কলমে: মিথিলা জামান নিভা – Methela Jaman Neva
সে রাতের কথা আমার আর কিছু মনে নেই। সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙে আমি নিজেকে আমার খাটেই দেখতে পাই। আমি ধরফর করে উঠে বসি। আমার অনেকটা সময় লাগে ধাতস্থ হতে। একেক করে সব মনে পড়তে থাকে আমার। আবছা আলো, কর্পূরের গন্ধ, ঘাড়ের কাছে গরম শ্বাস, আর রক্তের মতো লাল জাফরান রঙে রুহজানিয়া। আমি চিৎকার করে উঠলাম মনে করতেই। অবাক ব্যাপার, আপা আমার পাশেই। দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো আমাকে।
“কি হয়েছে সাজ? চিৎকার করছিস কেনো? খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস?”
আপাকে দেখে ছিটকে আসি আমি। আপার দ্বিতীয় সত্ত্বা রুহজানিয়া। আপাকেও ভয় করছে আমার।
আমার ব্যবহারে আপা যেনো তাজ্জব বনে যায়। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,”কি রে তুই আমাকে দেখে এমন করছিস যেনো ভূত দেখছিস।”
আপার ভালো ব্যবহারে আমি অবাক হই। তবে কি সত্যিই কাল রাতের সব ঘটনা আমার দু:স্বপ্ন ছিলো? আমি এই জিনিসগুলো নিয়ে অনেক ভাবছি তাই এসব আজেবাজে স্বপ্ন দেখছি? হ্যা তাই হবে। আমার আপা কেনো আমাকে ভয় দেখাবে? আর এই রুহজানিয়াটাই বা কে? এমন আজগুবি নাম তো জীবনেও শুনিনি। বাঙালি নামও মনে হচ্ছে না। তবুও ভিতরটা কেমন উশখুশ করছে। সবকিছু এমন জীবন্ত ছিলো গতকালের। কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছি না সব যে স্বপ্ন ছিলো। আপা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ করেই আমার চোখ যায় আপার টেবিলের দিকে। ওখানে আপার ডায়েরিটা ঠিক সেরকমভাবে পড়ে আছে, লক খোলা অবস্থায়। আমার মনে আবার একটা সূক্ষ্ম ভয় উঁকি দিতে থাকে।
আমি আপার দিকে না তাকিয়েই ছুটে যাই ডায়েরিটার দিকে। অন্যদিন আপার ডায়েরি ধরলে আপা খুব বকাবকি করে। কিন্তু আজ কিছুই বললো না। অবাক হয়ে আমাকে দেখছে যেনো।
আমি হুটোপুটি করে ডায়েরিটা খুললাম। সেই পৃষ্ঠাটা যেখানে কাল দেখেছিলাম ওই লেখাটা। অদ্ভুত ব্যাপার! কিছুই লেখা নেই। এমনকি একটা লাল দাগ কোথাও নেই। আমি তন্ন তন্ন করে সারা ডায়েরি খুঁজলাম। কোথাও নেই। জাফরানের রঙ তো এভাবে ওঠানো সম্ভব না। পৃষ্ঠাটা কি ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে? নাহ সেরকম কোনো চিহ্নও পেলাম না। তবে কি সবটা সত্যিই আমার দু:স্বপ্ন ছিলো? আমি ডায়েরিটা হাতে চেপে কাঁপতে থাকি।
আচমকাই মাথায় কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে মুখ উঠিয়ে তাকাই আমি। আপা স্নেহমাখা মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এইতো আমার আপা, ধুর আমি কিসব ভাবছি। সবটাই আমার ভ্রম ছিলো।
“সাজ তোর কি হয়েছে? আপাকে বলবি না? এমন করছিস কেনো তুই? কি স্বপ্ন দেখেছিস আমাকে বলবি তো?”
আমি আস্তে আস্তে আমার হাতটা আমার মাথা থেকে নামিয়ে আমার মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলি,”আপা তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? ঠিকঠাক উত্তর দিবি?”
“কোনোদিন আমাকে ভুলভাল উত্তর দিতে দেখেছিস?”
“যা জিজ্ঞেস করছি শুধু তার উত্তর দে।”
আপা ছোট্ট একটা নি:শ্বাস ছেড়ে বলে,”বল।”
“তুই রুহজানিয়া নামের কাউকে চিনিস?”
আপা ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকায়। আপার মুখ দেখে স্পষ্ট মনে হচ্ছে আমার মতো আপাও এই নাম প্রথম শুনলো।
“কি নাম বললি? রুহজানিয়া?”
আমি ধীরে ধীরে মাথা নাড়ি।
“সাজ, তোর হয়েছেটা কি বলতো? এমন আজগুবি নাম তো বাপের জন্মেও শুনিনি। কে সে? পুরুষ না মহিলা?”
“আপা সত্যিই তুই এই নামে কাউকে চিনিস না?”
আপা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে নিজের হাতটা আমার মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,”সাজ, আমার মনে হয় তোকে একটা ভালো ডাক্তার দেখানো উচিত। ইদানীং তোর ব্যবহারগুলো যেনো কেমন মনে হচ্ছে। কি না কি স্বপ্ন দেখে আমার ডায়েরি ঘাটাঘাটি শুরু করলি। এখন আবার এক আজব নাম নিয়ে প্যাচাল শুরু করেছিস। বললাম না এই নামে কাউকে চিনিনা আমি?”
আমি মনে প্রাণে চাচ্ছি সব যেনো স্বপ্নই হয়, তবুও এতো জীবন্ত কোনো স্বপ্ন হয়? স্বপ্নের কথা তো এতো স্পষ্ট মনে থাকার কথা না।
আপাকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই নিচতলা থেকে বিকট চিৎকার ভেসে আসলো। চিৎকার করছেন বাবা। বাবার চিৎকার শুনে আমরা দুই বোন দুইজনকে জড়িয়ে ধরলাম।
“আপা কি হলো বাবার? বাবা এভাবে চিৎকার করলো কেনো?”
“জানিনা রে, চল নিচে যাই।”
হঠাৎই আমার মনে পড়লো সেই চিরকুটের কথা। আজ তো সেই চিরকুট পাওয়ার দ্বিতীয় দিন। বাবা কি তবে চিরকুটটা ছিঁড়ে ফেলেছে?
আমি আপাকে ধাক্কা দিয়ে পেছনে ফেলে ছুটতে থাকলাম নি:শ্বাস বন্ধ করে। যেভাবে হোক বাবাকে আমার বাঁচাতেই হবে দুষ্ট শক্তির হাত থেকে। আপাও আমার পেছন পেছন দৌঁড়াতে থাকে।
নিচে নামতেই আমার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল একটা স্রোত নেমে যায়। বসার ঘরের অবস্থা লণ্ডভণ্ড। বাবা মেঝেতে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। তার দৃষ্টি এলোমেলো। মেজোচাচা আর ছোট চাচাও বাবাকে ধরে কাঁপছেন। দুই চাচীও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। শুধু আমার মা কে তুলনামূলক শান্ত লাগছে।
আপা দৌড়ে যেয়ে বাবার কাঁধে হাত রাখে।
“কি হয়েছে বাবা? এভাবে চিৎকার করলে কেনো? আর তোমাদের এই অবস্থা কেনো? কি হয়েছে বলো আমাদের?”
কেউ কোনো কথা বলে না। সবাই যেনো হতবিহ্বল হয়ে গেছে। আপা অসহিষ্ণু হয়ে একে একে মেজোচাচা আর ছোট চাচাকেও জিজ্ঞেস করে, কেউ কোনো কথা বলে না।
আপা চিৎকার করে বলে,”কেউ কি কিছু বলবে? হয়েছে কি সবার?”
এবার মা মুখ খুললেন।
“আর বলো না সাঁঝ। তেতলার চাবি যে রূপার বাক্সে ছিলো, সেই বাক্স আজ সকালে তোমার বাবা খুলেছেন। সেখানে চাবি নেই। গতকালও নাকি দেখেছেন চাবি আছে, আজ নেই। তাই সবাই চিন্তিত।”
আপা ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। তার মুখের ভঙ্গি আমার চোখ এড়ালো না। সারা শরীর কাঁপছে তার থরথর করে। হ্যা চাবি নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকারই কথা। কারণ এই চাবি নিয়ে অনেক কাহিনি আছে। কিন্তু আপার এই মুখভঙ্গি যেনো অন্য কিছু বলছে।
আমি হঠাৎ করে কিছু না বুঝেই বলে বসলাম,”কাল যে চিরকুটটা বাবা পেয়েছিলো সেইটা কোথায় আছে মা?”
হঠাৎই সবাই কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো চমকে উঠে। আমি নিজেও বুঝলাম না এতো চমকানোর কি আছে?
কিছুটা তোতলাতে তোতলাতে বললাম,”কি হলো? সবাই এভাবে তাকাচ্ছো কেনো আমার দিকে?”
মেজোচাচা ভ্রু কুঁচকে বললেন,”তুমি কি ওই জাফরানে লেখা অন্যভাষায় লেখা চিরকুটটার কথা বলছো সাজ?”
আমি অবুঝের মতোই মাথা নাড়লাম। সবাই এমন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে কেনো আমার দিকে?
বিড়বিড় করে বাবা বললেন,”এই রূপার বাক্সেই আমি গতকাল চিরকুটটা রেখেছিলাম। চাবির সাথে ওটাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু তুমি হঠাৎ ওটার কথা তুললে কেনো?”
আমার মনে হলো কেউ বুঝি আমার গলাটা চেপে ধরেছে। চিৎকার করে উঠতে মন চাচ্ছে আমার, কিন্তু কোনো অদৃশ্য শক্তি আমাকে চিৎকার করতে দিচ্ছে না।
হ্যা দাদী, দাদীর কাছে যেতে হবে আমাকে এখন। কোথায় গেলো সেই চিরকুট? কারণ এখন আমাকে তেতলার আতঙ্ক থেকে বেশি আতঙ্কিত করছে বাবার প্রাণ সংশয়।
আমি কারো দিকে না তাকিয়ে ছুটতে শুরু করলাম, পিছনে পড়ে রইলো কতো জোড়া সন্দেহপ্রবন চোখ।
দাদীর ঘরে ঢুকতে যাবো ঠিক এমন সময় কেউ আমার হাত শক্ত করে ধরে আমাকে টেনে আনলো। আমি ঝট করে পিছনে ফিরে দেখি মা।
মা ভ্রু কুঁচকে বললেন,”ওভাবে ছুটে এলি কেনো?”
“মা তুমি আমাকে আটকালে কেনো?”
“এখন দাদীর ঘরে কি কাজ তোর?”
“দাদীকে জানাতে হবে মা তেতলার চাবির কথা।”
“না, তিনি বয়স্ক মানুষ এখন এতোকিছু জানিয়ে কাজ নেই।”
আমি মায়ের হাত ছুটে চলে যেতে গেলে মা আরো শক্ত করে আমাকে চেপে ধরেন।
“কি বলছি কানে যাচ্ছে না তোর? আমাকে এখন সত্যি করে একটা কথার উত্তর দে।”
“তোমার সব কথার উত্তর পরে দিবো মা। এখন আমাকে দাদীর সাথে কথা বলতে হবে।”
“একদম চুপ সাজ। তুই সবার চোখ ফাঁকি দিতে পারবি, মায়ের চোখ কখনো পারবি না।”
আমি হতবাক হয়ে বললাম,”মানে কি মা? আমি কার চোখ ফাঁকি দিলাম?”
“কিছুই বুঝতে পারছিস না তাইনা? তোর মেজোচাচা সেদিন তাহলে ঠিক দেখেছিলো, তুই মাঝরাতে আমার আর তোর বাবার ঘরে গিয়েছিলি। কেনো গিয়েছিলি বুঝিনি আমি?”
আমি ভয়ার্ত গলায় বললাম,”কেনো গিয়েছিলাম?”
“ওই রূপার বাক্সের মধ্যে যে চাবি আছে ওটা আনতে।”
“মা এসব কি বলছো তুমি?”
“যা সত্যি তাই বলছি। ওই চাবি তুই সরিয়েছিস তাইনা? কার কথায়? ওই পাগল বুড়ির কথায়?”
“মা।”
“একদম চিৎকার করবি না। শোন ওসব ভূতপ্রেত কিছু না। তোর দাদাকে এই পাগল বুড়িই মেরেছে। সিঁড়ি থেকে কে ধাক্কা দিয়েছিলো তাকে? তোর দাদী আর দাদা ছাড়া কেউ এখানে ছিলো না সেদিন, পড়ে যাওয়ার পরেও প্রথম দেখেছিলো তোর দাদী। শুকনো খটখটে জায়গা, তোর দাদা এমনি এমনি পড়ে গেলো? আর তোর মেজোদাদাজানকে কে আত্মহ*ত্যার জন্য প্ররোচিত করেছে তুই জানিস? এই তোর দাদী। আর এগুলো কেনো করেছে তুই জানিস? তার বাবা মায়ের হ*ত্যার প্রতিশোধ নিতে। মীর মতলেব খাঁ কে উনিই প্রতিরাতে নির্যা*তন করতো, এরপর শেষে একদিন মেরেই ফেললো। শুধু তাই না, এই মীরবাড়ির র ক্ত যার যার শরীরে আছে সবাইকে উনি মেরে ফেলবে। তোর বাপ, চাচা, তোর আপা, তোকে কাউকে বাঁচতে দিবে না উনি। পুরোটাই একটা রহস্য সৃষ্টি করে তার কাজ হাসিল করে নিবে উনি।”
মা এইটুক বলে থামলেন। আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করছে মায়ের কথা শুনে। মা এসব কি বলছে?
“কিন্তু ছোট দাদাজান? উনি তো বেঁচে আছেন, দাদীই তাকে বাঁচিয়েছেন।”
“তাকেও তোর দাদী মেরে ফেলতে চেয়েছিলো। কিন্তু সে সবসময় তার বাবা মানে মীর মতলেব খাঁ এর বিরুদ্ধে ছিলো, আর তোর দাদীর পক্ষে কথা বলতো। তাই সে বেঁচে যায়।”
আমি কানে হাত দিই। এতো কথা আমি আর শুনতে পারছি না। বিশ্বাস অবিশ্বাসের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি আমি।
“এরপরেও যদি তোর দাদীর উপর তোর অগাধ বিশ্বাস থাকে তবে যা। মনে রাখিস কেউ বাঁচবি না উনাকে বিশ্বাস করলে।”
আমি দাদীর ঘরের সামনেই মেঝেতে বসে পড়লাম। মা কোনো কথা না বলে সেখান থেকে চলে যান। আমার মাথা যন্ত্রণা করছে অসহ্যরকম।
হঠাৎই মিষ্টি করে দাদীর ডাকে আমার সম্বিৎ ফিরে পায়।
“সাজবুড়ি, ভিতরে আসবি না সোনা?”
দাদীর ডাকে যেনো মোহ লেগে আছে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাদীর ঘরে ঢুকলাম।
“দাদী।” আমার চোখে টলমল করছে পানি।
“আয়, বোস আমার পাশে।” দাদীকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে, একদম স্নিগ্ধ সুন্দর। মনে হচ্ছে কেবলই দুধস্নান করে এসেছে।
আমি দাদীর পাশে যেয়ে বসলাম। মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে দাদীর শরীর থেকে।
“তোকে এমন দেখাচ্ছে কেনো রে সাজবুড়ি? মা বকেছে?”
“তুমি কি কিছুই জানো না দাদী? নাকি জেনেও না জানার ভান করছো?”
দাদী হামানদিস্তায় পান বাটছিলেন। আমার কথা শুনে কাজ থামিয়ে অবাক হয়ে তাকালেন আমার দিকে।
“কি বলছিস? কি জেনেও না জানার ভান করছি?”
“তেতলার চাবি পাওয়া যাচ্ছে না।”
দাদীর হাত থেকে হামানটা নিচে পড়ে গেলো, ঠনঠন করে শব্দে গড়িয়ে যেতে লাগলো ওটা।
“তুই কি বলছিস? মাথা ঠিক আছে তোর?”
“কেনো দাদী? কিছুই জানো না তুমি?”
“হায় আল্লাহ গো! এ কি সর্বনাশ হলো গো।”
আমার আজ কেনো জানি দাদীর এই চিৎকারটা আজ মিথ্যা মনে হচ্ছে। তবে কি মায়ের কথা আমি বিশ্বাস করা শুরু করেছি?
“কাল সাঁঝদাদুকে যখন জংলা থেকে নিয়ে আসা হলো তখন তার কপালে সাতটা পোড়া মরিচ ছোঁয়ানো হয়েছিলো?”
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকি।
“কি হলো চুপ করে আছিস কেনো? বল।”
আমি শান্তভাবে না-সূচক মাথা নাড়ি।
দাদী যেনো পাথর হয়ে গেছেন।
“আরো একটা কথা, ওই চিরকুটটাও পাওয়া যাচ্ছে না, যেটা কাল বাবা পেয়েছিলো।”
দাদী কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে চিৎকার করতে থাকেন।
আমি কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে বলি,”নিজেই এসব করে এই নাটকগুলো করছো তুমি তাইনা?”
দাদী হঠাৎ কান্না থামিয়ে বোবাদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকান। কিন্তু সেই দৃষ্টি দেখে আমার একটুও আর মায়া লাগছে না,যদিও সব সত্যি আমি জানিনা।
“তুই কি বললি সাজদাদু?”
আমি উঠে দাঁড়িয়ে চেচিয়ে উঠি।
“কি বলবো দাদী? ভূতপ্রেত বলে কিছুই হয়না। হ্যা এটা ঠিক তোমার বাবা মাকে খুব অন্যায় ভাবে এই বাড়িতে খু*ন করা হয়েছিলো। তার মানে তো এটা না, এই বাড়ির র ক্ত যার যার শরীরে আছে সবাইকে তুমি মেরে ফেলবে। নিজেকে একটা রহস্যের মধ্যে ঘিরে রেখে সবাইকে বোকা বানাচ্ছো আর একের পর এক নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করে যাচ্ছো। এতোদিন অন্ধের মতো তোমার সব কথা বিশ্বাস করেছি আমি। আপাকে অবিশ্বাস করেছি। আপাকে তো একটা পুতুল বানিয়ে রেখেছো তুমি। একবার তাকে দিয়ে আমাকে এক কথা বলাও, আবার আমাকে আপার নামেই অন্য কথা বলো। শেষমেশ নিজের ছেলেদেরও নিজের রোষানল থেকে মুক্তি দিলে না? কি দোষ আমার বাবার? হ্যা সে এই মীর বাড়ির সন্তান, কিন্তু সে তো তোমারও সন্তান দাদী। তোমার একটুও হাত কাঁপবে না তাকে মারতে? এবার কি করবে? মেজোচাচা আর ছোট চাচাকেও মারবে? এরপর কার পালা হবে? আপা আর আমি এরপর এ বাড়ির ছোট ছোট বাচ্চাগুলো? এরপর তোমার শান্তি হবে তো দাদী? তুমি একা একা পচে মরবে এই বাড়িতে। কেউ আসবে না তোমাকে দেখতে।”
আমি এতোটুকু বলে বড় বড় নি:শ্বাস ফেলতে থাকি। দাদীর দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারি দাদী স্তম্ভিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কেনো জানি তাকাতেও ইচ্ছা করছে না দাদীর সুন্দর মুখটার দিকে। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলিনা আমরা।
নীরবতা ভাঙেন দাদী।
“তুই মনে করিস এসবই আমি করেছি?”
“আমি মনে করছি না দাদী। সত্যিই এতোদিন অন্ধবিশ্বাস করেছি আমি। আজ মা আমাকে সবটা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে না দিলে এখনো অন্ধই থাকতাম আমি। ঠিকই তো, তুমি কীভাবে জানলে ওই চিরকুট পানিতে ভিজিয়ে কোনো গাছের গোড়ায় দিলে গাছ মরে যাবে? তবে কি ওই চিরকুটের জাফরানে বিষ মেশানো আছে? যদি তাই থাকে তুমি কীভাবে জানলে? আর আপাকে যে কাল ওই জংলায় পাওয়া যাবে তুমি কীভাবে জানলে? যদি তাই জানতে তাহলে সারাদিনে কেনো জানাওনি? সন্ধ্যার পরই কেনো জানালে? সারাটা দিন আমার বোনটা ওইরকম একটা নোংরা জায়গায় পড়ে আছে। আর তুমি জানালে কিনা সন্ধ্যায়?”
“আমি একটা বিছানায় পড়া মানুষ। আমি কীভাবে এসব করবো?”
“তুমি কীভাবে এগুলো করেছো নাকি কাউকে দিয়ে করিয়েছো তাতো আমি জানিনা। তবে এগুলো যে তোমার মৃ*ত বাবা মা করিয়েছে এসব আর বিশ্বাস করাতে পারবে না আমাকে। মৃ*ত মানুষ কখনো ফিরে এসে প্রতিশোধ নিতে পারে না।”
“সাজদাদু, পৃথিবীতে অনেক কিছুই হয় যা আমরা জানিনা, অথচ সবই হয়।”
“দয়া করে এসব নাটক বন্ধ করো তুমি। এসব থামাও। তোমার ছেলের উপর তোমার কোনো মায়া মমতা না থাকতেই পারে, কিন্তু আমার বাবা আমাদের কাছে সব। আমরা আমাদের বাবাকে তোমার হাত থেকে বাঁচাবো। তুমি যা করার করে নিও, আমিও দেখবো কি করতে পারো তুমি। আর আপাকে দিনের পর দিন নিজের ঘরের মধ্যে ডেকে এসব ভুলভাল বুঝিয়ে নিজের দলে নিতে চাচ্ছো তাইনা? তা হবে না, আমি আর তা হতে দিবো না।”
“তোর মনে হয় আমার ছেলেকে, আমার স্বামীকে আমি মারতে চাই?”
আমি কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকলাম। আজ বুঝলাম কেনো মা চাচীরা দাদীকে পাগল বুড়ি বলে ডাকে। দাদী বাবা মায়ের এমন মৃ ত্যুতে আসলেই পাগল হয়ে গেছে। প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে যা মন চাচ্ছে করে যাচ্ছে। আজ মা আমাকে সব বুঝিয়ে না বললে আমি তো বুঝতামই না।
দাদী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,”এতোদিন আমি জানতাম আমার বাড়ির বউরাই বুঝি আমাকে অবিশ্বাস করে। তোদের দুই বোনের উপর আমার বিশ্বাস ছিলো, তোরা আমাকে বিশ্বাস করবি। আজ যখন তোরাও আমার বিপক্ষে, আজ থেকে তোদের আর কিছুতেই আমি নেই। ভুলে যা, এই বাড়িতে তোর দাদী বলে কেউ আছে। তোদের যে কোনো বিপদে আমি আমার জীবন দিয়ে ঢাল হয়ে দাঁড়াবো। এই ঘরে তোরা আর আসবি না। চলে যা, চলে যা।”
আমি কোনো কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। দাদীর জন্য কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু দাদী তার বাবা মায়ের মৃ*ত্যুর প্রতিশোধ হিসেবে যে পথ নিয়েছে তা একেবারেই অন্যায়।
“দাদী তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
দাদীর চোখে পানি টলমল করছে, খুব মায়া লাগছে আমার দেখতে। কিন্তু কিছুই করার নেই। অন্যায় যে করবে তাকে শাস্তি পেতেই হবে।
“বল কি বলবি।”
“তোমার বাবার নাম কি ছিলো?”
“শাহনেওয়াজ আফসার।”
“আর তোমার মায়ের নাম?”
“আয়েশা আফসার।”
আমি একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। কোথাও যেনো রুহজানিয়া নামটা খুব অস্বস্তি দিচ্ছিলো আমাকে। বারবার মনে হচ্ছিলো নামটার সাথে দাদী কোনোভাবে জড়িত। আমি মনে মনে স্বস্তি পাই। তাহলে কাল রাতের ব্যাপারটা পুরোটাই আমাএ ভ্রম ছিলো। দাদীই এসব আমার মাথায় ঢুকিয়েছে তাই স্বপ্নেও এসব দেখছি আমি। আর আমিও কি বোকা! এসব ভেবে আবার ভয়ও পাচ্ছি, মনে মনে হেসে দিই আমি।
“কিন্তু।”
দাদীর কথা শুনে একটু ভ্রু কুঁচকে তাকাই আমি।
“কিন্তু কি দাদী?”
“আমার মায়ের নাম আয়েশা রাখা হয়েছিলো বাংলাদেশে আসার পর। কারণ পারস্যে তার যে নামটা ছিলো এখানে অনেকেই সেই নামটায় তাকে মেনে নিতে পারতো না।”
হঠাৎ আমার বুকে হাতুড়িপেটা শব্দ হতে থাকে।
তোতলাতে তোতলাতে বললাম,”কি নাম দাদী?”
“কেনো? তা জেনে তুই কি করবি?”
“বলো।”
“রুহজানিয়া আফসার।”
আমার কাছে যেনো প্রতিধ্বনি হয়ে চারদিক থেকে একটা নাম ভাসতে থাকে,”রুহজানিয়া, রুহজানিয়া, রুহজানিয়া।”
এই নাম তো আগে আমি শুনিনি দাদীর কাছে, তবে কাল রাতে এটা আমি কীভাবে স্বপ্নে দেখতে পারি?
তবে কি দাদীর কথা সত্যি? আমি কি ভুল করে ফেললাম কোনো? মাথাটা ঘুরতে থাকে আমার, মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে আমি পড়ে যাবো।
“দাদী দাদী।”
আপার চিৎকারে আমি আর দাদী দুইজনেই দরজার দিকে তাকাই।
“দাদী গো, বাবাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। শেষবার নাকি তাকে তেতলার সিঁড়িতে দেখা গিয়েছিলো। বাবা কোথায় গেলো দাদী?”
আমি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দাদীর দিকে তাকাই, তার চোখমুখ শক্ত।
“যা সাজ, বাবাকে বাঁচানোর সময় হয়েছে, বাঁচা তোদের বাবাকে তোরা।”
এখন কি করবো আমি? কীভাবে বাঁচাবো বাবাকে?
(চলবে….)