__হুমায়ূন আহমেদ
সুরাইয়া অবাক হয়ে তার ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে।
ছেলের নাম ইমন। বয়স পাঁচ বছর তিনমাস। মাথা ভর্তি কোকড়ানো চুল। লম্বাটে ধরণের মুখ। মাঝে মাঝে সেই মুখ কোন এক বিচিত্র কারণে গোলগাল দেখায়, আজ দেখাচ্ছে। ইমন তার মায়ের বিস্মিত দৃষ্টির কারণ ধরতে পারছে না। সে ভুরু কুঁচকে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ভুরু কুঁচকানোর এই বদঅভ্যাস সে পেয়েছে তার বাবার কাছ থেকে। ইমনের বাবা হাসানুজ্জামান অতি তুচ্ছ কারণে ভুরু কুচকে ফেলেন। সেই কুঁচকানো ভুরু সহজে মসৃন হয় না।
সুরাইয়া বলল, ইমন একটা কাজ কর। আমার শোবার ঘরে যাও। ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটার সামনে দাঁড়াও। দাঁড়িয়ে সুন্দর করে হেসে আবার আমার কাছে চলে এসো।
ইমন বলল, কেন?
আমি যেতে বলছি। এই জন্যে যাবে। সব কিছুতে কেন কেন করবে না।
ইমন সরু গলায় বলল, সবকিছুতে কেন কেন করলে কি হয়?
সুরাইয়া বিরক্ত গলায় বলল, খুব খারাপ হয়। বড়রা কোন কথা বললে কেন কেন না বলে সেই কথা শুনতে হয়। তোমাকে আয়নার সামনে যেতে বলছি তুমি যাও। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুব সুন্দর করে হাসবে। মনে থাকে যেন।
হাসলে কি হবে?
হাসলে খুব মজার একটা ব্যাপার হবে।
ইমন আয়নার দিকে যাচ্ছে। খুব যে আগ্রহের সঙ্গে যাচ্ছে তা না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাসলে মজার কিছু হবে বলে তার মনে হচ্ছে না। বড়রা যে প্রায়ই অর্থহীন কথা বলে এই সত্য সে ধরতে শুরু করেছে।
ইমন আয়নার সামনে গেল। ঠোঁট টিপে ভুরু কুঁচকে নিজের দিকে তাকিয়ে রইল। মা হাসতে বলেছেন। না হাসলে মজার কিছু ঘটবে না। কাজেই সে সামান্য হাসল। এত সামান্য যে ঠোঁট পর্যন্ত ফাঁক হল না। মজার কিছু ঘটল না। ঘটবে না তা সে জানতো। বড়রা ছোটদের ভুলাবার জন্যে মিথ্যা কথাও বলে। ইমন আয়নার সামনে থেকে সরে গেল। রওনা হল তার দাদীর ঘরের দিকে। মিথ্যা কথা বলায় মার কাছে তার এখন আর যেতে ইচ্ছা করছে না। সে ঠিক করল মায়ের সামনে দিয়েই সে দাদীর ঘরে যাবে তবে মার দিকে ফিরে তাকাবে না। শুধু শুধু আয়নার সামনে দাঁড় করানোয় মার উপর তার রাগ লাগছে।
সুরাইয়া মিথ্যা কথা বলে নি। ইমন যদি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাসত তাহলে সত্যি মজার একটা ব্যাপার ঘটত। ইমান দেখতে পেত। তার সামনের পাটির একটা দাঁত পড়ে গেছে। সামান্য একটা দাঁত পড়ে যাবার জন্যে তার চেহারা গেছে পাল্টে। তাকে চেনা যাচ্ছে না।
সুরাইয়া আগ্রহ নিয়ে বারান্দায় অপেক্ষা করছে। এই বুঝি ছেলের বিকট চিৎকার শোনা যাবে—মা, আমার দাঁত পড়ে গেছে। মা আমার দাঁত পড়ে গেছে। সেরকম কিছুই হল না। ছেলেকে গম্ভীর ভঙ্গিতে বারান্দায় আসতে দেখা গেল। মার সামনে দিয়েই সে যাচ্ছে অথচ সে তার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। সুরাইয়া ডাকল, এই ব্যাটা। এই। ইমন মায়ের ডাক সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ঢুকে গেল দাদীর ঘরে। সুরাইয়ার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই ছেলে কি পুরোপুরি তার বাবার মত হয়ে যাচ্ছে? রোবট মানব? কোন কিছুতে কোন আগ্রহ নেই, কৌতূহল নেই। বিস্মিত হবার ক্ষমতা নেই। প্রথম দাঁত পড়া যে কোন শিশুর জন্যে বিরাট রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, অথচ ইমন কেমন নির্বিকার।
দাদীর ঘরে ঢোকার আগে ইমন তার ছোট চাচার ঘরের সামনে দাঁড়াল। ছোট চাচাকে তার বেশ ভাল লাগে। ছোট চাচা বড় মানুষ হলেও বড়দের মত না। ছোট চাচার ঘরের দরজা খোলা। তিনি ইমনকে দেখে ডাকলেন–এই যে মিষ্টার স্ট্রং ম্যান, শুনে যা। ইমনের তখন আর ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করল না। সে রওনা হল দাদীর ঘরের দিকে। ইমনের ছোট চাচা ফিরোজ ঘর থেকে বের হল। সুরাইয়ার কাছে গিয়ে হাই তুলতে তুলতে বলল, ভাবী একটু চা খাওয়াওতো।
ফিরোজের বেশ কদিন ধরে জ্বর চলছে। তার চোখ লাল। শেভ করছে না বলে খোচা খোচা দাড়িতে তাকে ভয়ংকর লাগছে। অসুখ বিসুখ তাকে খুব কাবু করে। এই কদিনের জ্বরে সে শুকিয়ে চিমসা হয়ে গেছে।
সুরাইয়া বলল, তোমার জ্বরের অবস্থা কি?
জ্বরের অবস্থা জানি না ভাবী। আমার জল বসন্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। শরীরে গোটা গোটা কি যেন উঠেছে।
বল কি, চিকেন পক্স হয়েছে?
ফিরোজ হাসি মুখে বলল, হয়েছে। এবং আমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটাও জল বসন্তের মতই ভয়াবহ। আমি এম এ পরীক্ষা দিচ্ছি না ভাবী।
ড্রপ দিচ্ছ?
ড্রপ ট্রপ না। পড়াশোনার পাঠ শেষ করে দিলাম। এম এ পাশ বেকার শুনতে খুব খারাপ লাগে। বি এ পাশ বেকার শুনতে তত খারাপ লাগে না। শ খানিক টাকা দিতে পারবে ভাবী? দিতে পারলে দাও।
অসুখ নিয়ে কোথায় বের হবে?
ফিরোজ গম্ভীর মুখে বলল, সব বন্ধু-বান্ধবের বাসায় যাব। এম এ পরীক্ষা যে দিচ্ছি না। এই খবরটা দেব এবং জল বসন্তের জীবাণু ডিসট্রিবিউট করে আসিব। ওরা বুঝবে কত ধানে কত চাল। ভাবী শোন, চা যে আনবে শুধু লিকার, নো মিল্ক, নো সুগার। আচ্ছা থাক, চা লাগবে না।
লাগবে না কেন?
চা খাব ভেবেই কেমন বমি বমি লাগছে। চায়ের বদলে টাকা দাও। একশ না পারলে পঞ্চাশ। পঞ্চাশ না পারলে কুড়ি।
সুরাইয়া শান্ত গলায় বলল, টাকা আমি দিচ্ছি, তুমি আমার কথা শোন। কোথাও বের হয়ো না। শুয়ে রেস্ট নাও। কয়েকদিন আগে জণ্ডিস থেকে উঠেছ।
ফিরোজ শোবার ঘরের দিকে চলে গেল। বিছানায় শুয়ে থাকার জন্যে গেল না। কাপড় বদলাবার জন্যে গেল। চারদিন ঘরে থেকে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস ফেলার জন্যে তাকে বাইরে যেতেই হবে। জল বসন্তের জীবাণু ডিসট্রিবিউটের ব্যাপারেও সে রসিকতা করছে না। সে আসলেই ঠিক করে রেখেছে। সব বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে দেখা করবে। যতদূর সম্ভব ঘসা ঘসি করে আসবে।
আকলিমা বেগমের ঘর থেকে তার এবং ইমনের হাসির শব্দ আসছে। ইমন হাসতে হাসতে প্ৰায় ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছে। হেচকির মত উঠছে। সুরাইয়া ভুরু কুঁচকে ফেলল। তার কোন কথায়তো ছেলে এমন করে হাসে না। শাশুড়ির ঘরে এমন কি ঘটল যে হাসতে হাসতে ছেলের হেঁচকি উঠে গেল? বাচ্চারা বাচ্চাদের সঙ্গ পছন্দ করবে। সত্ত্বর বছরের একজন বৃদ্ধার সঙ্গ তার এত পছন্দ হবে কেন? সুরাইয়ার সবচে যেখানে আপত্তি তা হচ্ছে ছেলে তার দাদীর সঙ্গে থেকে থেকে গ্রাম্য কথা শিখে যাচ্ছে। আকলিমা বেগম বিশুদ্ধ নেত্রকোনার ভাষায় কথা বলেন–বিছুন আইন্যা বাও দে অর্থাৎ পাখা এনে বাতাস কর জাতীয় অদ্ভুত ভাষা। শিশুরা অদ্ভুত ভাষাটাই সহজে গ্রহণ করে। ইমন এর মধ্যেই তার দাদীর কাছ থেকে বিকট বিকট কিছু শব্দ শিখেছে। খুব স্বাভাবিক ভাবে সে শব্দগুলি বলে। আর সুরাইয়া আতংকে অস্থির হয়।
এইতো কয়েকদিন আগে ইমন খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল, ব্যথা করছে।
সুরাইয়া বলল, কোথায় ব্যথা করে—পেটে?
ইমন বলল, না পেটে না।
তাহলে কোথায়?
ইমন ভুরু কুঁচকে বলল, পুন্দে ব্যথা।
সুরাইয়া হতভম্ব। পুন্দে ব্যথা মানে? এটা কোন ধরনের ভাষা? সুরাইয়া প্ৰায় কেন্দে ফেলার উপক্রম করল—এই ছেলে কি সব ভাষা শিখছে?
ইমন সরু চোখ করে মার দিকে তাকিয়ে আছে। তার কোথাও কোন ব্যথা নেই। সে একটা নতুন শব্দ শিখেছে। মার উপর সে এই শব্দের প্রভাব লক্ষ্য করছে। বুঝতে পারছে প্রভাব ভয়াবহ। কাজেই এই শব্দ তাকে আরো ব্যবহার করতে হবে।
সুরাইয়া শাশুড়িকে এই সব নিয়ে কিছু বলতে পারছে না। তিনি যদি স্থায়ী ভাবে তাদের সঙ্গে থাকতেন তাহলে সুরাইয়া অবশ্যই বলত। তিনি প্রতিবছর মাসখানিকের জন্যে ছেলের কাছে থাকতে আসেন। সম্মানিত একজন অতিথিকে নিশ্চয়ই মুখের উপর বলা যায় না–আপনি আমার ছেলেকে আজে বাজে ভাষা শেখাবেন না। তিনি যখন পান খেয়ে মেঝেতেই পিক ফেলেন তখন তাকে বলা যাবে না-মা, আপনি পানের পিক মেঝেতে না ফেলে বেসিনে ফেলবেন। তার শাশুড়ির যে ব্যাপারটা সুরাইয়ার অসহ্য লাগে তা হচ্ছে—তিনি শাড়ির নিচে ব্লাউজ-ট্রাউজ কিছুই পরেন না। তার নাকি দমবন্ধ লাগে। সুরাইয়া লক্ষ্য করেছে ইমন কৌতূহলী চোখে তার দাদুর আব্দুল গায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই বয়সের বাচ্চাদের কৌতূহল থাকে তীব্ৰ। ইমন যে তার দাদুর ঘরে যাবার জন্যে এত ব্যস্ত, এটাও তার একটা কারণ হতে পারে।
এখন বাজছে এগারোটা। ফিরোজ জ্বর নিয়েই বের হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সে তার এম এ পরীক্ষা সত্যি দেবে না। ফিরোজের এই একটা ব্যাপার আছে। হাসি তামাশা করেও যা বলে তাই। সুরাইয়া গম্ভীর মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে ক্রিমের একটা কৌটা। কোটায় ইমনের দাত। দাতটা সুরাইয়া সকাল বেলায় বিছানা ঠিক করতে গিয়ে পেয়েছে এবং অতি মূল্যবান বস্তুর মত কোটায় ভরে রেখেছে। ইমন নিশ্চয়ই দাতটা পেয়ে খুব খুশী হবে। একটা বস্তু নিজের শরীরের অংশ ছিল এখন নেই। ব্যাপারটার মধ্যে বিরাট নাটকীয়তা আছে। ইমন তার দাদীর ঘর থেকে বের হচ্ছে না। আকলিমা বেগম ডাকলেন, বৌমা হুইন্যা যাও।
সুরাইয়া তার শাশুড়ির দরজার সামনে দাঁড়াল। তার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কি বিশ্ৰী ব্যাপার-আকলিমা বেগমের শরীরের উপরের অংশে আজ কোন কাপড় নেই। শাড়ির উপরের অংশটা তিনি কোমরে প্যাচ দিয়ে পরে আছেন। আকলিমা বেগম হাসি মুখে বললেন, কারবার দেখছ? ইমাইন্যার দাঁত পড়ছে।
সুরাইয়ার গা কাটা দিয়ে উঠল। ইমাইন্যা। ইমাইন্যা। আবার কি? তার ইমন কি কাজের ছেলে যে তাকে ইমাইন্যা ডাকতে হবে!
বান্দরডারে কি সুন্দর লাগিতাছে দেখ। বান্দর আবার ফোকলা দীতে হাসে। ও বান্দর তুই হাসস ক্যান? ইমাইন্যা বান্দর হাসে। ভ্যাকভ্যাকাইয়া হাসে।
ইমন কি হাসবে আকলিমা বেগম হেসে হেসে কুটি কুটি হচ্ছেন। তিনি পা লম্বা করে মেঝেতে হেলান দিয়ে বসেছেন। ইমান বসে আছে তার ছড়ানো পায়ের উপর। তিনি মাঝে মাঝে পা নাড়ছেন ইমনের আনন্দ তাতেই উথলে উঠছে। আকলিমা বেগম হাসি মুখে ছড়া কাটলেন,
দাঁত পরা কুলি পরা
মধ্যিখানে খাল
বুড়ি বেটি হাইগ্যা থুইছে
বাইশ হাত লম্বা নাল।
এইবার হাসার পালা। ইমনের। এমন মজার ছড়া মনে হয় সে তার ইহ জীবনে শুনেনি। সুরাইয়া কঠিন গলায় বলল, ইমন আসতো।
আকলিমা বেগম বললেন, থাউক না খেলতাছে খেলুক। তুমি তোমার কাম কর। ও ইমাইন্যা দাতের ফাঁক দিয়া ছেপ ফেল দেখি।
ইমন দাঁতের ফাঁক দিয়ে পিচ করে থুথু ফেলল। সেই থুথু পড়ল তার দাদীর গায়ে। তিনি হেসে কুটি কুটি হচ্ছেন। তাঁর নাতীও হেসে ভেঙ্গে পড়ছে। আনন্দের আজ যেন বান ডেকেছে।
সুরাইয়া তাকাল ছেলের দিকে। ছেলে চোখ বড় বড় করে মাকে দেখছে। সুরাইয়ার বুকের ভেতর হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল। আহারে, ছেলেটাকে কি সুন্দর লাগছে। সত্যি সত্যি কাঁচা হলুদ গায়ের রঙ। সুরাইয়া নিজে এত ফর্সা না। তার বাবাও না। ছেলে এমন গায়ের রঙ পেল কোথায়? দাঁত পড়ায় ছেলের চেহারা আজ আরো সুন্দর হয়ে গেছে। দাতপড়া ছেলেটার অদ্ভুত মুখটায় ক্রমাগত চুমু খেতে ইচ্ছা করছে। শাশুড়ির পায়ের উপর থেকে ছেলেটাকে জোর করে ধরে নিয়ে এলে কেমন হয়? খুব ভাল হয়। কিন্তু সম্ভব না। সুরাইয়া চলে এল। তার ইচ্ছা করছে ইমনের বাবার অফিসে একটা টেলিফোন করতে। টেলিফোন করাও সমস্যা। তাদের টেলিফোন নেই। বাড়িওয়ালার বাসা থেকে টেলিফোন করতে হয়। বাড়িওয়ালা বাসায় থাকলে কিছু বলেন না। কিন্তু তিনি বাসায় না থাকলে তাঁর স্ত্রী খুব বঁকা ভাবে কিছু কথা শুনিয়ে দেয়। তাছাড়া কারণে অকারণে টেলিফোন করা ইমনের বাবা পছন্দ করে না। হাসানুজ্জামান অনেকবার বলেছে এক্সট্রিম ইমার্জেন্সি ছাড়া টেলিফোন করবে না। আমার টেবিলে টেলিফোন থাকে না, বড় সাহেবের টেবিলে টেলিফোন। উনার সামনে এসে কথা বলতে হয়। উনি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। খুব অস্বস্তি লাগে।
টেলিফোনে ইমনের বাবার সঙ্গে কথা বলতে সুরাইয়ার খুব ভাল লাগে। তার গলাটা টেলিফোনে সম্পূর্ণ অন্যরকম শোনা যায়। খুব আন্তরিক লাগে। মনে হয় গম্ভীর ধরনের একজন মানুষ মায়া মায়া গলায় কথা বলছে। সুরাইয়ার একটা ছেলেমানুষী স্বপ্ন হচ্ছে কোন একদিন তাদের টেলিফোন আসবে এবং সে তখন রোজ একঘন্টা করে ইমনের বাবার সঙ্গে কথা বলবে। মানুষটা বিরক্ত হোক বা রাগ হোক কিছুই যায় আসে না। সে কথা বলবেই।
ছেলের দাঁত পড়ে যাওয়া নিশ্চয়ই কোন এক্সট্রিম ইমার্জেন্সি না। টেলিফোনে এই খবর দিলে ইমনের বাবার রেগে যাবার সম্ভাবনা। তবে রাগটা সে প্ৰকাশ করবে না। যত রাগই হোক মায়া মায়া করে কথা বলবে। ফিরোজের জল বসন্ত এটাও দেবার মত খবর। সে এম এ পরীক্ষা দেবে না এটাও বলা যেতে পারে। অনেক কিছুইতো আছে বলার মত।
অবশ্যি আরেকটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খবর আছে। সেই খবরটা টেলিফোনে দেয়া যাবে না। সব খবর কি আর টেলিফোনে দেয়া যায়? সুরাইয়া টেলিফোন করা ঠিক করল।
ভারী এবং রাগী গলার এক ভদ্রলোক টেলিফোন ধরলেন, কাকে চাই এমন ভাবে বললেন যেন কাউকে চাওয়াটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সুরাইয়া হকচাকিয়ে গিয়ে বোকার মত বলল, দয়া করে ইমনের বাবাকে দিন।
ইমনের বাবার নামটা জানতে পারি?
সুরাইয়া লজ্জিত গলায় নাম বলল। ভদ্রলোক বললেন, আপনি ধরে থাকুন, লাইন ট্রান্সফার করে দিচ্ছি। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ইমনের বাবা মায়া মায়া গলায় বলল, কে সুরাইয়া? কেমন আছ?
সুরাইয়ার এত ভাল লাগলো যে চোখে প্রায় পানি এসে গেল। সে বোকার মত বলে বসল, এখনো আসছ না কেন?
অফিস ছুটি হোক তারপর আসব।
শোন, ইমনের দাঁত পড়ে গেছে। উপরের পাটির দাঁত, তাকে যে কি অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
ছয় বছরে দাঁত পড়ে, ওর পাঁচ বছর তিনমাস।
ও আচ্ছা।
তোমার ভাইয়ের গায়ে গোটা গোটা কি যেন উঠেছে। ওর ধারণা জল-বসন্ত। সে জল-বসন্ত নিয়েই বাইরে গেছে।
ও আচ্ছা।
আমাকে বলছিল। সে এম এ পরীক্ষা দেবে না।
নিশ্চয়ই ঠাট্টা করেছে।
আমার কাছে ঠাট্টা বলে মনে হয় নি। আচ্ছা শোন, এই যে হঠাৎ টেলিফোন করলাম রাগ করানিতো।
না, রাগ করব কেন? টেলিফোন করাটাতো কোন ক্রাইম না।
তোমার বড় সাহেব, উনি কি তোমার দিকে তাকিয়ে আছেন?
উনি তাকিয়ে থাকবেন কেন? টেলিফোনতো আমার টেবিলে। আমাকে টেলিফোন দিয়েছে।
বল কি, কবে দিয়েছে?
গত সপ্তাহে। ডিরেক্ট লাইন না। পি বি এক্স লাইন।
গত সপ্তাহে টেলিফোন দিয়েছে তুমি আমাকে বলনি কেন?
এটা কি বলার মত কোন ব্যাপার?
অবশ্যই বলার মত ব্যাপার। আশ্চর্য তুমি এরকম কেন? আমাকে কিছুই বলনা। আচ্ছা শোন, তুমি আমাকে কার্ডফোনের একটা কার্ড করিয়ে দেবে, আমি রোজ তোমাকে টেলিফোন করব।
সুরাইয়া শুনল ইমনের বাবা হাসছে।
আজ কিন্তু অনেকক্ষণ তোমার সঙ্গে কথা বলব। তোমার কাজ থাকুক। আর যাই থাকুক।
সুরাইয়া আজ চারটার সময় আমাদের একটা মিটিং আছে। আমাকে সেই মিটিং এর ফাইল তৈরী করতে হবে তিনটার মধ্যে। কাজেই তোমাকে টেলিফোন রাখতে হবে।
সুরাইয়া দুঃখিত গলায় বলল, ও আচ্ছা।
আমি এক কাজ করি আজ সকাল সকাল চলে আসি। তারপর কোন একটা স্টুডিওতে নিয়ে গিয়ে ইমনের একটা ছবি তুলে রাখি। বড় হয়ে দেখলে মজা পাবে।
আচ্ছা।
সুরাইয়া রাখি?
ইমনের বাবা টেলিফোন রেখে দিল। সুরাইয়া তারপরেও বেশ কিছু সময় টেলিফোন কানে ধরে রাখল। পো পো শব্দ হচ্ছে। শব্দটা শুনতে এমন খারাপ লাগছে।
আর কাউকে কি টেলিফোন করা যায়? ছেলের দাঁত পড়েছে এই খবরটা নিশ্চয়ই অন্যকে দেবার মত। বড় ভাইজানকে কি খবরটা দেব? সুরাইয়া মনস্থির করতে পারছে না। তার বড় ভাই জামিলুর রহমান শুকনা ধরণের মানুষ। নিজের ব্যবসা ছাড়া অন্য কিছুই বুঝেন না। তিনি কোন কিছুতে বিরক্তও হন না, বা আনন্দিতও হন না।
সুরাইয়া ভাইজানের বাড়িতে টেলিফোন করল। জামিলুর রহমান টেলিফোন ধরলেন এবং গম্ভীর গলায় হ্যালো বলার বদলে বললেন, কে?
সুরাইয়া বলল, ভাইজান আমি সুরাইয়া।
কি ব্যাপার?
না কিছু না, এমনি খবর নেয়ার জন্যে টেলিফোন করলাম। আপনারা ভাল আছেন?
হ্যাঁ।
ভাবী—ভাবী ভাল আছেন?
হ্যাঁ।
ইমনের আজ একটা দাঁত পড়েছে।
ও আচ্ছা।
মিতুর কি দাঁত পড়েছে? মিতুর বয়সতো ইমনের কাছাকাছি। ইমনের দুই মাসের ছোট। মিতুর দাঁত পড়ে নি?
জানিনাতো।
আপনার শরীর ভাল আছে ভাইজান?
হুঁ।
হজমের যে সমস্যা ছিল সমস্যা মিটেছে?
না আছে। সুরাইয়া এখন রাখি-আমাকে একটু পুরোনো ঢাকায় যেতে হবে। তোরা একদিন চলে আসিস। জামাইকে নিয়ে আসিস। তোর শাশুড়িকেও নিয়ে আসিস।
সুরাইয়া কিছু বলার আগেই তিনি টেলিফোন রেখে দিলেন। সুরাইয়া তারপরেও টেলিফোন কানে দিয়ে রাখল। পো পো শব্দ হচ্ছে। মন খারাপ করা শব্দ। তারপরেও আজ কেন জানি শব্দটা শুনতে ভাল লাগছে। মানুষের জীবনে একেকটা দিন একেক রকম হয়ে আসে। কোন কোন দিনে মন খারাপ হবার মত ব্যাপার ঘটলেও মন খারাপ হয় না। বরং মন ভাল হয়ে যায়। আজি মনে হয়। সে রকম একটা দিন।
ব্যাপারটা কি? রাত এগারোটা বাজে ইমনের বাবা এখনো আসছে না। সুরাইয়া প্রাণপণ চেষ্টা করছে দুঃশ্চিন্তা না করতে। যেদিন সকাল সকাল বাড়ি ফেরার কথা থাকে সেদিন দেরি হয় এটা জানা কথা। তার কোন বন্ধু হয়তো তাকে বাসায় ধরে নিয়ে গেছে। তার ছেলের জন্মদিন বা এই জাতীয় কিছু। রাতে না খাইয়ে ছাড়বে না। খাওয়া দাওয়া শেষ করে গল্প করতে করতে দেরি
হচ্ছে।
সুরাইয়া বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। একবার ফিরোজের ঘরে উঁকি দিল। ফিরোজও ফিরে নি। তাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করার কিছু নেই। সে প্রায়ই রাত বিরেতে বাড়ি ফেরে। একবার ফিরে ছিল রাত তিনটায়। কিন্তু ইমনের বাবাতো কখনো এত দেরি করে না। সত্যিকারের কোন বিপদ হয়নিতো? বড় শহরের বিপদগুলিও হয় বড় বড়। কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ গণ্ডগোল লেগে যায়। গাড়ির কাচ ভাঙ্গা হতে থাকে, ককটেল ফুটতে থাকে। এক সময় পুলিশের গাড়ি আসে। বেশির ভাগ সময়ই পুলিশরা গাড়ি থেকে নামে না। যদি নামে তাহলে নিরীহ মানুষ যারা সাতেও নেই পাচেও নেই তাদের দিকে হুংকার দিয়ে ছুটে যায়। লাঠি পেটা করে। মাথা ফাটিয়ে দেয়। যেদিন কোথাও কোন গণ্ডগোল থাকে না সেদিন ফুটপাতে ট্রাক উঠে পড়ে। এই অদ্ভুত শহরে নিশ্চিন্ত হয়ে ফুটপাথ দিয়েও হাঁটার উপায় নেই।
আজ কি শহরে কোন গণ্ডগোল হচ্ছে?
পত্রিকায়তো কিছু লেখেনি। পত্রিকাটা অবশ্যি সুরাইয়ার ভালমত পড়া হয়নি। এখন বারান্দায় বসে পত্রিকাটা পড়া যায়। এতে সময়টা কাটবে। সুরাইয়ার কেন জানি মনে হচ্ছে রাত বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই ইমনের বাবা আসবে। তার আবার যা মনে হয় তাই হয়। সুরাইয়া পত্রিকা নিয়ে বসল। রাত বারোটা পাঁচ পর্যন্ত সে পত্রিকা পড়ল। কেউ এল না। সুরাইয়ার বমি বমি লাগছে। এই বমি, উদ্বেগ জনিত বমি না। এর কারণ ভিন্ন। তার শরীরে আরো একজন মানুষ বাস করছে। সে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। মানুষটার কথা হাসানকে এখনো বলা হয়নি। আজ বলে ফেললে কেমন হয়। শুধু তার শাশুড়ি জানেন। ছেলের বাড়িতে পা দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি নিচু গলায় বললেন, ও বউ, তোমার কয় মাস? সুরাইয়া হতভম্ব। তার মাত্র তিনমাস চলছে। কারো কিছু বোঝার কথাই না। তিনি কি করে বুঝলেন? পুরানো দিনের মানুষদের চোখ এত তীক্ষ্ণ?
আকলিমা বেগম ঘুমিয়ে পড়েছেন। তিনি জেগে থাকলে সুরাইয়া তার উদ্বেগের খানিকটা তার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারত। তাকে কি ডেকে তুলবো? না, আরো আধাঘন্টা যাক। তাকে না জাগানোই ভাল। তিনি জেগে গেলে ঝামেলা করবেন। কান্নাকাটিও শুরু করতে পারেন। এই বয়সের মানুষদের মাথার ঠিক থাকে না। আকলিমা বেগমের মাথা একটু মনে হয় বেশী রকমের বেঠিক। তিনি রাতে ভাত খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েন। রাত একটা দেড়টার দিকে জেগে ওঠেন। শুরু হয় একা একা কথা বলা, বারান্দায় হাঁটা। মাঝে মধ্যে গানের মত সুর করে কি জানি বলেন। শুনতে ভাল লাগে। প্রথমবার শুনে সুরাইয়া চমকে ওঠে বলেছিল, আম্মা গান গাচ্ছেন নাকি? হাসান বিরক্ত গলায় বলেছে, গান গাইবে কেন? টেনে টেনে কথা বলছে।
কথাগুলি কি বুঝতে পারছি?
না।
উনি কি সব সময় এ রকম করেন–না। আজই করছেন?
প্রায়ই করেন। ফালতু আলাপ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা কর।
সুরাইয়া বারান্দায় বসে আছে। বারান্দা থেকে রাস্তা দেখা যায় না। বাড়িওয়ালা তার বাড়ির চারদিকে খুব উঁচু করে দেয়াল দিয়েছে। দেয়ালে আবার সূচালো লোহার শিক বসানো—যেন চোর দেয়াল টপকে ঢুকতে না পারে। গেট আছে। গেটে দারোয়ান নেই। সব ভাড়াটের কাছে একটা করে চাবি দেয়া। রাতে বিরেতে কেউ ফিরলে চাবি দিয়ে গেট খুলে ঢুকতে হবে। তিন তলা বাড়ির এক তলায় দুজন ভাড়াটে থাকেন। তিন তলায়ও দুজন ভাড়াটে। দুতলার সবটা নিয়ে থাকেন বাড়িওয়ালা। এদের কারোর সঙ্গেই সুরাইয়ার কোন যোগ নেই। যোগ থাকলে ভাল হত— আজি এই বিপদের সময় এদের কাছে ছুটে যাওয়া যেত। বিপদে তারা কি করত না করত সেটা পরের কথা। সুরাইয়াদের পাশের ডান দিকের ফ্ল্যাটে থাকেন আব্দুল মজিদ সাহেব। বেঁটে খাট মানুষ। গাউী গোট্টা চেহারা। মুখে সব সময় পান। সকালে যখন ব্রিফ কেস হাতে বের হন তখন ভুর ভুর করে জর্দার গন্ধ পাওয়া যায়।
সুরাইয়ার সঙ্গে দেখা হলো থমকে দাঁড়ান। অকারণে গলা খাকাড়ি দেন। তার চোখের দৃষ্টি গা বেয়ে নামতে থাকে। ভয়ংকর ব্যাপার। সুরাইয়ার কয়েকবারই ইচ্ছে করেছে বলে-আপনি এই ভাবে তাকান কেন? এ ভাবে তাকাবেন না। আমি নিতান্তই ভদ্র মেয়ে বলে কিছু বলছি না। কোন একদিন কঠিন কোন মেয়ের পাল্লায় পড়বেন, সে উলের কাটা দিয়ে আপনার চোখ গেলে দেবে। বিপদ যত বড়ই হোক-আব্দুল মজিদ সাহেবের কাছে যাওয়া
যাবে না।
কোথাও কি টেলিফোন করা যায়? বাড়িওয়ালা সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়লেও তাদের ছোট মেয়েটা এবার এস. এস. সি. পরীক্ষা দিচ্ছে। বলতে গেলে প্রায় সারা রাত জেগে পড়ে। দরজায় ধাক্কা দিলেই সে দরজা খুলে দেবে। কোথায় টেলিফোন করবে?
ভাইজানের বাড়িতে? তাঁকে কি বলবে? ভাইজান দশটার ভেতর ঘুমিয়ে পড়েন। একবার ঘুমিয়ে পড়লে তাকে জাগানো নিষেধ। ভয়ংকর বিপদ এই কথা বললে তাকে হয়ত ডেকে দেবে-তিনি সব শুনে হাই তুলতে তুলতে বলবেন—এত রাতে কোথায় খোজ করবি? সকাল হোক। তাছাড়া পুরুষ মানুষ এরা এক দুই রাত বাইরে থাকেই।
অফিসে? অফিস কি কেউ রাত একটা পর্যন্ত খোলা রাখে। হাসপাতালে? এক্সিডেন্ট করে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে কি-না জানতে চাওয়া। নাম হাসানুজ্জামান বয়স বত্রিশ। পরনে চেক ফুল সার্ট, খয়েরী প্যান্ট। পায়ে স্যাণ্ডেল। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। গায়ের রঙ ফর্সা। দেখতে সুন্দর-হালকা পাতলা। টেলিফোনে তার গলার স্বর খুব মিষ্টি।
সুরাইয়া চমকে উঠল। ছিঃ ছিঃ এইসব সে কি ভাবছে? হাসপাতালের কথা মনে আসছে কেন? মানুষটা হাসপাতালে কেন যাবে? কু চিন্তা মনে আসা ঠিক না। যে চিন্তা মনে আসে তাই হয়। ভাল কোন চিন্তা মনে আনতে হবে। সুন্দর কোন চিন্তা।
বৌমা! বারিন্দায় বইসা আছ কেন?
সুরাইয়া উঠে দাঁড়াল। আকলিমা বেগমের ঘুম ভেঙ্গেছে। তিনি বারান্দায় চলে এসেছেন। বাকি রাতটা বারান্দায় হাঁটাহাটি করে এবং গান গেয়ে কাটাবেন। সুরাইয়া বলল, আম্মা ও এখনো ফেরেনি।
রাইত কত হইছে?
দুটা বাজতে পাঁচ মিনিট।
রাইতাতো মেলা হইছে।
জ্বি।
তুমি ভাত খাইছ?
জ্বি না।
যাও, তুমি গিয়া ভাত খাও। চিন্তার কিছু নাই—পুরুষ মানুষ দুই এক রাইত দেরী করেই। এইটা নিয়া চিন্তার কিছু নাই। বন্ধু-বান্ধবের বাড়িত গেছে, টাশ খেলতাছে।
ও তাস খেলে না মান।
খেলে না বইল্যা যে কোনদিন খেলব না এমুন কোন কথা নাই। বিলাই আর পুরুষ মানুষ এই দুই জাতের কোন বিশ্বাস নাই। দুইটাই ছোকছুকানি জাত। যাও, ভাত খাইতে যাও—আমি বসতেছি। যাও কইলাম।
সুরাইয়া রান্নাঘরের দিকে রওনা হল। রান্নাঘরে না যাওয়া পর্যন্ত তার শাশুড়ি এই একটা বিষয় নিয়েই কথা বলতে থাকবেন—ভাত খাও, ভাত খাও। গ্রামের মানুষদের কাছে ভাত খাওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ইমনকে রাতে খাওয়ানোর সময় সুরাইয়ার প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছিল। ক্ষিধের যন্ত্রনায় নাড়ি পাক দিচ্ছিল। এখন একেবারেই ক্ষিধে নেই। বরং বমি বমি ভাব হচ্ছে। এক গ্লাস লেবুর সরবত বানানো যায়। ঘরে আর কিছু থাকুক না থাকুক লেবু আছে। ইমনের বাবা লেবু ছাড়া ভাত খেতে পারে না। গরম ভাত ছাড়া খেতে পারে না। পাতে যখন ভাত দেয়া হবে তখন সেই ভাতে ফ্যান মাখা থাকতে হবে। ফ্যান ভাত থেকে ধোঁয়া উঠতে হবে। এমন গরম ভাত মানুষ কপি কপ করে কি ভাবে খায় কে জানে।
সুরাইয়া চুলা ধরাল। রাতের বেলা হাসান যখন বলে–ভাত বার, ক্ষিধে লেগেছে। তখনই সে চুলা ধরিয়ে আধাপটি চাল দিয়ে দেয়। হাসানের হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে খেতে আসতে আসতে চাল ফুটে যায়। আজকের অবস্থা, ভিন্ন। ভাত রাধা থাকুক। কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকা। ভাত রাধতেওতো কিছু সময় যাবে।
আকলিমা বেগম মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসেছেন। তিনি চেয়ারে বসতে পারেন না, খাটে বসতে পারেন না। রাতে ঘুমুবার সময়ও মেঝেতে চাদর বিছিয়ে ঘুমান। সুরাইয়া মেঝের মশারি খাটিয়ে দিতে চেয়েছে, তিনি রাজি হন নি। মশারা নাকি তাকে কামড়ায় না।
বুড়া মাইনষের রক্তে কোন টেস নাই গো বউ। শইল্যে মশা বয় ঠিকই–কামুড় দেয় না।
আজ আকলিমা বেগমকে মশা কামড়াচ্ছে। তিনি এর মধ্যে কয়েকটা মশা মেরে ফেলেছেন। মৃত মশাগুলি জড় করছেন। যেন এরা মহামূল্যবান কোন প্রাণী, এদের মৃতদেহগুলির প্রয়োজন আছে। আকলিমা বেগমের বুক ধড়ফড় করছে। এত রাত হয়ে গেল ছেলে বাসায় ফিরছে না কেন? এই বয়সে সবচে খারাপটাই আগে মনে হয়। ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে কি? আজকের রাতটা কি ভয়ংকর কোন রাত? তার সত্তর বছরের জীবনে অনেক ভয়ংকর রাত এসেছে— এবং চালেও গেছে। হাসানের বাবার মৃত্যুর কথাই ধরা যাককবুতরের খুপড়িতে হাত দিয়েছে। কবুতর ধরবে। নতুন আলু দিয়ে কবুতরের মাংস রান্না হবে। হাত দিয়েই হাত টেনে নিল-রাঙ্গা বউ ইন্দুরে কামড় দিছে। কবুতরের বাসাত ইন্দুর।
না, ইঁদুর না—সাপ। বিরাট এক সাপ। তাদের চোখের সামনেই কবুতরের খোপ থেকে বের হয়ে এল। দুজনই হতভম্ব। আকলিমা বেগম দিশা হারালেন না, সঙ্গে সঙ্গেই পাটের কোষ্টা দিয়ে হাত বাধলেন। ওঝা আনতে লোক পাঠালেন। কালা গরুর দুধে হাত ড়ুবিয়ে রাখলেন। শাদা বর্ণের দুধ যদি কালচে হয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে জীবনের আশা নেই। দুধ কালচে হল না। আকলিকা বেগম আশায় আশায় বুক বাধলেন। ওঝা এসে পড়ল দুপুরের মধ্যে। ঘন্টা খানিক ঝাড়ফুকের পর বাঁধন খোলা হল। মানুষটা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হাত জুইল্যা যাইতেছিল–এখন ব্যথা কমছে। পানি খাব বউ। পানি দাও। পানি আনা হল। পানির গ্লাস হাতে নিয়ে মুখে দেবার আগেই লোকটা মারা গেল।
এইসব কথা আকলিমা বেগম মনে করতে চান না, তবু মাঝে মধ্যেই মনে পড়ে। লোকটা পানি খেয়ে মরতে পারল না— ভরা গ্লাস হাতে নিয়ে ধড়ফড় করে মরে গেল এই দুঃখও কম কি? জগতের কোন দুঃখই কম না। ছোট দুঃখ, বড় দুঃখ, সব দুঃখই সমান।
আজ তাঁর জন্যে কি দুঃখ অপেক্ষা করছে কে জানে। মন শক্ত করে রাখতে হবে। বাচ্চা বউটার দিকে তাকিয়ে মন শক্ত করতে হবে। বাচ্চা মানুষ দুঃখ পেয়ে অভ্যাস নেই। বউটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাত পার করতে হবে। দিনের বেলা যে কোন কষ্টই সহনীয় মনে হয়–রাতে ভিন্ন ব্যাপার। কিছু কিছু রাতকে এই জন্যে বলে কাল-রাত। কালদিন বলে কিছু নেই। এটাও একটা আশ্চর্য ব্যাপার, তিনি তার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন-নরম মেয়েগুলি কঠিন বিপদ সামাল দিতে পারে। শক্ত মেয়েগুলি পারে না। চিৎ হয়ে পড়ে যায়। এই শক্তের একটা গেরাইম্যা নাম আছে-চিৎ শক্ত।
আম্মা, চা নেন।
আকলিমা বেগম চায়ের কাপ হাতে নিলেন। শহরে এলে তার চা খাবার রোগে ধরে। বেঁটা এই ভয়ংকর সময়েও চা বানিয়েছে, এটা ভাল লক্ষণ। মন শক্ত আছে। আসল বিপদ সামাল দিতে পারবে।
বৌমা বাজে কয়টা?
দুইটা পঁচিশ।
রাইত কাটতে বেশী দিরং নাই–তুমি ভাত খাইছ?
হুঁ।
তুমি ভাত খাও নাই–মিছা কথা বলছি। মুরুব্বির সাথে মিছা কথা বলা ঠিক না। যাই হউক, চেয়ার টান দিয়া আমার সামনে বও, তোমার লগে আলাপ আছে।
সুরাইয়া চেয়ার টেনে বসল। কেন জানি তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।
বউমা মন দিয়া শোন–আমি একটা গনা গনছি। গনার মধ্যে পাইছি হাসান ভাল আছে। কাজেই মন খারাপ করবা না। সে আসব সক্কালে।
কি গনা-গুনেছেন?
সেইটা তুমি বুঝবানা—আমি পুরান কালের মানুষ আমি অনেক গনা জানি।
আকলিমা বেগম কোন গনা জানেন না। বাচ্চা মেয়েটার মন শান্ত করার জন্যে কিছু মিথ্যা কথা বলা। এই মিথ্যা বলার জন্যে তাঁর পাপ হচ্ছে—আবার মেয়েটার মন শান্ত করায় পূণ্য হচ্ছে। পাপ-পূণ্যে কাটাকাটি হয়ে সমান সমান।
ইমন জেগে উঠেছে। কাঁদছে। তাকে বাথরুম করাতে হবে। সুরাইয়া ছেলের কাছে গেল। আকলিমা বেগম আরাম করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। ছেলে ফিরছে না। এই দুঃশ্চিন্তা এখন আর তার মাথায় নেই। গনার ব্যাপারে যা বলেছেন তা সর্বৈব্য মিথ্যা। বাচ্চা মেয়েটাকে শান্ত করার জন্যেই বলা। বউটা তাকে দেখতে না পারলেও তিনি তাকে খুবই পছন্দ করেন। মেয়েটার মনে দরদ আছে। স্বামীর জন্যে সে খুবই ব্যস্ত। আকলিমা বেগমের ঘুম পাচ্ছে। তিনি বারান্দা থেকে উঠলেন। কিছুক্ষণ ঘুমালেও কাজে আসবে। সকালে কোন ভয়ংকর সংবাদ এসে উপস্থিত হয় কে জানে।
ইমন বাথরুম করল। পানি খেল। সব কিছুই ঘুমের মধ্যে। সুরাইয়া তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। ঘুমের মধ্যেই সে বিড় বিড় করে কথা বলছে। আবার মাঝে মাঝে দাঁত কট কট করছে। পেটে কৃমি হয়েছে না-কি? যে ভাবে চিনি খায় পেটে কৃমি হওয়া বিচিত্র না। সুরাইয়া ক্লান্ত গলায় ডাকল—ও বাবু, ও বাবু! ইমন ঘুমের মধ্যেই বলল, কি ৷
তোমার বাবা এখনো আসছে না কেন গো বাবু?
উঁ।
আমার খুব অস্থির লাগছে গো সোনা।
ইমন আবারো বলল, উ। আর তখনি বারান্দায় রাখা পানির বালতি থেকে পায়ে পানি ঢালার শব্দ হল। এই শব্দ সুরাইয়ার পরিচিত শব্দ। ইমনের বাবা বাইরে থেকে এলেই প্রথম যে কাজটা করে-বালতি থেকে পানি নিয়ে পায়ে ঢালে। তার জন্যে বালতি ভরতি পানি এবং একটা মগ বারান্দায় রাখা থাকে।
সুরাইয়ার শরীর ঝিম ঝিম করছে। ছুটে গিয়ে যে দেখবে সেই শক্তিও তার নেই। বারান্দায় যেতে ভয় লাগছে। গিয়ে যদি দেখে সে না, ইমনের দাদী নামাজের অজু করছেন। রাত বিরাতে অজু করার অভ্যাস।
নামাজের জন্যে অজু করবেন, তারপর নামাজ পড়তে ভুলে যাবেন।
সুরাইয়া উঠল। বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
ইমনের বাবা না, ফিরোজ। বালতি থেকে পানি নিয়ে পায়ে ঢালছে। ফিরোজ বলল, কি হয়েছে ভাবী? এ ভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
সুরাইয়া জবাব দিতে পারল না, তার মাথা ঘুরে উঠল। সে হাত বাড়িয়ে দেয়াল ধরতে চেষ্টা করল। ধরতে পারল না। ফিরোজ ছুটে এসে ধরে ফেলার আগেই মেঝেতে পড়ে গেল।
চলবে…
অপেক্ষা গল্পের লিংক (সম্পূর্ণ)