আমার দাদার বাবা ছিলেন জমিদার। জমিদার মানে জমিদার। হুলুস্থুল পর্যায়ের জমিদার। শোনা যায়, তাঁর নাকি ইচ্ছা ছিলো এই বিস্তীর্ণ গ্রামের পুরোটাই কিনে নেওয়ার। কোনো জমির মালিক যদি তাঁর কাছে জমি বেচতে না চাইতো, তিনি নাকি জোরপূর্বক তার বউ বা মেয়েদের তাঁর বাড়িতে ধরে আনতেন তারপর রাতভর নির্যাতন চালানোর পর ভোরবেলা তাকে তার বাড়ি ফেলে আসতেন। লোকলজ্জার ভয়েই হোক আর যে কারণেই হোক সেই ভদ্রলোক পরদিন রাতের অন্ধকারেই পরিবার নিয়ে গ্রাম ছাড়তেন। তখন দাদার বাবার আর কোনো সমস্যাই হতো না তার জমি দখল করতে। আর এতো নামকরা মানুষের বিপরীতে মামলা মোকদ্দমা চালানোর মতো সাহস বা অর্থ কোনোটাই গ্রামের কারো ছিলো না। এরকম করে নাকি উনি প্রচুর সম্পদ বানিয়েছিলেন। শেষের দিকে নাকি কেউ ভয়ে উনার মুখের উপর না বলতে পারতো না, পাছে আবার তার মেয়ে বউকে তুলে নেয় যদি। কিন্তু ওইযে কথায় আছে, পাপের সম্পদ, সর্প হয়ে করে দংশন। দাদার বাবা মীর মতলেব খাঁ এর শেষ জীবন ছিলো অত্যন্ত বিভীষিকাময়। তাঁর ছিলো তিন ছেলে, মেয়ে ছিলো না। তিন ছেলের মধ্যে আমার দাদা ছিলেন বড়। তার তিন ছেলেই কমবয়সে বখে গেলো। জুয়া, মদ, নারী এমন কোনো নেশা নেই যা তারা করতো না। মীর মতলেব খাঁ মাত্র পঁয়ষট্টি বছর বয়সে কোনো এক অজানা কারণে পঙ্গু হয়ে যান। একদম বিছানায় পড়ে যান। শোনা যায়, তার শরীরে এমন দুর্গন্ধ হয়েছিলো কেউ তার কাছে যেতে পারতো না তার সেবা করার জন্য, এমনকি কোনো দাসীও পাওয়া যেতো না। ছেলের বউরা মানে আমার দাদী আর তার দুই জা শুধু খাবারটা দিয়ে আসতেন তার ঘরে আর মাঝে মাঝে তার বাথরুম পরিষ্কার করে দিতেন। এছাড়া কেউ তার কাছে যেতে পারতো না। শেষের দিকে নাকি অনেক রাতে উনি চিৎকার করে কাঁদতেন আর বলতেন,”আমারে ছাইড়ে দে রে তোরা, ছাইড়ে দে। আর মারিস নে আমারে, ছাইড়ে দে।”
দাদীরা ভয়ে সেদিকে যেতেন না। কে তাকে ধরছে, কে তাকে মারছে কিছুই দেখার সাহস ছিলো না তাদের।
এই সুযোগটা নেয় দাদা আর তার দুই ভাই। জোরপূর্বক তাদের বাবার কাছ থেকে টিপসই নিয়ে একের পর এক জমি তারা নিজেদের নামে নিতে থাকে আর বেচতে থাকে নিজেদের নেশার খরচ মেটানোর জন্য। দাদার বাবা নাকি তখন বিছানাতে শুয়েই ছেলেদের শাপশাপান্ত করতেন। এরপর বিছানায় থাকা অবস্থাতেই পচাত্তর বছর বয়সে মীর মতলেব খাঁ এর মৃ ত্যু ঘটে। মৃ ত্যুর সময় নাকি তার শরীর একদম নীল বর্ণ ধারণ করেছিলো। কেউ কেউ ধারণা করেছিলো তাকে বিষ দিয়ে মারা হয়েছে। আবার শরীরে অসংখ্য কালশিটে দাগও দেখা গিয়েছিলো নাকি। যারা তাকে গোসল করিয়েছিলো তারা দেখে শিউরে উঠেছিলো সেই দাগ। কিন্তু বাড়ির কেউ তাকে বিষ দেয়নি বা কেউ মারেনি। তবে এসব কিসের দাগ? সেসব এখনো অমীমাংসিত রহস্য। এ সবকিছুই অবশ্য শোনা কথা। আমরা এগুলো দাদীর মুখ শুনেছি। আমাদের জমিদারির কিছুই এখন নেই তিনটা বাড়ি ছাড়া। দাদারা তিন ভাই তিনটা বাড়ি দখলে রাখতে পেরেছিলো। বাকিসবই প্রায় বিক্রি করে দেন তারা। আমরা নিজেদের ভাগে এই বাড়িটা পাই। আর এই বাড়িটাতেই মীর মতলেব খাঁ মৃ ত্যুবরণ করেছিলেন। বাকি যে দু’টি বাড়ি সেগুলো গঞ্জে। দাদার দুই ভাই সেই দু’টি বাড়ি নিয়েছেন। আমার বাবারাও তিন ভাই। আমার বাবা মীর মশাররফ খাঁ সবার বড়। আমরা দুই বোন। আমার বড় বোন সাঁঝ আর আমি সাজ। দুইজনের নাম অনেকটা একই। আমরা দেখতেও অবিকল একই। সবাই ভাবে আমরা বুঝি জমজ। আসলে তা না, আমার আপা আমার চেয়ে বছর চারেকের বড়। আমাদের স্বভাবও একদম ভিন্ন। আমার আপা ভীষণ শান্ত, একদম মুক্তোর মতো স্নিগ্ধ। সারাদিন গল্পের বইতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। ভীষণ মেধাবী আপা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চেয়েছিলো। কিন্তু আমার বাবা চাননি তার মেয়েরা কেউ বাড়ির বাইরে যেয়ে, হলে থেকে পড়াশোনা করুক। জমিদারি নেই, কিন্তু বাবা চাচাদের জমিদারি মন মানসিকতা কমেনি।
আর আমি ভীষণ অশান্ত আর ফাঁকিবাজ মেয়ে। পড়াশোনার ধারেকাছেও যাইনা, ভালো লাগেনা। সারাদিন গাছে গাছে উঠে পেয়ারা, কাঁচা আম পাড়ি, বাড়ির সাথে লাগোয়া বিশাল পুকুরে সাঁতার কাটি, বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে গোল্লাছুট, কানামাছি, লুকোচুরি খেলি। কিন্তু সবই এই বাড়ির গন্ডির মধ্যে। এ নিয়ে বাবা চাচাদের কম ঝগড়া শুনিনি। প্রায়ই আমাকে নিয়ে শালিস বসে।
মেজো চাচা দাঁড়ি চুলকে বলেন,”মা সাজ, জমিদার বাড়ির মেয়ে হয়ে তোমার এ আচরণ একেবারেই ভালো লাগে না আমাদের। তুমি তো ছোট না, যথেষ্ট বড় হয়েছো। তোমার বোনকে দেখো, কতো শান্ত, ভদ্র। আর তুমি? না না সাজ মা, এ খুবই অন্যায়।”
আমার মেজোচাচার গঞ্জে চালের আড়ৎ আছে। শোনা যায়, গঞ্জে মীর মোস্তাফা খাঁ এর মতো ধূর্ত চাল ব্যবসায়ী আর একটাও নেই। লোকে আড়ালে তাকে ‘শিয়াল’ বলে ডাকে তার ধূর্ততার জন্য। এগুলো সবই আমাকে দাদী বলেছেন। দাদী সারাদিন বিছানায় শুয়ে বসেও কীভানে বাইরের এতো খবর জানেন, সে এক বিস্ময়।
আমার বাবা মীর মশাররফ খাঁয়েরও গঞ্জে ব্যবসা। কা’ফনের কাপড়, আতর, তসবীহ এসবের ব্যবসা তার। আমার মেজোচাচা যতটা ধূর্ত ততটাই বোকা আর সহজ সরল আমার বাবা। তার ব্যবসা সারাবছর মন্দা থাকে। তার দোকানে কোনো কোনো দিন একটা মাছিও ওড়ে না। তবুও সে সবসময় এমন একটা ভাব ধরে থাকে যেনো সে বিশাল ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
মেজো ভাইয়ের কথায় সে-ও মাথা নাড়ায়।
“হ্যা, সাজ। তোমার মেজোচাচা ঠিক বলেছে। তোমার এখন তোমার এই দস্যিপনা থামানো উচিত। আজ বাদে কাল তোমার বোনের বিয়ে হবে, এরপর তো তোমার কথা আমাদের চিন্তা করতে হবে। এভাবে কতোদিন চলবে?”
আমার ছোট চাচা একজন চিত্রশিল্পী। কোনো নামডাক নেই, তারপরেও তার ভাবটা এমন যে, সে যেনো লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। সবসময় বাবড়ি চুল রাখবে, এলোমেলো, ময়লা জামাকাপড় পরবে আর ইয়া বড় এলোমেলো দাঁড়ি রাখবে। বাবা আর মেজোচাচা অনেক বলেও তাকে ঠিক করতে পারেনি। পারিবারিক শালিসে সে কোনো কথা তেমন বলে না। শুধু দুইভাইয়ের কথার সাথে মাথা দোলায়, আর খুব বেশি প্রয়োজন পড়লে মিনমিন করে বলে,”যথার্থ বলেছেন, যথার্থ।”
আমি একটা হাই ছাড়ি। তা দেখে মেজোচাচা আরো রেগে যান।
“সাজ, তোমাকে আমরা কিছু কথা বলছি, তুমি কানে নিচ্ছো না?”
আমার তখন ভীষণ ঘুম ধরেছে। চোখ পিটপিট করে বললাম,”চাচা, আপনি কি একটা কথা জানেন?”
“কি কথা?”
“আপনি হাত দিয়ে চেপে না ধরেও নি:শ্বাস আটকে রাখতে পারবেন। তখন নাক দিয়ে কোনো ঘ্রাণ পাবেন না। আবার চোখ হাত দিয়ে না চেপেও চোখ বন্ধ করতে পারবেন। কিন্তু কানে না হাত না দিয়ে কান বন্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। কানে হাত না দেওয়া পর্যন্ত সব কথা আপনাকে শুনতেই হবে।”
মেজোচাচা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,”তো এই কথা এখন বলার মানে কি সাজ মা?”
“এইযে আপনি বললেন আমি নাকি আপনার কথা কানে নিচ্ছি না। আপনি কি আমাকে একবারও কানে হাত দিতে দেখেছেন?”
মেজোচাচা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালেন।
“দেখেননি তো? এখানের কেউ দেখেনি। তাহলে আমি কীভাবে আপনার কথা কানে না নিলাম?”
ছোট চাচা মনে হয় অন্য খেয়ালে ছিলো। আমি কথা শেষ করার সাথে সাথে আমার দিকে ফিরে বললেন,”যথার্থ বলেছিস, যথার্থ।”
আমি ফিক করে হাসলাম। মেজোচাচা চিৎকার দিয়ে বললো,”দেখেছো ভাইজান দেখেছো? কত্তো বড় বেয়াদব হয়েছে তোমার ছোট মেয়ে?”
বাবা রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ছোটচাচাকে বলি,”আজ কি কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং আঁকলেন চাচা? দেখি তো।”
ছোটচাচা অপমানিত বোধ করেন। ফোঁসফোঁস করে বলেন,”তুই তো আসলেই বেয়াদব রে সাজ।”
আমি রিনঝিন শব্দে হাসতে হাসতে দাদীর ঘরের দিকে দৌঁড়াই। আমার ঝমঝম নুপূর বাজতে থাকে সারা মহলা জুড়ে।
“দাদী কি করো?”
দাদী হামানদিস্তায় পান বাটছিলো। আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,”আয় এটা দিয়ে তোর মাথায় একটা বাড়ি দিই। এতো দুষ্টুমি বুদ্ধি আসে কোথা থেকে মাথায়?”
আমি যেয়ে দাদীর কোলে শুয়ে পড়ি। দাদীর শরীর থেকে সবসময় মিষ্টি একটা গন্ধ আসে। অনেকটা পান, জর্দা এসব মিলিয়ে একটা গন্ধ, বড় ভালো লাগে।
“দাদী, তোমার মেজো ছেলেটাকে কি দত্তক এনেছিলে?”
দাদী আপন মনে হাসতে হাসতে পান বাটতে থাকে।
“সবসময় এরকম তেতে থাকে, যেনো মাথায় একটা গরম তাওয়া নিয়ে ঘুরছে। তোমার এই মেজো ছেলের পরামর্শেই বাবা আপাকে বাইরে পড়তে যেতে দিলো না। বাবাকে তো পুরোপুরি হাতের পুতুল বানিয়ে রেখেছে। উনি যা বলে, বাবা তাই শুনে। এখন কি আর আগের যুগ আছে দাদী, তুমিই বলো? এখনকার মেয়েরা বাইরে যেয়ে পড়াশোনা করছে না? এমনকি দেশের বাইরে যেয়েও পড়ছে। আপার মনটা সারাদিন খারাপ থাকে। কতো স্বপ্ন দেখেছিলো আপা, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, বড় চাকরী করবে। কিছুই হতে দিলো না উনি। কিছু বললেই বলে, জমিদার বাড়ির মেয়েরা অমুক করেনা, জমিদার বাড়ির মেয়েরা তমুক করে না। জমিদারির ‘জ’ ও বাঁচায় রাখতে পারেনি, আবার বড় বড় কথা। ভারী রাগ লাগে আমার।”
দাদী তখনও আপন মনে হেসেই চলেছে। আমি রাগ করে উঠে বসলাম।
“দাদী, তোমাকে কিছু বলছি না আমি?”
“শুনছি তো, আমি তো আর কান চেপে রাখিনি। দেখেছিস আমাকে কানে হাত দিতে?”
আমি হাসবো না হাসবো না করেও হেসে দিলাম। আমার দাদী ভীষণ রসিক মানুষ। আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছে।
“শোন সাজদাদু, তোর মেজোচাচা অনেকটা আমার শ্বশুর মানে মীর মতলেব খাঁ এর মতো হয়েছে। আমি যখন বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে আসি, তখন দেখতাম কি প্রতাপের সাথে চলতেন মানুষটা। মানুষকে মানুষ বলে মনেই করতেন না। সবাইকে হাতের পুতুল বানিয়ে রাখতে চাইতেন। তোর মেজোচাচাও হয়েছে তেমন। তিনি জমিদার ছিলেন, প্রতিপত্তি ছিলো, সে এগুলো করতে পারতো৷ কিন্তু তোর বাপ চাচা দের তো কিছুই নেই। তাই বাইরের কারো সামনে তোর চাচা এগুলো দেখাতে পারে না। তোর বাপ, আর ছোট চাচার উপর এসব প্রয়োগ করে।”
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই দরজায় মা এসে দাঁড়ায়।
“সাজ, এদিকে এসো।”
দাদী মিষ্টি করে হেসে বলেন,”তোর মা তোকে এখন বকবে। এখানে এলি কেনো?”
মাঝে মাঝে বেশ অবাক লাগে আমার। বাড়ির আনাচেকানাচে কি হচ্ছে দাদী সবকিছু জানে কীভাবে? এইযে দাদীর ঘরে আসলে যে মা আমাকে বকা দেয়, এটা দাদী কীভাবে জানলো?
কোনো একটা অজানা কারণে মা দাদীকে পছন্দ করেন না। শুধু মা-ই নয়, আমার বাকি যে দু’জন চাচী আছেন, কেউ দাদীকে পছন্দ করে না। সবাই দাদীকে একটু এড়িয়েই চলে। নেহাৎ আমার বাবা চাচারা মা বলতে পাগল তাই সরাসরি তাকে কিছু বলতে পারে না। বরং সামনা-সামনি দাদীর সাথে সবাই বেশ মিষ্টি করেই কথা বলে, তার সেবা করে। কিন্তু দাদী কীভাবে যেনো বুঝে ফেলেন মায়েদের মনের কথা।
আমি কিছুটা হেসে দাদীর কথা উড়িয়ে দিই।
“কি যে বলো না দাদী। তোমার ঘরে আসলে মা কেনো বকবে? এইযে আজ সারাদিন পড়তে বসিনি। তাই নিয়েই নিশ্চয়ই বকাবকি করবে।”
দাদী শুধু হাসেন নিজের মনে, কিছু বলেন না। আমি দাদীর হামানদিস্তা থেকে এক খাবলা পান নিয়ে ছুট লাগাই। দাদী পিছন থেকে চিৎকার করতে থাকেন,”এই লক্ষীছাড়া, দুষ্টু মেয়ে। আমার পান দিয়ে যা বলছি, দিয়ে যা।”
কে শোনে কার কথা? আমি ততক্ষণে পান মুখে পুড়ে দৌড় দিয়েছি। দাদীর হামানদিস্তায় পেষা পান এতো মজার!
বারান্দায় মূর্তির মতো মা দাঁড়িয়ে আছে। এখানে অল্প আলো আসে, সন্ধ্যার পর তো একেবারেই অন্ধকার এদিকটা।
“তোকে কতোবার বলেছি সাজ, দাদীর ঘর যাবি না? কানে যায় না কোনো কথা তোর?”
“মা, সে তো বাইরের কেউ না। আমার দাদী। তার ঘরে গেলে অসুবিধাটা কোথায়? তোমরাই বা এমন করো কেনো তার সাথে?”
“তুই ছোট মানুষ, তুই এতো কিছু বুঝবি না। তোকে মানা করলাম, ওই পাগল বুড়ির কাছে আর যাবি না তুই। এরপর যদি যাস, একদম পা ভেঙ্গে রেখে দিবো তোর।”
“আর যাই বলো মা, তুমি দাদীকে পাগল বুড়ি বলবে না। কোনোদিন বলবে না।”
মা কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে একছুটে নিজের ঘরে চলে আসি। এই ঘরটা দোতলার সর্বদক্ষিণের ঘর। ঘরটা আমার আর আপার দুইজনের। ঘরের দুই পাশে দুইটা বিশাল পালঙ্ক। একটায় আমি থাকি, একটায় আপা।
ঘরে ঢুকে দেখি আপা খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে কি একটা বই পড়ছে। তার কোমর ছাড়ানো লম্বা চুলগুলো ছাড়া। আপা দেওয়ালের দিকে মুখ করে বসে ছিলো, আর ঘরে ঢোকার দরজাটা আপার পিছনে। আমি কোনো শব্দ করে ঢুকিনি।
কিন্তু আপা তা সত্ত্বেও বুঝে ফেললো আমি এসেছি। শান্ত স্বরে আপা বললো,”একটাও শব্দ করবি না সাজ। আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ বই পড়ছি।”
আপার এসব আচরণে আমি আর অবাক হইনা। আপা যেনো নি:শ্বাসের শব্দ শুনেও বুঝে ফেলে কে এসেছে। এ বাড়িতে দাদী আর আপা দুইজনের আচরণই বড্ড রহস্যজনক লাগে আমার। মাঝে মাঝেই দুইজন দাদীর ঘরের দরজা আটকে ঘন্টার পর ঘন্টা কীসব যেনো আলোচনা করে। ওই সময় কারো ওই ঘরের আশেপাশে যাওয়া নিষেধ। আমি একবার গিয়েছিলাম, বন্ধ দরজার ভিতর দিয়েও দাদী কীভাবে যেনো বুঝে ফেলেছিলো যে আমি আছি ওখানে। হাসতে হাসতে দাদী বলেন,”সাজ বুড়ি, এখন এখান থেকে যাও। সময় হলে তোমাকে সব জানানো হবে।”
সেদিন রাতে কেনো জানি আমি ভীষণ জ্বর এসেছিলো। এরপর থেকে আমি আর তাদের ব্যাপারে নাক গলাই না।
আমি পা টিপে টিপে হেঁটে আপার পিছনে যেয়ে দাঁড়াই। আপাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরি। আমি জানি আপা এই কাজটায় খুবই বিরক্ত হয়। কিন্তু আপাকে বিরক্ত করতে আমার অনেক ভালো লাগে।
কিন্তু আজ আমাকে অবাক করে দিয়ে আপা একটুও বিরক্ত হয়না। আমার হাত ধরে টেনে এনে আপার সামনে বসায়। আপার মুখটা দেখে একটু চমকে উঠি আমি। ওর ফর্সা মুখটা কেমন লাল হয়ে আছে, যেনো ভীষণ রেগে আছে কারো উপর। আপার কোলের উপর একটা বই।
“সাজ, আমার একটা উপকার করবি?”
“কি উপকার আপা?”
“আগে বল করবি।”
“আচ্ছা করবো তো। কিন্তু আগে বলবি তো কি ব্যাপার? কি উপকার?”
“শোন, তোর কাজ হলো বাবার কাছ থেকে তেতলার চাবি সংগ্রহ করা। এরপর ওটা আমাকে দেওয়া। ব্যস, তোর কাজ শেষ।”
আমি আঁৎকে উঠি। আমার তেতলায় যাওয়া নিষেধ। শুধু আমার না, এ বাড়ির কারোই তেতলায় যাওয়ার অনুমতি নেই। আমাদের দাদা তার জীবদ্দশায় এ নিয়ম করে যান। তখন থেকে আমার বাবা চাচারা এই নিয়ম মেনে চলে। আমরা এতোগুলো মানুষ নিচতলা আর দোতলার ঘরগুলোতে থাকি। বাড়ির মানুষ যতই বাড়ুক, তেতলায় যাওয়াও আমাদের নিষেধ। এমনকি তেতলায় বাতি জ্বালানোও নিষিদ্ধ এ বাড়িতে। পুরো বাড়ি আলোয় ঝলমল করে শুধু তেতলা থাকে একদম অন্ধকার, শুনসান, নিস্তব্ধ।
দাদীর কাছে শুনেছি মীর মতলেব খাঁ তেতলার কোনো একটা ঘরেই মৃ ত্যুবরণ করেন, শুধু তাইনা তার জীবনের শেষ কিছু বছর, যেদিন থেকে তিনি পঙ্গুত্ব ধারণ করেন সেদিন থেকেই তিনি তেতলায় থাকতেন। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন ঘরে তার মৃত্যু হয়েছে তা কেউ জানতো না। কারণ তাকে তেতলার বারান্দার একটা গ্রিলে মৃ’ত অবস্থায় ঝুলতে দেখা গিয়েছিলো। যেদিন তিনি মারা যান, তার আগের দিন তিনি তার বড় ছেলে মানে আমার দাদাকে ডেকে তিনি বলেছেন,”এই বাড়িটা তুমি নিও, এটা তোমার আর কোনো ভাইকে দিও না। আর আমি যে ঘরে মৃত্যুবরণ করবো সেই ঘরে তুমি বা তোমার আর কোনো বংশধরকে আসতে দিও না। তোমার বংশধর বাদে আর কেউ আসলে সমস্যা নেই, কিন্তু এই পরিবারের রক্ত যাদের শরীরে আছে তারা যেনো ও ঘরে না আসে।”
যদিও মীর মতলেব খাঁ পঙ্গু ছিলেন। কিন্তু খুব অদ্ভুত ব্যাপার এটাই যে, তাকে প্রতিদিন সকালে একেকদিন তেতলার একেক কক্ষে পাওয়া যেতো। তিনি কাউকে কোনোদিন বলেন নি, কীভাবে এটা হতো। যদিও তার শরীরের দুর্গন্ধের জন্য কেউ তার পাশে যাইতেই চাইতো না, এতো কথা শোনার সময় কোথায়? আর এই কারণেই কেউ জানে না, তার মৃত্যু আসলে কোন কক্ষে হয়েছিলো, নাকি আদৌ কোনো কক্ষে হয়েছে নাকি বারান্দায় হয়েছে। আমার দাদার উপর তার বাবার খুব রাগ ছিলো। শেষ দিকে দাদা তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। জমিদারির কিছুই আর বাকি ছিলো না তখন বলতে গেলে। তাই তিনি তার বাবার শেষ কথা রাখতে আমার বাবা চাচাদের এই হুকুম করে গিয়েছেন যেনো এই বাড়ির কোনো বংশধর তেতলায় না যায়। আমার ভীতু বাবা চাচা আরো এক কাঠি সরেস। তারা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে তেতলার সিঁড়ির রাস্তা। যাতে শুধু এ বাড়ির লোকরাই নয়, কেউ উঠতে যেনো না পারে।
“আপা, তুই কি পাগল হলি? তেতলার চাবি আমি কোথা থেকে পাবো? তুই তো জানিস সব।”
আপা চোখের ভারী ফ্রেমের চশমাটা খুলে ওড়নাএ কোণা দিয়ে মুছতে মুছতে বললো,”তুই কীভাবে আনবি সে তো তুই জানিস। তোকে একটা উপকার করতে বলছি, তুই করবি। আমি তো জানিনা কীভাবে আনবি।”
আমার আপা শান্তশিষ্ট হলেও ভীষণ জেদী। যা বলবে তাই করতে হবে।
“তা তুই যা না, বাবাকে যেয়ে বল। দেখি কেমন আনতে পারিস।” আমি বিড়বিড় করে বলতে থাকি।
“কি রে কিছু বলছিস?”
“তুই দাদীকে যেয়ে বল আপা। দাদী কিছু করতে পারে কিনা দেখ। এমনিতে আমাকে নিয়ে রোজ রোজ শালিস বসে বাড়িতে।”
“দাদীর হাতে যদি এই চাবি থাকতো, অনেক আগেই আমি যেতে পারতাম। দাদা অনেক কিছু বুঝেই দাদীকে এই চাবি দিয়ে যায়নি, বাবাদের দিয়ে গেছে।”
“তুই কি বলছিস আমি কিছুই বুঝতে পারছি না আপা। আর আমরা তো এই বাড়ির মেয়ে। মীর মতলেব খাঁয়ের রক্ত আছে আমাদের শরীরে। আমাদের তো ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না আপা। খাঁ বাড়ির কোনো বংশধর ওখানে যেতে পারবে না, জানিস না?”
আপা হাসে, সারা শরীর দুলিয়ে হাসে। আপার হাসি দেখে কিছুটা ভড়কে যাই আমি। কেমন যেনো গা ছমছমে একটা হাসি দেয় আপা।
“শোন সাজ, আমাদের চারপাশে অনেক কিছুই হয়, আমরা জানিনা, দেখতে পাইনা। আমাদের যা বুঝানো হয় আমরা তাই বুঝি, যা দেখানো হয় আমরা তাই দেখি। কেনো আমাদের নিজেদের মস্তিষ্ক নেই? আমাদের নিজেদের চোখ নেই? আমরা কেনো সবটা নিজেরা বুঝে দেখিনা? বল তো?”
আপার কথা কিছুই ঢুকছে না আমার মাথায়। কি বলছে আপা এসব? এর আগেও মাঝে মাঝে আমি দেখেছি তেতলায় যাওয়ার জন্য আপার অস্থিরতা। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আপা বুঝি আজকেই ওখানে যেয়েই ছাড়বে।
আমি কিছুটা অসহিষ্ণু হয়ে বলি,”কিন্তু ওখানে তোকে আমি একা যেতে দিবো না। আমি চাবি আনার ব্যবস্থা করবো, কিন্তু একটা শর্ত আছে। আমিও তোর সাথে যাবো।”
আপা চশমাটা আবার চোখে দিয়ে বললো,”না তুই যাবি না। তুই দোতলাতেই থাকবি। কারণ আমার যদি কিছু হয় তুই যেনো অন্যদের খবর দিতে পারিস। দুইজনই বিপদে পড়লে তখন বাড়ির লোকদের কে খবর দিবে?”
আমার বুকটা ধক করে ওঠে। বিপদ? কিসের বিপদ? যদি বিপদের আশংকাই থাকে তবে আপা কেনো যেতে চায় সেখানে?
“আপা, আমার খুব ভয় করছে। কিসের বিপদ হতে পারে?”
“এতো কথা বলতে ইচ্ছা করছে না সাজ। যদি পারিস চাবিটা এনে দে। আজ অমাবস্যা, আলো নেই বাইরে। এটাই সুন্দর সময়। নাহলে আবার পরের অমাবস্যার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ও হ্যা আর একটা কথা, কেউ যেনো না জানে চাবির কথা। পারলে চুরি করে আনবি বাবার কাছ থেকে। বাবার ঘরের কাঠের আলমারির ডানপাশের কোণার একদম উপরে একটা রূপার বাক্স আছে, সেই বাক্সের মধ্যে চাবি আছে এক গাছা। রূপার তৈরি চাবি, ওটাই তেতলার। কিন্তু রূপার বাক্সটার চাবি কোথায় আছে এটা তোখে খুঁজে বের করতে হবে।”
আমি ঢোক চেপে আপার দিকে তাকাই। কি বিপদে পড়লাম। বাবাকে একটু ভয় পাই আমি, বাবার থেকে বেশি ভয় পাই মেজোচাচাকে। মেজোচাচা আমাকে কখনোই অনেক বকে না, মারে না। কিন্তু কেনো জানি মাঝে মাঝে তাকে বেশ ভয় পাই আমি। বাবা জানতে পারলে নিশ্চয়ই মেজোচাচাকে জানাবে। এ কি বিপদে পড়লাম? আপাকে কি একা ওখানে যেতে দেওয়া ঠিক হবে? একবার কি দাদীর সাথে কথা বলে নিবো? কিন্তু আমার কথা শুনে তো মনে দাদী সবই জানে, আর এটা হয়তো দাদীরই বুদ্ধি। অস্বস্তিতে ঘাম ঝরতে থাকে আমার অনর্গল।
(চলবে…..)