পন্দন বেগতিক হারে ছুটতে থাকে, স্বাভাবিক নিশ্বাসটা পযর্ন্ত উপর নিচ হচ্ছে ডায়েরির প্রতিটি শব্দমালা পড়ে,
‘ আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি ঘুমাতে পারছিনা। ওই দৃশ্যটা কতবার ভেবে আমি শিউরে উঠেছি জানা নেই। একটা মেয়ের কাছে কোনো অপরিচিত ছেলের সামান্য টোকা যেমন অস্বস্তিকর আমার কাছেও তাই। আমি পূর্ণতার স্পর্শ ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের হাতটা পযর্ন্ত টাচ করিনি। আমার শরীরের উপর একটা পোশাকহীন মেয়ের অস্তিত্ব ছিলো যাকে আমি চিনিনা, জানিনা, ওই অন্ধকারে দেখাও সম্ভব হয়নি ভাবলেই আমার বুক শুকিয়ে আসে। আমি ঘুমে বিভোর ছিলাম। দুটো প্রাজেল খেয়ে মাথাব্যথা থেকে বাচঁতে চেয়েছিলাম.. আমি কখনো ভাবিনি এমন খারাপ পরিস্থিতির শিকার হবো। আমি পূর্ণর সামনে কিভাবে দাড়াবো? ওকে কিভাবে বলবো পূর্ণ আমি এসব কিছুই জানিনা। তোমার পূর্ব কখনো এমন জঘন্যতম কাজ করার দুঃসাহস দেখাবেনা। ‘পুরুষজাতি নারীকুলে আসক্ত’ — চট করে এ কথাটা ওর মাথায় চলে আসবে। আমিও অন্যান্য ছেলেদের মতো সুযোগ লুফে নারীসঙ্গে সময় কাটিয়েছি। মেন্টালি ডিপ্রেশ্ড জিনিসটা কয়েক ঘন্টার মধ্যে আমায় কুড়েকুড়ে গিলে খাচ্ছে। সময় যাচ্ছে না যেনো থেমে আছে। আমি প্রচণ্ড মাথাব্যথায় ভুগছি, হুট করে এই অদ্ভুত ব্যথাটা কেন হচ্ছে তাও জানিনা। মাঝেমাঝে এমন ব্যথা করে মাথাটা কেটে ফেললে রেহাই পেতাম। আমি কি মরে যাবো? ওই বাড়িতে যাওয়ার পর থেকেই আমার মাথাব্যথাটা ঘিরে ধরেছে আমি পূর্ণতার সাথেও রাগারাগী ছাড়া কিছু করিনি। পার্টির কাজে এমনও হয়েছে টানা আটত্রিশ ঘন্টা আমি র্নিঘুমে কাজ করেছি কিন্তু মাথা ঝিমঝিম করা ছাড়া প্রকটরূপে ব্যথা কখনো ছিলো না। পূর্ণর সামনে যেয়ে এসব নোংরামির কথা বলার জন্য ভীষণ সময় আমার দরকার। আমি মরে যাওয়ার মতো কথা কখনো বলবো নিজেরই অবাক লাগছে। কঠিন থেকে কঠিন পরিস্থিতির শিকার হয়েছি কিন্তু মনের দূর্বলতা বানানোর পর থেকে আমি সুস্থ নই। সবসময় পূর্ণতাকে নিয়ে টেনশন ঘিরে ধরে। আমার শত্রুপক্ষ আমাকে কুটিকুটি করে মেরে ফেলুক তাতে আমার আফসোস নেই। ওর গায়ে একটা আচঁড় পরলেই আমি খুন হয়ে যাবো। আমি কোন কোন দিক সামলাবো? নিজের পাটি? নিজের শত্রু? নিজের সমস্যা? I’m dying, Purno. Can’t take it more. Can’t take it more… ‘
পূর্ণতা ফোনটা ফেলেই পূর্বের মাথা বালিশ থেকে তুলে চেপে ধরে। একটা মানুষ যাবতীয় চিন্তাভাবনা মাথার মধ্যে পুষে মনের ভেতরে কিভাবে চেপে রাখে? পূর্বের জীবনটা এমন স্ট্রিক্ট কঠোরভাবে চলছে তা এতোদিন ধোয়াশা ছিলো পূর্ণতার কাছে। ও ভাবতো, পূর্ব আমাকে মূল্য দেয়না, নিজের রাগ এটিটিউট নিয়েই ব্যস্ত থাকে রাজনীতির নামে কোনো ব্যস্ততা নেই ওর , নিজেরটাই ঠিক অন্যরা ভুল এমন মতবাদে অটল। পূর্ণতা ওর মুখে অজস্র ঠোঁটে ছুয়িয়ে রক্ত জমা ঠোঁটে আঙ্গুল বুলাতে থাকে।
– পূর্ব? ঘুম থেকে উঠো। দেখো না আমি চলে এসেছি। আমি…
পূর্ব হঠাৎ নিচুকন্ঠে বলে উঠে,
– মাথা ফেটে যাচ্ছে পূর্ণতা…
– তুমি কি একটু উঠতে পারবে? হতবিহ্বলে কন্ঠে পূর্ণতার প্রশ্ন!
– হু.. পূর্বের নিচু উত্তর।
– দাড়াও…
পূর্ণতা চটজলদি বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুম থেকে এক বালতি পানি নিয়ে আসে। বালিশের উপর মাথার নিচে রাবার ক্লথ বিছিয়ে পূর্বের মাথায় পানি ঢালে। টানা আধাঘন্টা পানি ঢালার পর পূর্ব একটু একটু চেতন ফিরে পায়। পূর্ণতা পানির বালতি ওয়াশরুমে রেখে তোয়ালে দিয়ে পূর্বের মাথা মুছতে মুছতে বলে উঠে,
– ডাক্তার ডাকবো? তুমি সুস্থ বোধ করছো? মাথাব্যথা এখনো হচ্ছে?
– ঠিক আছি। ব্যথা নেই। হালকা লাগছে।
পূর্ণতা মাথার নিচ থেকে ভেজা ক্লথটা নিয়ে গোল করে মুড়িয়ে বারান্দায় রেখে আসে। পূর্ব এখন বিছানায় উঠে বসেছে। পূর্ণতা ওর ঠিক সামনে বসে ভেজা চুলগুলো নাড়াচাড়া করতেই পূর্ব স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
– রাতে ঘুমাওনি ঠিক? কেদেঁ চোখ কি করছো? তোমার আম্মাজান বকেনি?
– চুপ! মাথাব্যথা করবে!
পূর্ণতা একটু জোর দিয়ে কথা বললে পূর্ব ওর কোমর আকড়ে টান মেরে জাপটে ধরে। পূর্ণতার চুলের কাটা টান দিয়ে খোপা আলগা করে খুলতে খুলতে ঠান্ডা গলায় বলে উঠে,
– আজ তো পূর্ব আস্তানায় নিজেই ধরা দিলে এখন পালাবে কোথায়? কালকের শোধ তুলবো? তোমাকে আগেও বলেছি, আমার সামনে চুল বেধেঁ রাখবেনা। একদম মেরে ফেলবো!
পূর্ণতার মন উদাস হয়ে যায়। পূর্ব এখনো কালকের ঘটনা স্কিপ করে পূর্ণতার কাছে গোপন করছে। এই মানুষটা এতো শক্ত কেন?পূর্ণতার মন খারাপের প্রসারটা আরো বিশাল গহ্বর তলিয়ে পূর্বকে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে ধরে বলে,
– আমি কোথাও পালাবো না। এখানেই থাকবো।
পূর্ব খটকা গলায় বলে উঠে,
– কিছু হয়েছে?
পূর্ণতা ওকে ছেড়ে কোনো জবাব না দিয়ে গালে চুমু দিয়ে বলে,
– কিছু হয়নি।
পূর্ব ঠোঁট বাকিঁয়ে মুচকি হেসে দেয়। মজা করে বলে উঠে,
– সত্যি কিছু হয়নি? তুমি পাগলের মতো চুমু দিচ্ছো কেন?
পূর্ণতা পূর্বের সমস্ত মুখে চুমু দিয়ে ওর মায়াকাড়া চোখদুটোতে দৃষ্টি আবদ্ধ করলো। পূর্বের রক্ত জমা ঠোটে প্রফুল্লচিত্তের হাসি ঝিলমিল করছে কিন্তু চোখ কিছুটা কৌতুহলে ঠাসা। পূর্ণতা পূর্বের হাত এনে কোমরে রেখে নাকে নাক লাগিয়ে বলে উঠলো,
– সৃষ্টিকর্তা আমার অভাব জানতে চাইলে আমি বারবার তোমার কষ্টগুলো নিজের জন্য চাইবো।
পূর্ব কিছুটা আশ্চর্য হয়, পূর্ণতা এই কথা কেন বললো? ও কি টেলিপ্যাথি সিস্টেমে পূর্বের কথা পড়ে ফেলছে? পূর্ব নিজেকে বোঝায় পূর্ণতা কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়নি যে কালকের ঘটনা জানতে পারবে। পূর্ব ঠোঁট টিপে মৃদ্যু হেসে পূর্ণতার অপলক দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে বলে উঠে,
– জীবন আমাকে বারবার অপ্রত্যাশিত জায়গায় নিয়ে যায়। ভালোবাসা আমাকে বহুবার তোমার কাছে আনে। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে এটাই চাইবো শত বাধা শেষে যদি মরেও যাই পরবর্তী জীবনে যেন তোমাকে ফিরে পাই।। এই ফিরে পাওয়ার জীবনটা যেনো দীর্ঘ হোক, অনন্ত হোক, অসীমের মতো সীমাহীন হোক। আমি আর কিছুই চাইনা। আমার চাওয়া এটুকুই।
‘ চলবে ‘ …………………
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
#FABIYAH_MOMO
ফটো ক্রেডিট : @Muhurto
( নোটবার্তা : আজকে শরীর দূর্বল হয়ে আছে। সত্যিই ভেবেছিলাম গল্প দিবো না। যেহেতু কাল বলেছি আজ দিবো তাই দিলাম। আমি দুঃখিত, আজও রহস্য রেখে দিলাম। )