লেখক: হৃদয় আহমেদ
পর্ব ৯
শরীর কাঁপছে! রাগে থরথর করে কাঁপছে। আধঘন্টা হলো ফোন করেছি এখনো উনি আসেনি। কেন? বিছানার চাদর খিচে নিলাম। চিঠিটা পড়ার পর রিকশা থেকে নেমে পরি আমি। ট্যাক্সি করে চলে এসেছি মামীদের বাসায়। নিচে সবাইকে উপেক্ষা করে ছুটে আমাদের রুমে চলে এসেছি। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য লাগছে। কাল আব্বু কত শক্ত কন্ঠে বলেছিলো,’ পৃথিবী উল্টে গেলেও যেন তাকে ভুল না বুঝি! ‘ কথাগুলো বারবার প্রতিধ্বন্নি হয়ে কানে বাজছে। আর সেখানে লোকটা নিজেই একটা শিশুর খুনি? কেন উনি খুন করেছেন একটা শিশুর? কতটুকু ছিলো বাচ্চাটি? ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে আসছে! অথচ মুখে কাঠিন্যে ভাব! কতটা কষ্টকর! তবুও রেখেছি। আজ আমার সকল প্রশ্নের উত্তর ওনাকে দিতে হবে! জানতেই হবে সবটা আমায়।
‘ এভাবে এখানে আসার মানে কি সিয়া? কিসব অভদ্রতা বলবি আমায়? ‘
সিয়াম ভাইয়ার স্বর পেতেই কড়া চোখে তাকালাম আমি। উনি হাঁপাচ্ছেন। হয়তো ছুটে এসেছেন সিঁড়ি দিয়ে। আমি চুপ করে তাকিয়ে রইলাম এই লোকটার দিকে। উনি আবারো বলতে আরম্ভ করলেন,
‘ নিচে কাউকে কিছু না বলে চলে এসেছিস কেন তুই? মা চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে। ‘
……
‘ ওয়াট রং উইথ ইউ? চুপ করে আছিস কেন তুই? ‘
……
‘ এবার কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে। ওদিকে তোর আব্বুও চিন্তিত! ‘
উনি রাগে গজগজ করতে করতে ছুটে এলেন আমার সামনে। বাহু ঝাঁকিয়ে কর্কশ গলায় বললেন,
‘ তুই কিন্তু লিমিট ক্রস করছিস! ‘
শান্ত দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার হাতের দিকে। আমার অদ্ভুত চাউনিতে উনি ভ্রু কোঁচকালেন। শান্ত গলাতেই বলে উঠলাম,
‘ কে সেই ছেলেটি সিয়াম ভাইয়া? কার খুনী আপনি? ‘
বিমুঢ় দৃষ্টিতে তাকালো সিয়াম ভাই। তার মুখ মুহুর্তে পাল্টে যায়। চোখ শিতল হয়। মুখশ্রীতে রাগ নেই। চাউনি অবাক! কেবল পাথর মুর্তির মতো একচোখে আমার দিকেই তাকিয়ে রইলেন উনি।
‘ বলবেন না? কেন খুন করেছেন? ‘
‘ কিভাবে জানলি তুই? ‘ কন্ঠ কেমন শোনালো। ঘার থেকে হাত সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালাম আমি। বুক হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে। উনি ধপ করে বসে পরলেন বিছানায়।বললাম,
‘ অজানা কেউ আপনার মুখোশ খুলে দিয়েছে আমার সামনে। ‘
উনি আমার পিছনে এসে দাড়ালেন। তার মুখেচোখে ভয়! সব হারাবার ভয় পুলকিত হতে লাগলো। উনি স্তব্ধ কন্ঠে বলে ওঠেন,
