#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব ৪৫
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
বুকে হাত দিয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে বুঝালো,
-“চলো আর একবার বিয়ে করে করে ফেলি, আর তারপর আরেকবার বাসর।”
পৃথা চোখ গরম করে তাকালো তুর্যের পানে। লোকটা ইদানীং নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছে ভীষণ। স্থান, কাল, পাত্র সব বিবেচনা হারিয়েছে। পৃথাকে চোখ গরম করে তাকাতে দেখেও থামলো না তুর্য। একের পর এক নির্লজ্জ ধাঁচের ইশারা করেই যাচ্ছে। পৃথা তুর্যের পানে খেয়াল করতে করতেই হঠাৎ ভেসে এলো কাজী সাহেবের কন্ঠস্বর। কাজী সাহেব বেশ নম্র কন্ঠে ইরাকে বললেন,
-“বলুন মা কবুল।”
ইরা হাঁসফাঁস করে উঠলো। খামচে ধরলো পৃথার এক হাত। কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ছেয়ে গেছে মেয়েটার মন প্রাণ। আরুশকে যেদিন এ বাড়িতে প্রথম দেখেছিল ইরা সেদিনই ছেলেটার প্রতি একটা অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করেছিল তার হৃদয়ে। তারপর আস্তে আস্তে সেই ভালোলাগা ভালোবাসায় পরিণত হলো। অনেকবার আরুশকে নিজের মনের কথা জানাতে গিয়েও ভয়ে পিছিয়ে এসেছে মেয়েটা। লোকটা নিতান্তই ভদ্র এবং সভ্য ধাঁচের সে যদি না মেনে নেয় ওকে, ভালো না বাসে তখন কি হবে? প্রিয় মানুষটার কন্ঠে “ভালোবাসি না” এই বাক্যটা শোনার মতো শক্তি ছিল না ইরার। তাই সে আরুশকে ভালোবাসলেও তা প্রকাশে ছিল ভীত। অথচ আজ দেখো সুন্দর এক ভাগ্যের চাওয়ায় নিজ প্রিয় পুরুষটার পাশেই বসে রয়েছে বউয়ের সাজে। আর খুব অল্প সময়ের মধ্যে হয়তো সে হয়েও যাবে আরুশের, শুধুমাত্র আরুশের। ইরার আকাশ পাতাল চিন্তা ভাবনার মধ্যেই আবারও ভেসে এলো কাজী সাহেবের কন্ঠস্বর। কাজী সাহেব নম্র কন্ঠে আবার বললেন,
-“বলুন মা কবুল।”
ইরা এবার আর নিজের ভাবনা চিন্তায় সময় ব্যয় করলো না। থেমে থেমে উচ্চারণ করলো,
-“কবুল, কবুল, কবুল।”
সাথে সাথেই চারদিকে সমস্বরে প্রতিধ্বনিত হলো,
-“আলহামদুলিল্লাহ।”
এরপর কাজী সাহেব আরুশকে কবুল বলতে বললে সে সময় নিল একটু। সে তো আর তুর্যের ন্যায় নির্লজ্জ নয়। তাই চারদিকে একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে থেমে থেমে বলল,
-“কবুল, কবুল, কবুল।”
ঝামেলাবিহীন সুন্দর সুষ্ঠভাবে বিয়েটা সম্পন্ন হলো আরুশ এবং ইরার। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পরে তুর্যদের বাড়িতে ছোট খাটো একটা খাবার আয়োজনও করা হয়েছিল সকলের জন্য। আরুশদের বাড়ির সকলে খাওয়া দাওয়া শেষ করে এসে বসলো বসার কক্ষের সোফায়। এবার তাদের যাওয়ার পালা। একেক করে সোফা থেকে সকলে উঠে চলে গেলেও আরুশ উঠছে না, ঠাঁয় বসে রয়েছে ছেলেটা। তুর্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো আরুশের পানে। চোখ ছোট ছোট করে প্রশ্ন করলো,
-“তুই উঠছিস না কেন? এখনও এখানে বসে আছিস কোন দুঃখে?”
আরুশ ঠিক কি উত্তর দিবে ভেবে পেল না। আজ তার আকদ হয়েছে। অন্তত একটু সময়ের জন্য হলেও তো ইরার সাথে দেখা করতে দিবে তাকে। বিয়ের আগে মেয়েটার সাথে তেমন কথা হয়নি আরুশের। এখন বিয়ে হয়েছে তাই এই টুকু সুযোগ তো অন্তত তাকে দেওয়া উচিৎ। তাছাড়া তাহমিনা বেগমও বলেছেন আরুশকে আজ থেকে যেতে। হয়তো একটু সময় নয় আজ পুরো রাতটাই ইরাকে কাছে পাবে সে। সেই আশাতেই সোফায় বসে ছিল বেচারা। কিন্তু এই তুর্য নামক প্রাণীর সম্মুখে নিজের মনের আশার কথা সে বলবে কি করে? আরুশ আমতা আমতা শুরু করলো। কিছু একটা বলার জন্য মুখ খোলার আগেই তাহমিনা বেগম এসে উপস্থিত হলেন ঐ স্থানে। তুর্যের মুখ পানে তাকিয়ে বললেন,
-“ও আজ থাকবে আমাদের বাড়িতে। বিয়ে যেহেতু হয়েছে দুজন দুজনের সাথে একটু কথা বলার জন্য হলেও ওদের সময় দেওয়া প্রয়োজন।”
আরুশ খুশিতে গদগদ হলো। যাক এবার অন্তত নিজের প্রেয়সির নিকটে যাওয়ার সুযোগ পাবে সে। তবে আরুশের এই খুশি বোধহয় সহ্য হলো না একজনের। কপাল কুঁচকে তুর্য বলল,
-“এসব কি ধরনের কথা মা। আকদের তারিখ আমি ঠিক করেছি তাহলে তোমাদের যেকোনো সিদ্ধান্ত আমাকে জানিয়ে নেওয়া উচিৎ ছিল না?”
-“মানে?”
তাহমিনা বেগমের প্রশ্নে কুটিল হাসলো তুর্য। মাকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে বলল,
-“ইরার সামনে পরীক্ষা মা। বিয়েটা হয়েছে বলেই যদি ওদের এক সাথে থাকতে দাও, এক সাথে সময় কাটাতে দাও তাহলে এর প্রভাব ইরার মনে পড়বে। মেয়েটার বয়স কম স্বামীর সান্নিধ্যে গেলে ওর মনোযোগ সম্পূর্ণরূপে স্বামী সংসারের দিকে যাবে। পড়াশোনায় কিন্তু আর মন বসবে না ওর।”
থামলো তুর্য। আবার বলল,
-“বিয়ে যখন হয়ে গেছে সারাজীবন পড়ে আছে ওদের একসাথে থাকার জন্য। অথচ পরীক্ষায় যদি একবার ফেল করে তাহলে আমাদের যে সম্মানটা হারাবে তা কিন্তু আর ফিরে আসবে না মা।”
তাহমিনা বেগম মনোযোগ দিয়ে শুনলেন ছেলের কথা। ছেলে তার ভুল বলেনি একটা কথাও। ইরার কিশোরী হৃদয়। এই বয়সটা তারাও অতিবাহিত করে এসেছে। এই বয়সে মেয়েদের বিবেকের তুলনায় আবেগ কাজ করে বেশি। প্রিয় পুরুষ, স্বামী, সংসার এসব সম্পর্কে নতুন নতুন অনুভূতির জন্ম দেয় হৃদয়ে। সে হিসেবে এখন আরুশ আর ইরাকে একসাথে থাকতে না দেওয়াই শ্রেয়। তাহলে এর প্রভাব ইরার পড়াশোনার উপরে পড়বে। কিন্তু আরুশকে বা সে কিভাবে বাড়িতে যেতে বলবে। নতুন জামাই তাকে একবার থাকতে বলে পর মুহুর্তে বাড়িতে যেতে বলতে পারে নাকি। বিষয়টা খারাপ দেখায়। তাহমিনা বেগম আমতা আমতা করলেন। ইতস্তত করে বললেন,
-“কিন্তু….”
মায়ের এইটুকু কথাতেই বাকিটা বুঝে নিল তুর্য। আরুশকে টেনেটুনে সোফা থেকে তুলে দাঁড় করালো। কাঁধে হাত রাখলো বেচারার। মায়ের পানে তাকিয়ে বলল,
-“তুমি একদম চিন্তা করো না মা। ও আমার সহকারী কম বন্ধু বেশি। ওকে আমি একটা কথা বললে ও জীবন দিয়ে হলেও তা রাখবে।”
কন্ঠে তোলা কথার পরিসমাপ্তি ঘটিয়েই আরুশকে টেনে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো তুর্য। আর আরুশ! বেচারার মাথা বোধহয় ঘুরছে এই মুহূর্তে। এ কোন তুর্যকে দেখছে সে? একটু আগে যে লোক আরুশের সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে ধরা দিল এখন সে সবচেয়ে বড় শত্রুর ভূমিকা পালন করছে। এই ছিল এই লোকের পেটে পেটে? এর জন্যই বোধহয় এত তাড়াহুড়া করে তুর্য তাদের বিয়েটা দিয়েছিল। অথচ আরুশ ভেবেছিল তুর্য ভালো হয়ে গেছে। এই পৃথিবীতে তুর্য ব্যতীত উত্তম পুরুষ আর নেই কেউ। আরুশের হৃদয় কেঁদে উঠলো। তীব্র ব্যথা নিয়ে গেয়ে উঠলো,
-“সম্পর্ক বদলে গেল একটি পলকে।
কে আপন কে যে পর হলো রে।”
আরুশের উথাল পাতাল চিন্তা ভাবনার মধ্যেই বাড়ির বাহিরে বেরিয়ে এলো তারা। তুর্য আরুশের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে ভদ্র বাচ্চাদের ন্যায় বলল,
-“রাত অনেক হয়েছে। এখন বাড়ি চলে যা, নিজের একলা বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে জব্বর একটা ঘুম দে।”
আরুশের বুক ফেটে চৌচির অবস্থা। বিয়ের পরও একলা বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমানোর উপদেশ দিল এই পুরুষ! এর হৃদয়ে কি একটু দয়া মায়া বলতে কিছু নেই? কেন করলো এই লোক এমন? আরুশের হৃদয়ে ভয়ের তুলনায় বউ হীনা হাহাকারের পরিমাণ বাড়লো। কন্ঠে সাহস এটে সে বলল,
-“আমার সাথে এটা কেন করলেন স্যার।”
তুর্য ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে শুধালো,
-“কি করেছি আমি?”
-“এই যে আমাকে বিয়ে করতে না করতেই বউ ছাড়া করলেন।”
আরুশের অসহায় কন্ঠস্বর। তুর্যের চোখে মুখে গম্ভীর ভাব ফুটে উঠলো সাথে সাথে। থমথমে কন্ঠে সে বলল,
-“ছিঃ ছিঃ আরুশ! তোকে দেখে আমার লজ্জা হচ্ছে। আমার মতো একজন নম্র ভদ্র লাজুক পুরুষের সাথে থেকে তুই এতটা নির্লজ্জ কবে থেকে হলি? বিয়ে করতে না করতেই বউয়ের কাছে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিস।”
হতবম্ব হলো আরুশ। সে নির্লজ্জ আর তুর্য লাজুক! এ কেমন ভ’য়ং’ক’র কথা। এই কথা শোনার আগে তার কান বন্ধ হয়ে গেল না কেন? আরুশ হতবাক কন্ঠেই বলল,
-“আমি নির্লজ্জ?”
তুর্য কপাল টানটান করে তাকালো। বেশ গৌরবের সাথে বলল,
-“তা নয়তো কি? আমাকে দেখে, আমাকে দেখে কিছু শেখ। বিয়ে করেও টানা আট বছর ব্যাচেলর জীবন কাটিয়েছি। আমার মতো ধৈর্য্যশীল, সুশীল, ভদ্র, লাজুক পুরুষ তুই এই দেশে কেন এই পৃথিবীতেও পাবি না। আমাকে তো নোবেল দেওয়া উচিৎ। শুধুমাত্র সিক্রেট মিশনে থেকে নিজের সবকিছু লুকিয়ে রেখেছি বলে এখন নোবেলটা পাচ্ছি না।”
কথাটা বলেই থামলো তুর্য। বিরবিরিয়ে বলল,
-“ভাগ্যিস রাত ১২ টার পর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলাম। নয়তো মাত্র অল্প সময়ের জন্য এই ৮ বছরের রেকর্ডটা মিস হয়ে যেতো।”
আরুশ তুর্যের বিরবিরিয়ে বলা কথাগুলো শুনলো না। তবে আগের বলা কথা ঠিক শুনেছে। আরুশ জানে ঐ আট বছরের কথা মিথ্যা নয়। তাই আর সে কথা বাড়ালো না। কিন্তু একটা খটকা থেকেই যায়। তুর্য এমনি যেমনই হোক কারণ ছাড়া কিছু করে না। আরুশকে যে তুর্য ইরার কাছ থেকে নিজের পূর্বপরিকল্পনা মাফিক সরিয়েছে তা সে ঠিক বুঝতে পেরেছে। এত বড় অফিসার হয়েও এই টুকু যদি সে বুঝতে না পারে তবে সে কেমন অফিসার? আরুশ সরু দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের পানে। সন্দিহান কন্ঠে শুধালো,
-“সত্যি করে বলুন তো স্যার আমার বাসর ঘরে আপনি আঘাতটা কেন হানলেন?”
তুর্য হাসলো। ওষ্ঠ বাঁকিয়ে বলল,
-“কি ভেবেছিস আমি সব ভুলে গেছি? রাজশাহীতে বউয়ের হাত কেঁটে যাওয়ায় তার সেবা যত্ন করে একটু কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু তুই এসে ব্যাগরা দিয়েছিলি। আর তারপর আমার মাথায় বারি। একটা কথাও ভুলিনি আমি। প্রতিটির কথা মনে রেখেছি, এখন নিজের বোনের সাথে বিয়ে দিয়ে পাই টু পাই হিসাব নেব সবকিছুর। প্রস্তুত থাক।”
কথাটা বলেই তুর্য চলে গেল ঘরের ভিতরে। হতবম্ব হয়ে ঐ স্থানেই দাঁড়িয়ে রইলো আরুশ। তুর্যের বউয়ের সাথে কাটানো মুহূর্তে একটু ব্যাগরা দেওয়া আর ভুলবশত মাথায় একটা আঘাতের জন্য এত বড় একটা শাস্তি দিয়ে দিল আরুশকে? সোজা একদম তার বাসর ঘরে আঘাত করে দিল? এই তুর্যের বোনকে বিয়ে করে আর কি কি তার কপালে আছে সৃষ্টিকর্তাই জানেন। আরুশের বুক ভারী হলো। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
-“একটা ভুল সারা জীবনের কান্না।”
৪৯.
পুরো বাড়িতে উৎসব লেগেছে। চারদিকে হইহই রইরই অবস্থা। ইরার আর আরুশের বিয়ের দিনক্ষণ এগিয়ে এসেছে যে। সময়ের প্রবাহমান গতিতে এর মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে বেশ কয়েকটি মাস। পৃথা এবং ইরার এইচএসসি শেষ হয়েছে, রেজাল্টও চলে এসেছে ইতমধ্যে। মোটামোটি ভালো রেজাল্ট করেছে দুজনই। আর এদিকে আরুশও তার পরিবারকে দিয়ে ইরাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার চাপ দিচ্ছে। তাই আর দেরী করতে চাইলো না কেউ। এমনিই এই পরীক্ষা পরীক্ষা করে বেশ অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়েছে। সামনের সপ্তাহে আরুশ এবং ইরার আনুষ্ঠানিক দিন ধার্য করা হয়েছে। আর তার আগের দিন গায়ে হলুদ। সেই অনুপাতে ইতমধ্যে বাড়িতে অতিথিদের আগমনও শুরু হয়ে গেছে। তুর্যও ছিল আজ বাড়িতেই। বসার কক্ষে বসেছিল সবার সাথে। যদিও তার নজর রান্নাঘরে। কারণ সেখানে যে বেচারার এক এবং একমাত্র বউ কোমড়ে ওড়না বেঁধে রান্নার কাজ সামলাচ্ছে। তুর্যের পৃথার পানে উঁকি ঝুঁকির মধ্যেই তার পকেটে থাকা মোবাইলটা বেজে উঠলো প্রবল ঝংকার তুলে। তুর্য রান্নাঘরের পানে দৃষ্টি রেখেই কল ধরে মোবাইলটা কানের ধরলো। মুহুর্তেই চোখ মুখের রং পাল্টে গেল ছেলেটার। শক্ত কন্ঠে বলল,
-“আসছি আমি। “
চলবে…..