#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
চারিদিকে জমজমাট আয়োজন। রুদ্র ও তটিণী-র বিয়ে আজ। ঈদের একদিন পরই বিয়ের আয়োজন হলো। গতকাল বিশাল আয়োজন করে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করা হয়েছে। ইতিমধ্যে তটিনী ও রুদ্রের সামনাসামনি কাজি এসে বসেছেন। বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন তিনি। প্রাপ্তি, প্রণয়কে পরিণয় এ রুপান্তর করতে রুদ্র ও তটিনী আবারও আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ে করে নিলো। রুদ্র পড়েছে সাদার মধ্যে সোনালি কারুকার্যের শুভ্র পাঞ্জাবি। তটিনী লাল খয়েরী ভারী শাড়ি ও মাথায় লাল চকচকে কাজ করা দোপাট্টা। সাথে ভারী মেকআপ এ মন্দ লাগছে না।
রুদ্র ও তটিনীর বিয়ের পর এলো মুখ দেখা পর্ব। সবাই চারিদিক থেকে গোল হয়ে দাড়িয়েছে। রুদ্র তটিনীর দোপাট্টা তুলে দিলো সিথি সমান। হাত ভর্তি মেহেদী তার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। সাথে ঠোঁটর কোনের সর্বনাশী হাসি রুদ্রের সর্বনাশ করতেই যথেষ্ট। রুদ্র সবার আড়ালে কানে ফিস ফিস করে বলল, ‘সর্বনাশিনীর সর্বনাশী রুপে রুদ্র ইরফানের সর্বনাশ সর্বদার মতো প্রযোজ্য! কৃতজ্ঞতা তোমায় রুদ্রের সর্বনাশিনী হওয়ার জন্যে!
আংটিবদল হলো। রুদ্র নিজের ইনকামের উপার্জন দিয়ে ছোট একটি ডায়মন্ডের আংটি কিনেছে। সেটাই তটিণী-কে পড়িয়ে দিয়েছে সে। তারপর এলো খাওয়া দাওয়ার পাট। সবাই খেতে বসলো। রুদ্র তটিনীকে নিজ হাতে খাইয়ে দিলো। ফটোশুট তো সবসময়ই করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে রুদ্র নিজেদের ছবিসহ মেরিড স্ট্যাটাস দিয়ে দিয়েছে। রুদ্রের কমেন্ট বক্সে কমেন্টর ঝড়। সে ডাটা অফ করে রেখে দিয়ে তটিণী-র হাত ধরে বসে রইলো।
রুপান্তর ও মিনহাজকে দেখা গেলো। তারা ম্যাচিং ড্রেস পড়েছে। তটিণী-র কানে কানে বলল, ‘দোস্ত দোয়া করে দিস যাতে এবার আমার বিয়েটা হয়। শুনেছি বিবাহিত মহিলাদের দোয়া লেগে যায়।’
তটিনী ঠোঁট চেপে হাসলো। মিনহাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘তুই ওর কানে কানে কি বলছিস? জোরে বল আমিও শুনবো।’
রুপান্তর কোমড়ে হাত রেখে বলল, ‘আমাদের পার্সোনাল কথা জোরে বলতে যাবো কেন?’
মিনহাজ রুদ্রের পাশে বসলো। রুপান্তর বসলো তটিণী-র পাশে। ক্যামেরায় তাদের যুগলবন্দী হলো।
গাড়ি কমিউনিটি সেন্টার থেকে রুদ্রদের বাড়ির দিকে ছুটছে। আজ থেকে তটিনী পারমানেন্ট ভাবে রুদ্রের ঘরের রাণী হয়ে গেলো। রুদ্রের ঘরের সবকিছুতেই এখন তটিণী-র অধিকার। আজ থেকে আর কাউকে লুকিয়ে কাছাকাছি আসতে হবে না। আজ থেকে সবাই জানলো তটিনী ইফফাত ঐশির বসবাস একমাত্র রুদ্র ইরফানের বুকে। আজ থেকে সবাই অবগত হলো রুদ্র ইরফানের একমাত্র ও শুধুমাত্র একজনই আর সে তার প্রিয়তমা ঐশি!
*
ফুলে সজ্জিত বিছানায় দোপাট্টার আড়ালে মুখ লুকিয়ে বসে আছে তটিনী। রুদ্র রুপান্তর ও মিনহাজসহ দরজা আটকে রাখা বাকিদের সামলে ভেতরে ঢুকলো রাত বারোটার পর। তটিণী-র তখন ঘুম চলে এসেছে চোখে। রুদ্র ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো। দোপাট্টা তুলে মুখ তুলে চোখ ভরে দেখলো। তটিণী-র ঘুম জড়ানো চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলো।
‘ঘুম পেয়েছে?’
‘হু।’
‘ঘুমিয়ে পড়তে।’
‘উঁহু আজকের রাতটা তো বার-বার ফিরে আসবে না। ঘুমিয়ে নষ্ট করতে চাই না।’
রুদ্র হাসলো পুনরায়। তটিণী-র কপালে গাঢ় করে ঠোঁট ছুয়ে দিলো। তটিনী বুকে ঢলে পড়লো। রুদ্র শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। চুলের ভাজে ঠোঁট চেপে ধরে বসে রইলো দীর্ঘক্ষণ।’
‘আমি দেখেছি, পেয়ে গেলে পুরনো হয়ে যায় বলে আগের মতো ভালোবাসে না। কিন্তু আপনি সেই ধারণা পাল্টে দিয়ে আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করলেন।’
‘তুমি আমার কাছে কখনোই পুরোনো হবে না ঐশি। তুমি আমার কাছে সবসময়ই একই থাকবে। রুদ্র ইরফানের বউ হয়ে সারাজীবনই আমার বুকের মধ্যে বিচরণ করবে। তোমার জায়গা আমার বুকে সবসময়ই থেকে যাবে ঐশি।সেটা কখনোই পরিবর্তন হবে না। ভালোবাসা দেহ দেখে না ঐশি। সেজন্য তুমি কখনোই পুরনো হবে না। যখন তোমার আমার শরীরের প্রয়োজন হবে না তখন আমি তোমাকে মনের টানে কাছে টানবো।’ ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখা যায় হাতে হাত রেখেও। বুঝতে পেরেছো?’
‘হু।’
‘আর যাদের কাছে পুরোনো হয়ে যায় তারা আসলে ভালোবাসেনি। প্রেম আর ভালোবাসা আলাদা জিনিস ঐশি। প্রেমে শরীর আবশ্যক। ভালোবাসায় প্রিয় মানুষের বিশ্রি মুখটাও সর্বোচ্চ সৌন্দর্যের অধিকার বহন করে। তুমি আমি যখন বৃদ্ধ হবো, তখন আমাদের একজন মানুষের প্রয়োজন হবে। কথা বলার মানুষ। আমি তোমার সেই মানুষ হবো, আর তুমিও আমার সে-ই মানুষই হবে। এটাই ভালোবাসা।’
তটিনী মুগ্ধ হয়ে কথাগুলো শুনলো। রুদ্রের কপালে গাঢ় করে ঠোঁট ছুয়ে হাসলো। রুদ্র ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘কি?’
তটিনী ফটাফট রুদ্রের বক্ষস্থলে ওষ্ঠদ্বয় ডোবালো। রুদ্র শিহরিত হলো। তটিনী চুলের সিঁথিতে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিয়ে বলল, ‘কাপড় চেঞ্জ করে নাও, আমরা বের হবো তো।’
তটিনী ও রুদ্র কাপড় চেঞ্জ করলো। তটিনী সাদা জামদানী শাড়ি পড়েছে। রুদ্র সাদা শার্ট। সবার অগোচরে দুজন বের হয়ে গেলো বাড়ি থেকে। রুদ্র তার সেই বাইকটায় তটিনীকে নিয়ে চেপে বসলো। যেটাতে বসে জীবনের কতশতবার তটিনীকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে সে।
রুদ্র তার সেই মন খারাপের সময় চলে আসা জায়গায় এসে বাইক থামালো। সরোবরে গোলাপি রঙের শাপলা ফুলে আজও ভরপুর। সিঁড়িতে এসে বসলো দুজন। তটিনী পা পানিতে ডুবিয়ে বসলো। রুদ্র ফিসফিস করলো, ‘এই জায়গায় আমরা শেষ কবে এসেছি মনে আছে?’
‘হ্যাঁ, আপনি বিদেশে যাওয়ার পূর্বের দিন।’
‘এটা না বলে বলতে পারতে, তোমার আমার প্রণয়ালিঙ্গনের দিন।’
তটিনী রুদ্রের বাহুতে চাপড় মারলো। রুদ্র শরীর দুলিয়ে হাসলো৷ তটিনীর চুলের ভাজে গুঁজে দিলো সদ্য সরোবর থেকে নেওয়া শাপলা। তটিণী-র সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেলো রুদ্রের চোখে। তটিনীর কমোড় চেপে নিজের উরুতে বসালো। চুলের ভাঁজে নাক ডুবিয়ে বসে রইলো দীর্ঘক্ষণ। চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে সরোবরের পানিতে। রুদ্র বসার আগে মোবাইল সেট করতে ভুলেনি। ভিডিও থেকে স্কিনশর্টের মাধ্যমে সুন্দর সুন্দর ছবি নিয়ে নিলো। তটিনী মুখে হাত দিয়ে বলল, ‘এতো সুন্দর!
সে রুদ্রের আইডিতে ঢুকে নিজে পোস্টসহ স্টোরি দিলো। ক্যাশন দিলো, ‘একটি নির্জন সরোবরের পাড়ে শাপলা ফুলের সুবাসের মায়ায় শুভ্রের মায়ায় জড়ানো দুজন প্রকৃতি প্রেমি।’
রুদ্র হাসলো। ‘সুইজারল্যান্ডে যাবে নাকি মধুচন্দ্রিমায়?’
তটিনী গলা জড়িয়ে ধরলো, ‘যাওয়া যায়।’
রুদ্র নাকে নাক ঘষলো। ‘তার আগে বাংলাদেশের মধুচন্দ্রিমা সেরে নেই?’
রুদ্রের কোলে করে তটিনী শহরের নির্জন রাস্তার মধ্যে ঘুরে বেড়ালো। ফজরের আগে দুজন এসে পৌঁছালো বাড়িতে। রুদ্র কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করলো, ‘এবার আমার প্রেম প্রেম পাচ্ছে বউ।’
*
আজ রুপান্তর ও মিনহাজের ঝগড়া হয়েছে। রুপান্তর প্রস্তাব রেখেছিল তারা পরিবারকে জানিয়ে বিয়ে করে নিবে। কিন্তু মিনহাজের এক কথা, ‘আগে স্বাবলম্বী হই। তারপর বিয়ে।’
কিন্তু রুপান্তর মানতে নারাজ। তটিণী-র বিয়ে দেখে তার মাথাতে বউ সাজার ভূত চেপেছে। সুতরাং সে হুমকি দিয়েছে, ‘হয় তুই বিয়ে কর, নয়তো আমি অন্য কাউকে বিয়ে করে হলেও বউ সাজবো।’
রুপান্তরের এহেন হুমকিতে মিনহাজের মাথায় হাত। এ কোন সমস্যার মধ্যে ফেললো রুপান্তর তাকে! চিন্তায় তার মাথা ঘুরছে। রুপান্তরকে অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে না, ফোনও তুলছে না। তাকে ফেলে বউ সাজার উদ্দেশ্যে অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলে নি তো?’
রুপান্তর ফোন তুললো ফজরের পর। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, ‘বাসর টাসর সেড়ে তোর ফোন তুললাম, কি বল তো তোর দুলাভাই বেশিই রোমান্টিক সেজন্য সহজে ছাড়লো না।’
মিনহাজের কান দিয়ে ধোয়া বের হতে লাগলো। চোখেমুখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে। চিৎকার করলো, ‘তোকে আমি খু ন করে ফেলবো রুপ!
মিনহাজের মোবাইল ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। রাগে মোবাইলের এই হাল করেছে সে। রুপান্তরকে সামনে পেলে না জানি কি করবে। এদিকে বেচারি রুপান্তর শায়েস্তা করতে ভুলভাল বলেছে। মিনহাজ সেটা সিরিয়াসলি নিয়ে যে এভাবে রিয়েক্ট করবে সেটা সে ভাবেনি। তার এখন নিজেরই মাথা ঘুরছে, না জানি সকাল হলে তার কপালে কি ঘটে যায়!
(চলবে)