#ফাবিয়াহ্_মমো
ধপ করে বিছানার ধার ঘেঁষে ফ্লোরে বসে পরলো পূর্ণতা। হাতের চিরকুটটা ফ্লোরে বেহালভাবে পরে আছে। আচ্ছা বিশ্বাসঘাতকদের মুখ কি কখনো কালো হয়? কালি দিয়ে কালো করে দিলে কেমন হয়? অন্ততপক্ষে নোংরামি করার চিহ্নটা তার মুখের উপর ভেসে থাকবে। মানুষ জিজ্ঞেস করবে, কিরে? তোর মুখ ওমন কালো কেন? তখন লজ্জায় কিচ্ছু বলতে না পেরে অন্য আরেকজন তার হয়ে বলবে, নোংরামি করেছে। নোংরার চিহ্ন।পূর্ণতা নিশ্চল দেহের মতো স্তব্ধ হয়ে আছে। বুকের ভেতর যে প্রলয় হচ্ছে তা যেন বাইরের ঝড়কেও হার মানিয়ে ছাড়বে। এতো বড় ধোকা? এর চেয়ে মৃত্যুটা কি শান্তি না?
ঠান্ডা পায়ের আলতো পদচারনার শব্দ আসছে কানে। এইতো দরজার বাইরে কেউ হাঁটা থামিয়ে দিলো। কে বাইরে? কে দাড়িয়ে? দরজায় কেনো টোকা দিচ্ছেনা? পূর্ব বিছানা থেকে উঠতেই হারিকেনের পলতেটা বাড়িয়ে দিলো। গ্রামাঞ্চলে ইলেক্ট্রিসিটির দারুন সমস্যা। হালকা বাতাস ছাড়তে দেরি, কারেন্ট হাওয়া হতে দেরি করেনা। তানিয়া হাসিহাসি মুখে দুলতে দুলতে টেবিলের উপর হারিকেন দিয়ে যায় যার ফলে লুমটা এখন আধো অন্ধকারে ঠাসা।। পূর্ব নিজের ভেজা চুলগুলোকে লেফটসাইডে ঠেলতেই দরজার দ্বার খুলে দাড়ায়। মায়াদৃষ্টির চোখ দুটো কি ভার হয়ে আছে! সরু ঠোঁট দুটো যেনো শীতের কাপুনির ন্যায় কাঁপছে। পূর্ব দরজার বাইরে একহাত বাড়িয়ে পূর্ণতাকে ধীরেসুস্থে ভেতরে আনলো। দরজাটা ঠিক করে লাগিয়ে দিলো। পূর্ণতা যন্ত্রমানবের মতো থমকে আছে। আচ্ছা ও কাঁদছে না কেন? অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর ব্যাপারটা কি ফলে গেলো নাকি? পাথর হলে তো সমস্যা! বুকে ব্যথা দিবে! প্রচুর ব্যথা দিবে! পূর্ব তো নিজেকে ‘সদা প্রস্তুত’ কমান্ডের মতো তৈরি রেখেছিলো। যখন পূর্ণতা হুমড়ি খেয়ে কাঁদবে পূর্ব ওকে বুকে টেনে শান্ত করাবে। এ কি হলো?
পূর্ব কিছু একটা অতিদ্রুত চিন্তা করলো, খুবই সুকৌশলে দারুন একটা পরিকল্পনা সাজালো। মুষলধারে বেগতিক বৃষ্টির মধ্যে রুমের পেছনের দরজাটা পুরো খুলে দিলো এতে পূর্ণতা একচুলও নড়লো না। অন্যসময় হলে পূর্ণতা একটু ফুসে যেতো। পূর্ব হাত থেকে ঘড়ির হুকটা টেনে পূর্ণতার পাশ কাটিয়ে টেবিলের উপর খুলে রাখলো। এখনো পূর্ণতা লক্ষ করলো না পূর্ব ধীরেধীরে তৈরি হচ্ছে। আচ্ছা পূর্ব কি করবে? মারবে? মারার আগে হাত সাফ করা তো ফিল্মি ব্যাপার স্যাপার। সিনেমায় গুন্ডাদের পেটালে নায়করা পূর্বের মতো ভাবসাব নিয়ে হাতের ঘড়ি খুলে। এবার বাদামী পান্জাবীর হাতাটা উল্টো ভাঁজ করে ধবধবে কবজিটার একটু দূরে গুটালো। ইশ! মারাত্মক দৃশ্য! হাতের উপর বিছিয়ে থাকা পশমস্তরগুলো যেনো অতি লোভনীয়! পূর্ণতা কি একবার তার সুদর্শন পূর্বকে দেখবেনা? দেখলে নির্ঘাত চোখ ফেরানোর ক্ষমতা রাখতো না! গায়ের বাদামী পান্জাবীটা কি ভয়ংকর সুন্দর লাগছে, ভিজে উঠা চুলের এবড়ো থেবড়ো অবস্থা মাথার তালুতে খাড়া হয়ে কি চমৎকার লাগছে পূর্ণতা তো দেখলোই না। হঠাৎ পূর্ণতার হাতে টানশক্তির ফলে বুলেট গতিতে দরজার বাইরে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে এলো। কি তুখোড় বৃষ্টি! মাথার তালুতে ঠান্ডার ঘাণিতে বেশ কঠিন অনুভূতি! কয়েক মিনিটের মধ্যে নাকানিচুবানি ভেজার মতো কঠিন দশা হবে এমন বৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশে।।
বলা প্রয়োজন, পেছন দরজা দিয়ে বেরুলে ছোট্ট খোলামেলা একটা জায়গা দেখা সম্ভব। যেখানে বাগান করার জন্য পূর্ণতার নানাভাই শোলার বেড়ায় চর্তুপাশ ঘিরে দিয়েছেন। এরপর বিশাল বড় বিস্তৃত মাঠ যেটা ফসলী শষ্যবস্তু গাদা গাদা করে রাখা হয়। মূলত সে অর্থেই জায়গাটা নিরিবিলি এবং সেখানে পূর্বের নতুন গাড়িটা তেরপাল দিয়ে ঢাকা।
পূর্ণতা বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার তবুও যেনো হুশহীন স্তব্ধ অবস্থা। অন্ধকারাচ্ছন্ন বৃষ্টিমুখর পরিবেশে চোখ সয়ে থাকাটাই যেন বিরাট ব্যাপার। পূর্ব সজাগ দৃষ্টিতে তবুও একবার আশেপাশে দেখে নিলো কেউ আছে কিনা। যাক কেউ নেই। পূর্ণতার দিকে ফিরে তাকাতেই দেখলো পূর্ণতা কাঁপছে। ও কি শীতে কাপছে না ব্যথায় কাঁদছে? বোঝা মুশকিল। পূর্ব কাছাকাছি হয়ে দাড়ালো। হালকাভাবে গাল ঝাঁকিয়ে ঠান্ডা সুরে জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি কাঁদছো না কেনো পূর্ণ? কিজন্যে?
পূর্ণতা সৎবিৎ ফিরে পাওয়ার মতো গা ঝাঁকিয়ে চমকে উঠলো। চোখ তুলে ঠিক করে তাকাতেই বুঝলো সে এখন ভারি বর্ষনের নিচে! পূর্ব কপাল কুঁচকে আরো কিছু বলবে হঠাৎ পূর্ণতা ডুকরে কেদেঁ উঠলো। আকাশে জমা মেঘগুলো এখন বৃষ্টি হতে শুরু করেছে। পূর্ব এবার স্বস্তিতে নিশ্বাস ছেড়ে পূর্ণতার মাথায় হাত রাখলো। আকাশের দিকে চোখবন্ধ করে মনেমনে বললো, ‘আল্লাহ্ তুমি পূর্ণর কষ্ট লাঘব করো। পৃথিবীতে সরল সহজ মানুষদের এতো কষ্ট দিও না। যারা হামেশা পাপ করে বেড়ালো তাদের তুমি কঠিন শাস্তি না দিলে দুনিয়া ধ্বংস হতে বেশিদিন লাগবেনা। পাপের দুর্গন্ধে পূণ্যরা দূষিত হবে। আমার আকুল মিনতি, বিনীত অনুরোধ আমার পূর্ণতাকে তুমি কঠোর বানিয়ে দাও। ওকে এতোটাই কঠোর করো আজ থেকে ওর নবসূচনা হোক!’
কথা শেষ না হতেই কান্নার বেগতিকে পূর্ণতা শরীর ছেড়ে দিয়ে মাটিতে বসতে নিলে পূর্ব চট করে হাত ধরে ফেলে। পূর্ণতা কিছুক্ষণ হাত ছাড়াতে চাইলেও শেষে পূর্বের বুকে কপাল ঠেকিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। দেহের রক্তক্ষরণ সবাই দেখলেও মনের রক্তক্ষরন কেউ দেখেনা। মনের রক্তক্ষরন হলে মানুষের ছোট্ট সুন্দর মনটা স্বাভাবিক থাকেনা। পূর্ণতার নরম কোমল মনটা রাজিব, শ্রেয়া নামক দুজন মানুষ ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। রাজিবেরটা নাহয় বিপরীত ধর্মী আর্কষন ছিলো, কিন্তু শ্রেয়া তো ওর বোনের মতো বান্ধুবী ছিলো। বোনরূপী বান্ধুবী কখনো এমন আঘাত করতে পারে? এই নশ্বর দুনিয়ায় কি বান্ধুবী বলতে সত্যি কিছু নেই? কষ্ট হয়। প্রচুর কষ্ট হয়। কলিজার বান্ধুবী বা জিগার কা দোস্ত বলে যাদের মনের কোণে স্থান দেওয়া হয় দিনশেষে তারাই মনটাকে খুন করে চলে যায়। খুনিরা থাকে খুশিতে, ভিক্টিম মরতে থাকে ধুকে ধুকে।
বাঁধের সেই বিচ্যুত গাছের গুড়ির উপর বসে আছে আয়মান। গায়ের মাখন রঙের শার্টটা ভিজে জবজবা। চোখদুটোর সাদা অংশ লাল হয়ে চক্ষুকোটরে স্রোতস্বিনী নদীর মতো টলটল করছে। বাকরুদ্ধ হয়ে জ্বলছে বুকের কোথাও। কুড়ে কুড়ে লন্ডভন্ড হচ্ছে শরীরের আনাচে কানাচে। রাগ দমন হচ্ছেনা, কষ্ট নিবারণ সম্ভব না, দমটাও ছেড়ে যাচ্ছেনা এ কেমন যন্ত্রণা? এই যন্ত্রণা কেনো সহ্য হচ্ছেনা? কোত্থেকে উদয় হলো এই অসহ্যকর দহন? চক্ষুদৃষ্টি পুকুরের উপর বৃষ্টি জলধারায় তাক করতেই হঠাৎ গাছের গুড়ির উপর নির্লিপ্তে পাঁচ আঙ্গুলের মুঠোবন্দিতে ঘুষাতে লাগলো। এক,দুই,তিন,চার….আট নম্বর ঘুষিতে নেতিয়ে পরলো হাত। আয়মান নিজের চুল টেনে ধরলো দুহাতে। গুড়ি থেকে দাড়িয়ে পরলো ও। অস্থির লাগছে! শরীরে চামড়া যেনো ফেটে যাচ্ছে! পুড়ে যাচ্ছে! কি করবে? মরে যাবে? পুকুর পাড়ের অতি সন্নিকটে এসে চুল ছেড়ে তীব্র চিৎকার করলো আয়মান। ভেতরের সব কষ্টের আভাস বেরিয়ে গেলো না বুক থেকে, কোথাও যেনো গুটি পাকিয়ে লুকিয়ে গেলো ভেতরে। আজ ছেলেধর্মের একটা রুলস ভঙ্গ করবে? হাউমাউ করে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। আয়মান কি তা করবে? কিছুক্ষণ পর বৃষ্টির কঠিন ঝাপটায় কিছু করুণ আহাজারের শব্দ হলো। পরপর বহুবার। বড় ঘরের রুম থেকে আনিশার মা সাজেদা ও আয়মানের মা আফিয়া হঠাৎ কি যেনো শুনতে পেয়ে একসঙ্গে অবাক হলো। আফিয়ার সন্ধানী উদ্বিগ্ন মন আচমকা বলেই ফেললো,
– বাদলা দিনে কেউ কাঁদে নাকি? কেমন জানি চিৎকারের আওয়াজ শুনলাম। গ্রামে আবার যেই ঘটনা শুনি। ওইসব কিছু ডাকে নাকি আপা?
সাজেদা বিরসমুখে বললেন,
– আরে না গো, এখন কি ওই আগের যুগ আছে? আগে তো মাগরিবের আযান দিলে উঠোনে যাওয়াই নিষেধ ছিলো। এখন তো ঘরে ঘরে কারেন্ট।
আফিয়া আর কথা বাড়ালোনা। সাজেদা আপার কথাই ঠিক তবুও মনে যেনো ভারী শঙ্কার আভাষ অনুভূত হলো। মাতৃমনের সেই বিচলিত শঙ্কা। ছেলে কি উনার ঠিক আছে?
.
নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো আমার। কোনোভাবেই শ্বাস নেওয়ার জন্য নাকের ছিদ্রদুটো দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় অক্সিজেন টানতে পারছিলাম না। পূর্ব আমার কঠিন দশা দেখে কিছুক্ষন অস্থির হলেও এখন আমাকে আবদ্ধ করেছেন উনার বাহুর কোলে। বৃষ্টির পানিগুলো মুখের উপর পরছে, আমি কাশতে কাশতে শ্বাস নেওয়ার জন্য ঠোঁটে খুলে হাপাচ্ছি। পূর্ব এই বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে হেঁটে কোথায় নিয়ে এলো সেই হুঁশ আমার নেই। যখন একটু স্বাভাবিক হয়ে ভালো করে শ্বাস নিচ্ছিলাম তখন বুঝলাম ভূতুড়ে বটগাছের নিচে আছি। সামনে মাছ চাষের ছোট্ট খাল খানা । বাশেঁর বেন্ঞ্চির সাথে লাগোয়া বিশাল বটগাছটায় খুব খারাপ ঘটনা শুনেছি। পূর্ব আমাকে বেন্ঞ্চির উপর বসিয়ে পাশে ঘা ঘেঁষে নিজেও বসলো। আমাকে একটু ঠান্ডা হতে দেখেই আমার কপালে হাত রেখে বলে উঠলেন,
– আমার ইচ্ছে করছে তোমার গালে একটা থাপ্পর বসাই। মারি একটা?
ধীর কন্ঠে শক্তি জুগিয়ে বললাম,
– মারবা কেন?
– গ্রামে বৃষ্টিতে যদি ভিজতে না পারো জীবনে কি করেছো? মুখে ঘাস নিয়ে ছিলে এতদিন?
– মা আমাকে কখনোই বৃষ্টিতে ভিজতে দেয়নি। আমার তো নার্ভ…
– তোমার নার্ভ আমি কিভাবে নার্ভাস বানাই দেখো খালি! ফাজলামি পেয়েছো? ঢঙ করো? ঢঙ করো আমার সাথে? বৃষ্টিতে নিয়ে এসেছি দুমিনিটও হয়নি সে এখন এ্যাজমা…
হঠাৎ পূর্ব ভ্রু কুঁচকে কথা শেষ না করতেই পূর্ণতার শরীরে হাত রাখলো! ওমনেই চমকিত স্বরে বলে উঠলো,
– তুমি কাঁপছো? আমি ফাজলামি করে বলে…! ইয়া আল্লাহ্! এই মেয়ে? কথা বলো! আল্লাহ্! কি করলাম?
.
ধামধাম — করে দরজায় দু’বার কড়াঘাত করতেই চোখ কচলাতে কচলাতে দরজার একপাট খুললো শ্রেয়া। অন্যপাটে শরীর হেলিয়ে হাই তুলে ঘুমু চোখে বিরক্তির সুরে বলে উঠলো,
– এ্যাই ফাজিল! এইসময় আসলি কেন? ঘুমাচ্ছি না? কি সুন্দর বৃষ্টি, আমার মজার ঘুমটা…
বলতে বলতে আবার হাই ছাড়লো শ্রেয়া। আয়মান শ্রেয়ার পিছনে দৃষ্টিপাত দিয়ে ঘরে একবার লক্ষ করলো। পরক্ষনে ধাক্কা দিয়ে শ্রেয়াকে ভেতরে ঠেলে নিজেও ঢুকে পরলো। শ্রেয়া যেনো আশ্চর্যের চূড়ান্ত স্তরে! আয়মান দরজা লাগাতে থাকলে শ্রেয়া ভ্রু কুচঁকিয়ে বলে উঠলো,
– বদমাইশ দরজা লাগাচ্ছিস কেন?
– চুপ! একদম চুপ করবি ! আয়মানের রাগান্বিত কন্ঠ!
শ্রেয়া একটা ঢোক গিলে কন্ঠে কোমল ভাব এনে বলে উঠলো,
– কিছু হয়েছে দোস্ত? এনিথিং প্রবলেম?
আয়মান গম্ভীরভাবে তর্জনী তুলে বিছানায় বসতে ইশারা করলো। শ্রেয়া থতমত খেয়ে ঢোক গিলতে গিলতে বিছানায় বসলে আয়মান ওর পায়ের কাছে চেয়ার টেনে বসে। বাঁ পায়ের উপর ডান পা তুলে ভাবুক ভঙ্গিতে চোখ স্থির করলে শ্রেয়া অনেকটা চাপাকন্ঠে বলে উঠে,
– সমস্যা কি বলতো? এই রাতেরবেলা কাক ভেজা অবস্থায় কোত্থেকে এলি? এলি তো এলি তাও আমার রুমে কি জন্যে?
– কি দোষ ছিলো আমার? জবাব আছে তোর কাছে?
– কি বলছিস তুই? এগুলো কেমন কথা?
– তুই কি আমারে মূর্খ ভাবোস শ্রেয়া? উত্তরটা দে তো!
– তোর মূর্খতা দিয়ে আমার কি যায় আসে?
– ওহ্ হ্যাঁ তাইতো। আমি তো শালা আন্ঞ্চলিক মারাই। শুদ্ধ ভাষায় পেচাল পারিনা। কথাবার্তায় স্মার্ট না, তাইনা?
– ফাউল কথা বলবিনা আয়মান! রাতের ঘুম হারাম করে এখানে কোন ধানের আবাদ দেখতে আসছিস!
– তোর কি একটুও লজ্জা নাইরে শ্রেয়া? তুই কি মেয়ে না?
– মুখ সামলে কথা বল! কি ধরনের কথা এগুলো?
– তোর সাথে ঠিকই মুখ সামলায়া কথা বলতাম। এখন আর ছিড়িবিড়ি মানতাম না।
– তুই আমার রুম থেকে বিদায় হ! আই সেইড গো!
– কেন? পূর্ণতার ভাতারের দিকে তোমার নজর পরে? লজ্জা করেনা? শালা বারোভাতারি! কেমন পারলি পূর্ব ভাইয়ের সাথে ছ্যাঁচড়ামি করতে? ভাই তুই আমিরে খালি বুঝা কেমনে পারলি!
– জাস্ট শাট আপ আয়মান! এগুলো কেমন ফাজলামি? যেতে বলছি না? বেরিয়ে যা!
– তুই কি সোজাসুজি স্বীকারে আসবিনা? আমার টেকনিক কিন্তু খুবই ত্যাড়া! ভালোয় ভালোয় কথা বমি কর।
– কি জানতে চাস?
– পূর্ব ভাইয়ের সাথে ওইদিন কেন ওইসব করছিলি!
শ্রেয়া মুখ নিচু করে হাতের তালুতে আঙ্গুল ঘষতে থাকে। হঠাৎ নিরবতার চিত্রে পানি ঢেলে আয়মান বলে উঠে,
– তুই ভাইয়ের উপ্রে ক্রাশ খাইছিলি ঠিকনা? ভাই তোরে পাত্তাও দিতোনা। পূর্ণতার একসেস পাগলামির দিন ভাইরে যখন ডাকলাম আর ভাই যখন আসলো তখনই তোর মন ঘুরে গেছে। আরে শয়তান রে! তুই কতো বড় বাটপারি করলি ভাবছোস? ভাই কি তোরে একলা ইগনোর করতো? আনিশারে ইগনোর করেনাই? অন্য মেয়েরে ইগনোর করেনাই? তুই কেমনে পারলি রে ছ্যাঁচড়ামি করতে? পূর্ণতার কাছে কেমনে যাবি? ওর অবস্থা একটু ভাবছোস?
আয়মান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রেয়ার দিকে। শ্রেয়া সেই যে মাথা নিচু করেছে সেই মাথা তোলার কোনো নামসূত্র নেই। আয়মান আবার বলে উঠে,
– তুই তো ভালো আছিলি শ্রেয়া, কেমনে এমন অশ্লীল কা..
হঠাৎ আয়মানের বাক্যে দাড়ি বসিয়ে শ্রেয়া বলে উঠলো,
– চুপ কর! তোর কাছ থেকে আমি আমার চরিত্রের সার্টিফিকেট চাইনা। হ্যাঁ আমার পূর্বকে খুব ভালো লাগতো। এখনো লাগে। অনেক চেষ্টা করেছি ওর সাথে একটু যোগাযোগ করার জন্য, ও কখনোই আমাকে ভেল্যূ দিতোনা। পূর্ণতার কাছ থেকে নাম্বারটা পযর্ন্ত চেয়েছি ও দেয়নি। মানুষের নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি প্রবল আর্কষন থাকে। আমার ক্ষেত্রেও সেটাই হইছে! আচ্ছা? তোর মতো ক্ষ্যাতের কাছে আমি আমার মনের কথা বলতেছি কেন? কে তুই? তোর মতো লাফাঙ্গা পোলাপান তো আমি এমনেতেই আঙ্গুলের ইশারায় নাচাতে পারি। শুধু পূর্ণতার কথা চিন্তা করে কখনো কিছু বলিনি। যা বের হ এখন।
শ্রেয়ার পরিবর্তিত রূপ দেখে আয়মান হতভম্ব দৃষ্টিতে হা করে আছে। মেয়ে মানুষের মধ্যে এতো পরিবর্তন? এটা না সেই শ্রেয়া যে পূর্ণতার সকল দুঃসময়ে পাশে ছিলো? পূর্ণতার জন্য তো কান্নাও করেছিলো বহুবার! কি করে এতো পরিবর্তন? হাউ পসিবল? হ্যাঁ শ্রেয়ার সাথে খুনশুটি হতো, বাড়াবাড়ি রকমের ঝগতো হতো, কথা কাটাকাটি চলতো তাই বলে আয়মান ক্ষ্যাত, লাফাঙ্গা? আয়মান নিজের চোখ দুটিকেও বিশ্বাস করতে পারছেনা। খুব কষ্টে একটা ঢোক গিলে শ্রেয়ার দিকে স্থির চাহনিতে বলে উঠলো,
– আমি কি ভুল মানুষরে পছন্দ করতাম?
– তোর পছন্দ মানে? তোকে কে পছন্দ করে যে তুই অন্যকে পছন্দ করবি? যোগ্যতা আছে তোর? মুখের ভাষাও তো ক্ষ্যাতমার্কা! কে তোর উপর ফিদা হবে? এহ্ আসছে আমার পছন্দটা! যা সর!
আয়মান ভিড়মি খাওয়ার মতো ধাক্কা খেলো। কি কঠিন কথাগুলো অর্নগল বলে দিচ্ছে শ্রেয়া! আয়মান তো ওকে কাছের মানুষ ভাবতো বলেই কখনো কথাবার্তা ভেবেচিন্তে মেপে বলতো না। নিতান্ত আপন মানুষের সাথেই আমরা দুনিয়ার জঘন্য ভাষায় কথা বলতে পারি যা আমরা বাবা মায়ের সাথেও অনেকক্ষেত্রে বলতে পারিনা। শ্রেয়ার তাচ্ছিল্যপূর্ণ চেহারা দেখে আয়মান নিজেকে সামলালো। বুকভর্তি নিশ্বাস টেনে নাসাপথে প্রশ্বাস ছাড়তেই তাচ্ছিল্য হাসিতে বলে উঠলো,
– শালা নিষিদ্ধ জিনিসের প্রবাদ মারায়! দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জালিমের বাচ্চায় বলছিলো, এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার! নাহ্…আর কিছুই বলতাম না। কুত্তার কাছে গরুর ডাক শুনতে চাওয়া বোকামি!
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াতেই চলে যাওয়ার জন্য দরজা খুললো আয়মান। যেতেই হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে ফের বলে উঠলো,
– আমরা যাদের জন্য নিয়ম ভাঙি, তারাই আমাদের ভেঙে দিয়ে যায়। আই ক্যান স্যা দিস ওয়ার্ড ইন ইংলিশ বাট ইউ থিংক আ’ম এ্যা ড্যামিশ গায়। হা হা, ম্যা আল্লাহ্ ব্লেস ইউ ইয়ার, আই হেভ নাথিং টু স্যা। আমি খুব শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারি যেমনটা আমার বাবা মার সাথে বলি। কিন্তু তোকে খুব আপন ভেবে বোকার কাজ করেছি শ্রেয়া। খুব দুঃখ দিলি। যদি আমি শিক্ষিত বাবা মায়ের সন্তান হয়ে থাকি আর কোনোদিন তোর সাথে যোগাযোগ রাখার মতো ভুল করবোনা।
ঝমঝম প্রখর বৃষ্টির মধ্যে আবার বেরিয়ে গেলো আয়মান। আজ কোনো পিছুটান নেই বুকে। সব ঝেড়ে মুছে শ্রেয়া নামক মানুষটার কাছে ফেলে এসেছে। যারা আমাদের মূল্য দেয়না তাদের কখনো কাছে রাখা ঠিক না। সময় আমাদের শেষ হাসিটার সুযোগ একদিন দিবেই। প্রকৃতি কখনো না-ইনসাফি করেনা। আচ্ছা পূর্ণতা এখন ঠিক আছে তো? হঠাৎ নিজের খেয়ালিপনা ছেড়ে পূর্ণতার জন্য ব্যতিব্যস্ত হলো আয়মান। সবচেয়ে বেশি আঘাত তো পূর্ণতা পেয়েছে ও কি এখন ঠিক আছে? আয়মান উঠোন পেরিয়ে বৃষ্টির পানিতে থপথপ পা ফেলে পূর্ণতার রুমের কাছে আসলো। দরজায় টোকা দেওয়ার কয়েক মিনিট পর দরজা খুললে সে দেখে পূর্ব কেমন অস্থির হয়ে আছে।
– ভাই কোনো সমস্যা? পূর্ণতা ঠিক আছে তো?
– ও সেন্সলেস হয়ে গেছে আয়মান।
– কি বলেন! ডাক্তার আনবো?
– না, প্লিজ। লাগবেনা। তুমি ঠিক আছো?
– আমার আবার কি হইবো? আমি তো বিন্দাস…
– আমার সামনে মিথ্যে বলো না। আমি চোরের মন ও মিথ্যার প্রবণ দুটোই টের পাই।
– আমি ঠিক আছি ভাই। কিছু হয়নাই। আসলে ভাই, আমরা ছেলেরা মনেহয় মেয়েজাতি দিয়াই আজীবন কষ্ট পাই ঠিকনা?
– হা হা হয়তোবা। মন খুব খারাপ? চাইলে ভেতরে এসে বসতে পারো।
– না ভাই কালকে আসি। আপনার পান্জাবী ভিজা ভাই। পান্জাবীটা পাল্টান। ঠান্ডা ধরবো।
– চিন্তা নেই, আমাকে এসব ঝড়বৃষ্টির অসুখ নাগাল পায়না। তুমি ভেতরে আসো,
– না ভাই। আপনে ঘুমান। সকালে আসবো।
আয়মান হাসি দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য শরীর ঘোরাবে হঠাৎ কাধে হাত রেখে থামিয়ে দিলো ওকে। আয়মান মুখ ঘুরিয়ে পূর্বের দিকে তাকাতেই পূর্ব পিঠ চাপড়ে বলে উঠে,
– মেয়েরা ফুলের মতো। সঠিক ফুলটাকে বেছে তাকে আগলে ধরো। গুড লাক।
পূর্বের দুটি বাক্য আয়মান স্তব্ধ হয়ে শুনলেও হুট করে গা ভেজা পূর্বকে জাপটে ধরে আয়মান। কি ভেবে জাপটে ধরলো বোঝা না গেলেও পূর্ব মিচকি হেসে ওর পিঠে হালকা দুটো কিল বসিয়ে বলে উঠে,
– এভাবে থমকে যেতে নেই। কাটা উপড়ে, হাঁটা দিতে হয়। একদিন জীবন তোমাকে সুখ দিবেই। কষ্ট পেওনা আয়মান। এসব তুচ্ছ ঘটনাকে মনে রেখোনা।
আয়মান পূর্বকে ছেড়ে দিয়ে সম্মতিতে মাথা দুলিয়ে ঠোট জুড়ে একচিলতে হাসি আনলো। হাসির আভাষ রাখতেই আয়মান নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। পূর্ব দরজা আটকিয়ে বিছানায় শোয়া পূর্ণতার দিকে একঝলক তাকিয়ে গায়ের পান্জাবীটা দুহাতে খুলে ফেললো। মাথা ঝাড়া দিয়ে একটা টিশার্ট আলনা থেকে তুলে গায়ে জড়ালো। প্যান্টটা চেন্জ করে একটা ট্রাউজার পরতেই পূর্ণতা কপালে হাত দিয়ে চোখ কুঁচকে নড়াচড়া করে উঠলো। পূর্ব টিশার্ট টেনে ঠিক করে বেডস্ট্যান্ডে পান্জাবী, প্যান্ট নেড়ে পূর্ণতার কপালে হাত ছুঁয়ে বললো,
– এই উঠোতো একটু। প্যারাসিটামলটা খেয়ে নেও। কি বললাম? কথা কানে যায়না? উঠতে বলছিনা?
– তুমি আমার কাপড় কখন বদলালে?
– তোমার কাপড় নিয়ে গবেষণা করতে হবেনা। মেডিসিন গিলতে বলেছি সেটা গিলো।
– তোমার চুলগুলো মুছো না কেন? ঠান্ডা লাগবে তো!!
– ট্যাবলেট ধরো আমি চুল মুছছি।
– তোয়ালে কই? আনো। আমি মুছে দিচ্ছি।
– আমি মুছতে পারবো। এগুলো ধরতে বলছি।
– সারা ফ্লোরে পানি ভাসিয়ে কি করেছো?
– সাগর বানাচ্ছি! হয়েছে? ট্যাবলেট ধরবে?
– এগুলো কিসের ট্যাবলেট? এতোগুলো কেন?
– একটা চড় মেরে মুখের কথা ছুটিয়ে দেবো! আমি ট্যাবলেট নিয়ে তোমার বকবক শুনতে চেয়েছি? না গিলতে বলেছি?
পূর্ণতা ক্যাপসুলগুলো খেতেই পূর্ব পানির গ্লাসটা ঢেকে পূর্ণতার কাথার ভেতরে ঢুকে পরলো। পূর্ণতাকে দুহাতে টেনে বুকে জাপটে ধরতেই বলে উঠলো,
– জ্বর বাধালে তোমার খবর আছে!
– বৃষ্টিতে নিয়ে গেলে কেন? আমার জ্বর আসবেনা তার গ্যারান্টি কিভাবে দিবো?
– ঔষুধ খাইয়ে দিয়েছি এখন চুপচাপ ঘুমাও। নাকি আরো কিছু করতে চাও?
– অতোগুলো ক্যাপসুল কিসের ছিলো?
– চড় চিনো চড়? ঘুমাও বলছি!
পূর্ণতা হুট করে বুক থেকে মাথা তুলে পূর্বের উপর উঠে গা ছেড়ে শুয়ে বললো,
– আমার সাথে রাগারাগী করলে ওইদিনের মতো ঠোঁটে কামড়ে খুন করে ফেলবো!
– আহা! কথাটা বলে খুব উপকার করলেন বিবি সাহেবা?এমনেই একব্যথায় কিছু খেতে পারছিনা। আপনিও দেন। ধন্য করেন আমায়।
– আমার সাথে ইয়ার্কি করো না বলছি।
– এক কাজ করুন নাহয় আমাকে কেটেকুটে নিলামে তুলে বিক্রি করে দিন।
– চুপ করো পূর্ব।
– বুকের উপর শুয়ে চুমু দেওয়া বন্ধ করো। আমার বুক পুড়ছেনা। আ’ম কুল এন্ড ফাইন।
পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পরতেই পূর্ব ডানদিকে হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর হারিকেনের পলতেটা কমিয়ে দেয়। কাথা টেনে পূর্ণতার মাথা পযর্ন্ত ঢেকে দিতেই কপালে ঠোঁট ছুয়িঁয়ে দেয় পূর্ব। শীতল পরিবেশে ওম করা গরমে পূর্ণতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই মনেমনে বলে উঠে,
– ঘুমাও ঘুমাও, কালকের জন্য এখনি ঘুমাও। দেখো না কালকে কি করি!
.
পাখির কিচিরমিচির শব্দে মিষ্টি রোদ্রের স্নিগ্ধ পরিবেশে ঘুম ভাঙলো পূর্ণতার। ঘুমের আড়ম্বর ভেঙে বিছানায় উঠে বসতেই শরীর টানা দিলো। হঠাৎ কি যেনো ভেবে চোখ খুললো, ওমনেই এক গগনস্পর্শী চিৎকার দিয়ে ককিয়ে উঠলো! আশ্চর্য! এটা কি! পূর্ব কই??
– ‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক