রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৫৮
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
পাতা ঝরা হেমন্ত যখন দুয়ারে এসে দাঁড়াল, তখন গিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ফেরার সময় হলো আমার। ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশা আর কোথা থেকে ছুটে আসা শিউলি ঝরা গন্ধ মুঠোয় নিয়ে ময়মনসিংহে পা রাখলাম আমি। পরিবর্তন, পরিবর্ধনের কাটছাট। পরিচিতের দেয়াল পেরিয়ে, খোলা আকাশের নিচে নিজের মুখোমুখি হওয়ার পর আমি তখন অন্য মানুষ। শান্ত, স্থির। আগের থেকে বুঝি একটু পরিণতও।
ময়মনসিংহ ফিরে এসেই হাসপাতালে হানা দিলাম আমি। তকতকে, ঝকঝকে হাসপাতাল কেবিনে শুরু হলো আমাদের ছোট্ট হাসপাতালীয় সংসার। পাশাপাশি দুটো বিছানা, এক চিলতে বারান্দা আর আমরা পাঁচজন মানুষ। অথচ কত প্রশান্তি! মায়ের প্রতি বাবার নিশ্চুপ যত্ন। সবার চোখের আড়ালে স্বচ্ছ আদর মেখে মায়ের দীর্ঘ চুলে বাবার বিনুনি করার চেষ্টা। দিন-রাত পাশের চেয়ারটিতে ঠাঁই বসে থাকা।
কাঁথার আড়ালে খুব সন্তপর্ণে মায়ের রুগ্ন হাতটা চেপে রাখা। সবই যেন এই কংক্রিটের জীবনে মৃদুমন্দ ভালো লাগা। চট্টগ্রাম থেকে ফেরার দিন তিনেক পর ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল হলো। আমার জীবনে যে আশ্চর্য প্রাপ্তিগুলো আছে? সেই আশ্চর্য প্রাপ্তির সংখ্যাটাকে আরও একটু ভারী করতেই মেধাতালিকায় আমার রোলটা জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠল। আমি অবাক হলাম। প্রথম প্রেমের মতো উত্তেজনা হলো। কাঙ্ক্ষিত মুক্তির আশায় কান্না পাওয়ার মতো আনন্দ হলো।
বুক ধরফর খুশি নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় একদম নির্লিপ্ত হয়ে বসে রইলাম। বহু ঝড়-ঝঞ্ঝা, ডিপ্রেশন, নিজস্ব দুঃখ-কষ্টের আড়ালে যে মায়াময় মামানিকে ভুলে বসেছিলাম। সেই মামানিকে খুব সুখের দিনটিতে আচমকা মনে পড়ে গেল। মানুষটা কেমন আছে? কতদিন দেখা হয় না মামানির সাথে! মামানিও যে এলো না একবার? শুভ্র ভাইয়ের মতো মামানিও কী….? আমার ভাবনার মাঝেই ফোন বাজল। ফোন তুলতেই ভাইয়ার প্রশ্ন,
‘ চা খাবি? খেলে নিচে চলে আয়। আমি হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মামানির চিন্তাটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়ে চায়ের প্রতি লোভ হলো। রাত তখন দুটো বাজে। হেমন্তের মৃদু ঠান্ডা ভাব। এমন নির্ঘুম, শীতল রাতে টং দোকানের চা হলে মন্দ হয় না। চট্টগ্রামের রেজাল্টটা পেয়ে পাথর চাপা হৃদয়টা এবার বেরিয়ে আসতে লাগল। নিঃশ্বাস নিতে লাগল। অল্প অল্প খুশি হতে লাগল। আমি গুনগুনিয়ে গাইতে গাইতে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলাম। দীর্ঘদিন পর নীল-সাদার দুনিয়ায় উঁকি দিলাম।
সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার ছোট্ট, সুন্দর একটা জগৎ আছে। নিজস্ব মন খারাপের খেয়াল রাখতে রাখতে বহুদিন হলো সেই দুনিয়ার খেয়াল রাখা হয় না। তাদের হাসি-আনন্দে সঙ্গ দেওয়া হয় না। সিঁড়ি বেয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে আসতেই আচমকা পা জোড়া থমকে গেল। পরিচিত এক চেহারার মুখোমুখি হয়ে ফোন থেকে মনোযোগ হটালাম। সামনের মানুষটিও বুঝি অবাক হলো। বিস্ময় নিয়ে ঘড়ি দেখল। শুধাল,
‘ এতো রাতে হসপিটালে? এভ্রিথিং ইজ ওকে রোদেলা? কেউ অসুস্থ নাকি?’
অনিচ্ছা স্বত্তেও কপালের উপর মৃদু ভাঁজ পড়ল। এপ্রোন গায়ে ভীষণ সুন্দর মেয়েটির দিকে চেয়ে অল্প কথায় উত্তর দিলাম,
‘ আম্মুকে ভর্তি করা হয়েছে। এখন ভালো আছেন। আউট অব ডেঞ্জার।’
তাসনিম আপুর চোখে আজ ভারী চশমা। ডানহাতে গুটিয়ে রাখা স্টেথোস্কোপ। হয়তো নাইট ডিউটি করছেন। আমার কথায় বেশ কৌশলে ভ্রু বাঁকালেন। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,
‘ তাই নাকি? আমাকে জানাওনি কেন? এই হসপিটালেই আছি। কিছু হলেও সাহায্য করতে পারতাম।’
আমি মৃদু হাসলাম। তাসনীম আপুর দূর্দান্ত একটা গুণ হলো, অন্যের প্রতি তিক্ত অনুভূতিটা উনি খুব যত্ন করে লুকিয়ে যেতে পারেন। এইযে উনি আমায় একবিন্দু পছন্দ করেন না, তা উনার সুন্দর চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই। তার চেহারা ফুটন্ত পদ্মফুলের মতো সর্বদাই ফুটন্ত। আমি মুখের হাসি ধরে রেখে বললাম,
‘ এখানে আমার একজন কাজিন আছেন। সার্জন। উনিই দেখাশোনা করছেন পুরো ব্যাপারটা। ইট’স টোটালি অল রাইট।’
তাসনিম আপু সুন্দর করে হাসলেন। সাথে সাথেই আমার মনে হলো, শুভ্র ভাই খুব ভুল করেছেন। মারাত্মক ভুল। রূপ বড়ো সত্য জিনিস। এমন চরম সুন্দরী মেয়ের সাথে শুভ্র ভাইয়ের নিষ্ঠুর বিচ্ছেদ করাটা উচিত হয়নি। আমি হলে কক্ষনো করতাম না। নৈব নৈব চ।
‘ ওহ্ আচ্ছা। তা, কোথায় যাচ্ছ?’
তাসনিম আপুর প্রশ্নে ভাবনার দেয়ালটা পেরিয়ে এলাম আমি। বললাম,
‘ এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করছিলাম। তেমন কিছু না।’
‘ তাড়া না থাকলে আমার কেবিনে এসে বসো না। একসাথে চা খাই?’
তাসনিম আপুর সহাস্য প্রস্তাবটা সহাস্যেই ফিরিয়ে দিলাম আমি। কুটিল মন বহুদিন পর সজাগ হলো। চোখ সরু সরু করে শুধাল, এই ভদ্রমহিলার আজ হলোটা কী? তোর প্রতি এতো আপ্লুত ভালোবাসায় বা আসছে কেন? চায়ে সায়ানাইড মিশিয়ে হত্যার পরিকল্পনা টরিকল্পনা করছে না তো? ইয়া মা’বুদ! আমি আঁতকে উঠলাম। লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহ্ , দু’দিন আগে হলেও ঠিক ছিল। এই মুহূর্তে আমার মরে টরে যাওয়ার মুড নেই। একদম না। আমার সরাসরি নাকচ বোধহয় তাসনিম আপুর খুব একটা পছন্দ হলো না। উনি কয়েক মুহূর্ত আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে অদ্ভুত এক আবদার করলেন,
‘ তোমার হাতটা একটু ধরলে কী তুমি রাগ করবে রোদেলা?’
আমি অবাক হলাম। তাসনিম আপুর অদ্ভুত ব্যবহারে হকচকিয়ে গেলাম। উনি হাত বাড়িয়ে আমার ডানহাতটা ধরলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘ মাসখানেক আগে তোমাকে রাস্তায় দেখেছিলাম আমি। বিশ্বাস করো, আমার এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল আমি তোমাকে নয়, নিজেকে দেখছি। নয়/দশ বছর আগের তাসনিমকে। একই রকম ভঙ্গুর, উদাস। আমি অবচেতনে সবসময় তোমার ক্ষতিই চেয়েছি। ঈর্ষা হয়েছে। এই পৃথিবীতে হয়তো তোমার মতো অপছন্দ আমি আর কাউকে করি না। কিন্তু সেদিন তোমায় দেখার পর কেন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেল মন।
সারারাত ঘুম হলো না। আমি তোমাকে কখনোই মেনে নিতে পারব না। আমি জানি, তুমিও পারবে না। কিন্তু আমি এই দুনিয়ার কোনো মেয়েকেই আমার মতো পরিস্থিতিতে দেখতে চাই না। সেটা তুমি হলেও না। নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে, কাউকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসে ফেলাটা খুব কষ্টের রোদেলা। একবার সর্বস্ব খুঁইয়ে দিলে দ্বিতীয়বার আর ভালোবাসা যায় না। আমি জানি না তোমার জীবনে কী চলছে। কিন্তু বিশ্বাস করো, কেউ তোমায় সর্বস্ব খুঁইয়ে ভালোবেসে ফেলেছে।
আমি বুঝতে পারছি না, যাকে কেউ সর্বস্ব খুঁইয়ে ভালোবাসে তার জীবনে এতো দুঃখ কীসের? আর সেই মানুষটাও তো খুব একটা সাধারণ মানুষ নয়। আপাতত আমার কাছে তো নয়। সে রাগ, অভিমান, ঘৃণা, ভালোবাসা সবই খুব মনোযোগ দিয়ে করে। তবে? আমার জীবনে যা হয়েছে, তা তোমার জীবনেও ঘটছে তা আমি কল্পনাতেও বিশ্বাস করতে পারি না। সে তোমাকে আমার মতোই ”উই আর নট ফর ইচ আদার” বলে ছেড়ে যেতে পারে না। এমনটা অসম্ভব। তাই না, রোদেলা?’
আজ আমার মন ভালো। মন ভালো দিনগুলোতে আমার মস্তিষ্ক একটু ধীরে চলে। এবারও বোধহয় তাই হলো। তাসনিম আপু আমাকে সমাবেদনা জানাচ্ছে নাকি কৌতুক করছে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে দুঃখের বিষয় হলো, শুভ্র ভাই সত্যি সত্যিই আমায় ‘উই আর নট ফর ইচ আদার’ ধরনের কথা বলেছেন। বরং তার থেকেও অপমানজনক কথা বলেছেন। উনি বলেছেন, ‘ইউ আর নট মাই টাইপ।’ আমি ভঙ্গ হৃদয় নিয়ে তাসনীম আপুর দিকে চাইলাম। এতোবড় অপমানের পরও যে শয়নেস্বপনে ওই বেয়াদব লোকের কথা চিন্তা করছি ভেবেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। চা খাওয়ার ইচ্ছেটা ধূলিসাৎ করে বললাম,
‘ কোথাও একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হচ্ছে আপু। আমি এবং আমার জীবন দুটোই ঠিকঠাক চলছে। কারো ‘মেইট ফর ইচ আদার’ না হতে পারার দুঃখে জীবন থমকে যাওয়াটা বোকামো। আমি বোধহয় অতটাও বোকা নই। অনেকক্ষণ বেরিয়েছি, এবার আসি?’
সিঁড়ি বেয়ে কেবিনে ফিরে আসতে আসতে ভাইয়াকে ক্ষুদেবার্তা পাঠালাম, ‘আজ থেকে এক সপ্তাহ আমার চা খাওয়া বন্ধ। কঠোর অনশন। তুমি ওই চা ডাস্টবিনে ফেলে দাও।’ চিড়বিড়ে এক মেজাজ খারাপ নিয়ে কয়েক ধাপ পেরুতেই পেছন থেকে বলে উঠলেন তাসনিম আপু,
‘ আই থিংক, ইউ আর আ পেসেন্ট অব ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন রোদেলা। কেন মনে হচ্ছে, জানি না। তবে মনে হচ্ছে। ডোন্ট টেইক ইট ইজি। এজ আ ডক্টর, আই রিকুয়েষ্ট ইউ, টক টু সামওয়ান। ইউ নিড হেল্প।’
আমি ঘাড় ফিরিয়ে চাইলাম। ঠোঁটে দীর্ঘ একটা হাসি টানার চেষ্টা করে বললাম,
‘ আই উইল।’
দপাদপ লম্বা পা ফেলে সিঁড়ি পেরিয়ে এলাম আমি। রাগে গা জ্বলছে। ‘আই উইল’, মাই ফুট! কতবড় সাহস! আমায় বলে, ইউ আর নট মাই টাইপ! কেন ভাই? তুমি কী প্রিন্স চার্মিং? তোমার জন্য প্রিন্সেস দরকার? জাপানিজ প্রিন্সেস? ব্যাটা বাটপার! আসিস শুধু ময়মনসিংহে। চাকু দিয়ে কেটেকুটে ব্রহ্মপুত্রে না ভাসিয়েছি তবে আমার নামও রোদেলা নয়। মাথার ভেতর চিড়বিড়ে একটা রাগ নিয়ে কেবিনের এক কোণায় থম ধরে বসে রইলাম আমি। মাথাটা তখন জ্বলন্ত আঙ্গার। সেই আঙ্গারকে পাশ কাটিয়ে মামানির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার কথাটা মনেই রইলো না।
দিন দশেক হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফিরলাম আমরা। মায়ের অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি। ঠিকঠাক হাঁটাচলা করতে পারেন না। কথা বলেন ধীরে ধীরে। আম্মুকে বাসায় আনার পরের দিনই ফাইনাল সেমিস্টারের চাপে একরকম বাধ্য হয়েই ভার্সিটি হলে উঠে গেল আপু৷ আপু চলে যেতেই পুরো পরিবারের দায়িত্বটা হুড়মুড় করে আমার ঘাড়ে এসে পড়ল। রুগী দেখতে আসা একঘর অতিথি, ঘন্টায় ঘন্টায় আম্মুর ঔষধ, পথ্য, ঘরদোর গুছানো সব মিলিয়ে ভয়াবহ ফ্যাসাদে পড়ে গেলাম আমি। সারাদিন ছুটোছুটি। হাত ভর্তি কাজ। শ্বাস ফেলার সময় নেই। এই এতো এতো ব্যস্ততার মাঝেও মামানীর কথাটা খচখচ করে গেল মনে। চুলোয় রান্না বসিয়ে আম্মুকে ইনসুলিন দিতে বসেই শুধালাম,
‘ মামানি যে তোমায় দেখতে এলো না আম্মু?’
আম্মু বাচ্চাদের মতো মুখ করে বসে ছিল। সুঁচে তার আজন্ম ভয়। প্রতিবার ইনসুলিন দিতে বসলেই বাচ্চাদের মতো চোখ-মুখ খিঁচে ফেলেন। আমার কথায় চোখ-মুখের কুঞ্চনটা একটু শিথিল হলো। ফর্সাটে মুখে আলতো উদ্বেগ খেলে গেল। বলল,
‘ এসেছিল তো। অপারেশনের দিন তো সারাদিন হাসপাতালেই ছিলো। তোর মামুর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। আমার অপারেশনের পরের দিন ইন্ডিয়া গিয়েছিল ডাক্তার দেখাতে। আজ সকালেই নাকি ফিরেছে শুনলাম। বাসায় কেউ নেই। ভাইয়াকে একা ফেলে আসার জো আছে?’
আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ইনসুলিন দিতে গিয়ে সুঁচের খোঁচাটা একটু জোরে লেগে গেল। হতভম্ব কন্ঠে বললাম,
‘ মামানি ইন্ডিয়া গিয়েছিল? কই, আমি তো কিছু জানি না!’
এবার আম্মুর আগের রূপটা ফিরে এলো কিঞ্চিৎ। চোখ গরম করে চেয়ে থেকে নিজের বিরক্তি বুঝালো। ইনজেকশনের জায়গাটা চেপে ধরে বিরক্ত কন্ঠে বলল,
‘ তুই সামাজিকতার বুঝিস কিছু? আত্মীয়-স্বজন তো দূর। নিজের মানুষেরই খবর রাখিস না। বড় হচ্ছিস না তো অসামাজিক হচ্ছিস৷ মেয়ে মানুষের এতো উদাসীন হলে চলে? রাঁধতে জানলে, চুলও বাঁধতে জানতে হয়। কয়েক বছর পর শ্বশুরবাড়ি যাবি। এভাবে সংসার টিকবে?’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এটুকু বলেই হাঁপিয়ে উঠলেন আম্মু। শ্বাসে টান পড়ল। তবুও মেয়ের উদাসীনতায় ভয়াবহ বিরক্তিটা চেপে যেতে পারলেন না। মুখ তেঁতো করে বসে রইলেন। দুর্বল কন্ঠে বললেন,
‘ মানুষের সাথে মিশতে হয়। সম্পর্কের দাম দিতে হয়। সম্পর্ক আগলে রাখতে না শিখলে সম্পর্ক টিকবে কীভাবে? তোর মামানি তোকে এতো আদর করে। খোঁজ নিতে হয় না?’
আম্মুর কথায় অপরাধবোধটা তরতর করে বাড়তে লাগল। তাঁকে বুঝাতে ইচ্ছে হলো না, এই দুটো মাস আমি কী পরিমাণ মানসিক অসুস্থতার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। কতবার ভেঙেছি। নিজের সাথে যুদ্ধ করেছি। সম্পর্কের সুতো তো দূর জীবনের সুতোগুলোও এলেমেলো করে ধোঁয়াশা দিগন্তে ভাসিয়ে দিয়েছি। একটু মুক্ত বাতাস ব্যতীত আর কিছুর চিন্তাই মাথায় আসেনি। কিচ্ছু না। তাসনিম আপুকে যে বলেছিলাম, ‘আমি অতটা বোকা নই।’ কথাটা খুব মিথ্যে। আমার মতো বোকা বোধহয় পৃথিবীতে আর দুটো নেই। ছিল না কখনো।
বুকের ভেতর উথলে আসা দীর্ঘশ্বাসটা খুব সন্তপর্ণে গিলে নিয়ে রান্নাঘরে এসে দাঁড়ালাম। কমলা রঙা আগুনের দিকে চেয়ে নিজের পক্ষে শক্ত কোনো যুক্তি খুঁজে পেলাম না। কুটিল, সত্যকথন মনটা বারবার মনে করিয়ে দিতে লাগল, সম্পর্কের টানাপোড়েন যেমনই হোক। শুভ্র ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার বাবা-মাকে আগলে রাখার দায়িত্বটা কেবল আমার ছিল। শুভ্র ভাই যেমন তেমন। ওই মায়াময় রমনীটির অকৃত্রিম ভালোবাসার বিনিময়ে হলেও এতোটুকু খোঁজ তো নেওয়া উচিত ছিল!
কিন্তু আমারই বা কী করার ছিল? আমি তো….! আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সেদিন আর কোনো কাজেই মন বসলো না। তরকারী পুড়ে গেল। ডালে হলুদ বেশি পড়ল। ছোট মাছে লবণ দিতে ভুলে গেলাম। অপরাধবোধের সূক্ষ্ম এক কাঁটা খচখচ করতে লাগল গোটা হৃদয়জুড়ে। সিংক ভর্তি থালাবাসন, বাথরুম রাখা মায়ের কাপড়-চোপড় সবকিছু ফেলে রেখেই রাফিয়াকে ডাকলাম। রাফিয়া আজ সকালেই এসেছে। ঘরে বসে প্রেমিকের সাথে ফোনালাপ সারছে। আমার ডাকে ফোন হাতেই বেরিয়ে এলো। তাকে দেখেই বললাম,
‘ আম্মুর পাশে কিছুক্ষণ বস তো। আমি একটু মামানিদের বাসায় যাব৷ দরকার আছে।’
রাফিয়া ঠোঁট উল্টাল। উৎসাহ নিয়ে বলল,
‘ শুভ্র ভাইদের বাসায়?’
পরমুহূর্তেই মুখ কালো করে বলল,
‘ ওহ! শুভ্র ভাই তো বাসায় নাই। কী কাজ ওখানে?’
আমি বিরক্ত চোখে চাইলাম। হাতের কাজটুকু শেষ করে বললাম,
‘ কেন? শুভ্র ভাই ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মানুষ ওই বাসায় থাকে না? সারাদিন শুভ্র ভাই, শুভ্র ভাই। শুভ্র ভাইয়ের চামচা কোথাকার! আধাঘন্টা পর আম্মুর নাস্তার সময় হবে। ফোনটা রেখে দয়া করে ফলগুলো কেটে দিস? ঔষধ আর ফল টেবিলেই রেখেছি। মনে থাকবে?’
রাফিয়া মুখ কালো করে মাথা নাড়লো। আমি ওড়নাটা পাল্টে মূল ফটকের কাছে এসেও ফিরে তাকালাম। কী মনে করে শুধালাম,
‘ শুভ্র ভাইয়ের সাথে তোর কথা হয়? ফেসবুক অথবা হোয়াটসঅ্যাপে?’
রাফিয়া সোফায় বসে ফোন চাপছিল৷ আমার কথায় বিস্মিত চোখে চাইল। চোখ বড় বড় করে বলল,
‘ ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। শুভ্র ভাইয়ের সাথে কথা আর আমি? উনাকে হোয়াটসঅ্যাপ করার আগেই হার্ট ফেল করে সাত আকাশ পাড়ি দিয়ে ফেলব আমি।’
তারপর একটু ভেবে বলল,
‘ কিন্তু শুভ্র ভাইয়ের হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারই তো নেই আমার কাছে। তোর কাছে আছে রে নাম্বার? জাপানিজ নাম্বারগুলো কেমন হয়? চ্যাং প্যাং টাইপ?’
আমি উত্তর দিলাম না। নাম্বার আবার চ্যাং প্যাং হয় কী করে? ইংলিশ ডিজিট তো সব দেশে একইরকম। ওয়ান ইজ অলওয়েজ ওয়ান। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম৷ আমার জীবনের দীর্ঘশ্বাসের লিস্টটা আরও একটু ভারী করে যখন মামুর বাসায় পৌঁছালাম তখন গোধূলি হানা দিচ্ছে পায়ের কাছে। হেমন্তের ঝরা পাতার স্তূপ হয়ে আছে গেইটের পাশে। আমি দুরুদুরু বুক নিয়ে সিঁড়ি পেরুলাম। অনিশ্চয়তা আর আতঙ্কে শুকিয়ে এলো গলা। মামানি কী খুব রেগে আছে? অভিমান করেছে? কথা বলবে তো আগের মতো? যদি না বলে?
শুভ্র ভাইয়ের মতোই নির্লিপ্ত ব্যবহার করে? তখন কী হবে? সময়ের সাথে সাথে আতঙ্ক আরও বাড়তে লাগল। হৃদপিণ্ডটা পাখা ঝাপটাতে লাগল পাগলাটে পাখির মতো। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নাম আওড়াতে আওড়াতে কলিংবেল চাপলাম। একবার, দুইবার, তিনবারের মাথায় মামানি দরজা খুললেন। হয়তো ঘুমোচ্ছিলেন। এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে আমার দিকে চেয়েই থমকে গেলেন৷ অবাক চোখে চেয়ে রইলেন আমার মুখে। মামানির চাহনি দেখে গলার শুকনো ভাবটা তালুতে এসে ঠেকলো। অসহায় মুখে দাঁড়িয়ে রইলাম। এতোদিন বাদে মামানিকে কী বলে সম্ভাষণ জানাব বুঝে উঠতে পারলাম না। মামানি অবশ্য আমাকে অতো ভাবনা-চিন্তার সুযোগ দিলেন না। বরাবরের মতোই উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,
‘ চেহারার কী হাল করেছিস রে রোদু! মায়ের অসুখ বলে খাওয়া-দাওয়া বাদ দিলে চলবে? শুকিয়ে তো কঙ্কাল হয়ে যাচ্ছিস!’
আমি চোখ তুলে চাইলাম৷ এতোকিছুর পরও এই মায়াময়ী রমণীর অকৃত্রিম, অকৃপণ ভালোবাসায় ভিজে এলো বুক। মামানিকে সটান জড়িয়ে ধরে বললাম,
‘ লাভ ইউ মামানি। ইউ আর দ্য বেস্ট মামানি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।’
মামানি হেসে ফেললেন। পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালেন মাথায়। কিশোরীর মতো উচ্ছল কন্ঠে বললেন,
‘ জানিস? কলকাতা থেকে দুটো একইরকম সিল্কের শাড়ি কিনেছি। একটা তোর, আরেকটা আমার। তোর মামু এই নিয়ে আমায় কত কথা শুনালো। তার কথা হলো, শাড়ি তো শাড়িই। ময়মনসিংহের মানুষ কী শাড়ি পরছে না? তার জন্য কলকাতা থেকে কিনতে হবে কেন?’
আমি হেসে ফেললাম। আমার দুশ্চিন্তা, মন খারাপ সব কর্পুরের মতো উড়ে গেল। মামানিকে আরো একটু গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে বললাম,
‘ আজ তোমায় একটুও ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। তুমি এতো মা মা কেন মামানি?’
মামানি হেসে ফেললেন। দুই হাতে জাপ্টে ধরে বললেন,
‘ আমি তো তোর মা’ই। আমার দুইটা বাচ্চা।’
আমি আদুরে শশক ছানার মতো মামানির বুকে মুখ গুঁজে রইলাম। মামানির বুকে ছোট্ট শিশুটির মতো প্রশ্রয় পেয়ে কোথা থেকে এক মুঠো কান্না ছুটে এলো বুকে। চোখের কোণা বেয়ে টপাটপ দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। এতোদিনকার জ্বালাপোড়নে এই আদরটুকুই যেন দরকার ছিল আমার। ঠোঁট উল্টে আহ্লাদী হয়ে বললাম,
‘ আই মিস ইউ মামানি।’
মামানি হেসে ফেললেন। আনন্দে তার চোখদুটো টলমল করে উঠল। কন্ঠে একরাশ আদর নিয়ে বললেন,
‘ কী অবস্থা বলো দেখি! ছেলে-মেয়ে দুজনেই বলছে, মিস ইউ। তোদের এতো ভালোবাসা আমি রাখব কই?’
আমি উত্তর দিলাম না। মামানি আমায় নিয়ে সোফায় বসলেন। আমি অধৈর্য কন্ঠে শুধালাম,
‘ মামু এখন কেমন আছে? ডাক্তার কী বললেন?’
মামানি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘ এতো লম্বা জার্নি করেই দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তোর মামু শুভ্রকে বলেও ছিলো, দরকার নেই। ভালো আছেন। কিন্তু কে শুনে কার কথা? বাপের থেকেও দু’কাঠি উপরে আমার ছেলে। এতো জেদ ছেলেটার! আমাদের জন্য টিকেট করে রেখে তবেই গিয়েছে। কয়েকটা টেস্ট করিয়ে, রিপোর্ট দেখালাম। ডাক্তার বলল, তেমন কোনো রিস্ক নেই। ডাক্তারের পরামর্শ মতো চললেই আলহামদুলিল্লাহ।’
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। পরমুহূর্তেই কপাল কুঁচকে চাইলাম,
‘ তোমরা সকালে ফিরেছ। ফিরে কিছু খেয়েছ?’
মামানি হাসার চেষ্টা করে বললেন,
‘ এতোটা এসে আর শরীর সাঁই দেয়নি। এখনই রান্না বসাবো। তুই কী খাবি বল?’
আমি ঘড়ির দিকে চাইলাম। ঘড়ির কাটায় শেষ গোধূলির সাক্ষ্য। কিছুক্ষণ পরই আজান পড়বে। আমি অবাক হয়ে মামানির দিকে চাইলাম। চাপা একটা অপরাধবোধে ছেঁয়ে গেল মন। নিজের উপরই থমথমে এক রাগ নিয়ে বললাম,
‘ সন্ধ্যা হতে চলল এখনও খাওনি তোমরা? এভাবে খেলে শরীর টিকবে? তুমি চুপ করে বসো তো। এই অভুক্ত, ক্লান্ত শরীরে খবরদার রান্নাঘরে যাবে না। আজ আমি রান্না করবো। বাসায় কোনো বাজার টাজার আছে?’
মামানি উত্তর দিলেন না৷ আমি ঝটপট রান্নাঘরে গেলাম। রান্নাঘরের সিংকে ধুলোর আস্তরণ, জলের দাগ। দশ-বারোদিনের নিতান্তই অব্যবহারে রুক্ষ চারপাশ। বুঝলাম, রান্নাঘরটা পরিষ্কার করতে হবে। ফ্রিজ খুলে বাজারের অবস্থা দেখতে দেখতে বললাম,
‘ কাল সকালে ভাইয়াকে দিয়ে খাবার পাঠাবো আমি। তুমি কিন্তু একদম রান্নাবান্নায় হাত দিবে না। জার্নি টার্নি করলে তোমার শরীর কত খারাপ হয়। আমি কী জানি না?’
মামানি এবার উঠে এলেন। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন,
‘ হয়েছে। আর পাকনামো করতে হবে না। এসব করতে অনেক সময় লেগে যাবে। আমি পারব। তোর মা বাসায় একা না?’
‘ উঁহু। রাফিয়া আছে। রাতের রান্না করে এসেছি। একটু দেরী হলেও সমস্যা নেই।’
‘ রাখ তো তুই এসব। দুটো ভাত, ডাল সিদ্ধ দিলেই হয়ে যাবে। পাশে এসে বোস, একটু গল্প করি।’
আমি সরু চোখে চাইলাম,
‘ আগে তো কখনো ভাত, ডাল সেদ্ধ খেতে না মামানি।’
মামানি হেসে ফেললেন। পরমুহূর্তেই প্রগাঢ় এক মন খারাপে ছেঁয়ে গেল মুখ। অসহায় চোখে চেয়ে বললেন,
‘ আমার ছেলেটা ওখানে কীভাবে আছে কে জানে? খাওয়া-দাওয়া নিয়ে খুব রুচিশীল আমার ছেলেটা। যেন-তেন খাবার তার রুচে না। বাসাতেই কেমন করে দেখিস না? ওখানে না-জানি কেমন আধাসিদ্ধ বিশ্রী খাবার খেতে হচ্ছে। এসব মনে পড়লে আর রান্নাবান্নায় মন পাই না। আমার বাচ্চাটা!’
আমি হাসলাম। পাত্তাহীন কন্ঠে বললাম,
‘ বাচ্চা, বাচ্চা করো না তো। তোমার ছেলে আর বাচ্চা নাই মামানি। ঠিক সময়ে বিয়ে করালে দুই বাচ্চার বাবা হয়ে যেতো। এতো বছর ভার্সিটি হলে থেকেছে। হলের ছাত্রদের পাকস্থলী শক্ত হয়। ওসব নবাবি চাল শুধু তোমার সাথেই দেখায়। ভার্সিটি হলের খাবার কত জঘন্য হয় জানো না?’
মামানি হাসতে গিয়েও দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চোখ-মুখ কুঁচকে বললেন,
‘ হ্যাঁ রে? ওখানকার মানুষ নাকি সাপ, বিচ্ছুও খায়?’
মামানির মুখের অভিব্যক্তিতে হুহা করে হেসে উঠলাম আমি। বহুদিন পর হাসতে হাসতে চোখে জল চলে এলো আমার। বললাম,
‘ তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করতে পারো না? সে সাপ, বিচ্ছু খায় কি-না?’
মামানির বোধহয় একটু মন খারাপ হলো। ম্লানমুখে বললেন,
‘ বললে না জিজ্ঞেস করব? কত কথা জিজ্ঞেস করি, একটা কথারও উত্তর দেয় না। শুধু বলে, ভালো আছি। আমার ছেলেটা কেমন পাল্টে গিয়েছে রোদু। চুপচাপ থাকে। তোর মামু না বুঝলেও আমি বুঝি। আমার রগচটা, উচ্ছল ছেলেটা আর আগের মতো নেই। কোনো কিছুতেই আগের মতো রাগ নেই। অভিযোগ নেই। জেদ নেই। আগে কতো বকতাম। এখন মনে হয়, আগেই ভালো ছিল। রাগ করতো, জেদ করতো, জ্বালাতো। কত কথা বলতো! আমার প্রাণটা ভরে যেতো। হঠাৎ এতো দূরের কেন হয়ে গেলাম? শুভ্রর কী মায়ের প্রতি খুব অভিমান? ভাবলেই কেমন অস্থির অস্থির লাগে আমার।’
আমি মনোযোগ দিয়ে সবজি কাটছিলাম। মামানির কথায় স্থির হয়ে গেল হাত। মামানির দিকে এক পলক চেয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলাম। অন্যমনস্ক, অপটু হাতটা আবারও চলতে লাগল ধীরে ধীরে। খাঁ খাঁ নিস্তব্ধ রান্নাঘরটা বড়ো বিষাক্ত ঠেকলো। বুক বেয়ে বেরিয়ে এলো আরও একটি দীর্ঘশ্বাস। কার কতটুকু দোষ? কার কতটুকু অভিমান? ভাবতে ইচ্ছে হলো না। বিশ্রী বিষাদে ছেঁয়ে গেল মন। খুব সত্যকথন মনটা ফিসফিসিয়ে বলল, ‘বিষণ্ণ সন্ধ্যাটা কেবল তোমার নয়! এই সন্ধ্যায় অসংখ্য ভাগ। টুকরো টুকরো অসংখ্য মন খারাপ।’ একমাত্র ছেলের কথা ভাবতে ভাবতেই বুঝি আষাঢ়িয়া আকাশের মতোই অন্ধকার হয়ে গেল মামানির মুখ। বিষণ্ণ চোখদুটো মেলে কে জানে কোথায় চেয়ে রইলেন। দীর্ঘক্ষণ পর বহুদূর থেকে ভেসে এলো তার উদাস কণ্ঠস্বর,
‘ শুভ্রর এডমিশনের দুই মাস আগে হঠাৎ টাইফয়েড ধরা পড়ল শুভ্রর। সেই সাথে গুটি বসন্ত। এতো অসুস্থ হয়ে পড়ল ছেলেটা! বিছানা থেকে উঠে বসতে পারে না। শুয়ে থাকাও মুশকিল। সারা শরীর ব্যথা। প্রায় একমাস হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছিল৷ ডাক্তারদের কথায় ভয় পাই। টেনশনে রাতে ঘুম হয় না। একটামাত্র ছেলে আমার। যদি কিছু হয়ে যায়? কী করব আমি? কিন্তু ছেলের সেদিকে খেয়াল নেই। আমি অবাক হয়ে দেখি, সারা গায়ে এমন অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে ছেলে বই হাতে বসে আছে।
জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। মাথা ভার। গায়ে হাজার টন ব্যথা। মাঝে মাঝে খিঁচুনি হচ্ছে। অথচ শুভ্র বই হাতে পড়ার চেষ্টা করছে। আমি ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদি। বলি, পড়াশোনা অনেক হবে। আগে জীবন বাঁচা। বেঁচে না থাকলে বুয়েটে পড়ে কী হবে? তোর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হবে না। শুভ্র বিরক্ত হয়। রাগারাগি করে। আমার ছেলেটাকে আমি কঠিন পরিশ্রম করতে দেখেছি। হতাশ হতে দেখেছি। কিন্তু কখনো ভেঙে পড়তে দেখিনি। অসুস্থতার জন্য এতো শখের বুয়েটে যখন ভর্তির সুযোগ হলো না তখনও ছেলেটা কত শক্ত ছিল।
একদিনের জন্যও বলেনি, আম্মু আমাকে দিয়ে হবে না। আমি পারছি না। অথচ সেদিন সে আমায় ফোন দিয়ে বলছে, আম্মু আমাকে দিয়ে হবে না। আমি আর পারছি না। কথাটা শুনেই আমার দুনিয়াটা শূন্য হয়ে গেল। বুঝে গেলাম, আমার ছেলে ভালো নেই। আমার এতো শক্ত ছেলের কী হয়ে গেল? আমার খাবার গলা দিয়ে নামে না রোদু। আমি ঘুমাতে পারি না। আমার ছেলে একা বিদেশে পড়ে আছে। কষ্ট পাচ্ছে। অসহায়ের মতো মাকে খুঁজছে। আমি তো আমার ছেলের কাছে নাই। ওর মাথায় হাত রাখার মানুষ নাই।’
কথাগুলো বলতে বলতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন মামানি। আমি স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম। ডানহাতটা আপনাআপনিই মুখের উপর গিয়ে স্থায়ী হলো। দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল গালে। এগিয়ে গিয়ে মামানিকে সান্ত্বনা দেওয়ার শক্তি খুঁজে পেলাম না। মামানির কান্নার আওয়াজে ছুটে এলেন মামু। মামানি ততক্ষণে মেঝেতে বসে পড়েছেন। হাতগুলো থরথর করে কাঁপছে। মামানিকে এই অবস্থায় দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন মামু। কিছুক্ষণ নির্বাক চেয়ে থেকে আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
‘ কী হয়েছে?’
আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। মামু এগিয়ে গিয়ে মামানিকে ধরলেন। টেনে তুলতে তুলতে বারবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে? কী হয়েছে?’ মামানির কান্না থামল না। অবুঝের মতো বললেন,
‘ আমার ছেলে তো ভালো নেই। ওর কষ্ট হচ্ছে। ওকে তুমি চলে আসতে বলো। আমার ছেলেটাকে আমি প্রাণভরে দেখি।’
মামু মামানিকে সোফায় বসাতে বসাতে মৃদু ধমক দিলেন,
‘ তোমাকে বলেছে ছেলে ভালো নেই? ছেলেটা পড়তে গিয়েছে ওকে পড়তে দাও। এমন কান্নাকাটি করে ওকে ডিস্ট্রেক্ট করো না। মেয়ে মানুষের সবসময় বাড়াবাড়ি।’
মামানি ক্ষিপ্ত প্রতিবাদ করলেন,
‘ তুমি বুঝো কিছু? তুমি আমার ছেলেকে জীবনে বুঝেছ?….’
মামু-মামানির তর্কাতর্কির আর কিছুই যেন কানে এলো না আমার। সব কথায় বাষ্প হয়ে উড়ে গেল কানের পাশ দিয়ে। নিজেকে খুব বোঝা মনে হলো। পৃথিবীর সকল মানুষের দুঃখের কারণ মনে হলো। আমি যদি না থাকতাম তাহলেই যেন ঠিক হয়ে যেতো সব। মামু ভালো থাকতো, মামানি ভালো থাকতো,আব্বু, আম্মু, তাসনিম আপু, শুভ্র ভাই, না-জানি আরও কত মানুষ! এতো মানুষের মন খারাপের দায় নিয়ে কী বেঁচে থাকা যায়? হাতে থাকা সবজি কাটার চাকুটির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম আমি। সুন্দর, ঝকঝকে চাকু। বামহাতের কব্জিতে জ্বলজ্বলে দাগটার উপর আরও একটা দাগ পড়লে কেমন হয়? সাদা মেঝেটা রক্তে রক্তে ভেসে যাক। সবাইকে স্তব্ধ করে গল্পটা এখানেই থেমে যাক। শান্তি পাক পৃথিবী।
মামানিদের বাসা থেকে অনেকটা যন্ত্রের মতো ফিরে এলাম আমি। সন্ধ্যা কেটে গিয়ে রাত নেমেছে। পথের ধারে টিমটিমে এক রাত বাতি জ্বলছে। সাদা ফকফকা তার আলো। আমার ইচ্ছে হলো, রাত বাতির আলোর পিঠে খুব অন্ধকার কোণাটায় চুপচাপ বসে থাকি। অন্ধকারে কোনো ভয় নেই। মানুষ নেই। কারো জীবনে সমস্যা হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে নেই। আছে শুধু নিঃশেষ নীরবতা। বাসায় ফেরার তাগাদা, পুরাতন মানুষদের মুখোমুখি হওয়ার চিন্তাটা মাথায় আসতেই দমবন্ধ হয়ে এলো বুক। বুকের ভেতরটা পাহাড়সম ভারী ঠেকল। উফ! কতো দায়বদ্ধতা এই বুকে! পৃথিবী সমান সমস্যা চারদিকে। সবার চোখে বিরক্তি। দোষারোপ।
আমার আর কারো বিরক্তির কারণ হতে ইচ্ছে করে না। আমি কী করেছি? কতটা দোষ করেছি? ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত আমি। এখন আর দোষী হতে ইচ্ছে করে না। শুধু একটু শ্বাস নিতে ইচ্ছে করে। হাসতে ইচ্ছে করে। সবার কাছে জোর হাতে ক্ষমা চেয়ে কোথাও একটা হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সবার ইচ্ছে তো পূরণ হওয়ার নয়। কিছু মানুষের ইচ্ছে কেবল ইচ্ছে করার জন্যই হয়। আমার ইচ্ছেটাও ইচ্ছে করার মাঝেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল।
আম্মু হঠাৎ আপত্তি তুললেন, অতোদূরের শহর চট্টগ্রামে মেয়েকে পড়াবেন না। দুইদিনের মেয়ে তার। অতো দূরের শহরে কোন কলিজায় রাখবেন তাকে? আমার দুনিয়াটা যেন ঘুরে গেল। যে মুক্তির আশায় ছটফট করছিলাম। সেই আশা মরিচীকার মতো মিলিয়ে যেতেই তীব্র বিষণ্ণতা আর রাগগুলো যেন ফিরে ফিরে আসতে লাগল। জ্বলে উঠল মস্তিষ্কের সকল স্নায়ু। তবু, নিজেকে শান্ত করে অসুস্থ আম্মুকে বুঝালাম,
‘ অনেকে অনেক দূর দূরান্ত থেকে পড়তে আসছে মা। আমি তো একা নই।’
আম্মু শক্ত কন্ঠে বললেন,
‘ চট্টগ্রামের ক্যাম্পাস ভালো না। পঁচাত্তর শতাংশই ছেলে। মেয়েদের সেফটি নেই।’
আমি হতাশ কন্ঠে বললাম,
‘ এসব বহু আগের কথা আম্মু৷ এখন আর এসব ভেবে মেয়েদের ঘরবন্দী থাকার সময় নেই। এখন মেয়েরা অনেক এগিয়ে গিয়েছে। এসব খুবই ছেলেমানুষী যুক্তি আম্মু। এসব ঠুনকো যুক্তিকে আঁকড়ে ধরে আমার পড়াশোনা থেমে যেতে পারে না।’
আম্মুর কঠোরতা কমলো না৷ কঠিন কন্ঠে বললেন,
‘ তোকে চট্টগ্রামেই পড়তে হবে কেন? জাহাঙ্গীরনগরে তো এখনও পরীক্ষা হয়নি শুনলাম৷ সেখানে পরীক্ষা দে। অতোদূরে মেয়ে আমি দিব না। যদি কিছু হয়ে যায়? দূর্ঘটনা কী বলে কয়ে আসে?’
‘ আম্মু আমি জাহাঙ্গীর নগরের ফরমই তুলিনি। পরীক্ষা দেব কী করে? কতো মেয়েরা পড়ছে চট্টগ্রামে। কিচ্ছু হবে না আমার। একটু বোঝার চেষ্টা করো।’
আম্মু বুঝার চেষ্টা করলেন না৷ অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তাঁর মৃত্যু, দূর্ঘটনা নিয়ে বিশ্রী এক ভয় তৈরি হয়েছে। বাজে বাজে স্বপ্ন দেখছেন। তারওপর ছোট ফুপ্পির কান ভারী করা কথায় ভয়টা বাড়ছে হুহু করে। কিছুতেই সেই ভয় কাটানো যাচ্ছে না। তবু চেষ্টা চলল। আপু, ভাইয়া, বাবার নিরন্তর বুঝানোর পর দিন দশেকের সাধনায় চেষ্টা সফল হলো। আম্মু রাজি হলেন। কিন্তু সুখ পাখিটা বড়ো চঞ্চল। ছটফটে তার পদচারণ। ধরা দিয়েও ধরা দিতে চায় না৷ কাছে এসেও কাছে আসতে চায় না। এবারও তাই হলো।
সুখ পাখিটা হাতের কাছে এসেও দূর-দূরান্তে গা লুকালো। চট্টগ্রামে ভর্তি হতে যাওয়ার ঠিক আগের দিন টিভিতে একটা ব্রেকিং নিউজ এলো, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলন্ত বাসে গৃহবধূকে ধর্ষণ।’ আম্মু আবারও বেঁকে বসলেন। সিদ্ধান্ত পাল্টে গেল। কঠিন কন্ঠে জানিয়ে দিলেন, ‘মেয়েকে তিনি অতদূর পাঠাবেন না। কোনোভাবেই না। রাতের বাসে যেতে হয়। যদি কোনো দূর্ঘটনা ঘটে? পড়াশোনা অনেক হবে। মেয়ে হারালে মেয়ে পাওয়া যাবে না।’
আমি আম্মুকে কী করে বুঝাই? আমি হারিয়ে গিয়েছি। খুব নিষ্ঠুরভাবে হারিয়ে ফেলছি নিজেকে। আমার দাঁড়ানোর একটা জায়গা দরকার। এক চিলতে মুক্ত আকাশ দরকার। নিজেকে আবারও একটু খুঁজে পাওয়া দরকার। একটুখানি বাঁচা দরকার। বেঁচে থাকা মানেই তো বেঁচে থাকা নয়।
এভাবে আর পারা যাচ্ছে না। নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমি ক্লান্ত। আমি আর পারছি না। বাসায় শুরু হলো যুক্তি পাল্টা-যুক্তির আসর। রাগারাগি, কথাকাটিতে দমবন্ধকর অবস্থা। সেই দমবন্ধকর পরিস্থিতিকে আরও বিষাক্ত করে দিতেই আবারও অসুস্থ হয়ে পড়লেন আম্মু। হঠাৎ করে খিঁচুনি শুরু হলো। শুরু হলো ক্রমাগত বমি। সবাই ভয় পেয়ে গেল। অপারেশনের রুগীর জন্য বমি হওয়াটা এক আতঙ্ক। যে কাজিন ভাইয়া আম্মুর অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন তাকে ফোন করা হলো। ভাইয়া শহরে নেই। এদিকে আম্মুর বমির গতি বাড়ছে।
পুরো দুটো দিন নির্ঘুম কাটলো সবার৷ ভয়ে, আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গেল সবার মুখ। জেদের দিক থেকে আমি বোধহয় কিছুটা শুভ্র ভাইয়ের মতো হয়েছি। আদরে প্রশ্রয়ে সেই জেদ বেড়ে আকাশ ছুঁয়েছে। আমার কিছু চাওয়া মানে, এই মুহূর্তে, অবশ্যম্ভাবীভাবে চাওয়া। যতক্ষণ পর্যন্ত পাব না ততক্ষণ পর্যন্ত চিৎকার,চেঁচামেচি, হৈ-হুল্লোড়ে বাড়ি মাতোয়ারা। আমার উনিশ বছরের জীবনে এই উঠতি জেদের কোনো হেরফের হয়নি। নিজের সাথে একবিন্দু ছাড় দিইনি। হেরে যাইনি।
কিন্তু এবার সব উল্টো হলো। হঠাৎ করেই জেদ ধরার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললাম। জীবনের কোনোকিছু নিয়েই আর অভিযোগ তুলতে ইচ্ছে হলো না। মনে হতে লাগল, যা হচ্ছে হোক। তবু পৃথিবী শান্ত হোক। একটু মানসিক আরাম পাই। সবাই আমাকে ভুলে যাক। আমায় নিয়ে আলোচনা বন্ধ হোক। বিনাবাক্য ব্যয়ে চট্টগ্রামের টিকেটদুটো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলাম। আমার স্বপ্নগুলোও হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে উড়ে গেল যোজন যোজন দূরে।
চট্টগ্রামে ভর্তি হওয়ার ডেডলাইন পেরিয়ে গেল। আমার বুকের নির্লিপ্ত অশান্তিটাও দাউদাউ করে বাড়তে লাগল। কোথাও একবিন্দু স্বস্তি নেই। শান্তি নেই। কারো সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই। কোথাও একটা বেঁচে থাকার কারণ নেই। ধীরে ধীরে আবারও বিষণ্ণতার অতলে তলিয়ে গেলাম আমি। যে একটু প্রভাত কিরণ ছড়িয়েছিল বড়ো মায়া নিয়ে? তাও যেন নিমজ্জিত হলো গাঢ় সন্ধ্যার ধারে। পৃথিবী থেকে দূরত্ব বাড়লো। দূরত্ব বাড়লো কাছের মানুষগুলোর থেকে।
আপন হলো কেবল আমার দোর দেওয়া অন্ধকার ঘর আর হঠাৎ হঠাৎ গোধূলি আসা এক চিলতে বারান্দার আলো। পছন্দের ডায়েরি, সবচেয়ে সুন্দর কলম, লেখালেখির অভ্যাস, জল রঙের কৌটো, আঁকার কাগজ সবই জ্বালিয়ে দিলাম এক সন্ধ্যেবেলায়। এক সময়কার প্রিয় জিনিসগুলো ধীরে ধীরে অপ্রিয়, বোঝা হয়ে গেল। আমি খুব সন্তপর্ণে উপলব্ধি করলাম, মনটা মরে গিয়েছে আমার। এভাবে থাকলে শরীরটাও মরে যাবে একদিন। হয়তো নিজেই কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলব। অবচেতনই এলোমেলো করে ফেলব জীবন।
কিন্তু আমি তো বাঁচতে চাই। এভাবে ভেঙে গুড়িয়ে গিয়ে মরে যাওয়ার জন্য তো জন্মায়নি? আমার জীবনটা কোনো হেরে যাওয়া গল্প হতে পারে না। আমি আমার উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠায় তীব্র বিষাদে গুমরানো কান্না দেখতে চাই না। জীবনের গল্পে কোনো স্যাড এন্ডিং, হ্যাপি এন্ডিং হয় না। জীবন তো চলমান। সুখ-দুঃখের সুমিশ্র সমাবেশ। আমার উপন্যাসটা দুঃখের পাতায় সমাপ্ত হতে পারে না। এমন হেরে যাওয়া কেঁজো গল্প কখনো আমার হতে পারে না।
খুঁইয়ে যাওয়া মানসিক শক্তিটুকু একটু একটু জড়ো করে আবারও উঠে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। নিজেকে নিয়ে ভাবার চেষ্টা করলাম। আবারও একটা সুযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। নিজের সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবতে বসে প্রথমেই উপলব্ধি করলাম, এই বাসায় থাকা আর চলবে না। পরিচিতের গন্ডি পেরুতে হবে। স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা করতে হবে। দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে বাবার কাছে গেলাম। বহুদিন পর জেদী হলাম। স্পষ্ট কন্ঠে জানালাম,
‘ বাবা আমি এই বাসায় থাকব না। একা থাকতে চাই। তুমি ব্যবস্থা করে দাও। নয়তো আমি নিজেই ব্যবস্থা করে নেব।’
বাবা অবাক হয়ে বললেন,
‘ এই বাসায় থাকবে না তো কোথায় থাকবে?’
‘ ময়মনসিংহেই থাকব। কিন্তু নিজের মতো। একা। ভিন্ন এলাকায়।’
বাবার বিস্ময় যেন কাটছে না। আমি দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে নরম কন্ঠে বললাম,
‘ আমি কেমন পরিস্থিতিতে আছি তা আমি কাউকে বুঝাতে পারছি না বাবা। তোমাকেও না। নিজেকে এলোমেলো গোলকধাঁধার মতো লাগছে। নিজেও নিজেকে বুঝে উঠতে পারছি না। কিন্তু বুঝা দরকার। এই বাসায় থাকলে আমি বোধহয় নিজেকে বুঝতে পারব না। আমার এই বাসা, এই এলাকা, এই পরিচিত মানুষজন কাউকে সহ্য হচ্ছে না। আমি কী বলছি, আমার সাথে কী হচ্ছে, ব্যাপারটা তোমাকে কীভাবে বুঝানো উচিত, সেটাও বুঝতে পারছি না। শুধু এটুকু বুঝতে পারছি আমার এখানে দমবন্ধ লাগছে।’
বাবা আমার দিকে স্থির চেয়ে থেকে বললেন,
‘ বেশ! তবে তুমি ঢাকায় গিয়ে কোনো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হও। নয়তো দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেওয়ার জন্য টিউশন নাও। একই শহরে, এভাবে আলাদা, লোকে কী বলবে?’
‘ লোকের কথা ভাবা বন্ধ করো বাবা। প্লিজ। জীবনটা তোমার মেয়ের। লোকের নয়। আমি এই মুহূর্তে কারো এক্সপেকটেশনের বোঝা নিতে চাইছি না। নতুন কোনো দায়িত্ব, চাপ নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমি এখন শুধু আমার হতে চাইছি। শুধু আমার। আর কারো নয়।’
বাবা প্রত্যুত্তরে কিছু বললেন না। আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে শক্ত কন্ঠে বললাম,
‘বাবা! আমার সময় প্রয়োজন। তুমি জাস্ট আমাকে একটা বাসা দেখে দাও। একটু শ্বাস নিতে দাও। আর দয়া করে তোমার গোষ্ঠীকে আমার সম্পর্কে জানানো বন্ধ করো। পদে পদে তাদের এডভাইস আমার প্রয়োজন নেই। তাদেরকে আমার সহ্য হচ্ছে না। আমি কোথায় আছি, কী করছি তা দুনিয়ার সবার জানার দরকার নেই। আমার জীবনে কী হবে তা ডিসাইড করবো কেবল আমি। তুমি না, আম্মু না, তোমার গোষ্ঠীর কেউ না। কেউ মানে কেউ না।’
বাবা হতভম্ব চোখে চেয়ে রইলেন৷ আমি বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলাম। বাবার হতভম্ব দৃষ্টিকে আরও একটু শূন্য করে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বললাম,
‘ বেয়াদবি করে ফেলার জন্য সরি বাবা। আমার এভাবে কথা বলা উচিত হয়নি। তুমি তো জানো, রেগে গেলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। তুমি প্লিজ আমার কথায় কষ্ট পেও না। আমি এই মুহূর্তে ভেবেচিন্তে কথা বলার মতো মানসিক অবস্থায় নেই। তোমাকে আমি রিকুয়েষ্ট করছি, একটু হেল্প করো। দুইদিনের মধ্যে আম্মুকে ম্যানেজ করে একটা বাসা খুঁজে দাও। নয়তো আমার হাতে দুটো রাস্তা খোলা থাকবে, এক. আমি একাই বেরিয়ে যাব বাসা থেকে। দুই. আমি কী করব আমি জানি না। তবে ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে। আর তুমি জানো, এই কান্ডগুলো ঘটানোর সাহস আমার আছে।’
আমার এতো কথার প্রত্যুত্তরে বাবা একটি কথাও বললেন না। কেবল চেয়ে রইলেন চুপচাপ। সাথে সাথেই বুকের ভেতর অপরাধবোধের শীতল এক ছায়া মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। আমার জীবনটা তখন অপরাধবোধের আদলে গড়া বিশাল এক পাপমহল। আমার এই অপরাধবোধের শেষ নেই, শুরু নেই। কেবল আছে তীব্র রোদের মতো অসহনীয় যন্ত্রণা। লোকে বলে, মানুষের জীবনে এমন কিছু সময় আসে যখন শব্দ হারিয়ে যায়। অনুভূতি হারিয়ে যায়। কাহিনিরা খেঁই হারায়। এলোমেলো যুক্তিহীন হয়ে পড়ে চেতনা। আমার জীবনের শব্দরাও যেন ফুরিয়ে গেল। কী লিখছি? কী অনুভব করছি? সকল সুতোগুলোই হয়ে পড়ল ছন্নছাড়া। যুক্তহীন, অযথা। খুব অযথা এই বেঁচে থাকা।
এক সপ্তাহ পর, সত্যি সত্যিই একার এক সংসার পেয়ে গেলাম আমি৷ টাউনহলের এক পরিচিত গলির মুখে, পুরনো এক তিনতলায় ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে ঠাঁই হলো আমার। পাশাপাশি দুটো শোবার ঘর। তার মাঝে একটি ঘর আমার। এক চিলতে খোলা বারান্দা আর আলো-বাতাসে পরিপূর্ণ বিশাল বিশাল জানালার ঘরটাতে পা রেখেই মন ভালো হয়ে গেল আমার। লাগেজটা রেখে ঘরের গুটি কয়েক আসবাবের দিকে চোখ বুলাতেই উচ্ছল এক কন্ঠস্বর ভেসে এলো দরজা থেকে। নীলা আপুর পেছন থেকে উঁকি দিলো মিষ্টি একটি মুখ,
‘ হেই আপু! সরি সরি, আসসালামু আলাইকুম আপু। আই অ্যাম দ্য জুনিয়র। বেড শেয়ার করতে সমস্যা নেই তো তোমার? সরি! সরি! আপনার? আমি আপনাকে একটুও ডিস্টার্ব করবো না। আমার একদম হাত-পা তুলে দেওয়ার অভ্যাস নেই। তবে আমি কিন্তু দেয়ালের দিকটায় ঘুমাবো। আমি রাতে ঘুমোতে ঘুমোতে বিছানা থেকে পড়ে যাই।’
আমি হেসে ফেললাম। নীলা আপু হেসে বললেন,
‘ ও হলো ঋতু। তোমার কলেজ জুনিয়র। এবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। আজ থেকে তোমার রুমমেট।’
উত্তরে মৃদু হাসলাম আমি। ডাবল বিছানাটার উপর বসে চোখ ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখতে লাগলাম। ঘরে আসবাবের সংখ্যা সীমিত। একটা বিছানা। দুটো টেবিল। দুটো সেল্ফ আর একটা সোফা। সোফাটা বোধহয় মালিকের। নীলা আপুরও হতে পারে৷ এই দুই রুমের ফ্ল্যাটটা মূলত নীলা আপুর।
আমরা সাবলেট থাকছি। আমি উদাস চোখে বাইরে তাকালাম৷ বিশাল জানালাগুলোর উপর ভারী ভারী পর্দা টানা। দুটো টেবিলই রাখা হয়েছে জানালা বরাবর। টেবিলে বসলেই যেন আকাশ দেখা যায়, তাই এই ব্যবস্থা৷ যদিও আমার টেবিলে বসলে আকাশ দেখা যায় না৷ দেখা যায় পাশের বিল্ডিংয়ে মুখোমুখি জানালায় পড়াশোনা করতে থাকা খুব লাজুক একটি ছেলেকে। ঋতু জানিয়েছে ছেলেটি দুনিয়ার উদ্ভট। টিপটাপ করে ঘর গুছিয়ে রাখে। রাতের বেলা তার জানালায় লাল-নীল মরিচ বাতি জ্বলে। টেবিলের উপর রাখা ছোট্ট একুরিয়ামটাকে নিজের বাচ্চার মতো আদর করে।
মাঝে মাঝে ফেসপ্যাক লাগায়। সারাদিন পড়াশোনা করে। আর সবচেয়ে বেশি যে কাজটা করে, তা হলো মনোযোগ দিয়ে লজ্জা পায়৷ আমি হেসে ফেললাম। দুই একদিনের ব্যবধানেই ঋতু আর নীলাপু হয়ে গেল আমার নতুন পরিবারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আপনজন। সম্পূর্ণ একান্ততা দিয়েও আমাকে আগলে রাখার চেষ্টাটা আমায় মুগ্ধ করতো। কিন্তু তবুও….
কোথাও একটা ফাঁকা থেকে যেতো। ভীষণ দুপুরগুলোতে, বিষণ্ন সন্ধ্যা অথবা প্রেমাচ্ছন্ন বিকেলগুলোতে হৃদয় ভাঙার শব্দে মস্তিষ্ক চুরমার হয়ে যেতো৷ মন কেমনের আলোটা ধীরে ধীরে অকেজো করে দিতো প্রতিটি নিউরন। আমি বর্তমান ভুলে যেতাম, অতীত ভুলে যেতাম, আমার আমিকে ভুলে যেতাম। কেবল মনে থাকতো অদৃশ্য এক দুঃখ সাগর। যে সাগরে কেবল আমার নাম। থৈ থৈ অথৈ জল। ছোট্ট তরীর নড়বড়ে আত্মসংবরণ। থেকে থেকে ভীষণ ঝড়।
কালবৈশাখীর মতো তান্ডব। খুব দূরে কোনো অস্পষ্ট পুরুষের হাঁক। আমি শূন্য দৃষ্টিতে সেই ঝড়ের দিকে চেয়ে থাকতাম। দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতো। কখনো-বা গোধূলি কাটিয়ে হতো সন্ধ্যে। কপোত-কপোতীরা রাস্তায় নামতো। হাতে হাত পড়তো। চোখে পড়তো চোখ। আর আমার কপালে নামতো চিন্তার ঢেউ। একদিন হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমি বারান্দার রেলিঙের উপর বসে আছি। কখন বসেছি৷ কীভাবে বসেছি। কিচ্ছু খেয়াল নেই, কেবল বসে আছি। আর এক ইঞ্চি এদিক-ওদিক হলেই ইট-পাথরের রাস্তাটায় বিলীন হবে শরীর। থেতলে যাবে মুখমন্ডল।
আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। গলা শুকিয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে রেলিঙ থেকে নেমে এসে প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলাম, আমার সুইসাইডাল টেন্ডেসি বেড়ে যাচ্ছে। আমি আমার সাথে সেইভ নই। কী হাস্যকর অবস্থা! আমি ভাবতে বসলাম, নিজের থেকে নিজেকে বাঁচানোর উপায়! সেদিন সারাটাদিন ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমালাম আমি। পরের দিন দুপুরবেলা হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, আমি ড্রয়ারের চকচকে ওই চাকুটির দিকে চেয়ে আছি।
সুন্দর, কারুকার্য করা চাকু। অথচ সেই কারুকার্য নয়। আমায় আকর্ষণ করছে তার মসৃণ, ধারালো শরীর। চাকুটা দিয়ে হাতের শিরাগুলো কেটে ফেললে কেমন হয়? টলটলে রক্তে মেঝেটা ভেসে গেলে কেমন হয়? আমি শিউরে ওঠলাম। ঘামতে লাগল কপাল। নীলা আপু বা ঋতু কেউই বাসায় নেই। নিঃসঙ্গ, নির্ঝন দুপুরটাতে যদি উলোটপালোট কিছু করে বসি? কী হবে তখন? ঠিক তখনই দেবদূতের মতো কলিংবেল বাজল। দরজায় রান্না করার লোকটিকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। হাতের সুন্দর চাকুটা তার হাতে তুলে দিয়ে বললাম,
‘ এই চাকুটা আপনাকে উপহার দিলাম খালা। এটা আপনার।’
খালা অবাক হয়ে বলল,
‘ চাক্কুটা তো খুব সুন্দর। কিন্তু এই চাক্কু দিয়া আমি কী করুম আন্টি?’
আমি তাড়াহুড়ো করে পোশাক পাল্টাতে গেলাম। যেতে যেতে বললাম,
‘ আপনার মেয়েকে খেলতে দিবেন। চাকুটা সুন্দর না? আপনার মেয়ের পছন্দ হবে।’
খালা খুশি মনে রান্নাঘরে চলে যেতেই নিজের ডায়েরি আর ফোনটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম আমি। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে এই প্রথমবার রাস্তায় রাস্তায় হাঁটলাম। রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে পথচারীদের দেখলাম। তাসনিম আপুর বলা ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন সম্পর্কে ভাবলাম। পাবলিক লাইব্রেরিতে সময় কাটানো বাড়িয়ে দিলাম। অফিসকর্মীদের মতো পাবলিক লাইব্রেরির ন’টা-ছয়টার পাঠক হয়ে গেলাম।
উপন্যাসের চরিত্রদের বাইরে, তাত্ত্বিক বইগুলোর বাইরে আর কিছু নিয়ে চিন্তা করার বিন্দুমাত্র অবকাশ পেলাম না। বলতে হয়, অবকাশ দিলাম না। সপ্তাহ দুই পর নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত আমার সাথে নতুন এক ঘটনা ঘটলো। সন্ধ্যায় লাইব্রেরি থেকে বেরুতেই পেছন থেকে ডাক পড়লো।
পেছনে ফিরে চাইতেই লম্বাচওড়া এক যুবক দ্রুত এগিয়ে এলো। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল। শ্যামলা চেহারায় ভাবুক দুটো চোখ। চোখ ভর্তি অস্বস্তি। লজ্জায় নুইয়ে পড়ছে মুখ। আমি ছেলেটির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই আবিষ্কার করলাম, ছেলেটিকে আমি চিনি। আমার জানালার ঠিক মুখোমুখি জানালাটায় পড়াকু, লাজুক, উদ্ভট এই ছেলেটির বাস। কিছুদিন আগে ঝড়ের তোপে বারান্দায় মেলে রাখা ঋতুর ওড়নাটা উড়ে গিয়েছিল এই ব্যক্তির জানালায়।
খুব ভোরে এপাশের জানালা থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ওই ওড়না উদ্ধার করার গুরুতর দায়িত্বটা পড়েছিল আমারই উপর। ছেলেটি সেদিন বিনা প্রতিবাদে লেডিস ওড়নাটা আমাদের বিল্ডিং-এ পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। ‘ক’ পর্যন্তও উচ্চারণ করেনি। চোখ তুলে ঠিকঠাক তাকায়নি। অথচ খবরের কাগজের সাথে আমাদের ফ্ল্যাটে ইতোমধ্যে দু’দুটো চিরকুট পৌঁছে গেছে। ঋতুর বদ্ধমূল ধারণা, চিরকুট দুটো অবশ্যই এবং অবশ্যই এই উদ্ভট লোকটি পাঠিয়েছে। উপর উপর লাজুক দেখালেও ভেতরে ভেতরে লোকটা বিরাট পাঁজি। মিচকা শয়তান। আমি ছেলেটির দিকে খেয়ালী চোখে চাইলাম। সাথে সাথেই কোনো এক অদৃশ্য পুরুষের চোখ রাঙানীতে কেঁপে উঠল বুক। বিশ্বাসঘাতক শরীরটা গুটিয়ে গেল। শুধালাম,
‘ জি? কিছু বলবেন?’
ছেলেটি এক পলক আমার দিকে চাইল। পরমুহূর্তেই মাথা নেড়ে ‘না’ বুঝিয়ে দ্রুত সরে গেল। আমি কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব চোখে চেয়ে থেকে বাসার পথে পা বাড়ালাম। বাসায় ফিরে ঋতু আর নীলা আপুকে ঘটনা বলতেই হৈ হৈ করে উঠল দু’জন। ঋতুর রায় মুহূর্তেই পাল্টে গেল। তার হঠাৎ করেই মনে হতে লাগল। ছেলেটা আসলে ততটাও বদ নয়। আমার সাথে খুব ভালো মানাবে। একদম শাহরুখ আর কাজলের জুটি। আমি হাসতে গিয়েও থমকে গেলাম। প্রিয় মন খারাপরা আবারও ঘিরে ধরতে লাগল ধীরে ধীরে। কারো শূন্যতা হৃদয়ে দোলা দিয়ে গেল তীব্রভাবে। কারো হিংসুটে ধ্বংসলীলার কথা মনে পড়ে গেল বেলীফুলের সুবাসের মতো। ঋতু আমার পরিবর্তন বুঝতে পেরেই প্রসঙ্গ পাল্টাল। আমার ডায়েরিটা হাতে নিয়ে সাথে সাথেই রেখে দিয়ে শুধাল,
‘ আপু? আমি নীলা আপুর কাছে শুনেছি আপনি খুব ভালো গল্প শুনাতে পারেন। আমাকে একটা গল্প শোনান না, প্লিজ?’
আমি উদাস ভাবটা কাটিয়ে মৃদু হাসলাম,
‘ কী গল্প শুনবে?’
ঋতু বিছানায় পা উঠিয়ে উৎসাহ নিয়ে বসলো,
‘ যেকোনো গল্প।’
‘ কিন্তু আমার তো কোনো গল্পই মনে নেই।’
ঋতু একটুও মন খারাপ করল না। একটু ভেবে বলল,
‘ তাহলে আপনার কাছের কারো গল্প শোনান। এই মুহূর্তে আপনার যার কথা খুব মনে পড়ছে তার কোনো গল্প? প্লিজ!প্লিজ আপু! আমি জানি, আপনার যেকোনো কথা শুনতেই ভালো লাগবো।’
আমি হেসে বললাম,
‘ ধুর! কী বলে!
‘ প্লিজ আপু! প্লিজ! প্লিজ!’
সেদিন আর ঋতুকে গল্প শুনানো হলো না। পরের দিন সন্ধ্যেবেলা বারান্দায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থেকে আবারও গল্প শোনার বায়না ধরলো ঋতু। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। দূরের ওই লালাভ আকাশের দিকে চেয়ে আমার কোনো গল্পই মনে পড়ল না। কেবল মনে পড়ল তীব্র এক মন খারাপের কথা। হারিয়ে ফেলার বিষণ্ণতার কথা। আনমনা হয়ে বললাম,
‘ অনেক অনেকদিন আগে আমার জীবনে একটা হিংসুটে জাদুর মানুষ ছিলো। সেই মানুষটা আমায় ভালোবাসতো অনেকটা বর্ষার কদম ফুলের মতো। আমার ইচ্ছে, আমার পছন্দগুলো জেনে যেতো ম্যাজিকের মতো। তার জাদুর ঝুলিতে বাক্সবন্দী থাকতো আমার যাবতীয় মন খারাপ, সমস্যা, জেদ, অভিমান। সে সেই ভারী ঝুলি কাঁধে আমার পিছু হাঁটতো। জীবনের তাপে ক্লান্ত হলে বটগাছের মতো ছায়া দিতো। আমি অন্য কারো জাদুতে মুগ্ধ হওয়ার আগেই জ্বলে উঠতো হিংসুটে সূর্যের মতো। তার হিংসুটে আগুনে ঝলসে যেতো আমার পুরো পৃথিবী। সেই ঝলসে যাওয়া হৃদয়টাও আবার শীতল হতো তারই অদৃশ্য জাদুবলে।
সে আমায় আগলে রেখেছিল আদুরে পুতুলটির মতো। পায়ে পা রেখে পথ হেঁটেছিল বছরের পর বছর। কিন্তু আমি তাকে আগলে রাখতে পারিনি। তার সুন্দর অনুভূতির গুরুত্ব দিতে পারিনি। আমি বাঁধনহারা পাখির মতো উড়েছি। সে আমায় ঝাপটে ধরতে চেয়েছে। পারেনি বলে, অভিমান করেছে। আমি কখনো তার অভিমান ভাঙাইনি। যত্ন নিতে না জানা বেপরোয়া আমি যত্ন পেতে পেতে কখনো যত্ন নিতে শিখিনি। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ব্যথাগুলো হয়তো আমিই তাকে দিয়েছি। হয়তো এখনও দিচ্ছি। দিয়ে চলেছি অনবরত …..
সে বোধহয় আগের মতোই আছে। আমার বিশ্বাস, সে আমাকে আগের মতোই ভালোবাসছে। শুধু দূরত্বটা বেড়ে গিয়েছে। এতো বেশি দূরত্ব যে আমি এখন আর চাইলেই তাকে ছুঁতে পারছি না। তার হাসিতে হাসতে পারছি না। কান্নায় উদাস হতে পারছি না। সে আদৌ হাসছে নাকি কাঁদছে বুঝতে পারছি না। ‘সে কেমনে আছে?’- এই ছোট্ট প্রশ্নটা মুখ ফুঁটে বলতে পারছি না। এভাবেই অভিমান বাড়ে। তারও বাড়ছে। কতটা বাড়ছে? মহাকাশ সমান? হয়তো! আর আমি? বুক সমান আফসোস নিয়ে তাকে ভীষণ ভীষণ ভীষণ মিস করছি। যতটা মিস করলে বৃষ্টি নামে, বুক জ্বালা করে ঠিক ততটা মিস করছি!’
‘ সেই জাদুর মানুষটা এখন কোথায় আপু?’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আনমনেই বুক বেয়ে ছুটে এলো উত্তর,
‘ জানি না।’
পরমুহূর্তেই নির্লিপ্ত কন্ঠে বললাম,
‘ এটা শুধুই একটা গল্প ছিলো। সত্য নয়। বাস্তব জীবনে কেউ কারো জাদুর মানুষ হয় না।’
ঋতু কোনো উত্তর দিলো না। আমার ধিকধিক বিরক্তটা আবারও ফিরে ফিরে আসতে লাগল। তীব্র হলো মাথাব্যথা। শেষ ডিসেম্বরের হিমেল হাওয়া কানের কাছে গুনগুনিয়ে শুধাল, ‘জাদুর মানুষ হয় না। জাদুর মানুষ হয় না। সত্যিই কী জাদুর মানুষ হয় না?’
[ এই একটা পর্ব লিখতে গিয়ে বহু সময় নিয়েছি। বহু শব্দ খরচ করেছি। এক সময় উপলব্ধি করলাম, এই পর্বটা আসলে আমি গুছিয়ে লিখতেই পারব না। লিখলেও সময় দরকার অনেক অনেক বেশি। অনুভূতি কাজ করছে না। কেবল এই গল্পটা আমি জোর করে লিখতে পারি না। তবু লিখেছি। কেবল লিখে গিয়েছি। রি-চেইকও করিনি। পাঠকদের বিরক্ত হওয়ার সম্ভবনা আছে। সেজন্য দুঃখিত। ]
নৌশিন আহমেদ রোদেলার সাম্প্রতিক শেষ হওয়া নতুন গল্প
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
আরশিযুগল প্রেম গল্পের লিংক
https://kobitor.com/category/uponas/arsijugol/
নীল চিরকুট গল্পের লিংক