– আজ ৬ বছর পরে রাবেয়া কল দিয়ে বললো, গতকাল রাতে আমার একটা মেয়ে হয়েছে। আজ সকালে আমার স্বামী রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে আর আমি বিধবা হয়েছি।
আমি স্তব্ধ হলাম, ৪ বছরের রিলেশন করার পর রাবেয়ার সঙ্গে বিয়ে হবার কথা ছিল আমার। বিয়ে করার সবকিছু ঠিক ছিল, পালিয়ে বিয়ে করবো বলে আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু কথায় বলে যে জন্ম মৃত্যু বিয়ে সব আল্লাহর হাতে তাই কাজি অফিসে গিয়েও আমরা স্বামী স্ত্রী হতে পারিনি।
– আমি বললাম, তোমার বাচ্চা কেমন আছে?
– ভালো আছে, আমার শরীর ভালো না আরিফ। স্বামী মারা গেছে অথচ আমি আমার স্বামীর লাশ দেখতে পারিনি। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে চোখের পানি ছেড়ে আফসোস করছি।
– বিগত ছয় বছর ধরে কোনদিন একটা কল দিয়ে খোঁজ নিলে না কিন্তু আজকে হঠাৎ করে কীভাবে আমার কথা মনে হলো?
– জানি না, নাম্বারটা আজও মুখস্থ ছিল তাই কল দিলাম। তুমি কি বিরক্ত হলে?
– না অবাক হলাম, তুমি এখন কোন হাসপাতালে ভর্তি আছো? তোমার তো কোনো খোঁজখবর আমি জানি না তাই কিছুই জানা নেই।
– “কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল” ঢাকা। তুমি কোথায় থাকো?
– আমি চট্টগ্রামে আছি, তবে সপ্তাহ বা দশদিন পরপর ঢাকায় যাওয়া হয়। অফিসের কাজ।
– আচ্ছা ভালো থেকো, যদি পারো আমাকে ক্ষমা করে দিও কারণ সেদিন স্বার্থপর আমি ছিলাম।
অফিসের কাজ রেখে হঠাৎ মনটা বিষন্ন হয়ে গেল, চোখের সামনে তখন ছয় বছর আগের স্মৃতি।
সেদিন ছিল মঙ্গলবার।
আমি একপ্রকার দৌড়ে মেসের মধ্যে প্রবেশ করে আমার রুমমেট রাজুকে বললাম,
– রাজু আমরা আগামীকাল বিয়ে করবো, বিয়ের সাক্ষী দিতে পারবি?
– রাজু বললো, হ্যাঁ পারবো কিন্তু আরো তো মনে হয় পাঁচজন লাগবে।
– যোগাড় হয়ে যাবে, বর কনে রেডি থাকলে সাক্ষী দেবার লোকের সমস্যা নেই।
সকাল বেলা আমরা সবাই কাজি অফিসে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। রাবেয়া বাসা থেকে বের হয়ে রিক্সায় উঠে আমাকে কল দিল, আমি কাজি সাহেবকে সবকিছু তৈরি করতে বললাম।
নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেল, আর ঘন্টা দুই পার হয়ে গেল কিন্তু রাবেয়া আসছে না। মোবাইল নাম্বার অনেক আগে থেকে বন্ধ, আমি হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বুকের মধ্যে হঠাৎ তীব্র কষ্ট অনুভব হতে লাগলো, তারমানে কি রাবেয়া আসবে না?
– রাজুকে বললাম, রাবেয়া নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
– কি বলেন ভাই? রাস্তায় বিপদ ও হতে পারে। আমরা বরং খোঁজ নিয়ে দেখি চলুন আর অপেক্ষা করতে হবে না।
রাবেয়ার সত্যি সত্যি বিপদ হয়েছিল, রিক্সা নিয়ে আসার সময় এক্সিডেন্ট করেছে। মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ওর পরিবার আমাকে কখনো সহ্য করতে পারতো না তাই হাসপাতালে যাবার সাহস করতে পারিনি।
রাবেয়ার বান্ধবীর কাছে সবকিছু শুনতাম, কখন কি হতো সবটাই আমি জানতে পারতাম। এভাবে প্রায় সপ্তাহ খানিক পরে রাবেয়া মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেল। মাঝখানে আমি দুবার গেছিলাম কিন্তু কেউ বুঝতে পারে নাই।
আটদিন পরে রাবেয়া তার বান্ধবীর কাছে খবর দিল আমি যেন দেখা করতে যাই। আমি টিউশনি শেষ করে সন্ধ্যা বেলা হাসপাতালে গেলাম, রাবেয়া তখন জেগে ছিল। রাবেয়ার মা কেবিন থেকে বের হয়ে গেল, আমি খানিকটা অবাক হলাম।
– রাবেয়া বললো, কেমন আছো তুমি?
– আমার কথা বাদ দাও, তোমার কি অবস্থা সেটা বলো, কেমন লাগছে?
– এখন অনেক ভালো লাগে, ভেবেছিলাম জীবন হয়তো ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু এভাবে আবার পৃথিবী এবং তার সৌন্দর্য দেখবো ভাবিনি।
– সবকিছু আল্লাহর মেহেরবানী।
– তোমাকে একটা কথা বলার জন্য ডেকেছি।
– বলো।
– আমি এই এক্সিডেন্ট করার পর থেকে মা-বাবার ভালোবাসা দেখে সত্যিই বিস্মিত জানো?
– সুস্থ অসুস্থ সবসময়ই মা-বাবার ভালোবাসা ঠিক একই রকম থাকে। তবে সুস্থ অবস্থায় আমরা বাহিরের নানান ধরনের আড্ডা বন্ধু পড়াশোনার দিকে বেশি নজর রাখি তাই মা-বাবার এই ত্যাগ চোখে পড়ে না।
– আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
– বলো শুনি।
– আমরা আর বিয়ে করতে পারবো না, মা-বাবার পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করবো আমি।
– ওহ্ আচ্ছা।
– তুমি মন খারাপ করবে না, তোমার মন খারাপ আমি সহ্য করতে পারি না।
– আচ্ছা মন খারাপ করবো না।
– তোমার চাকরির কিছু হলো?
– না হয়নি, হয়ে যাবে শীঘ্রই।
– আমিও জানি হবে, তুমি খুব ভালো ছাত্র তাই তোমার ভাগ্যে ভালো চাকরি হবে। তারপর খুব ভালো একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করবে, আর যদি আমি তার আগে বিয়ে করি তাহলে তো হলোই।
– আমি কি এখন চলে যাবো?
– হ্যাঁ যেতে পারো।
– এরপর আর কোনদিন আমাদের দেখা করার কোনো প্রয়োজন আছে কি?
– তোমার যদি ইচ্ছে করে তাহলে আমাকে তুমি কল দিও, আমি চেষ্টা করবো।
– আমি তাহলে আসি।
– ভালো থেকো।
যতক্ষন হাসপাতালে ছিলাম ততক্ষণ চোখের পানি বের হয়নি, কিন্তু হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে পুনরায় হাসপাতালের দিকে ঘুরে তাকালাম। তখন চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো এক রিকসাওয়ালা বেল বাজিয়ে বললো মামা কোথায় যাবেন? আমি উত্তর দিলাম না।
সেই রাতটা আমি পার করলাম হেঁটে হেঁটে, পুরো শহরের বিভিন্ন রাস্তায় রাস্তার হেঁটেছি। বেশিরভাগ বড় রাস্তা কারণ ছোটখাটো গলির মধ্যে অনেক খারাপ ছেলেরা আড্ডা দেয়।
মেসে যখন ফিরলাম তখন ভোরের আলো বের হয়ে পাখি ডাকতে শুরু করেছে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে দরজা নক করতেই খুলে গেল, রাজু দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে গেছে। হয়তো ভেবেছিল আমি মাঝরাতে আসবো তাই কষ্ট করতে হবে না। রুমের মধ্যে ঢুকে আমি বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে গেছিলাম, ঘুমের মধ্যে আমার প্রচুর জ্বর এসেছে। তারপর সেই জ্বর থেকে ভালো হয়ে উঠতে আমার প্রায় দশদিন লেগেছিল।
মাস খানিক পরে হঠাৎ একটা কোম্পানির কাছ থেকে চাকরির অফার এলো। পরিচিত একজনের কাছে সবকিছু জমা দিছিলাম, মাঝে একদিন গিয়ে ইন্টারভিউ ও দিছিলাম। আজকে যখন দেখি তারা আমাকে ডেকেছে তখন বেশ আনন্দ হতে লাগলো। কিন্তু ঘন্টা খানিক পরে আরেকটা খবরে মনটা বিষে ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। রাবেয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে, খুব তাড়াতাড়ি নাকি তার বিয়ে সম্পন্ন হবে।
আমি মনের সবকিছু মনের মধ্যে রেখেই চাকরির দিকে মনোযোগ দিলাম। এরপর আরেকদিন খবর পেলাম বিয়ে হয়ে গেছে, রাবেয়া তার বিয়েতে দাওয়াত দিয়ে অপমান করেনি এটাই কৃতজ্ঞতা।
এরপর আর কোনদিন আমাদের দেখা বা কথা হয়নি, জীবন কিন্তু সেভাবেই যাচ্ছিল।
অফিসের কাজে মন দিলাম, যদিও কাজ তেমন নেই তবুও মনটা অন্যদিকে ফেরানোর চেষ্টা।
তিনদিন পরে হঠাৎ অফিস থেকে বললো আমাকে ঢাকায় যেতে হবে। এই তিনদিনের মধ্যে আমি রাবেয়াকে কল করেছিলাম কিন্তু রিসিভ করেনি।
পরদিন সকালে ঢাকায় রওনা দিলাম। রাবেয়ার নাম্বারে মেসেজ দিয়ে লিখলাম “আমি আজ ঢাকা যাচ্ছি!”
কুমিল্লা পার হতেই রাবেয়া কল দিল, রিসিভ করে দেখি অন্য কেউ কল করেছে। কথা বলে জানতে পারলাম উনি রাবেয়ার দেবর। রাবেয়া নাকি খুব অসুস্থ, প্রথম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অনেকটা অসুস্থ হয়ে গেছে। তারমধ্যে আবার তার স্বামীর মৃত্যুর শোক তো আছেই।
অফিসের কাজ সেরে হাসপাতালে গেছিলাম দেখা করার জন্য। রাবেয়ার দেবরের কাছে নিজেকে বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিলাম। তারই সাহায্যে খুব সহজে রাবেয়াকে খুঁজে পেলাম। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে রাবেয়া। আগের চেয়ে খানিকটা মোটা মনে হচ্ছে তাকে। সেদিন যেমন রাবেয়ার মা আমাকে দেখে কেবিন থেকে বের হয়ে গেছিল। আজও একইভাবে বের হয়ে গেল, রাবেয়া চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু বলতে গিয়ে হয়তো বলতে পারে না, আমি তার চোখের কোনে পানি দেখতে পেলাম। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের চোখের পানি লুকানোর জন্য বের হয়ে গেলাম।
রাস্তায় নেমে সিএনজি নিলাম। আকাশ ভেঙ্গে যদি প্রচুর বৃষ্টি হতো তাহলে এই মুহূর্তে আমি অনেক খুশি হতাম। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতাম। রাবেয়ার জন্য খারাপ লাগছে, আমি তাকে পাইনি ঠিকই কিন্তু কোনদিন চাইনি তার এমন পরিস্থিতি হোক।
পৃথিবীতে মানুষের জীবনে অনেক কিছুই আসে যেটা মানুষ আশা করে না। আবার এমন কিছু জিনিস হারিয়ে যায় যেগুলো মানুষ হারাতে চায় না। তবুও সৃষ্টিকর্তার কাছে আমরা পরাজিত, তিনি যেটাতে ভালো মনে করেন সেটাই করেন।
——- সমাপ্ত ——-
লেখা:-
মোঃ সাইফুল ইসলাম সজীব।