#শারমিন আঁচল নিপা
চারপাশের আযানের ধ্বনিতে মুখরিত। গ্রামটা একদম পাল্টে গেছে। আগের মতো কেউ আর গরীব নেই। সবারেই মোটামুটি টাকা হয়েছে। বেশিরভাগ টাকা এসেছে বিদেশে গিয়ে খেটে। আনহারি চারপাশটা তাকিয়ে দেখছে তার চোখগুলো রক্ত বর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কেমন জানি ভুতুরে সিনেমার সিনের মতো লাগছে সবটা। মনে হচ্ছে ডিরেক্টর এই বুঝি কাট বলবে। ধমকা বাতাস চারদিকে বয়ে চলেছে। ঝড় আসবে মনে হচ্ছে। অসময়ে ঝড় ভালো লক্ষণ নয়। আমাকে আর আনাহরিকে ছোটো ছোটো বাচ্চারা গরু নেওয়ার সময় দেখছে। তবে তারা গ্রামের প্রবীণ না হওয়ায় চিনতে পারছে না। তাদের বয়স দশ থেকে পনেরোর মধ্যে হবে। তাই তারা কেউ কোনো কিছু বুঝছে না। এটা নিয়ে এখনও শোরগোল দেখা যাচ্ছে না।
খানিকটা দূরেই দুলাভাইদের ভবন। ভবনটা এখনও সুসজ্জিত। ভবনের রঙ দেখলেই মনে হয় এ বাড়ির ভেতরের মানুষগুলো বেশ ভালোই আছে। আনহারিকে আমি বাড়িটা নির্দেশ করে বললাম
“ঐটায় আমার আপার শ্বশুড় বাড়ি।”
বাড়ির পেছনের জাম গাছটাকে আর দেখতে পেলাম না। হয়তো কেটে ফেলেছে। আমি আনহারিকে পুনরায় বললাম
“পেছনের জাম গাছটা হয়তো কেটে ফেলেছে। বাড়ির পেছনের জাম গাছটাতেই আপা গলায় দড়ি দিয়েছিল।”
আনহারি কিছুক্ষণ চুপ রইল। চারদিকটায় আযানের ধ্বনি থেমে গেল। অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথে গ্রামটাও নিস্তব হয়ে গেল।
আনহারি আর আমি আপার শ্বশুড়বাড়ির দিকে এগুচ্ছি। কত বছর পর এখানে আসলাম। ভীষণ ভয় আমাকে গ্রাস করছে। এর মধ্যেই আমিন চাচা সামনে আসলো। বারো বছর আগে কত তাগরা ছিল। এখন একদম নেতিয়ে গেছে। কালো চুলে সাদা পাক ধরেছে।চাচাকে দেখে আমার আগের কথাটা মনে পড়ে গেল। বাবা তখন আপার লা/শ নিয়ে ঘুরছে৷ কেউ আপাকে খাটিয়া পর্যন্ত দেয়নি৷ লা/শ টা বাবা বাশের দাড়ি (গ্রামের ভাষায় এটাকে দাড়ি বলে তবে এটা মূলত বাশ দিয়ে তৈরী পাটি) দিয়ে মুড়ে নিয়ে কবরস্থানে গিয়েছিল করব দিতে। তখন এ আমিন চাচায় বাবাকে প্রথম বাঁধা দেয়। বাবাকে সাফ সাফ করে বলে দেয়
“পেট বা/জায়ছে এমন নষ্ট মেয়ের লাশ এ কবরস্থানে দাফন করা যাইব না। আমার বাপ মা এ কবরস্থানে আছে। আরও অনেক সম্মানীয় মানুষ এখানে আছে। এ কবরস্থানকে তো অপবিত্র বানানো যাবে না। অনেক হাজীদেরও এখানে দাফ/ন করা হয়ছে। সুতরাং তোমার মেয়ের লা/শ এখানে দাফন করা যাবে না।”
বাবা তখন হাত জোড় করে বলেছিল
“ভাইজান আমার মেয়ে এতটাও খারাপ ছিল না। আপনি দয়াকরে আমার মেয়েটাকে কবর দিতে দিন। এ লা/শ আজকে কবর দিতে না পারলে পচে যাবে। দুর্গন্ধ ছড়াবে। চারদিকে শেয়াল কুকুর এসে আমার মেয়েকে খুব/লে খু/বলে খাবে। বাবা হয়ে এ দৃশ্য আমি দেখতে পারব না। আমার মেয়েটাকে দা/ফন করতে দিন দয়াকরে।”
বাবার আকুতি চাচার কানে পৌঁছালেও অন্তরে প্রবেশ করেনি। সে ধমক দিয়ে বাবাকে বলল
” আমি কেন গ্রাম বাসীর কেউ চায় না অনন্যার এখানে দা/ফন হোক। দেখো মিয়া কথা বাড়াইয়ো না। কথা বাড়ায়লে বিষয়টা খারাপ দিকে যাবে। হানাহানির দিকে যাবে। জঙ্গলে ফেলে দাও। এরকম নষ্টা/কে শেয়াল কুকুর খেলেই ভালো। এখান থেকে দূর হও। আলগা পিরীত দেখানোর সময় নাই।”
বাবা অনন্যার লা/শটা ধরে নিয়ে গেল সোজা জঙ্গলে। সেখানে আপাকে খুঁড়ে কবর দিল। পরদিন খবর আসলো আপার কবর শেয়াল খুঁড়ে লা/শ খেয়ে ফেলেছে অর্ধেক। বাবা আর যায়নি সেখানে। হয়তো সে দৃশ্য নিজ চোখে দেখার সাহস তার কুলায়নি। আপার এ কথাগুলো মনে হলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। এ মেয়েটা দুনিয়াতে বেঁচে থেকেও সম্মান পেল না। আবার ম/রে গিয়েও না।
আমিন চাচাকে দেখে আনহারি বলে উঠল
“কেমন আছেন চাচা? ভালো আছেন? চাচী কেমন আছে? বারো বছর পর গ্রামে আসলাম আপনাদের খোঁজ নিতে।”
চাচা আনহারির দিকে তাকিয়ে চুপসে গেল। অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করল
“কে তুমি?”
আনহারি হেসে জবাব দিল
“আরে আমি অনন্যা। চিনতে পারছেন না? গিয়েছিলাম দেশের বাইরে পড়াশোনা করতে। পড়াশোনা শেষে ফিরে আসলাম। লক্ষ্য করলাম বারো বছরে অনেক কিছু পাল্টে গেছে। দীপকও নাকি বিয়ে করে নিয়েছে। কিন্তু প্রথম বউ থাকা সত্ত্বে তাকে ডিভোর্স না দিয়ে অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করা তো আইনে নেই। এগুলো নিয়েই আলোচনা করব।”
আমিন চাচা “লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।” বলে দৌড় দিল। আনহারি একটু উচ্চ স্বরে হাসলো। আনহারির ভাব দেখে মনে হচ্ছে সে আমিন চাচাকে আগে থেকেই চিনে। আমি মনে কিন্তু নিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম
“আপনি কি আমিন চাচাকে চিনেন?”
উত্তরে সে বলল
“না। কেন বলো তো?”
“আমিন চাচা আপার দাফ/ন নিয়ে অনেক ঝামেলা করেছিল। হঠাৎ করে উনাকে এভাবে ভয় দেখানোতে মনে হলো চিনেন”
“উনি একটু বয়স্ক মানুষ অনন্যাকে চেনার কথা। তাই একটু মজা করলাম। এ গ্রামের মানুষ ও অনন্যার সাথে অন্যায় করেছে সেটার প্রতিশোধ নেওয়া তো দরকার তাই না?”
আমি কেবল দম ছেড়ে উত্তর দিলাম
“হুম”
আপার শ্বশুড় বাড়ির মূল ফটকে যেতেই নিয়ামত চাচা আটকে ধরলেন। এ বাসার দারোয়ান আগেও নিয়ামত চাচা ছিলেন। এ চাচায় আপার নামে প্রথম দূর্নাম রটায়। আপার পরকিয়া আছে এরকম বার্তা গ্রামবাসীর নিকট এ চাচায় রটিয়ে বেড়ায়ছিল। সেদিনের স্মৃতি আবারও চোখে ভেসে উঠল। আপাকে নিয়ে শালিস বসে। আপা বারবার বলতেছিল আমি সংসার করতে চাই। আমার কোনো সমস্যা নেই। তবে উনার পরকিয়া আমি মানতে পারছি না। উনাকে বলেন এসব বাদ দিতে। আমার সাথে মন দিয়ে সংসার করতে। তখন আপার জামাই বলেছিল
“আমি এই মেয়ের সাথে সংসার করব না। এ মেয়ে আমার আড়ালে পরপুরুষের সাথে ফস্টিনস্টি করে। আমি তো বোকাসোকা এতদিন ধরতে পারিনি। নিয়ামত নিজ চোখে দেখে আমায় বলেছে। বিশ্বাস না হলে নিয়ামতকে জিজ্ঞেস করেন।”
তখন এ নিয়ামত চাচায় জোর গলায় বলেছিল
“পেছনের দেয়াল দিয়ে এক অপরিচিত ছেলেকে আমি ঢুকতে দেখেছি এ মেয়ের ঘরে। সাহেব একদম সত্যি কথা বলছে।”
আপা শুধু অজোরে কেঁদে তাকে বলেছিল
“চাচা আমার নামে এত বড়ো অপবাদ দিতে আপনার বুক কাঁপলো না? আমি তো এমন কিছুই করিনি। কেন এত বড়ো মিথ্যা বলছেন। নিজের মেয়ে হলে পারতেন?”
তিনি নাক ছিটকিয়ে জবাব দিলেন
“আমার মেয়ে এত বড়ো ন/ষ্টা না। ভুলেও আমার মেয়ের সাথে তুলনা করবে না। একে তো পাথর নিক্ষেপ করে মা/রা দরকার।”
সেদিন শালিসে সবার সামনে আপার পরকিয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে আপার ডিভোর্সের পরোক্ষ কারণ হিসেবে এটা ধরা হয়। এবং এর সাক্ষী হিসেবে নিয়ামত চাচাকে রাখা হয়।
আনহারি আমার পেছনে। আমি সামনে গেলাম নিয়ামত চাচার। আমাকে দেখেই তিনি পথ আটকে বললেন
“কে আপনি কার কাছে যাবেন? অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ।”
“আমি ফিয়না। দীপক ভাইয়ার কাছে এসেছি। আমাকে ঢুকতে দিন।”
“উনি অনুমতি না দিলে ঢুকতে দিব না। উনাকে কল করেন।”
ঠিক সে মুহুর্তে আনহারি পেছন থেকে এসে বলল
“নিয়ামত চাচা আমি দীপকের বউ অনন্যা। আমার নিশ্চয় এ বাড়িতে ঢুকতে পারমিশন লাগবে না। ফিয়নাকে হয়তো চিনতে পারছেন না। আমাকে তো চিনতে পারছেন। ভালো করে দেখেন আমাকে। আর গেইটের সামনে থেকে সরেন। অনেক দূর থেকে এসেছি। ভীষণ ক্লান্ত আমি।”
নিয়ামত চাচা আনহারিকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। এক পলকে তাকিয়েই আছে কেবল। কিছুই সে বলতে পারছে না। মনে হচ্ছে গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। সব মিলিয়ে সে যে ভীষণ ভয় পেয়েছে সেটা বুঝা যাচ্ছে। আনহারি এবার তার হাতে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল
“সরেন তো…আমাকে ঢুকতে দিন।”
বলেই ঢুকতে নিল আনহারি। সাথে আমিও। ঠিক এ মুহুর্তে বোমার বিস্ফোরণের মতো নিয়ামত চাচা চেঁচিয়ে উঠল। আর এখান থেকে আনহারি আর আমার নতুন লড়াইয়ের শুরু হলো।
শারমিন নিপা
শারমিন আক্তার