কলমে: মিথিলা জামান নিভা – Methela Jaman Neva
এরমধ্যে আমাদের বাড়িতে ঘটে গেলো আরেকটা দুর্ঘটনা। আপাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আমি দাদীর ঘর থেকে বের হতেই মা আমাকে টেনে একঘরে নিয়ে গেলো।
“তুই আবার ওই পাগল বুড়ির ঘরে গিয়েছিলি? কি কথা বলছিলো উনি তোকে?”
“মা দয়া করে দাদীকে পাগল বুড়ি বলবে না, তোমাকে অনুরোধ করলাম।”
মা কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,”সাঁঝ কি ওর কোনো বান্ধবীর বাড়িতে গিয়েছে? তোকে জানিয়েছে এমন কিছু?”
আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম,”কই না তো মা। কেনো আপা বাড়িতে নেই?”
মা কিছুটা দমে যান। আপা কাউকে না বলে বাড়ি থেকে পা নাড়ায় না। কাউকে না বললেও আমাকে বলে যায়।
“তোর দাদীকে বলেছে?”
“না তো, আমি তো ও ঘর থেকেই এলাম। দাদী কিছু বললো না তো।”
মা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। বড় বাড়ি আমাদের। কোনোখানেই আপা নেই। তেতলায় যাওয়ার অনুমতি না থাকায় ছাদেও যাওয়া হয়না। আর রইলো বাকি বাগান। আমি আর মা ছুটে গেলাম বাগানে খুঁজতে, কোথাও নেই। মায়ের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
“কোথায় গেলো বল তো কাউকে কিছু না জানিয়ে?”
“বাবাকে বলবো মা?”
সকালের ঘটনার পর থেকে বাবা আজ আর দোকানে যান নি। নিজের ঘরে শুয়ে আছেন।
“না এখনই বলিস না। মানুষটা এমনিতে দুশ্চিন্তায় আছে। দেখি আরেকটু সময়। কোথায় আর যাবে? চলে আসবে নিশ্চয়ই।”
কিন্তু না, সকাল গড়িয়ে বিকাল হলো তবুও আপার দেখা নেই। সারাবাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেছে। মা চিৎকার করে কাঁদছেন, বাবা হাঁসফাঁস করছেন আর এদিক ওদিকে পায়চারি করছেন। মেজোচাচা বিরস মুখে বসে আছেন একপাশে, খবর পেয়ে দোকান থেকে চলে এসেছেন তিনি। ছোট চাচা গিয়েছেন আপার খোঁজ নিতে, কোনো বান্ধবীর বাড়িতে গেলো কিনা। তিনি এখনো ফেরেননি। আমি মা কে জাপটে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। দুশ্চিন্তায় আমারও অস্থির লাগছে।
“সাজ মা।”
“জ্বি মেজোচাচা।”
“তোমার বোন কি তোমাকে কখনো তার গোপন কিছু জানিয়েছে?”
“কি গোপন কিছু চাচা?”
“এইযে, তার অন্য কারো সাথে সম্পর্ক আছে কিনা।”
মা বিস্ফারিত চোখে মেজোচাচার দিকে তাকালেন।
“চাচা বুঝলাম না আপনার কথা।”
“না বোঝার মতো কিছু তো বলিনি। সহজ কথায়, তোমার বোন কি কারো সাথে প্রেম করে?”
“না না চাচা কি বলেন, তা করবে কেনো?”
“করবে কেনো তাতো জানিনা মা। শিক্ষিতা মায়ের শিক্ষিতা মেয়ে। কতো কিছুই সম্ভব। হতেও তো পারে মেয়ে তার সাথেই কোথাও চলে গেছে।”
মা উঠে দাঁড়ালেন, তাকে দেখে খুব ভয় করছে আমার।
“আর একটা কথাও আপনি বলবেন না মেজো ভাই। আপনার যদি আপনার ভাইঝিকে পাওয়া যাচ্ছে না, তাকে খুঁজতে হবে এটা মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে তাহলে তাকে খুঁজুন। আর যদি আমাকে খোঁচা দেওয়ার ইচ্ছা থাকে তাহলে দয়া করে এখান থেকে উঠে চলে যান।”
বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন,”তোমরা থামবে দয়া করে? আমার মেয়েটাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আর তোমরা এখানে নিজেদের মধ্যে কাঁদা ছোড়াছুড়ি করছো?”
মা কিছু না বলে আবার ধপ করে বসে পড়লো। আমার হঠাৎ কেনো জানি দাদীর কথা মনে পড়লো। দাদীর কাছে তো সকালের পর আর যাইনি। দাদী কি কিছু বলতে পারবে আপার কথা? কোথায় আছে ও?
আমি মা কে ছেড়ে দাদীর ঘরে ছুটলাম দ্রুত।
দাদীর ঘরের সামনে আসতেই আমি ভীষণ অবাক হলাম। দাদী অসুস্থ মানুষ, তাই কখনোই তার ঘরের দরজা আটকানো থাকে না। এমনকি আমরাও ঘরের দরজা আটকাই না যদি রাতবিরেতে দাদীর কোনো দরকার হয়। সেই দাদীর ঘর আজ আটকানো?
আমি দরজায় এসে জোরে জোরে ধাক্কা দিতে থাকি।
“দাদী ও দাদী। তুমি দরজা আটকিয়েছো কেনো? শুনছো দাদী? দরজা খুলো।”
কোনো সাড়াশব্দ নেই ভিতর থেকে। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে আসে। কি হলো দাদীর? সুস্থ আছেন তো উনি? আমি আরো জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে থাকি, কিন্তু কোনো সাড়া পাইনা।
কতক্ষণ এভাবে ধাক্কাধাক্কি করছি আমি জানিনা। যখন মনে হলো না, অনেকটা দেরি হয়ে যাচ্ছে। এবার নিচে যেয়ে সবাইকে জানাতে হবে।
আমি ফিরতেই যাচ্ছিলাম এরমধ্যে একটা গোঙানি শুনে স্থাণুর মতো জমে যাই আমি, কারণ গোঙানিটা ছিলো দাদীর।
“কেনো তোমরা এসব শুরু করেছো? ওদের কি দোষ? ওদের শরীরে এই মীর বাড়ির র ক্ত তার মানে কি সবাই দোষী? আমার স্বামীকে কেড়ে নিয়েছো আমার থেকে। এখন আমার ছেলে আর তার সন্তানদের দিকেও হাত বাড়িয়েছো? আমার সাঁঝকে ছেড়ে দাও৷ ও তো ছোট। কেনো ওর জন্মের পর থেকে ওকে স্বস্তি দিচ্ছো না?”
আমার গলার কাছে এসে হৃৎপিণ্ড লাফাতে থাকে। কে আছে দাদীর ঘরে এখন? কার সাথে কথা বলছে দাদী? আর আপাকে কে ধরে রেখেছে?
আমি বরফের মতো দাঁড়িয়ে আছি। কি করবো বুঝতে পারছি না। নিচে যেয়ে সবাইকে ডাকবো? এদিকে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে যাচ্ছে। আপার কোনো খোঁজ নেই। সন্ধ্যা নামার আগ মুহুর্তে দাদীর ঘরের সামনে কেমন অন্ধকার নেমে যায়, চারদিকে গাছে ঘেরা তো তাই। হঠাৎ মাগরীবের আজান পড়ে। দাদীর গোঙানিটা সাথে সাথে থেমে যায়। দরজাটা আচমকা আমার সামনে এমনভাবে খুলে যায় আমি ভয়াবহ ভাবে চমকে উঠি। মনে হলো শীতল একটা বাতাস হঠাৎ আমার পাশ দিয়ে চলে গেলো। সেই বাতাসে কেমন যেনো জাফরানের মিষ্টি গন্ধ।
আমি থরথর করে কাঁপতে থাকি। আমাকে দাদীর ঘরে ঢুকতে হবে। সে সাহস পাচ্ছিনা। রাত নামার আগেই যেনো এই জায়গায় রাত নেমে গেছে।
দাদীর ঘরটা অস্বাভাবিক রকম ঠান্ডা। ভাদ্র মাসের গরমেও এই ঘর এতো ঠান্ডা কেনো? আর এতো ঘুটঘুটে অন্ধকার, নিজের হাতটাও দেখা যাচ্ছে না। আর বাতাসে কর্পূর আর ছাইয়ের মিশ্রণে অদ্ভুত একটা গন্ধ।
আমি হাতড়ে হাতড়ে দাদীর বিছানার কাছে যাই। বিছানা হাতড়ে দাদীকে খুঁজতে থাকি। লাইটের সুইচ জ্বালানোর কথাও যেনো আমার মনে নেই। আমি ভীতুস্বরে দুইবার ডাকলাম,”দাদী, দাদী।”
কোনো সাড়া নেই। আমার কেমন যেনো মনে হচ্ছে দাদী উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। হঠাৎ আমার মনে পড়লো লাইট জ্বালানো কথা।
আমি হাতড়ে হাতড়ে সুইচের কাছে যাবো তার আগেই দাদী বলে উঠলেন,”আলো জ্বালিসনে সাজ। আমি যেভাবে আছি তুই সইতে পারবিনা।”
আমি চমকে উঠি দাদীর কথা শুনে। দাদী যে অবস্থায় আছেন মানে?
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,”ও দাদী, আমার ভীষণ ভয় করছে। তোমার কি হয়েছে?”
“এতো কথা বলার সময় নেই। আমাদের বাড়ির পূব দিকের জংলার কাছে যা। ওখানে সাঁঝকে দেখতে পাবি অজ্ঞান অবস্থায়। সাতটা মরিচ পোড়া ওর কপালে ছুঁইয়ে ওকে নিয়ে আয়। একটা মরিচও যেনো কম না হয়।”
আমার পা কাঁপছে। আমি কীভাবে এখান থেকে যাবো দাদীকে রেখে?
“যা সাজ যা, দেরি করিস না। আর এক মুহুর্তও দেরি করিস না। মাগরীবের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার আগেই সাঁঝকে ঘরে নিয়ে আয়।”
আমি হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটলাম মরিচ পোড়াতে। ওদিকে আমার মা প্রায় শয্যাশায়ী। আমাকে ওভাবে দৌড়াতে দেখে মেজোচাচী এসে বললেন,”কিরে সাজ? এভাবে ছুটছিস কেনো তুই?”
“মেজোচাচী, বেশি কথা বলার সময় নেই। এক্ষুনি সাতটা মরিচ পোড়াও। এরপর পূবের জংলায় যেতে হবে সবাইকে।”
“তোর কি বোনের শোকে মাথা খারাপ হয়ে গেলো সাজ? এসব কি আবোল তাবোল বকছিস? এই ভরসন্ধ্যায় পূবের জংলায় যাবি মানে? জানিস না সন্ধ্যার পর ওদিকে যাওয়া আমাদের নিষেধ?”
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো। আমার দাদাজান তার জীবদ্দশায় এ বাড়িতে নিয়ম করে গিয়েছেন সন্ধ্যার পর পূবের জংলায় যেনো কেউ না যায়।
আমি এতোকিছু মাথায় নিতে পারিনা। শুধু বুঝতে পারি আপা অনেক বিপদে আছে, আমাকে এক্ষুনি ওর কাছে পৌঁছাতে হবে।
এই মুহুর্তে আমার বাবা আর মা ছাড়া কেউ ওখানে যেতে রাজি হয়না। যেহেতু তাদের মেয়ে, তাদের তো যেতেই হবে।
মা চোখ বড় বড় করে আমাকে জিজ্ঞেস করেন,”তোর দাদী বলেছে সাঁঝ ওখানে আছে?”
“হ্যা মা। এই সাতটা মরিচ পোড়া নিয়ে ওর কপালে ছোঁয়াতে হবে। এরপর ওকে ঘরে আনতে হবে।”
“মরিচ পোড়া কেনো?” মেজোচাচা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
আমি তার দিকে তাকিয়ে কিছু বললাম না।
মা বাবাকে বললাম,”তোমরা কি যাবে? নাহয় দেরি হয়ে যাবে।”
মা মাথায় বড় করে চাদর টেনে দিয়ে বললেন,”আর কেউ না যাক, আমার মেয়ে আমি যাবো। চল সাজ।”
বাবা আস্তে করে বললেন,”দাঁড়াও রেনু, মেয়েটা তোমার একার না, আমারও। আমি যাবো। আমি আমার টর্চটা নিয়ে আসি।”
ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। কপাল থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঘাম পড়ছে। এখনো জানিনা আপাকে কি অবস্থায় ওখানে দেখতে পাবো। আর ও ওখানে গেলোই বা কীভাবে? এতো প্রশ্নের উত্তর কার কাছে পাবো? দাদী নাকি স্বয়ং আপা?
এখানে আসতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধে নাড়িভুড়ি উলটে ওঠে আমাদের। আমরা মুখে কাপড় চাপা দিলাম।
মা অস্থির হয়ে বললেন,”সাঁঝের বাবা আমার মেয়েকে খুঁজে বের করো, আমার মেয়েটা এখানে কীভাবে আছে?”
বাবাও পাগলের মতো খুঁজছে আপাকে। হঠাৎ টর্চের আলোয় আপার ওড়নার এককোণা দেখতে পেলাম আমি। সাথে সাথে চিৎকার করে বললাম,”মা ওদিকে।”
বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছি আমরা তিনজন। জংলার মধ্যে বৃষ্টির পানি জমে কিছুটা স্যাঁতসেঁতে জায়গাটা। ওখানেই আপা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। চুলগুলো মুখের উপর ছড়িয়ে আছে। আশেপাশে পোকামাকড়ের আনাগোনা।
মা হাউমাউ করে উঠলেন,”সাঁঝের বাবা আমার মেয়ে, আমার সাঁঝ।”
বাবা আপাকে পাঁজকোলা করে তুলতে যাবে তার আগে আমি হালকা চিৎকার করে বললাম,” বাবা আগে না, দাঁড়াও।”
বাবা মা দুইজনই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন।
“কেনো কি হয়েছে?”
“আগে এই মরিচ পোড়া গুলো আপার কপালে ছোঁয়াতে দাও।”
মা কঠিন গলায় বললেন,”এসব কি আজেবাজে কথা বলছিস? মরিচ পোড়া দিতে হবে কেনো ওর কপালে?”
আমি আমতা আমতা করে বললাম,”দাদী বলেছেন…..”
মা আমার কথা শেষ করতে দিলেন না। তার আগেই আমার হাত থেকে মরিচগুলো ছুড়ে ফেলে দিলেন দূরে জংলার মধ্যে।
আমি হতবাক হয়ে বললাম,”মা এটা কি করলে তুমি? ফেলে দিলে কেনো মরিচগুলো? তুমি জানো এতে আপার বিপদ হতে পারে?”
মা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,”বিপদ কার হবে এবার আমি দেখবো।”
এই বলে মা অগ্নিদৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালেন।
বসার ঘরে সবাই গম্ভীর মুখে বসে আছে। আপার জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে কি হয়েছে না হয়েছে তার কিছুই মনে নেই। মা গরম দুধ খেতে দিয়েছেন, সুন্দর মতো খেয়ে টেবিলে বসে পা দুলিয়ে গল্পের বই পড়ছে।
মা একটু কোমল গলায় বললেন,”মা আজ আর বই পড়তে হবে না, ঘুমিয়ে যাও।”
আপা অবাক হয়ে বললো,”কেনো মা? আজ কি হয়েছে?”
মা কিছু না বলে আমার দিকে তাকালেন। আমি শক্ত মুখে আপার দিকে তাকিয়ে আছি। এখানে আসার আগে দাদীর ঘরে গিয়েছিলাম। দাদী দিব্বি হামানদিস্তায় পান বাটছে। আমাকে দেখে বললেন,”কি রে পান বাটা খাবি? এই বয়সে আমার মতো দাঁত লাল হয়ে যাবে। পরে আর জামাই পাবি না লাল দাঁত দেখিয়ে।”
এই বলে কুটকুট করে হাসতে থাকে দাদী নিজের মনে। আমি আর কোনো কথা না বলে চলে এসেছি। হচ্ছেটা কি এসব?
বসার ঘরের মিটিং মা ডেকেছেন। তার নাকি সবাইকে কি জরুরি কথা বলার আছে।
“কি ব্যাপার বড়ভাবী? এতো রাতে সবাইকে এখানে কেনো বসিয়ে রেখেছেন? মেয়ের কাছে যান, ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করুন এসব নাটকের মানে কি?”
মা মেজোচাচার কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে বললেন,”মেজো ভাই মেয়েটার উপর দিয়ে কিছুক্ষণ আগে একটা ঝড় গেছে। আমরা জানিও না কি হয়েছে তার সাথে। আজ অন্তত ওকে ছেড়ে দিন।”
মেজোচাচা মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালেন।
মা সবার উদ্দেশ্যে তাকিয়ে বললেন,”আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর সেই সিদ্ধান্ত জানাতেই তোমাদের সবাইকে এখানে ডেকেছি।”
বাবাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। সারাদিনে তার উপর দিয়ে কম ধকল যায়নি। তার চোখ লাল। শ্রান্ত গলায় বাবা বললেন,”কি কথা রেণু? আগামীকাল বলা যায়না?”
“না যায়না। আজ এক্ষুনি আমাকে জানাতে হবে।”
“আচ্ছা বলো।”
“আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা আলাদা হয়ে যাবো। আলাদা হয়ে যাবো মানে এটা নয় যে একই বাড়িতে থেকে হাঁড়ি আলাদা হবে। আমরা এই বাড়িটাই ছাড়বো। সাঁঝের বাবা তুমি আমাদের জন্য একটা বাসা ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা করো। নাহয় আমি মেয়েদের নিয়ে আমার বাবার বাড়ি চলে যাবো।”
উপস্থিত সবাই যেনো মায়ের কথা বিশ্বাসই করতে পারছে না। ছোট চাচা শুধু অবাক হয়ে বললেন,”বড় ভাবী, এগুলো কি বলছেন আপনি?”
“হ্যা ছোট ভাই, যা শুনেছেন তাই বলছি আমি।”
বাবা এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কিছুটা জোর গলায় বললেন,”রেণু, তুমি এক কথা তখনও বলেছিলে যখন সাঁঝকে হলে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিলো না। আমি তখন তোমাকে কি বলেছিলাম তোমার মনে নেই? বলেছিলাম মা বেঁচে থাকতে এই বাড়ি ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব না? তুমি আবার একই কথা বলছো?”
“আমি তো বললাম তুমি না গেলে আমি আমার বাপের বাড়ি চলে যাবো দুই মেয়েকে নিয়ে।”
“আমি বেঁচে থাকতে আমাক আমার মেয়েদের কাছ থেকে তুমি আলাদা করতে পারো না রেণু।”
মা এবার চিৎকার করে উঠলেন,”তবে কি এবার তোমাদের জিদের জন্য আমার মেয়েদের প্রাণ সংশয় হোক তুমি তাই চাও?”
বাবা ভ্রু কুঁচকে বললেন,”প্রাণ সংশয় মানে?”
“আজ যা হলো তারপরেও তুমি বুঝতে পারছো না কিছু?”
“কি বুঝবো?”
“তোমাদের চোখ থাকলে তো তোমরা বুঝবে। সাঁঝকে খুঁজে খুঁজে আমরা হয়রান। মা সারাদিনে কোনো কথা বললেন না৷ যখনই মাগরীবের আজান দিলো তখনই সে ঠিকমতো বলে দিলেন সাঁঝ কোথায় আছে? উনি যদি জানতেন সাঁঝ কোথায় সারাদিনে কেনো বললেন না? আমার মেয়েটা সারাদিন ওই অবস্থায় পড়ে আছে। ওখানে আমরা কেউ যাইনা তাই জানিও না ও ওখানে। আর সারাদিন তো মা ঘরেই থাকেন, উনি কীভাবে জানলেন সাঁঝ কোথায়?”
মা থামলে সারাঘর থমথম করতে থাকে। সারাঘরে পিনপতন নীরবতা।
মেজোচাচা অনেকক্ষণ পর আস্তে আস্তে বললেন,”এখানে মায়ের দোষ আছে মানছি, কিন্তু মেয়েদের প্রাণ সংশয় বলতে কি বুঝালেন আপনি?”
“একটু বোঝার চেষ্টা করলেই ভালো করে বুঝতে পারবেন মেজো ভাই। এইযে সাতটা মরিচ পোড়া কপালে ছোঁয়ানো, মাগরীবের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার আগে ওকে ঘরে আনা এসবই মায়ের সাজানো নাটক। উনি সবসময় নাটকীয়তা করতে পছন্দ করেন৷ এটাই প্রমাণ করতে চান এই বাড়িতে অস্বাভাবিক, অতিপ্রাকৃত কিছু আছে। আমার মনে হয় সাঁঝকে ওখানে অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে আসার পিছনেও উনার কোনো একটা হাত আছে। আমার মেয়ে কেনো ওখানে যেয়েই অজ্ঞান হবে? ওরকম একটা নোংরা জায়গায় সাঁঝ কেনো যাবে?”
বাবা ক্ষিপ্ত হয়ে মা কে বললেন,”কথায় লাগাম দাও রেণু। মা তার ঘরের বাইরে কোথাও যান না এটা তুমি জানো না? সাঁঝকে কীভাবে মা ওখানে নিয়ে যাবে? আর এসব করে মায়ের লাভটাই বা কি? একজন বয়স্ক মানুষকে নিয়ে কি যা তা বলছো তুমি?”
“তুমি তাহলে আমাকে উত্তর দাও মা কীভাবে জানলেন সাঁঝ ওখানেই আছে অজ্ঞান অবস্থায়? এখন দয়া করে এটা বলো না যে মায়ের কোনো অদৃশ্য শক্তি মা কে এসব জানিয়েছে।”
বসার ঘরের সবাই চুপ করে আছে। কিন্তু আমি অনেক কিছুই এখন আঁচ করতে পারছি। দাদীর গোঙানি, সেই জাফরান গন্ধ মেশানো বাতাস, দাদীর চিৎকার উফফফ! আমি আর ভাবতে পারিনা। কিন্তু এসব যদি আমি এখন সবাইকে বলি, বিশ্বাস করবে আমার কথা? আর যদি সত্যিই মা আমাদের নিয়ে নানাবাড়ি চলে যায়? দাদীকে ফেলে, এই বাড়ি ফেলে কীভাবে যাবো আমরা? এই বাড়ি যে আমাদের অস্তিত্ব। এই সাঁঝবাতির সাজবাড়ি যে আমাদের শিরায় শিরায় মিশে আছে।
“আজ মেয়েকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে কাল যে আরো খারাপ কিছু হবে না ওর সাথে তার নিশ্চয়তা দিতে পারবে তোমরা? বলো? আমি আর কিছু শুনতে চাইনা। হয় তুমি আলাদা বাড়ি ভাড়া করে আমাদের নিয়ে যাবে নাহয় আমি ওদের নিয়ে চলে যাবো, এটাই আমার সিদ্ধান্ত।”
মেজোচাচা বিড়বিড় করে বললেন,”জমিদার বাড়ির মেয়েরা ভাড়া বাড়িতে……”
মা মেজোচাচাকে কথা শেষ করতে দেন না। তার আগেই উঠে যেয়ে হনহন করে সেখান থেকে চলে যান।
নিশুতি রাত। আপা গভীর ঘুম। আজ বারান্দার লাইট জ্বালিয়ে ঘুমিয়েছি। আবছায়া আলোয় আপাকে কি ভীষণ সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে ছুটে যেয়ে আপাকে জড়িয়ে ধরি। আপা খুবই সুন্দরী। যদিও আপা আর আমি দেখতে অনেকটাই একই রকম। তবুও কেনো জানি আপাকেই অতিরিক্ত সুন্দর লাগে। একদম কাচুমাচু হয়ে ঘুমিয়ে আছে যেনো একটা বাচ্চা শুয়ে আছে। কি নিষ্পাপ মুখখানি। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম দাদী যে আমাকে মানা করেছিলো আপার সাথে আজকের পর একা না ঘুমাতে। আমাদের বাড়িতে সবাই দশটা/এগারোটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। আজ এতো ঝামেলার পর একটু দেরি হয়েছে সবার। বারোটা বাজতে আর অল্প কিছু সময় বাকি। বাড়িটা একদম সুনসান নীরব, বাইরে শুধু বাদে বাদে ঝিঁঝি পোকা ডেকে যাচ্ছে। আমাদের পুকুর পাড়ে একটা হাস্নাহেনা ফুল আছে। অসময়েও ফুল দেয় গাছটা। অদ্ভুত মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে আসছে সেখান থেকে। কেমন যেনো ঘোর লাগা পরিবেশ। হঠাৎ আমার চোখে পড়লো আপার টেবিলে রাখা আপার ডায়েরি। সবসময় আপা এটাকে লক করে রাখে। কি যে লেখে ওতে কি জানি। কিন্তু আজ ডায়েরিটা খোলা। ভিতরে একটা কলম দিয়ে চাপা দেওয়া। বোঝাই যাচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই আপা কিছু লিখেছে, লক করতে ভুলে গেছে।
যদিও অন্যের ডায়েরি লুকিয়ে পড়া অসভ্যতা। তবুও আজ মন মানছে না। এমন তো হতে পারে আজ কি হয়েছে আপা ডায়েরিতে লিখেছে। হয়তো আমাদের বলতে পারছে না। হয়তো দাদীর উপর থেকে মিথ্যা দোষারোপ আমি সরাতে পারবো আপার লেখা মা কে দেখিয়ে।
ধরবো না ধরবো না করেও কেনো জানি ডায়েরিটা খুলে ফেললাম। খুব সুন্দর গোটা গোটা করে লেখা। আপার হাতের লেখাও বেশ সুন্দর। যেখানে কলম চাপা দেওয়া ছিলো ওখানে দেখলাম। তেমন কিছুই লেখা না। কিসব আঁকিবুঁকি করা। অন্য পাতা গুলোতেও আহামরি এমন কিছুই পেলাম না। একটু মনো:ক্ষুন্ন হই। ডায়েরিটা আবার রেখে দিতে যাবো এমন সময় হাতে ভেজা ভেজা কিছু টের পেলাম। হাতটা চোখের সামনে এনে তাকাতেই বারান্দার আবছা আলোয় দেখলাম লাল। আমি চমকে উঠলাম। তবে কি র ক্ত? র ক্ত কোথা থেকে আসবে? কিন্তু র ক্ত তো এরকম হওয়ার কথা না। আমি হাতটা নাকের কাছে আনতে জাফরানের মিষ্টি একটা গন্ধ পেলাম। তবে কি জাফরান দিয়ে কিছু লেখা? আর মনে হচ্ছে মাত্রই লেখা হয়েছে নাহলে এভাবে হাতে লাগবে কীভাবে?
আমি দ্রুত ডায়েরিটা আবার খুললাম। দেখলাম একটা পৃষ্ঠায় অসংখ্যবার জাফরান দিয়ে লেখা,
“রুহজাইনা ফিরে আসছে সাঁঝের দ্বিতীয় সত্ত্বা হয়ে।”
আমি চমকে উঠলাম। রুহজাইনা আবার কে? কোথা থেকে ফিরে আসছে সে? আপার দ্বিতীয় সত্ত্বা মানে? আমার হাত পা কাঁপতে থাকে।
হঠাৎ আচমকাই ঘাড়ে কাছে ঘন নি:শ্বাসের গরম বাতাস টের পাই। ঝট করে আপার বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখি আপা নেই। এখনই তো ওখানে ছিলো। আমি পেছনে ঘোরার সাহস পাইনা। হঠাৎ আমার দাদীর কথা মনে পড়ে যায়। রাত বারোটার পর যেনো আমি আপার সাথে একই ঘরে একা না থাকি। আমার গা গোলাতে থাকে।
“আমার ডায়েরি ধরেছিস সাজ?”
কার গলা এটা? এটা তো আপার গলা না। এতো ভারী গলা কার হতে পারে? পিছনে যদি আপা না থাকে তাহলে কে? আর আপা কোথায়? আমার গলা শুকিয়ে আসে। আমি চিৎকার করে মা কে ডাকতে যাই। কিন্তু মনে হচ্ছে অদৃশ্য কেউ আমার গলাটা চেপে ধরেছে শক্ত করে। একটা কথাও বের হয়না গলা থেকে। নি:শ্বাসের গরম বাতাস বাড়তে থাকে। অনেক রেগে গেলে যেরকম দ্রুত শ্বাস পড়ে তেমন।
ঠিক এমন সময় আমাদের বৈঠকখানার বিশাল ঘড়িটা ঢং ঢং করে বেজে ওঠে। ঘড়িটা শুধু চব্বিশ ঘণ্টায় দুইবার জোরে শব্দ করে সময় জানান দেয়। বেলা বারোটায় আর রাত বারোটায়। মানে বারোটা বেজে গেছে?
আচমকাই বারান্দার লাইট নিভে যায়। কোথা থেকে ঝড়ো বাতাসে জানালার কপাট সজোরে বাড়ি খেতে থাকে। বাতাসে কর্পূরের তীব্র গন্ধ। আমার মাথা ঘুরতে থাকে। আমি ছুটে বের হতে চাই ঘর থেকে। কোনো একটা অদৃশ্য শক্তি আমাকে টেনে ধরে রেখেছে।
আমি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলি,”আমাকে ছেড়ে দে আপা, ছেড়ে দে। আমি আর কোনোদিন তোর ডায়েরি ধরবো না।”
প্রতিধ্বনির মতো একটা আওয়াজ শুধু আসে,”রুহজানিয়া এসে গেছে, রুহজানিয়া এসে গেছে।”
কে এই রুহজানিয়া?
(চলবে….)