: কি ব্যাপার, আমাকে একদম এড়িয়ে চলছো আজকাল..
: কই নাতো!
: না হলে তো ভালোই, আজকে পড়াতে যাবে না?
: না, ছুটি নিয়েছি, বাড়ি যাওয়া দরকার, অনেকদিন যাওয়া হয়না।
: ও, তা কবে যাচ্ছো?
: আজই।
: আজ! ও… আচ্ছা তোমার বাসায় কে কে আছে বলতো, কখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি।
: বাবা, মা আর দুইটা বোন, এইতো।
: তা কি করে ওরা?
: বাবা আগে ডাকপিয়ন ছিলেন, এখন প্যারালাইজড.. বড় বোনটার বিয়ে হয়ে হয়েছিল, স্বামী এক্সিডেন্টে মারা গেছে, দুটো বাচ্চা নিয়ে আমাদের সাথেই থাকে আর ছোট বোন শেফা, ক্লাস নাইনে পড়ে।
: ও..
সোহেলের কথা শুনে চোখের সামনে যেন স্পষ্ট দেখতে পেলাম, অভাবী এক সংসার। বাবার অসুস্থতা, বোনের সংসার, ছোটবোনের পড়াশোনা …উফ্ আমি আর ভাবতে পারছিলাম না। জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হলো না যে তাদের সংসার হয়তো তার ওপরেই অনেক খানি নির্ভরশীল।
ইচ্ছে করেই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে অন্য কথা তুললাম।
: অনার্স ফাইনাল তো চলেই এলো, প্রিপারেশন কেমন?
: আর প্রিপারেশন! প্রিপারেশন ছাড়াই জীবনের কত শত পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছি, আর এটাতো …
সোহেলের গলায় হতাশার সুর স্পষ্ট। আমি আর ঘাটালাম না, থাক না একটু নিজের মত। কি হবে আর এতো কিছু জেনে।
অনার্স ফাইনাল রেজাল্টের পর দেখা গেল আমি ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে ডিপার্টমেন্টে সেকেন্ড হয়েছি আর বেচারা টেনেটুনে সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে। অথচ আমাদের ক্লাসের কত ব্রিলিয়ান্ট ছেলে ছিল সোহেল!
মাস্টার্সের ভর্তির ফর্ম পূরন করতে এসে জানতে পারলাম, সোহেল কোথায় যেন একটা ছোট খাটো চাকরিতে ঢুকে গেছে । মাস্টার্স করবে না। আমি মন খারাপ করে মাস্টার্সের ক্লাস শুরু করলাম কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারছিলাম না।
: আসব?
: রুপু তুমি!
: উফ্ কতবার বলেছি, আমার নাম রূপু না, তবু …
: তুমি এখানে কি করে! ঠিকানা পেলে কোথায়?
: তোমার বন্ধু শফিকের কাছে, আজকে ক্লাসে গিয়ে শুনি কি কারনে যেন ছাত্র পরিষদের ধর্মঘট, ক্লাস হবে না। তাই ভাবলাম তোমাকে দেখে যাই।
: ভালো করেছো, চল, তোমাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বাজে চা খাওয়াই।
আমি ফিক করে হেসে ফেললাম।
সোহেলের অফিসটা ছোট। সোনালী ইন্সুরেন্স কোম্পানি। এতো ছোট একটা জায়গাতে বসে এতো মানুষ একসাথে কাজ করতে পারে এখানে না এলে আমার জানাই হতোনা।
আমি এসে পড়ায় তাদের মধ্যে যেন কৌতূহলের বন্যা বয়ে গেল। একটু পর পরই কেউ না কেউ উকি ঝুঁকি মেরে দেখতে শুরু করল বলে সোহেল আমাকে নিয়ে অফিসের নিচে ছোট্ট একটা চায়ের দোকানে এসে দাঁড়াল।
: এই পিচ্চি, দু কাপ চা দে, একটু ভালো করে বানাস …
যাকে বলা হল তার কানের মধ্যে কোন কথা গেল বলে মনে হলো না তবে চা ঠিকই বানানো শুরু করল। চা মুখে দিয়েই আমি থমকে গেলাম, চমৎকার চা।
: চা টা তো বেশ ভালো।
: হুম, আগে থেকে বললে এক্সপেকটেশন বেশি থাকতো, তখন এতো ভালো লাগতো না।
: বুঝলাম, তারপর, অফিস ভালো লাগছে?
: ভালো লাগা না লাগার কিছু নাই, মাস শেষে বেতন পাচ্ছি এটাই তো অনেক।
: মাস্টার্স আসলেই করবে না?
: না।
আমি আর কোন কথা খুঁজে পেলাম না। সেদিনের মতো বিদায় নিয়ে চলে এলাম। পরের সপ্তাহে আবার সোহেলের অফিসে গিয়ে হাজির হলাম। পরের সপ্তাহে আবার। পরের সপ্তাহে আবার যেতেই সোহেল কাজ ফেলে নিচে চায়ের দোকানে উঠে এলো, মুখে কিছুটা বিরক্তির ছাপ।
: আজও চা খেতে এসেছো রুপু?
: হুম, চা টা খুব ভালো, বারবার খেতে ইচ্ছে করে।
: আচ্ছা খাও, আর এরপর থেকে কখনও এসো না।
: কেন?
: তোমাকে নিয়ে অফিসে সবাই কানাঘুষা করে, তোমার মত রূপবতী একটা মেয়ে রাস্তার পাশের চায়ের জন্য এখানে বারবার আসে এটা কেউ বিশ্বাস করে না।
: আশ্চর্য! তাই বলে তাদের কথার জন্য আমি চা খেতে পারব না?
: না, পারবে না। দরকার হলে তোমার ড্রাইভার কে পাঠিও, ফ্রাক্সে করে চা নিয়ে যাবে তবু তুমি আসবে না।
সোহেল চলে গেল। যাবার আগে একটা বারও পেছন ফিরে তাকালো না। তাকালেই দেখতে পেত, আমার চোখ জলে ভরে গেছে।
সেদিন বাসায় পৌঁছে অনেক কাঁদলাম। আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, মরে গেলেও আর সোহেলের সাথে দেখা করতে ওর অফিসে যাবনা।
অবশ্য তার ঠিক তিনমাস পরেই নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানে সোহেলের সাথে দেখা হয়ে গেল। চাকরির কি যেন একটা বই কিনতে এসেছে সে।
: কি খবর রুপু?
: ভালো।
: একটু শুকিয়ে গেছো মনে হচ্ছে।
: ডায়েট করছি।
: চোখের নিচে কালিও ফেলে দিয়েছো দেখছি, অবশ্য এতে ভালোই হয়েছে, শুকিয়ে গিয়ে তোমাকে একদম স্কুলে পড়া একটা বাচ্চা মেয়ের মত লাগছে।
আমি কোন কথা বললাম না। বললাম না সোহেল শুকিয়ে গেছে আমার চেয়েও অনেক বেশি। তবু জিজ্ঞেস করব না করব না করেও শেষ পর্যন্ত করেই ফেললাম।
: তুমি শুকালে কেন?
: আমার মত ছাপোষা মানুষ মোটা হলেই বরং প্রশ্ন করার কথা, আচ্ছা ভালো কথা, তোমার গাড়ি কোথায়? অনেক দিন গাড়িতে চড়ে হাওয়া খাওয়া হয়নি, সাথে আনোনি আজকে?
আমি গাড়িতে উঠে সোহেলের সাথে একটা কথাও বললাম না। অনেকক্ষণ ঘুরেফিরে মিরপুরের দিকে যেতেই বিজয় সরণির মোড়ে এসে সোহেল নেমে গেল। নামার আগে শুধু একটা কথাই বলে গেল…
: হলের ঠিকানায় আর চিঠি লিখো না রুপু, বেশিরভাগই আমার হাতে পৌছাতে পারে না, অন্যরা পড়ে হাসাহাসি করে।
: কিসের চিঠি! কে দিচ্ছে …এই …কথা না বলে কোথায় যাচ্ছ, সোহেল…
সোহেল উত্তর না দিয়ে জ্যামের মধ্যে হারিয়ে গেল। আর আমার ইচ্ছে করল, লজ্জায় মাটিতে মিশে যাই। আমি আসলেই সোহেলের হলের ঠিকানায় বেশ কয়েকটা চিঠি পাঠিয়েছি। কিন্তু টাইপ করা চিঠি দেখে সোহেল কি ভাবে বুঝল সেটা আমার লেখা!
কি জানি!
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক