(তেতলায় কি আছে সেই রহস্য ফাঁস)
আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি দাদীর সামনে। আমি জানিনা এখন আমার কি করা উচিত। আপার দিকে তাকালাম আমি। আপার চোখেমুখে দুশ্চিন্তা। তবে কি আপার অন্য সত্ত্বা এখন তার মধ্যে নেই? নিজের চিন্তায় নিজেই অবাক হলাম। এই মাত্রই আমি দাদীকে অবিশ্বাস করে কতোকিছু বললাম, আপার দ্বিতীয় সত্ত্বা বলে যে কিছু নেই। সেই আমি-ই কিনা আবার অন্যকিছু ভাবছি। তবে যে গতকাল রাতে আমি ওই ডায়েরিতে রুহজানিয়া নামটা দেখেছি। সব যদি দাদীই করিয়ে থাকেন ওই নাম কীভাবে জানলাম আমি? দাদী নির্লিপ্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমি কাঁদতে কাঁদতে যেয়ে দাদীর পা ধরলাম,”দাদী, আমার বাবা তো তোমারও ছেলে। তাকে বাঁচানো কি তোমারও দায়িত্ব না? আমি যদি কোনো অন্যায় করে থাকি সেই শাস্তি তুমি আমাকে দাও দাদী। কিন্তু যা কিছুর বিনিময়ে হলেও আমার বাবাকে বাঁচাতে হবে।”
দাদী আমার মাথায় হাত রাখলেন।
“এই বিপদের আশংকা অনেক আগে থেকেই করেছি আমি। তেতলার চাবি আমি নিজের কাছেও কখনো রাখিনি। তোর বাবার কাছে রেখেছি যাতে ওটা সুরক্ষিত থাকে। আমি গতকাল সত্যিই সারাদিনে জানতাম না সাঁঝ কোথায়। যখন আমাকে জানানো হলো, তখন সন্ধ্যা। আমি তোদের বারণ করেছিলাম ওকে ওভাবেই ঘরে নিয়ে না আসতে। সাতটা মরিচ পোড়া ওকে ছুইয়ে আনতে। কিন্তু তোরা আমার কোনো কথা শুনিস নি। ওর মধ্য দিয়েই কাল উনাদের একজন এই সাঁঝবাতির সাজবাড়ির আঙিনায় ঢুকে গেছেন। আর তিনিই তোর বাবার ঘর থেকে ওই রূপার বাক্স বের করে এনেছেন। তেতলা এখন আর বদ্ধ নেই।”
আপার মুখ দেখে কেমন ভীত মনে হলো৷ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না দাদীর কথা।
“দাদী এসব কি বলছো তুমি? কে ঢুকেছে বাড়ির আঙিনাতে? আর তেতলায় বদ্ধ কে?”
দাদীর চেহারায় হঠাৎ করেই রাগ ফুটে উঠতে শুরু করলো। তার ফর্সা মুখটা মুহুর্তেই কালো বর্ণ ধারণ করতে শুরু করলো ক্ষোভে।
“সে রাতে মীর মতলেব খাঁ এর লোকেরা আমার সামনেই আমার মৃ ত বাবাকে টানতে টানতে ওই জংলায় নিয়ে মাটি চাপা দিয়ে দেয়। আমি চিৎকার করে কাঁদতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কেউ একজন শক্ত করে আমার মুখ চেপে ধরে রেখেছিলো। কেউ কেউ বলছিলো আমাকেও মেরে ফেলবে। কিন্তু মীর মতলেব খাঁ এর হয়তো অন্য চিন্তা ছিলো। যেহেতু সেদিন সকালেই আমার বাবার সাথে তার দ্বন্দ্ব বেঁধেছিলো। তাই গ্রামের লোক সহজেই চিন্তা করতে পারতো বাবা মা নিখোঁজ হওয়া মানেই এখানে মীর মতলেব খাঁ এর হাত আছে৷ তাই উনি আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে মহৎ সাজার জন্য। আমি তেতলার বারান্দা থেকে দেখলাম দূরের ওই জংলাটায় মীর সাহেবের চ্যালাগুলো আমার বাবাকে গর্ত করে পুঁতে রাখলো। চিৎকার করার কোনো উপায় আমার ছিলো না। এক পুরুষালি হাত শক্ত করে আমার মুখ চেপে ধরে রেখেছিলো। আমার দু’চোখ বেয়ে শুধু অঝোরে পানি পড়ে যাচ্ছিলো। আমি তখনও আমার মৃ ত মা কে দেখতে পাইনি বা আমাকে দেখতে দেওয়া হয়নি।”
এটুকু বলে দাদী থামেন। তার মুখের রাগ মিলিয়ে যেয়ে সেখানে এক রাশ কষ্ট ভর করতে শুরু করেছে। আমার নিজের চোখেও পানি। আপাকে দেখলাম মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। আপা কি এসব আগে থেকেই জানে?
“তারপর কি হলো দাদী?”
“আমার চোখের সামনেই আমার বাবাকে পুঁতে ফেলা হলো। তখন ভোরের আলো কেবল ফোঁটা শুরু করেছে। সেই আবছা আলোয় শেষবারের মতো আমার বাবার মুখ খানা দেখলাম। ঠিক এরপরেই ওরা ঠিক করে একইভাবে আমার মা কে একই জায়গায় পুঁতে ফেলার ষড়যন্ত্র করছিলো। ঠিক এমন সময় এক বিপত্তি বাঁধে।”
“কি বিপত্তি দাদী?”
“মীর মতলেব খাঁ যেহেতু গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলো, তাই যে কোনো বিচার কাজে মানুষ মোড়লের কাছে না যেয়ে তার কাছেই আসতো। সেদিন ওই ভোরবেলাতেই গ্রামের দুই পক্ষ কিছু একটা নিয়ে মারামারি করায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাই তারা তখনই ঠিক করে মীরবাড়িতে এসে উপস্থিত হয় বিচারের জন্য। আর তখন বিচারের জন্য আলাদা কাচারি ঘর ছিলো ওই জংলাটার একটু পাশেই। মীর মতলেব খাঁ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। তিনি মায়ের মৃ*তদেহ নিয়ে বিপাকে পড়েন। কারণ একটু পরেই সকাল হলে তেতলায় তার স্ত্রী সহ তিন ছেলে আর কাজের লোক সবারই আনাগোনা হতে থাকবে। তিনি কখনোই তার পরিবারের কাছে নিজের আসল রূপ দেখাতে চাইতেন না। যদিও তার বড় ছেলে মানে তোর দাদা সবই জানতেন। তখনই মীর মতলেব খাঁ সেই সিদ্ধান্তটা নেয়, যা এখনো এই বাড়ির জন্য হুমকিস্বরূপ।”
“কি সিদ্ধান্ত দাদী?”
“আমার মা কে সেই ঘরেই ইটের মধ্যে গর্ত করে পুঁতে ফেলা হবে।”
শুনেই আমি চিৎকার করে উঠলাম,”কি বলছো দাদী?”
দাদীর গলার স্বর এখনো শান্ত।
“হ্যা আর তারা ঠিক সেই কাজটাই করে। আমি তখন জ্ঞান হারাতে বসেছি প্রায়। রাত থেকে নিজের সামনে হওয়া এতো ঘটনা দেখে আমি নিজেকে আর সামলাতে পারছিলাম না। শেষবারের মতো আমি মীর মতলেব খাঁ এর পা ধরে অনুরোধ করলাম আমার মায়ের মরামুখটা যেনো আমাকে দেখতে দেওয়া হয়। আমি আর কোনোদিন তার কাছে কোনো অনুরোধ করবো না। কিন্তু সেদিন তিনি আমার কোনো কথা শোনেন না। তার লোকদের নির্দেশ দিলেন আমাকে যেনো সেখান থেকে নিয়ে চলে যাওয়া হয় এবং বার বার করে তার লোকদের সাবধান করে দিলেন যেনো আমার গায়ে কোনো আচড় না পড়ে। এরপর আমি আর কিছুই জানিনা। আমাকে একটা ঘরে বন্দী করে রাখা হয়। আমি শুধু জানি আমার মা কে ওই তেতলারই কোনো এক ঘরে পুঁতে রাখা হয়েছে। এরপর আর কিছুই জানিনা।”
আমার গাল বেয়ে যে কখন যে টপটপ করে পানি পড়া শুরু হয়েছে আমি জানিনা। এটুকু জানতাম যে দাদীর সামনেই তার বাবা মাকে নির্মমভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। কিন্তু সেই দুর্ভাগ্য মানুষ দু’জনের কপালে যে জানাযা বা শেষ গোসলটুকুও জোটেনি এটা জানতাম না। আর এই বাড়িতেই মানুষ দু’জনের মৃ*তদেহ রয়েছে এভাবেই?
“তার কিছুদিন পর তোদের দাদার সাথে আমার বিয়ে দেওয়া হয়। আমি তখন মানুষ না, চাবি দেওয়া পুতুলে পরিণত হয়েছিলাম। আমাকে যা বলা হতো তাই করতাম। মুখ খুললেই আমাকে পাগল বলে আমার উপর নি’র্যাতন চালানো হতো।”
“দাদাজান কিছু বলতেন না?”
“না। উনি ততদিনে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে খারাপ সঙ্গে পড়ে বখে যেতে শুরু করেছেন। ঘর সংসারের দিকে কোনো মন ছিলো না তার। আর মীর মতলেব খাঁ এর সাথে আমার উপর নি’র্যাতন চালাতো তোর দাদার মেজো ভাই, মানে তোদের মেজো দাদাজান। আমি মুখ খুললেই আমাকে ঘরে বন্দী করে রাখা হতো, খেতে দেওয়া হতো না। ভয়ে আমি কখনো মুখ খুলতাম না। আবার মাঝে মাঝে আমার সাথে হওয়া অন্যায় সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে উঠতাম। তখন আমাকে রাতের অন্ধকারে একটা ঘরে বন্ধ করে রাখা হতো তেতলার এক পরিত্যক্ত ঘরে। সেখানে ইঁদুর,ছাড়পোকা সহ অনেক পোকামাকড়ের আখড়া। এরকমই একদিনে আমি অন্ধকার ঘরে বসে ভয়ে কাঁপছি। ঠিক এমন সময় আমি এমন কিছু টের পেলাম যা আমি আগে কখনো দেখিনি, আগে কখনো শুনিনি।”
“কি দাদী?”
“আমার বাবা আসা শুরু করে আমার কাছে।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,”মানে? তোমার বাবা আসা শুরু করবে কীভাবে? উনি তো তখন মারা গিয়েছেন।”
“সত্যি না, স্বপ্নে। তারা খুব কষ্টে আছেন। এভাবে অভিশপ্ত অবস্থায় তাদের থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে তাদের জানাযার ব্যবস্থা করতে বলেন। আমি প্রথম প্রথম খুব ভয় পেতাম স্বপ্নটা দেখে। কিন্তু আস্তে আস্তে রোজ ওই স্বপ্ন দেখা শুরু করি আমি। একদিন আমি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ওই জংলার কাছে যাই যেখানে আমার বাবাকে রাখা হয়েছে। আর সেদিন আমি সাঁঝের মতো অজ্ঞান হয়ে যাই। আমাকে এই বাড়িতে আনার পর আমি সম্পুর্ণ অন্য মানুষ। আমি সকালে ঠিক থাকি, রাত বারোটার পর থেকে আর কোনো কথা আমার আর কিছু মনে থাকে না। পরে অন্যদের কাছে শুনতে পারি রাতে নাকি আমি অন্য মানুষ হয়ে যেতাম। আমার শক্তির কাছে কেউ পারতো না। সবাই আস্তে আস্তে আমাকে ভয় পেতে থাকে। কিন্তু এসবের কিছুই আমার সকালে মনে থাকতো না। এরমধ্যেই প্রতিদিন সকালে শুনতাম আমার মীর মতলেব খাঁ নাকি রাতে তেতলায় কি নি’র্যাতন পেতেন। ততদিনে তিনি বিছানায় পড়ে গেলেন, শরীরে গন্ধ হতে থাকে। সবাই আমাকে দোষারোপ করতে থাকে। কিন্তু আমি তো কিছুই জানিনা। এভাবেই কোনো এক রাতে মীর মতলেব খাঁ এর মৃ ত্যু ঘটে তেতলায়। আর তার নির্দেশে চিরদিনের মতো বন্ধ হয় তেতলা। এরপর তোর দাদাজানেরা মিলে একটা নামকরা কবিরাজ ডেকে বাড়ি বন্ধের ব্যবস্থা করেন। তখন সেই কবিরাজ জানায় আমার উপর কিছু একটা আছড় রয়েছে। তিনি কিছু মন্ত্রের সাহায্যে নাকি সেই আছড়কে ওই জংলায় আটকে রাখেন। এরপর সবাইকে নির্দেশ দিয়ে যান ওখানে যেয়ে কেউ অজ্ঞান হয়ে গেলে তাকে যেনো এমনিতেই নিয়ে আসা না হয়। সাতটা মরিচ পোড়া তার শরীরে ছুঁইয়ে তাকে যেনো আনা হয়। আর সেই কথাই আমি কাল তোদের বলেছিলাম। আমার এখন যতদূর মনে হচ্ছে সাঁঝের মধ্য দিয়ে সেই আছড় আবার এই বাড়িতে ঢুকেছে। আর সে-ই রাত বারোটার পর সাঁঝের শরীর দিয়ে ওই চাবি তোর বাবার ঘর থেকে উদ্ধার করেছে। তেতলা হয়েছে উন্মুক্ত।”
আপা চোখ বড় বড় করে দাদীর দিকে তাকায়। তার চোখে ভয় আর শরীরে কম্পন। আমি দাদীকে জড়িয়ে ধরি। আমাকে কাঁপতে দেখে দাদী আমাকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরেন।
“তোকে এখন ভেঙে পড়লে চলবে না সাজ। তোর এখন অনেক দায়িত্ব।”
“দাদী, আমি তোমার কাছ থেকে কিছু কথা লুকিয়েছি।”
আমাকে টেনে নিজের সামনে এনে দাদী বলেন,”কি লুকিয়েছিস?”
আমি দাদীকে গতকাল রাতের কথা সব বলে দিই। সেই ডায়েরিতে জাফরান দিয়ে লেখা সব কথা, রুহজানিয়ার নাম, সেই কাঁধের কাছে অপার্থিব গরম শ্বাস সবকিছু। সব শুনে দাদী আর্তচিৎকার দিয়ে ওঠেন।
“তুই এই কথা আমাকে এখন জানাচ্ছিস?”
“দাদী আমি ভেবেছিলাম সবই বুঝি আমার ভ্রম, দু:স্বপ্ন।”
“যা সর্বনাশ হওয়ার এতোক্ষণে হয়ে গেছে। কাল সাঁঝের শরীরে আছড় হওয়ার পর সে তেতলার চাবি উদ্ধার করে, আর তেতলাকে করে উন্মুক্ত। এরপর তেতলায় যে আছে সে দ্বিতীয় সত্ত্বা হিসেবে সাঁঝকে বেছে নিয়েছে। মানে সাঁঝ এখন যা করবে সেইটা সাঁঝ করবে না, তার দ্বিতীয় সত্ত্বা করবে।”
আপা চেচিয়ে উঠে বললো,”দাদী এসব ভুল। আমি এখন সাঁঝ। বিশ্বাস করো আমি সাঁঝ।”
“আমি জানি তুই সাঁঝ। দিনের বেলা তুই সাঁঝ থাকবি। কিন্তু রাত বারোটার পর তুই অন্য কেউ হয়ে যাবি।”
আমি ভয়ে ভয়ে বলি,”আপা কে হয়ে যাবে দাদী? রুহজানিয়া?”
দাদী কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। আমার ভীষণ কান্না পেতে থাকে।
“আর সেইটা হবে সবচেয়ে ভয়ংকর কিছু। কারণ তখন কেউ বাঁচতে পারবে না। মীর বাড়ির র ক্ত যার যার শরীরে আছে কেউ বাঁচতে পারবে না। কারণ সেই সত্ত্বা সবচেয়ে ভয়ংকর। এতোদিন সে অতৃপ্ত হয়ে তেতলায় বদ্ধ ছিলো। সাঁঝকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছে ঘুমের মধ্যে চাবি উদ্ধার করার। এজন্যই সাঁঝ সবসময় ক্ষিপ্ত থাকতো চাবির জন্য। যদিও ও নিজেও জানে না কেনো এমন হতো।”
আপা হতভম্ব হয়ে বললো,”তুমি কীভাবে এতোকিছু জানলে দাদী? এই স্বপ্নের কথা তো কাউকে বলিনি আমি।”
“আমি জানি কারণ সেই স্বপ্ন এই বাড়ির বউ হওয়ার পর আমিও দেখেছি। কিন্তু আমি চাইনি এই বাড়ির কারো ক্ষতি করতে। ততদিনে আমি তোদের বাবা চাচার মা। মা কীভাবে পারে সন্তানকে এতীম করতে বা সন্তানকে মারতে? তারা নিজেরা আসতে না পেরে স্বপ্নের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। তোকেও তারা নিয়ন্ত্রণ করেছে স্বপ্নের মাধ্যমে। তাই তুই এমন অস্থির থাকতিস তেতলার চাবির জন্য। তুইও আমার মতো স্বপ্ন থেকে নিজেকে সামলাতে পারিস নি। সেই স্বপ্নই তোকে কাল ওই জংলা পর্যন্ত নিয়ে গেছে।”
আমি আর আপা দুইজন দুইজনের হাত ধরে কাঁপতে থাকি।
আপা ভয়ে ভয়ে বলে,”এখন কি হবে দাদী?”
“আমাদের হাতে সময় আছে আজ রাত বারোটা পর্যন্ত। তোর বাবা হারিয়ে যায়নি। তাকে কিছুক্ষণের মধ্যেই পাওয়া যাবে। কিন্তু আজ রাতই শেষ। তোদেরকে এই মীর বাড়িকে অভিশাপ থেকে বাঁচাতে হবে।”
“কিন্তু দাদী তুমি কীভাবে জানলে বাবাকে এখন পাওয়া যাবে?”
“সেসব কথা বলার সময় এখন না। এখন তোদের অনেক কাজ।”
“কি কাজ দাদী? আমরা কি-ই বা করতে পারবো?”
“তোদের শরীরে এই মীর বাড়ির র ক্ত। তাই যা পারার তোরাই পারবি। আর কেউ না।”
“কি করবো আমরা?”
“যা বলবো মন দিয়ে শুনবি। কেউ কোনো প্রশ্ন করবি না।”
আমরা মাথা নাড়লাম।
“প্রথমেই তোদের যা করতে হবে, তোদের মেজো চাচাকে চোখে চোখে রাখতে হবে।”
আমরা দুইজন একসাথে কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করলাম,”দাদী কি বলছো? মেজো চাচাকে চোখে চোখে রাখবো কেনো? তারও কি জীবনে সংশয় আছে?”
দাদী বিরক্ত হয়ে বলেন,”সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবি। কিন্তু সেই সময় এখন না।”
আমরা চুপ করে গেলাম।
“এরপর তোরা তোদের বাবা পোঁছানোর আগেই তেতলায় যাবি। কোনোভাবেই যেনো তোদের বাবা আগে না যায়।”
আমি ভয় ঢোক চেপে আপার দিকে তাকাই। দেখলাম আপাও ভয় পেয়েছে। এই আপাই কিনা তেতলায় যাওয়ার জন্য কতো অস্থির ছিলো। সেই আপা এখন তেতলায় যাওয়ার কথা শুনে ভয় পাচ্ছে? এখন তো বুঝলাম আপা ওই স্বপ্নের নিয়ন্ত্রণে থাকতো।
“কিন্তু দাদী আমরা কীভাবে বুঝবো বাবা কখন যাবে?”
“তোরা রাত বারোটা বাজার সাথে সাথে তেতলার সিঁড়িতে উঠে যাবি। আজ কৃষ্ণপক্ষ, ঘোর অমাবস্যা। দুইজনই গোলাপজলে স্নান করে পরিষ্কার শ্বেতশুভ্র কাপড় পরে যাবি, হাতে থাকবে না কোনো আলো। শ্বেত কাপড়ের জন্য নিজেদের নিজেরা দূর থেকে দেখতে পারবি।”
ভয়ে আমার শরীর কাঁপতে থাকে। এ কোন বিপদে আমরা পড়লাম? আপার অবস্থাও আমার মতো।
“ভয় পাস না আমার সাঁজবুড়ি, সাজবুড়ি। আমি সবসময় তোদের সাথে থাকবো।”
“তুমি কীভাবে থাকবে দাদী? তুমি তো বিছানা থেকে কোথাও যেতে পারো না।”
“সেসব নিয়ে তোদের ভাবতে হবে না। সেই ব্যবস্থা আমি করবো।”
“এরপর ওখানে যেয়ে আমরা কি করবো দাদী?”
“ওখানে যেয়ে তোদের সেই ঘর খুঁজে বের করতে হবে যে ঘরে আমার মায়ের আত্মাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে।”
“এতো ঘরের মধ্যে আমরা কীভাবে জানবো দাদী যে তোমার মা কে কোন ঘরে মারা হয়েছিলো?”
“সে তো আমি জানিনা। তোদের সেইটা বের করতে হবে নিজের বুদ্ধি দিয়ে।”
উত্তেজনায়,ভয়ে দরদর করে ঘাম দিচ্ছে আমাদের শরীর দিয়ে।
“এরপর সেই ঘরে তোরা ঢুকবি। সাবধান কেউ কাউকে ছেড়ে এক পা-ও কোথাও যাবি না। দুইজন একসাথে থাকবি। ওখানেই তোদের বাবাকে দেখতে পাবি তোরা।”
আমরা দুইজন একসাথে চিৎকার করে উঠি,”বাবাকে? কিন্তু আমরা তো বাবার আগেই তেতলায় পৌঁছাবো। বাবা কীভাবে আমাদের আগে ওখানে যাবে?”
“তোরা আগে খুঁজবি সেই ঘর, কিন্তু তোদের বাবাকে তো খুঁজতে হবে না। তাকে তো সম্মোহন করে নিয়ে যাওয়া হবে। জংলা থেকে যে আত্মা সাঁঝের শরীর হয়ে এ বাড়িতে এসেছে সে আজ অন্য কারো শরীরে ভর করবে। সে-ও হবে এই মীর বাড়ির কোনো সন্তান। সেক্ষেত্রে তোদের ছোট চাচায় হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।”
“কেনো মেজোচাচা কেনো নয়?”
“সে কথা পরে বলবো। তোর ছোট চাচা আর বাবা দুইজনই সেক্ষেত্রে একসাথে তেতলায় থাকবে। ততক্ষণে সেই আছড় তোর ছোট চাচাকে ছেড়ে দিবে। আর তেতলার আত্মা ততক্ষণে দ্বিতীয় সত্ত্বা হিসেবে সাঁঝের শরীরে প্রবেশ করবে। সে-ই চাইবে সাঁঝের মাধ্যমে ওদের দুইজনকে মারতে। তখন সাজ তোকে এই তিনজনকেই বাঁচাতে হবে।”
আমার শরীর অস্থির লাগা শুরু হয়। ঘাম ছুটতে থাকে অজস্র।
“আমি কীভাবে পারবো দাদী?”
“আমি তোকে একটা সুতো দিবো। সেই সুতো তুই তোর বাম হাতের বাহুতে বাঁধবি। এই সুতো আমাকে সেই কবিরাজ দিয়েছিলো। আমি জানতাম একদিন না একদিন এই সুতোর আবার দরকার হবে। এতোদিনে দরকার হয়নি কারণ সাঁঝের আগে এই বাড়িতে আর কোনো মেয়ে হয়নি, আমারও তিন ছেলে। মীর বাড়ির মেয়ের শরীর ব্যতীত ওই আছড় বাড়িতে প্রবেশ করতে পারতো না। তাই এই সুতো এখন কাজে লাগবে। তুই এখনই এই সুতো হাতে বেঁধে নে। আয় আমি তোকে বেঁধে দিই।”
আমি ধীর পায়ে হেঁটে দাদীর পাশে যেয়ে বসি। দাদী কিছু একটা পড়ে প্রথমে আমার শরীরে ফুঁ দেন। এরপর সুতোটা আমার হাতে বাঁধতে যাবেন ঠিক এমন সময় আমাকে কেউ জোরে টেনে এনে দাদীর পাশ থেকে উঠিয়ে নেয়।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা তিনজন হতভম্ব। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম আর কেউ নয়, আমার মা।
মায়ের চোখ দিয়ে যেনো আগুন ঝরছে। দাদীর দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে মা।
দাদী আস্তে করে বললেন,”বউমা তুমি?”
“হ্যা আমি। কেনো ভাবতে পারেননি তাইনা আমি এখন চলে আসবো?”
“না এমন কিছু নয়। আসলে….”
দাদীকে কথা শেষ করতে দেন না মা।
“হয়েছে মা। এবার থামুন। অনেক নাটক দেখেছি আপনার। দয়া করে এবার আমার মেয়ে দু’টোকে ছেড়ে দিন। আপনাকে এতোদিন কিছু বলিনি আমি। আপনার জীবনে অনেক কষ্ট তাই। কিন্তু আর না। যথেষ্ট করেছেন। ভুলভাল বুঝিয়ে আমার মেয়ে দু’টোর মাথা খাবেন না। আপনাকে অনুরোধ করলাম আমি। এরপরও আপনি এসব বন্ধ না করলে আমি অন্য ব্যবস্থা নিবো।”
“কি ব্যবস্থা নেবে বউমা?”
“আমার মেয়েদের নিয়ে এই বাড়ি ছাড়বো। আপনার ছেলে কি করবে তার ব্যাপার। কিন্তু আমি আমার মেয়েদের একটা পাগলের সংস্পর্শে রেখে তাদের জীবন নষ্ট করতে পারবো না।”
আমি আর আপা এবার একসাথে চিৎকার করে উঠি,”মা দাদীকে তুমি পাগল বলবে না। তুমি একদম দাদীর সাথে এভাবে কথা বলবে না।”
মা কঠিন দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকালেন। আমরা চুপ হয়ে গেলাম। দাদী শান্তই আছেন।
“ভাগ্যিস আমি এখানে এসেছিলাম। তোমাদের বাবাকে পাওয়া গেছে এটা জানাতেই এসেছিলাম আমি। না হলে তো জানতেই পারতাম না আমার মেয়েদের পাগল বানানোর প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই।”
এই বলে মা টানতে টানতে আমাদের ঘরের বাইরে নিয়ে যেতে লাগলেন। আমরা কোনোভাবেই ঘর ছাড়বো না। এখনো যে অনেক কিছু শোনার বাকি দাদীর কাছ থেকে। আজই যে শেষ সময়।
“আজ সারাদিন তোমরা নিজেদের ঘরে বন্দী থাকবে। একদম বের হবে না। খাবার দাবার সব ঘরেই হবে। এই ঘরেও তোমাদের আসা বন্ধ।”
আমরা দুই বোন আতঙ্কিত হয়ে একে অন্যের দিকে তাকালাম। মা যদি সত্যিই এই কাজ করেন সব তো শেষ হয়ে যাবে।
(চলবে….)