কলমে: মিথিলা জামান নিভা – Methela Jaman Neva
সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনি বাড়িতে বিশাল হৈচৈ, শোরগোল। এমনিতেই গত রাতে ঘুম হয়নি ভালো করে। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠেছি মীর মতলেব খাঁ এর নৃশং সতার কথা আর দাদীর মুখটা মনে করে। ভোরের দিক একটু চোখটা লেগে এসেছে। সকাল হতে না হতেই এতো চিৎকার চেচামেচি। বিরক্তিতে উঠে বসলাম। ঘড়িতে বাজে মাত্র সাড়ে আটটা। এমন সময় বাড়ি একদম চুপচাপ থাকে অন্যদিন। বাবা চাচারা সবাই খাওয়া দাওয়া করে বেরিয়ে যায় যে যার কাজে, বাচ্চারাও স্কুলে চলে যায়। কে এই সময় এভাবে শোরগোল করছে? পাশে তাকিয়ে দেখি আপাও নেই। আমি চোখ ডলতে ডলতে নিচতলায় নেমে যাই।
কে বা কারা বাবার দোকানের সামনে কাফনের কাপড় রেখে গেছে সুন্দর করে ফেলে, আর পাশেই একটা একটা কাগজে জাফরানের রঙ দিয়ে উর্দু আর হিন্দীর সংমিশ্রণে কিছু একটা লেখা। আমার দাদাজান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, তিনি হিন্দী পারতেন। তার কাছ থেকে আমার বাবা চাচারা হিন্দী শিখেছিলেন, শখের বশে আমি আর আপাও শিখেছিলাম। কিন্তু দুই ভাষার সংমিশ্রণে লেখা তাই সবটা পরিষ্কার বোঝা না গেলেও যেটুকু বোঝা গেছে তার মোদ্দাকথা এটাই যে, মীর সাহেব, তোমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমার বাবা একটু ভীতু, তিনি কিছুটা মিইয়ে পড়েছেন। চিৎকার করছেন আমার মেজোচাচা।
“এতো বড় সাহস, জমিদার বাড়ির ছেলেকে হুমকি দেওয়া। আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো।”
মা বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে বললেন,”মেজো ভাই, এই কথায় কথায় জমিদার বাড়ির গল্প বন্ধ করুন। কে এই কাজ করেছে তাকে আইনের আওতায় আনার প্রয়োজন।”
মেজোচাচা মায়ের উপর রাগ হলেন বুঝতে পারলাম। রাগ চেপে বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,”ভালো করে কাপড়টা দেখে বলো তো ভাইজান, এটা কি তোমার দোকানের?”
আমার বাবার কাফনের কাপড়, আতর এসবের ব্যবসা গঞ্জে।
বাবা আস্তে আস্তে না সূচক মাথা নাড়ে।
মেজোচাচা ঘরে পায়চারি করতে থাকেন। আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে দাদী এই বিষয়ে কিছু হলেও জানে। আমি কি দাদীর কাছে একবার জিজ্ঞেস করবো? কিন্তু এই মুহুর্তে এখান থেকে আমার নড়তে ইচ্ছা করছে না, বাবার জন্য কেমন ভয় করছে।
মেজোচাচা হঠাৎ পায়চারি করা থামিয়ে দেন। বাবার দিকে তাকিয়ে বলেন,”ভাইজান, গঞ্জে একজন নতুন ব্যবসায়ী এসেছিলেন না? তোমার মনে আছে?”
বাবা ঘোলাটে চোখে তার দিকে তাকায়, “কোন নতুন ব্যবসায়ী?”
“ওইযে, সবসময় উর্দু ভাষায় কথা বলে, লম্বা লম্বা জোব্বা পরে। তোমার দোকান থেকে তো মনে হয় আতর কিনলো আগের দিন। কি যেনো নামটা?”
“তুমি কি বায়েজীদ শাহ এর কথা বলছো?”
“হ্যা হ্যা, বায়েজীদ শাহ। তোমার কি মনে আছে কিছুদিন আগে উনি উনার তিন নাম্বার বিবি বানানোর প্রস্তাব দিয়েছিলো আমাদের সাঁঝের জন্য? তুমি সাথে সাথে তাকে না করে দিলে। উনি মুখ কালো করে বেরিয়ে গেলেন দোকান থেকে।”
“হ্যা মনে আছে সবই।”
“আচ্ছা ভাইজান, হতেও তো পারে এই কাজ তার। আর এই কাপড়ের সিলগুলো দেখো, সব উর্দুতে লেখা।”
মা এতোক্ষণ চুপ করে সব শুনছিলেন। মেজোচাচার দিকে তাকিয়ে এবার বললেন,”মেজোভাই এই চিরকুটটা কিন্তু শুধু উর্দুতে লেখা নয়, অন্য রকম একটা ভাষা। আমি ছোট থেকেই বিভিন্ন রকম ভাষার প্রতি অনেক দুর্বল ছিলাম। হিন্দী, উর্দু, ফারসি সবই টুকটাক শিখেছিলাম। কিন্তু এটা সে ধরণের কোনো ভাষা নয়। শুধু শুধু একজন নির্দোষকে না জেনে এভাবে দোষ দিবেন না। আগে সত্যিই জানুন উনি দোষী কিনা।”
মেজোচাচা ফোঁৎ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে মেজোচাচীর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন,”এইজন্য মেয়েমানুষের এতো পড়াশোনা করা উচিত না।”
এতেই মা রাগে ফেটে পড়েন। লাল চোখে মেজোচাচার দিকে তাকিয়ে বলেন,”যা বলবেন আমার দিকে তাকিয়ে বলুন। অন্যের কথা এভাবে সবার সামনে স্ত্রীকে বলা কাপুরুষতার লক্ষণ।”
“এখন কি আমার পরিবারের সাথে কি কথা বলবো না বলবো তাও আপনার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বলতে হবে ভাবীজান? তবেই কি আপনি আমাকে কাপুরষ না বলে সুপুরুষ বলবেন?”
মা তর্ক পছন্দ করেন না। নিজেকে সামলে বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,”আমার সাথে থানায় চলো, একটা ডায়েরী করতে হবে। যে-ই এই কাজ করুক তাকে শাস্তি পেতে হবে। এখানকার থানার ওসি আমার বাবার পরিচিত। দেরি করা উচিত হবে না, এখনই যেতে হবে।”
মায়ের কথা শুনে মেজোচাচার মুখ হা হয়ে যায়।
“কি বললেন আপনি? আপনি মীর বাড়ির বউ হয়ে থানায় যাবেন ডায়েরী করতে?”
“হ্যা, তাতে আপনার কোনো সমস্যা আছে?”
“দেখুন বড় ভাবী, আমাদের বাড়ির একটা মানসম্মান আছে। এ বাড়ির বউরা থানায় যেয়ে ডায়েরী করবে এটা একদমই ভালো কথা নয়।”
মা মুচকি হেসে বলেন,”আর একজন এ বাড়ির ছেলের দোকানের সামনে কাফনের কাপড় আর হুমকি দেওয়া চিরকুট রেখে গেলো, আর আপনারা আন্দাজে একজনকে দোষ দিয়ে দায়মুক্ত হলেন এটা বুঝি খুব ভালো হলো?”
“দায়মুক্ত হয়েছি কে বললো আপনাকে? এই ছোট চল থানায় চল, দেখি কোন ওসি খুঁজে বের করতে পারে।”
বাবা আর ছোট চাচা অসহায় মুখে বসে মা আর মেজোচাচার তর্কাতর্কি দেখছেন। বাবা মিনমিন করে বললেন,”আমারও কেনো জানি মোস্তফার কথা শুনে মনে হচ্ছে ওই নতুন ব্যবসায়ী এই কাজ করেছে।”
মেজোচাচা একটা বিজয়ীর হাসি দিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। মা রাগে বাবার দিকে তাকিয়ে বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলছে।
“আমি বলি কি ভাইজান, সাঁঝের একটা বিয়ে দিয়ে দাও। আমার পরিচিত একটা ভালো ছেলের সন্ধান আছে। শহরে বাড়ি তাদের, বিশাল বড় ব্যবসা। ছেলের বয়স একটু বেশি, তাতে কি? মেয়ে সুখে থাকলেই তো ভালো। আর স্বামীদের বয়স একটু বেশি থাকা ভালো।”
মা অবাক হয়ে মেজোচাচার দিকে তাকান,”এরমধ্যে আমার মেয়ের বিয়ের কথা কেনো আসছে মেজো ভাই? একটা সমস্যা হয়েছে সেইটার আগে সমাধান করুন। আমার মেয়ের বিয়ে নিয়ে এতো দুশ্চিন্তা আপনার না করলেও হবে।”
মেজোচাচা একটু রূঢ় গলায় বললেন,”আজকে ভাইজানের কাছে চিরকুট এসেছে, কাল আমার কাছে আসবে না তার নিশ্চয়তা দিতে পারবেন আপনি? কন্যা দায়গ্রস্ত থাকলে অনেক সমস্যা হয়ে পারে। মীর বাড়ির সম্মান থাকতে থাকতে আমার কথা শুনুন, নাহয় পরে পস্তাবেন।”
এই বলে হনহন করে মেজোচাচা বেরিয়ে যান। বাবা চুপ করে এককোণায় বসে থাকেন।
“দাদী আসবো?”
দাদী হামানদিস্তায় পান বাটছিলেন। আমার দিকে না তাকিয়েই মিষ্টি করে হাসেন। দাদীর দিকে তাকিয়ে কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যায়। কতোটা কষ্ট লুকিয়ে দাদী এতোগুলা বছর সংসার করেছেন এই বাড়িতে, তিনটা সন্তান জন্ম দিয়েছেন। যে বাড়িতে কিনা তার বাবা মায়ের সাথে কি নৃশং সতা হয়েছে তারই চোখের সামনে।
“আয় সাজদাদু, কাছে আয়।”
আমি আস্তে আস্তে হেঁটে দাদীর পাশে যেয়ে দাঁড়াই। দাদীকে আমার ভীষণ জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এখন জড়িয়ে ধরলেই আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না, চিৎকার করে কেঁদে দিবো। আমি চাইনা দাদী আমার কান্না দেখুক।
“তুই কি আমাকে কিছু বলতে এসেছিস সাজবুড়ি?”
“কেনো দাদী? কিছু না বললে কি তোমার কাছে আমি আসিনা?”
কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলিনা আমরা। শুধু হামানদিস্তায় পান বাটার শব্দ হতে থাকে ধীরে ধীরে।
বেশ কিছুক্ষণ পর দাদী খুব স্বাভাবিকভাবেই বলেন,”নিচে কি নিয়ে এতো চেচামেচি হচ্ছে সকাল সকাল? মীর মোস্তফা খাঁ এর চিৎকারের চোটে তো কান পাতা দায়।”
দাদী তার তিন ছেলেকে সম্পুর্ণ নাম ধরে ডাকেন সবসময়। আমার মেজোচাচার নাম মীর মোস্তাফা খাঁ।
আমি চোখ সরু করে দাদীর দিকে তাকিয়ে বলি,”নিচে কি নিয়ে শোরগোল হচ্ছে তুমি সত্যিই জানো না দাদী?”
দাদী পান বাটা থামিয়ে আমার দিকে তাকান কিছুক্ষণ। তারপর চিকনসুরে হাসতে থাকেন। হাসতে হাসতে তার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসে। ফর্সা মুখ লাল হয়ে যায় হাসির দমকে।
আমি ঈষৎ রাগ দেখিয়ে বলি,”হাসির মতো কিছু কি বলেছি আমি?”
দাদী অনেক কষ্টে হাসি থামান। এরপর আবার পান বাটায় মন দিয়ে বলেন,”তুই কি মনে করিস সাজবুড়ি? আমি বুঝি জ্যোতিষী? ঘরে বসেই আমি সব জেনে যাবো?”
“তুমি কি তা জানিনা আমি, কিন্তু তুমি অনেক কিছুই বুঝতে পারো।”
দাদী কিছু বলেন না, আপন মনে হাসতে থাকেন।
“তুই কি জানিস সাজবুড়ি তোর দাদাজানের মৃ ত্যু হয়েছিলো কীভাবে?”
“হ্যা জানি তো, দোতলার সিঁড়ি থেকে পড়ে যেয়ে দাদা ভীষণ আহত হন। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, ওখানেই দাদাজান মারা যান। কিন্তু কেনো দাদী?”
“তোর দাদাজানও কিন্তু তার মৃত্যুর আগে তার গঞ্জের দোকানের সামনে কাফনের কাপড় আর একটা জাফরানে লেখা চিরকুট পান। কোনো এক অজানা ভাষায় লেখা চিরকুট। তোর দাদাজান সে ভাষা বুঝতে পেরেছিলেন। তবে তিনি ছোট্ট একটা ভুল করে ফেলেছিলেন, তিনি ভেবেছিলেন কেউ মজা করে এই কাজ করেছে, হাসতে হাসতে চিরকুটটা ছিঁড়ে ফেলে দেন তিনি। আমি তার হাতে পায়ে ধরেছিলাম, চিরকুটটা যেনো তিনি না ছিঁড়েন। কিন্তু শেষদিকে উনি আমাকে একদম পছন্দ করতেন না। আমাকে বলতেন আমি নাম-পরিচয়হীন একটা মেয়ে। অথচ আমার সাথে কি কি হয়েছে সব তিনি জানতেন, তার বাবা আমার জীবনটা কীভাবে শেষ করে দিয়েছেন তাও জানতেন। দোষ করলো তারা আর আমি পাগল প্রমাণিত হলাম আমি। তবুও তিনি আমার স্বামী, আমি চাইতাম না এভাবে তিনি আমাকে ছেড়ে চলে যান। তবুও তিনি চলে গেলেন, আমার কথা শুনলেন না। চিরকুট পাওয়ার ঠিক তিনদিনের মাথায় তার মৃ ত্যু হলো।”
আমি চোখ বড় বড় করে দাদীর কথা শুনছি। দাদী কীভাবে জানলেন যে, ওই চিরকুট ছিঁড়ে ফেললে দাদাজানের মৃ ত্যু হবে না? হঠাৎ একটা চিন্তায় বসা থেকে এক লাফে উঠে যাই আমি। আমার বাবাও তো ওই চিরকুট পেয়েছে, বাবা কি ওটা ছিঁড়ে ফেলেছেন? আমি ছুটে দাদীর ঘর থেকে বের হতে গেলে দাদী আমার হাত ধরেন।
“কি ভাবছিস? তোর বাবাও ওই চিরকুট ছিঁড়ে ফেললো কিনা?”
“দাদী আমাকে যেতে দাও, এক্ষুনি সাবধান করতে হবে বাবাকে। তুমিই বা মা হয়ে এতো শান্তভাবে বসে আছো কী করে বুঝলাম না।”
দাদী হাসেন।
“বোস, সাজবুড়ি। তোর মা খুব বিচক্ষণ একজন মহিলা। আর তোর দাদাজান আমাকে দূরদূর করে দিলেও, তোর বাবা তোর মায়ের কথা কখনোই ফেলবে না। তোর মায়ের উপর আমার আস্থা আছে, যদিও সে আমাকে পছন্দ করে না। তার ধারণা আমি বদ্ধ উন্মাদ। তবুও আমি তাকে ভালোবাসি। সে চাইবে এই চিরকুট পুলিশকে দেখাতে, তাই সে এটা ছিঁড়ে ফেলতে দিবে না।”
আম বসি আবার দাদীর পাশে, তবুও আমার ভিতরের ছটফটানি কমে না। কিছুদিন যাবৎ এতো ধাক্কা পাচ্ছি একেকটা ঘটনা শুনে। নিজেকে সামলাতে পারছি না, সবটাই দু:স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
“তারপর কি হলো শোন। তোর দাদাজানের মেজো ভাই তখন গঞ্জের বাড়িতে থাকেন পরিবারসহ। তোর দাদাজানের তিনদিনের মিলাদে তিনি এলেন। ওটাই শেষ দেখা তার সাথে আমাদের। তার পরের দিন শুনতে পেলাম তিনি নিজের বাড়িতেই গলায় ফাঁ*স দেওয়া অবস্থায় মারা গেছেন। তার পরিবারের ভাষ্যমতে গতরাতেও সবাই একসাথে বসে খাবার খেয়েছে, একদম সব স্বাভাবিক। আত্মহ*ত্যার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তবুও ওভাবে তার মৃত্যু হলো। অনেকদিন পর আমার মেজো জায়ের কাছে আমি শুনি এই বাড়িতে যেদিন তোর দাদাজান মারা গিয়েছিলেন ওদিন একটা বয়স্ক লোক পুরো শরীর চাদরমুড়ি দিয়ে এসে তার কাছে একটা থলি দিয়ে যায়। দেওয়ার সাথে সাথেই লোকটা নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। সেই থলিতে ছিলো একটা কাফনের কাপড় আর একই রকম জাফরানে লেখা চিরকুট। উনি ভাইয়ের মৃত্যুতে তখন শোকাহত। তিনি ভাবেন কেউ মজা করেছেন তার সাথে। তিনি সাথে সাথে চিরকুটটা ছিঁড়ে ফেলে দেন আর থলিটা কাপড় সহ কোথাও ফেলে বাড়িতে নিয়ে যান। এই কথা তিনি তার মৃ ত্যুর আগের দিন রাতেই তার স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন।”
আমি থমকে গিয়েছি দাদীর কথা শুনে। কে এই কাজ করতে পারে? এটা কি কোনো মানুষের কাজ নাকি কোনো অতিপ্রাকৃত বিষয় লুকিয়ে আছে এরমধ্যে?
আমি আস্তে আস্তে দাদীকে বললাম,”কিন্তু ছোট দাদাজান তো এখনো বেঁচে আছেন, উনি কি কোনো চিরকুট পাননি?”
“হ্যা উনিও পেয়েছেন।”
“তাহলে?”
“সেদিন আমার মেজো জায়ের কাছ থেকে এই ঘটনা শুনে আমি ভয় পেয়ে যাই। কারণ মীর বাড়ির ওই প্রজন্মের বংশধরদের মধ্যে শুধু তিনিই আছেন। আর তোর বাবা চাচারা পরের প্রজন্ম। আমি সেদিন কালো বোরকায় আপাদমস্তক ঢেকে তোর ছোট দাদাজানের বাড়িতে যাই। নিজেকে ঢেকে যাওয়ার কারণ আমার ছোট জা আমাকে পছন্দ করতেন না, তিনি জানতেন আমি পাগল। একটা বাপ মায়ের পরিচয় না থাকা মেয়েকে এতো বড় জমিদার তার ছেলের বউ করে এ বাড়ি এনেছেন আমি সেই জমিদারকে খু*নী বলেছি, সবার চোখে আমি পাগল ছাড়া কি? যাই হোক, তোর ছোট দাদাজানের তখন সবজির আড়ৎ বাজারে। আমি পরিচয় দিই যে, আমি একজন চাষী বউ, আমার সবজি বিক্রির জন্য আমি উনার সাহায্য চাই। তখন আমি উনার সাথে দেখা করতে পারি। তোর ছোট দাদাজান আমাকে অনেক শ্রদ্ধা করতেন কারণ তিনি কিছু কিছু জানতেন তার বাবার নৃশং সতার কথা। আমাকে দেখে উনি অবাক হয়ে যান। আমি তার কাছে আগে জিজ্ঞেস করি, এমন কোনো চিরকুট সে পেয়েছে কিনা। সে অবাক হয়ে যায় আমার কথা শুনে, যে আমি জানি কীভাবে এই কথা? কারণ তার আগের রাতেই তিনি তার আড়ৎে একটা কাফনের কাপড় আর জাফরানে লেখা চিরকুট পেয়েছে। আমি আবারও তাকে জিজ্ঞেস করি সেই চিরকুট সে ছিঁড়ে ফেলেছে কিনা। সে জানায় সে এখনো ছিঁড়েনি, তবে তার ছেলেরা বলেছে ছিঁড়ে ফেলতে। আমি তাকে সাবধান করে আসি, যে কোনো মূল্যে যেনো ওই চিরকুট সে না ছিঁড়ে। তিনদিন কাটানোর পর ওই চিরকুট যদি সে পানিতে গুলে পানিটা একটা গাছের গোড়ায় দিয়ে দিতে পারে তবে গাছটা সাথে সাথে জায়গায় মরে যাবে, তখন আর তার প্রাণ সংশয় থাকবে না। সে আমার কথা কোনোভাবেই বিশ্বাস করে না। মনে করে সত্যিই বুঝি এক পাগল মহিলা তাকে রূপকথার গল্প শোনাতে এসেছে। সে আমার সামনেই ছিঁড়ে ফেলতে চায়। আমি হাতজোড় করে তাকে অনুরোধ করি এই কাজ যেনো সে না করে। তিনদিন পর যদি ওই কাগজে গোলানো পানিতে একটা গাছ না মরে, তাহলে তার যা মন চায় সে করতে পারে। সে আমার কথায় রাজি হয়। আমি বাড়িতে চলে আসি। ঠিক তার চারদিনের মাথায় ভোরবেলা আমার দরজার সামনে উনার কান্নার আওয়াজ শুনে ভয় পেয়ে যাই আমি। আমি তখন ফজরের নামাজ পড়ছিলাম। তড়িঘড়ি করে উঠে দরজা খুলে দিই। তোর ছোট দাদাজান আমার পায়ে পড়ে চিৎকার দিয়ে কাঁদেন, আমি বুঝে যাই সত্যিই ওই পানিতে গাছ মরেছে।”
বুকটা জোরে জোরে ধকধক করছে আমার। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কোনটা বিশ্বাস করবো? আসলেই কি অতিপ্রাকৃত বলে এই পৃথিবীতে কিছু আছে?
“তোকে একটা কথা বলবো সাজবুড়ি?”
“হ্যা দাদী বলো।”
“আজ থেকে তুই তোর আপার কাছে ঘুমাবি না। যদি ঘুমাস তোর মা কে তোর সাথে রাখবি।”
“এসব কি বলছো দাদী? আপার কাছে ঘুমাবো না কেনো?”
“আমার কথা শোন সাজদাদু। আমি চাইনা এই মীর বাড়ির আর একটা প্রাণও ওরা নিক। তোরাই তো আমার সব রে। যার কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার ছিলো তার কাছ থেকে তো নিয়েছে। বাকিদের তো কোনো দোষ নেই। তারা কেনো বিনা দোষে এতো প্রাণ হারাবে?”
“আমি তোমার কথা কিচ্ছু বুঝতে পারছি না দাদী। কে প্রাণ নিবে? কিসের প্রতিশোধ?”
“আস্তে আস্তে সব জানবি। একদিনে এতো কিছু তোর জানতে হবে না। আর একটা কথা।”
“বলো।”
“তোর আপা কি তোর কাছে তেতলার চাবি চেয়েছে? বলেছে তোকে তোর বাবার ঘরের রূপালী বাক্স থেকে চাবিটা এনে দিতে?”
আমি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলি,”হ্যা বলেছে দাদী।”
“তুই তার কাছে জিজ্ঞেস করিস নি যে এই কাজ তো সেও করতে পারে, তোকে কেনো আনতে বলছে?”
“করেছি দাদী, কিন্তু ও বলে ওর নাকি আনতে কি সমস্যা আছে। তাই আমাকেই যেতে হবে।”
“ভুলেও এই কাজ করবি না। এই বংশের কেউ যেনো কখনোই তেতলায় না যায়। সাঁঝ, তুই বা তোর আর কোনো চাচাতো ভাইবোন কেউ না।”
“কিন্তু দাদী, আপা যে বললো তোমার কাছে যদি এই চাবি থাকতো তুমি নাকি আরো আগেই দিয়ে দিতে তাকে। আরো অনেক কিছু বললো জানো? যা আমাদের দেখানো হয় তাই দেখি, যা জানানো হয় তাই জানি। নিজেরা দেখিনা বুঝিনা কেনো?”
“বেশি কথা বলবো না, রাত বারোটার পর সাঁঝদাদুর কোনো কথা তুই শুনবি না। ওর সাথে এক ঘরে থাকবি না।”
“কিন্তু দাদী……”
“কোনো কিন্তু না। তেতলার সিঁড়িতেও উঠবি না কেউ। এখন যা, আমাকে একা থাকতে দে। আমি একটু বিশ্রাম নেবো।”
আমি উঠে দাঁড়াই। কেমন যেনো টালমাটাল লাগছে আমার। দাদী যা বলছে সত্যি? নাকি আপা যা বলছে তা সত্যি? দাদীকে যে সবাই পাগল বলে তবে কি সেইটাই সত্যি? নাকি আপার সাথেই অন্য কোনো অতিপ্রাকৃত কিছু জড়িয়ে আছে? কাকে বিশ্বাস করবো এখন আমি?”
হঠাৎ একটা চিন্তা আমার মাথায় আসে, আমি ঝট করে পিছন ঘুরে তাকাই।
“আর কিছু বলবি সাজদাদু?”
“আচ্ছা দাদী একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“কর।”
“তোমার বাবা কি করতেন?”
“উনার ব্যবসা ছিলো গঞ্জে।”
“কীসের?”
“কাফনের কাপড় আর জাফরানের।”
হৃৎপিণ্ডটা ধকধক করে ওঠে আমার গলার কাছে এসে। দাদীর মুখ মিষ্টি একটা হাসি, কিন্তু সেই হাসি এতো ভয়ংকর লাগছে কেনো আমার কাছে?”
“দাদী আরেকটা প্রশ্ন ছিলো।”
“আমি জানি কি প্রশ্ন করবি তুই। যে আমার বাবা মা বাঙালি ছিলেন কিনা।”
আমি ঢোক চেপে দাদীর উত্তর জানার জন্য তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
“না আমার বাবা মা কেউ বাঙালি ছিলেন না, তারা ছিলেন পারস্যের।”
আমি চোখ বড় বড় করে দাদীর দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার হাঁটু থরথর করে কাঁপছে। আমি আর এক পা-ও হেঁটে যেতে পারছি না। দাদী রহস্যের হাসি দিয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকলেন।
(চলবে…….)