‘ কে বলেছে তোকে? ‘ কন্ঠ কত করুন, আক্ষেপে জর্জরিত শোনালো। আমার নিজেরই বিশ্বাস হতে কষ্ট হচ্ছে আমি যাতে মুগ্ধ সে খুনী! কোন বাচ্চাকে নরপশুদের মতো খুন করেছে। বুকের জ্বালা বেড়ে দ্বীগুন হলো। আমার ওষ্ঠাদ্বয় তিরতির করে কাঁপছে! বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, ঝলসে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি নিজেকে আটকাতে পারলাম না, ঘুরে গিয়ে তার কলার চেপে চেঁচিয়ে উঠলাম,
‘ কোন মায়ের বুক খালি করেছেন আপনি? কাকে মেরেছেন উত্তর দিন! ‘
আমার প্রশ্নে তার চিবুক কেঁপে ওঠে। দৃষ্টি এলোমেলো, কনকনে শিতে তার কপালে গুচ্ছ গুচ্ছ ঘামের কনা। আমার বুক বিরতিহীনভাবে ওঠানামা করছে। উনি চুপ! চুপ থাকারই তো কথা। খুন করে অন্তত কেউ বরগলায় কিছু বলতে পারে না। কিন্তু ওনার চুপ থাকা যে আমার রাগ কয়েকশোগুন বাড়িয়ে তুলছে। কপালের রগ দপদপ করছে আমার।
‘ এভাবে চুপ থেকে প্রমান করবেন না আপনি দোষী! বলুন। সবটা বলুন। ‘
উনি চুপ। একচোখে তাকিয়েই আমার দিকে। ফের বললাম,
‘ কি হলো বলুন! কে সেই ছেলেটি সিয়াম ভাইয়া? ‘
আমার প্রশ্নকে অগ্রাহ্য করে কলার থেকে হাত নামিয়ে দুহাত শক্ত করে ধরে নিলেন উনি। উত্তজিত গলায় বললেন,
‘ তুই? সিয়া তুই বিশ্বাস করিস আমি খুন করতে পারি? আমি…এই আমি কাউকে খুন করেছি তোর বিশ্বাস হয় সিয়া? ‘
গাল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। তার চোখ ভর্তি আকুতি! আমার উত্তরের অপেক্ষা সে চোখে। শুকনো ডোগ গিলে কড়া গলায় বললাম আমি,
‘ করি! বিশ্বাস করি আমি। ‘
হাত ছেড়ে দূরে গিয়ে দাড়ালেন উনি। চোখ ছলছল করছে ভাইয়ার। কি করবেন কি না করবেন ভেবে পাচ্ছে না। বিছানার পাশে রাখা টেবিলটা থেকে উনি কাঁচের একটি টপ তুলে নিলেন। অজানা ভয়ে আৎকে উঠলাম আমি। একমুহূর্ত না দাড়িয়ে ছুটে গিয়ে হাত আটকে নিলাম ওনার।
‘ কি করছেন আপনি? ‘
আমার প্রশ্নকে অগ্রাহ্য করে জড়িয়ে নিলেন আমায় উনি। একটু ভয় পেয়ে গেলাম। তার হৃদপিণ্ড দ্রুততম বেগে লাফাচ্ছে। হয়তো তুফান বইছে। এত শিতেও তার শরীরে একটি শার্ট ছাড়া কিছু নেই। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রইলেন উনি। শরীর ঘেমে একাকার ভাইয়ার। একটু পর অস্ফুটস্বরে বললেন,
‘ তুই পারিস না আমায় ভুল বুঝতে। পারিস না। ‘
থেমে হেলাম। ছোটবার তেজটা কমে এলো। সান্ত গলায় বললাম,
‘ কেন পারি না? অবশ্যই পারি! ‘
‘ না…না….কিছুতেই না। ‘
‘ আমায় বলুন সবটা। ‘
দূরে ছিটকে ফেলে দিলেন উনি। টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে বসে পরলাম। কিংকর্তব্যবিমুঢ় চাউনিতে তাকালাম ওনার দিকে। শুকনো ঠোঁটে কিছু বিরবির করছেন উনি। আবারো আমার পাশে মেঝেতে বসে পরলেন। উন্মাদ, পাগল লাগছে। দু হাত আমার মুখে রেখে বললেন,
‘ কিভাবে জেনেছিস তুই? সিয়া বল! কে বলেছে তোকে? ‘
আলতো করে চিঠিটা হাতে দিলাম ওনার। উনি ভ্রু কুঁচকে হাত থেকে নিয়ে নিলেন। এরপর পড়তে লাগলেন। ফুপিয়ে উঠলাম। গাল ভিজে গেলো নোনাজলের স্রোতে!
খুনী সিয়াম?,
হাতচেঁড়া মৃতের মতো সে দৃশ্য কত ভয়ঙ্কর, নিকৃষ্ট ছিলো,মনে আছে তো তোমার? ওর মাথায় গুলি করা হয়েছিলো। জানো সিয়া? তোমার সাথে যার বিয়ে হলো সে একজন খুনী। আমি জানি না কে হও তুমি ওর। কিন্তু এটুকু বুঝেছি তুমি একটু স্পেশাল ওর কাছে! সিয়ামের মুখে তোমার নাম শুনেছি বহুবার। কিন্তু একটা মেয়ে হিসেবে তো আমারই উচিত তোমায় বাঁচানো তাইনা? তাই বলছি! আমি চেয়েও পারিনি বিয়ের আগে চিঠিটা পৌছাতে। লিখছি খুব তারাতাড়ি। কি লিখছি জানা নেই। তাও তুমি আসরে বসার পর লিখছি। যাইহোক, একটা আশা রাখবো তোমার কাছে, তুমি শুধু জানতে চাইবে কেন খুন করেছিলো ও। ব্যাস এতটুকুই! আমি মনে করি ওকে ছেড়ে দেয়া উচিত তোমার। আমায় খোজার চেষ্টা করোনা। এ চিঠিটা যেন কারো হাতে না পড়ে। আমায় খোজার বৃথা চেষ্টা করে নিজের সময় নষ্ট করোনা। মনে করতে পারো তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী আমি।
চিঠিটা পড়তেই পানিভরা দৃষ্টিতে তাকালেন উনি। তুফান বয়ে যায় বুকে তার তাকানোর ভঙ্গিতে। তার চাউনি দেখলে বুক ফেটে আসে। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে বলতে ইচ্ছে হয় ,’ সবটা বলো! সবটা। ‘ কেন এমন হচ্ছে। আমিকি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি? তাহলে তো এগুলো নাটক ছিলো! এতকিছু আনা,নাটক ছিলো সবটা! তবুও কেন এখনো মায়া হচ্ছে আমার? কেন ওনার চোখের পানি নরম করছে আমায়?
_____
আজ নিয়ে কেটে গেছে দুদীন। ভাইয়া দুদীন কোথায়, কেমন আছে জানা নেই। ফোন দিলে রিসিভ করেন না উনি। মামা-মামী চিন্তা পাগল হয়ে যাচ্ছেন। ড্রইংরুমের সোফায় চিন্তিত হয়ে বসে আছি আমি। উনি উধাও হয়ে কেন গেলেন? আমিতো বলিনি সবাইকে সব বলবো! তাহলে? গুম হয়ে এটা বোঝাচ্ছে যে উনি নির্দোষ? নাকি এটা বোঝাচ্ছে আসলেই সব দোষ ওনার। আর কে সেই চিঠি প্রেরক? ত্রিধাপুর কথা মাথায় এসেছিলো, কিন্তু ত্রিধা হয়ে থাকলে কি আবার কোন ইঙ্গিত দিতো না? সব গুলিয়ে আসছে! এ কোন বেরাজালে আবদ্ধ হলাম আমি? দুদীন ধরে তার দেখা নেই! চিন্তাও যে কম হচ্ছে তা নয়!
‘ মা, ভাবি কই তোমরা? ভাইয়া ফোন রিডিভ করেছে। ‘
কথাটা কর্নকুহরে পৌছাতেই পিছু ফিরে তাকালাম আমি। সায়েম একপ্রকার হন্তদন্ত হয়ে নিচে নামছে। সোফা ছেড়ে উঠে আমি এগোতেই মামী ছো মেরে ফোনটা হাতে নিলো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
‘ সিয়াম…বাবা কই তুই? ফোন কেন রিসিভ করছিলি না? ফিরে আয়। ‘
ওপাড় থেকে কিছু বলতেই মামী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ কেউ ভালো নেই। তুই জলদি ফিরে আয় বাবা। ‘
আবারো ওপাড় থেকে কিছু বললেন ভাইয়া। মামী হু হু করে কেঁদে উঠলো। হয়তো আসবে না বলছে! সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ বিগড়ে গেলো আমার। মামীর কাছে গিয়ে বললাম, ‘ ফোনটা দাও! ‘ ফোন দিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো মামী। শক্ত গলায় বললাম,
‘ শুনতে পাচ্ছেন মায়ের কান্না? কেমন ছেলে আপনি? এখানে সকলে কত চিন্তায় রয়েছে জানেন আপনি? আজকের ভিতরে আপনাকে বাড়িতে দেখতে চাই আমি। কোন এক্সকিউজ শুনতে চাইছি না। আপনার এতটুকু মনুষ্যত্ববোধ থাকলে আজই চলে আসেন। ‘
একটানে কথাগুলো বলে দম ফেললাম। উনি খানিকটা সময় চুপ থেকে বললেন,
‘ এতটা ঘৃনা তোর আমার প্রতি? ‘
‘ ঘৃনা, অবিশ্বাস কিছুই নেই! মামীর কান্না আমার সহ্য হচ্ছে না। আপনি চলে আসুন। ‘
‘ তোর কান্না দেখে বাঁচতে বলছিস? ‘
চোখ ছলছল করে উঠলো৷ এতক্ষণ শক্ত হয়ে কথা বললেও গলা ভেঙে আসছে আমার। উনি আবারো বললেন,
‘ আসছি, আজ সব বলবো তোকে। ‘
ফোন কেটে দিলেন উনি। ফোনটা সায়েমের হাতে দিয়ে ‘ উনি আসছেন। ‘ বলে চলে গেলাম উপরে। বিকেলে বিদ্ধস্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরলো সিয়াম ভাইয়া।
#চলবে…