‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখো’-এই গান শোনেননি, এমন শ্রোতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর এই গান যখন কানে বাজে তখন আনমনেই চোখের কোণে ভেসে ওঠে একজন সুদর্শন নায়কের মুখ। তিনি সালমান শাহ। বাংলা চলচ্চিত্রের নক্ষত্র ছিলেন তিনি।
গুগল নিউজে ফলো করুন আরটিভি অনলাইন
রাজধানী ঢাকার নিউ ইস্কাটন রোডের ইস্কাটন প্লাজার বি-১১ নম্বর ফ্ল্যাটে ঠিক ২৮ বছর আগে ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন শহীদ চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন ওরফে সালমান শাহ। ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম কমর উদ্দিন চৌধুরী ও মায়ের নাম নীলা চৌধুরী। সালমান ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে। এই ক্ষণজম্মা চিত্রনায়ক জম্মেছিলেন ১৯৭১ সালে আর চলে গেলেন ১৯৯৬ সালে। তখন তার বয়স মাত্র ২৫ বছর।
তার মৃত্যুর বিষয়টি এখনও রহস্যঘেরা। তবে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে সালমান শাহের স্ত্রী সামিরা দাবি করলেও। তার মা নীলা চৌধুরী বারবার দাবি করেছেন সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে। সেই রহস্য এখনও উন্মোচিত হয়নি। চলছে বিচার।
সালমানের সাবেক স্ত্রী সামিরা এত বছর পর আবারও দাবি করেছেন যে, সালমান-শাবনূরের প্রেম ছিল। শাবনূরের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি সালমান নিজেই নাকি স্বীকার করেছিলেন। আর সালমান শাহের রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সেটি আদালতেও উপস্থাপন করা হয়। ওই প্রতিবেদনে সালমানের মৃত্যুর পেছনে শাবনূরের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতার বিষয়টি উঠে এসেছে।
এ ব্যাপারটি আরও জোরালো গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সামিরা বলেন, শাবনূরের সঙ্গে যে প্রেম ছিল সালমান নিজেই সেটি আমার কাছে স্বীকার করেছিলেন। কাজ করতে করতে একে অপরের কাছাকাছি এসেছিলেন সালমান-শাবনূর। এটি আমি মেনে নিতে পারিনি। সালমানের সঙ্গে শাবনূর সিঙ্গাপুরেও যান। এই কথাগুলো আমি পিবিআইকে বলেছি। শাবনূরের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সালমানও ব্ল্যাকমেইল হওয়ার শঙ্কায় থাকত।
তবে সেদিনের ঘটনাগুলো বিভিন্ন সময়ে নিকটজনদের বয়ানে পাওয়া যায়- ১৯৯৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ‘প্রেমপিয়াসী’ ছবির ডাবিং করতে এফডিসিতে গিয়েছিলেন সালমান শাহ। সেখানে ডাবিংয়ের জন্য আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন এই ছবির নায়িকা শাবনূর।
এফডিসিতে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর সালমান শাহ বাবাকে ফোন করে বলেন, তার স্ত্রী সামিরাকে নিয়ে এফডিসির সাউন্ড কমপ্লেক্সে আসার জন্য। ফোন পাওয়ার পরপরই সালমানের বাবা সামিরাকে নিয়ে এফডিসি আসেন। শ্বশুরের সঙ্গে সাউন্ড কমপ্লেক্সে এসে সামিরা দেখতে পান, সালমান ও শাবনূর ডাবিং রুমে খুনসুটি করছেন। ওই সময়ের বেশ কিছু বিনোদন পাক্ষিক এবং সালমানকে নিয়ে একাধিক গ্রন্থে লেখা হয়েছে, সালমানকে শাবনূরের সঙ্গে খুনসুটি করতে দেখে রেগে যান সামিরা। সালমানের বাবা চলে যাওয়ার পর সামিরাও দ্রুত গাড়িতে ওঠেন। ‘অবস্থা জটিল’ বিষয়টি বুঝতে পেরে একই গাড়িতে ওঠেন সালমান শাহ ও চিত্রপরিচালক বাদল খন্দকার। কিন্তু গাড়িতে বসে সালমানের সঙ্গে কথা বলেননি সামিরা। তাকে বোঝাতে থাকেন বাদল খন্দকার।
গাড়ি এফডিসির গেট পর্যন্ত গেলে সালমান প্রধান ফটকের সামনে নেমে যান। তার সঙ্গে বাদল খন্দকারও নেমে পড়েন। এরপর সেখানে কিছুক্ষণ আড্ডা দেন। এরপর ডাবিং রুমে ফিরে গেলেও সেদিন আর ডাবিং হয়নি। পরে রাত ১১টার দিকে নিউ ইস্কাটন রোডের ইস্কাটন প্লাজার বি-১১ নম্বর ফ্ল্যাটে সালমানকে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেন বাদল খন্দকার। বাসায় ফেরার পর রাতের ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন রকমের বক্তব্য পাওয়া যায় সে সময়ের পত্রিকাগুলোতে। তবে সেসব বক্তব্য প্রত্যক্ষদর্শী কারও বয়ানে ধারণ করা নেই।
এ ব্যাপারে চলচ্চিত্র পরিচালক বাদল খন্দকার জানান, তিনি পরদিন সকালেই সালমানের বাসায় গিয়েছিলেন। বাদল খন্দকার বলেন, ছবির কাজের শিডিউল নিতে তিনি সকালে সেখানে গেলে বাসার নিচে দারোয়ানরা তখন বলাবলি করছিলেন, সালমান রাতেই ফাঁস দিয়ে মারা গেছেন।
অন্য আরেক চলচ্চিত্র পরিচালক শাহ আলম বলেন, শেষের দিকে অনেক মানসিক চাপে ছিলেন সালমান শাহ। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং প্রযোজকদের সঙ্গে বোঝাপড়ার ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। কিছুদিন শিল্পী সমিতির কাছে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন।
তবে ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর নিউ ইস্কাটন রোডের ইস্কাটন প্লাজায় ঘটে যাওয়া ঘটনা বর্ণনা করে সালমান শাহের মা নীলা চৌধুরী বিবিসিকে বলেন, সেদিন সকাল সাতটায় বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরী ছেলে শাহরিয়ার চৌধুরী ইমনের সঙ্গে দেখা করতে ইস্কাটনের বাসায় যান। কিন্তু ছেলের দেখা না পেয়ে তিনি ফিরে আসেন। কারণ বাসার নিচে দারোয়ান সালমান শাহর বাবাকে তার ছেলের বাসায় যেতে দেননি।
নীলা চৌধুরীর বর্ণনা ছিল এ রকম, বলেছে স্যার এখন তো ওপরে যেতে পারবেন না। কিছু প্রবলেম আছে। আগে ম্যাডামকে (সালমান শাহর স্ত্রীকে) জিজ্ঞেস করতে হবে। একপর্যায়ে উনি (সালমান শাহর বাবা) জোর করে ওপরে গেছেন। কলবেল দেওয়ার পর দরজা খুলল সামিরা (সালমান শাহর স্ত্রী)। উনি (সালমান শাহর বাবা) সামিরাকে বললেন, ‘ইমনের (সালমান শাহর ডাকনাম) সঙ্গে কাজ আছে, ইনকাম ট্যাক্সের সই করাতে হবে। ওকে ডাক।’ তখন সামিরা বলল, ‘ও তো ঘুমে।’ তখন উনি বললেন, ‘ঠিক আছে আমি বেডরুমে গিয়ে সই করিয়ে আনি।’ কিন্তু যেতে দেয়নি। আমার হাজব্যান্ড ঘণ্টা দেড়েক বসে ছিল ওখানে।
খাটের মধ্যে যেদিকে মাথা দেওয়ার কথা, সেদিকে পা। আর যেদিকে পা দেয়ার কথা সেদিকে মাথা। পাশেই সামিরার (সালমান শাহর স্ত্রী) এক আত্মীয়ের একটি পারলার ছিল। সেই পারলারের কিছু মেয়ে ইমনের হাতে-পায়ে শর্ষের তেল দিচ্ছে। আমি তো ভাবছি ফিট হয়ে গেছে। আমি দেখলাম, আমার ছেলের হাত-পায়ের নখগুলো নীল। তখন আমি আমার হাজব্যান্ডকে বলেছি, আমার ছেলে তো মরে যাচ্ছে।’ তাৎক্ষণিক ইস্কাটনের বাসা থেকে সালমান শাহকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানকার চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে বলা হয়, সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন। তবে বিষয়টি এখনো বিচারাধীন। সালমানের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে না পারায় তাঁর ভক্তদের মধ্যে তৈরি হয় নানা প্রশ্নের।
বরাবরই পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে। নীলা চৌধুরীর অভিযোগ ছিল, তাঁরা হত্যা মামলা করতে গেলে পুলিশ সেটিকে অপমৃত্যুর মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে। পুলিশ বলেছিল, অপমৃত্যুর মামলা তদন্তের সময় যদি বেরিয়ে আসে যে এটি হত্যাকাণ্ড, তাহলে সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে হত্যা মামলায় মোড় নেবে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৩ সালে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবি দিয়ে দেশীয় চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে সালমান শাহর। পরে ‘তুমি আমার’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘বিক্ষোভ’, ‘প্রেমযুদ্ধ’, ‘দেনমোহর’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘আঞ্জুমান’, ‘বিচার হবে’, ‘এই ঘর এই সংসার’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘জীবন সংসার’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’, ‘আনন্দ অশ্রু’ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন