- একজন বড় ভাই।
- ভালোবাসার আরেক নাম বড় ভাই।
- ভাই বোনের সম্পর্ক নিয়ে স্ট্যাটাস।
- বড় ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
- ভালোবাসার প্রিয় ভাই।
1.একজন বড় ভাই
অফিসে যাওয়ার জন্য যখন তৈরি হচ্ছিলাম তখন ছোটবোন অবনী আমার রুমের সামনে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি ওকে বললাম,
— কিরে, কিছু বলবি?
অবনী তখন বললো,
-“ভাইয়া আজ কিন্তু মাসের ৫তারিখ। তুমি বলেছিলে এই মাসের ৫তারিখ বেতন পেলে আমায় ফোন কিনে দিবে।”
আমি হেসে বললাম,
— যা সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার সময় তোর জন্য মোবাইল কিনে আনবো
অবনী আনন্দে উত্তেজিত হয়ে বললো,
-“তোমায় যে ফোনের কথা বলেছিলাম সে ফোনটাই কিনে দিতে হবে। অন্য ফোন দিলে আমি কিন্তু নিবো না।
আমি মুচকি হেসে বললাম,
— ঠিক আছে এটাই কিনে দিবো..
অবনী হাসতে হাসতে চলে গেলো। আমাদের ভাই বোনের কথা গুলো মনে হয় মা রুমের বাহিরে থেকে শুনেছিলো। মা তখন আমায় বললো,
-” তুই অবনীকে কিসের ফোন কিনে দিবি?”
আমি মাকে বললাম,
— কম দামী একটা একটা ফোন কিনে দিবো মা। ইন্টারে পড়ে একটা মেয়ে ফোন তো এখন লাগেই।
মা রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“সত্যি করে বল তো অবনী তোর কাছে কতটাকা দামের ফোন চেয়েছে?”
আমি মাকে কখনো মিথ্যা বলি না। তাই মাথা নিচু করে মাথা নিচু করে মাকে বললাম,
— বেশি না, যে ফোনটা চেয়েছে সেটার দাম ২২হাজার টাকার মতো।
আমার কথা শুনে মা আমায় বললো,
-“তুই ২৫হাজার টাকা বেতনের চাকরি করিস তার তোর বোন কিনা তোর কাছে ২২হাজার টাকা দামের ফোন চেয়ে বসে আছে। বাপ মরা মেয়ের এতো শখ কেন? দাড়া আমি জমিদারের মেয়েকে বুঝাচ্ছি।”
এই কথা বলে মা যখন চলে যাচ্ছিলো তখম আমি পিছন থেকে মায়ের হাত ধরে বললাম,
— মা তুমি অবনীকে কিছু বলবে না। ছোট বোন আমার কাছে একটা আবদার করেছে। আমি যদি সেটা পূরণ না করি তাহলে আমি কিসের বড় ভাই
মা মুখটা মলিন করে বললো,
-“কিন্ত তুই”–
— কোন কিন্তু না মা। টাকা আমি কোন না কোন ভাবে জোগাড় করে ফেলবো। তবুও আল্লাহর দোহাই লাগে তুমি আমার বোনকে কিছু বলো না…
এইকথা বলে আমি অফিসে যাওয়া উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হলাম। একটা খালি রিকশা দেখে আমি ডাকতে চেয়েও ডাকলাম না। শুধু শুধু ২০টাকা রিকশাভাড়া দেওয়ার চেয়ে কিছুটা পথ না হয় হেঁটে গেলাম।
অফিসে ঢুকার আগ মুহূর্তে আমার আরেক ছোটবোন লাবণী আমায় ফোন দিয়ে বললো,
-“ভাইয়া মেসের ভাড়া বাড়িয়েছে, তাছাড়া এইমাসে আমার কিছু বই কিনতে হবে। তুমি এইমাসে আমায় ৫হাজার না ৮হাজার টাকা পাঠিও।”
আমি শান্তগলায় বললাম,
— ঠিক আছে তোকে ৮ হাজার টাকাই দিবো। তুই শুধু ভালো করে পড়াশোনা করিস। আর তোর যা যা লাগবে আমায় বলিস….
সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে লাবণীকে ৮হাজার টাকা পাঠালাম। বাসায় এসে অবনীকের হাতে ওর পছন্দের ফোনটা তুলে দিলাম। ফোনটা হাতে পেয়ে ছোটবোনের হাস্যেজ্জ্বল চেহারাটা দেখে আমার চোখে জল এসে গেলো। অবনী ফোন নিয়ে অন্য রুমে চলে গেলে মা আমার হাতটা ধরে বললো,
-“আমি তোর মা আমার কাছে মিথ্যা বলিস না। তুই এতো গুলো টাকা কোথায় পেলি?”
আমি মুচকি হেসে মাকে বললাম,
— আমার ফোনটা বিক্রি করে দিয়েছি।
মা তখন কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-” তোর বাপ তো মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। আর এই সংসার আর দুই বোনের দায়িত্ব তোর কাঁধে দিয়ে গেছে।”
আমি মাকে বললাম,
— তুমি শুধু দোয়া করো মা। আমি যেন ভাই হয়ে বাবার দায়িত্ব পালন করতে পারি।
পরেরদিন সকালে আমি আর ছোট বোন নাস্তার টেবিলে নাস্তা করছি আর মা অন্যরুমে ছিলো। হঠাৎ ছোট বোন আমার দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“দেখো ভাইয়া আমরা এইখানে সবজি দিয়ে রুটি খাচ্ছি আর আপু ঐখানে বান্ধবীদের চাইনিজ খাওয়াচ্ছে”
অবনীর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে দেখি লাবনী ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেছে আর ক্যাপশনে লেখা, “বান্ধবীদের আজ চাইনিজ খাওয়ালাম”
আমি অবনীকে বললাম,
–তোকেও চাইনিজ খাওয়াবো যদি এই কথাটা মাকে না বলিস
আমি আমার জায়গা থেকে সব সময় চেষ্টা করেছি আমার ছোট দুইবোনের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে। নিজে সল্প বেতনের চাকরি করার পরেও বোনদের পড়াশোনা করিয়েছি ভালো জায়গায় বিয়ে দিয়েছি।কখনো নিজের কথা ভাবি নি। একদিন মা আমায় ডেকে বললো,
-“অনেক তো এই সংসারের জন্য করলি। বোনদের বিয়েও দিলি। এইবার নিজের কথা ভাব। বয়সতো কম হয় নি। এইবার বিয়ে কর”
আমি তখন মাকে বললাম,
— মা, আমি চাচ্ছিলাম এই চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা করতে। কিন্তু ব্যবসা করতে লাখ পাঁচেক টাকা লাগবে। কিন্তু এতো টাকা কোথায় পাবো সেটাই ভাবছি।
আমার কথা শুনে মা বললো,
-“গ্রামে যে তোর বাবার জায়গা আছে সেগুলো বিক্রি করে দে”
— কিন্তু মা এই জায়গাগুলোতে তো আমার বোনেরও হোক আছে। ওরা সম্মতি না দিলে আমি একা কি করে বিক্রি করবো?
মা আমায় বললো,
-“যে বোনদের জন্য তুই এতো কিছু করলি ওরা কখনোই আপত্তি জানাবে না দেখিস।”
পরের দিন মা আমার দুই বোনকে ফোন দিয়ে বাসায় এনে সম্পত্তির বিষয়টা বললো। ওরা দুইজনেই এক সাথে বলে উঠলো আমরা কেন আমাদের বাবার সম্পত্তির হোক ছাড়বো? আমাদের প্রাপ্য সম্পত্তি আমাদের হিসাব মতো বুঝিয়ে দিতে হবে।
মা অবাক হয়ে ওদের বললো,
-” তোদের বাপ মারা যাবার পর তোদের ভাই তোদের জন্য এতো বছর এতো কষ্ট করলো। তোরা কি পারিস না এইটুকু ছাড় দিতে৷ তাছাড়া তোদের স্বামীদের অবস্থা ভালো। সামান্য সম্পত্তির জন্য তো কিছু কমে যাবে না”
তখন ছোটবোন অবনী বললো,
-” কি এমন করেছে আমাদের ভাই আমাদের জন্য? আমরা অভাবেই বড় হয়েছি। তাছাড়া বড় ভাইয়ের কর্তব্য বড় ভাই পালন করেছে। তাই বলে আমাদের সম্পত্তি তাকে দিয়ে দিতে হবে নাকি?”
আর লাবণী বললো,
-“আমি হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করার সময় ভাই আমার খরচের বাহিরে একটাও বেশি দেয় নি। দরকার হলে আমার পিছনে ভাই যতটাকা খরচ করেছে আমি সব শোধ করে দিবো। তবুও বাপের সম্পত্তির ভাগ আমি ছাড়বো না।”
আমি বোনদের কথা শুনছিলাম আর নিরবে চোখের জল ফেলছিলাম। এতো কিছুর পরেও আমি বোনদের জন্য নাকি কিছুই করি নি।
আমি তখন মাকে বললাম,
— ওরা ঠিকিই বলেছে মা। আমি শুধু বড় ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করেছি। এর জন্য তো আমি ওদের কাছে ওদের হোক দাবি করতে পারি না। আমি ওদের প্রাপ্য সম্পত্তি ওদের বুঝিয়ে দিবো
বোনরা চলে গেলে মা আমার হাতটা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-“বোনদের জন্য এতকিছু করে তুই কি পেলি বাবা?”
আমি কান্নাভেজা চোখে মুচকি হেসে মাকে বললাম,
–কিছু পাওয়ার জন্য তো আমি ওদের জন্য কিছু করি নি। আমি শুধু বড় ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করেছি…
★★বড়ভাইয়ের_দায়িত্ব
★★আবুল_বাশার_পিয়াস
(সমাপ্ত)
2. ভালোবাসার আরেক নাম বড় ভাই
আনিস ভাই আমার কাছে ব্যর্থ একজন মানুষ। যেই মানুষের বউ তাকে ছেড়ে তার বন্ধুর সঙ্গে চলে যায় তিনি ব্যর্থ না হওয়ার কোন কারণ নেই। উনার দুই সন্তানও তাদের মায়ের সঙ্গে আছে। জুয়েল ভাই সন্তানসহ ভাবীকে গ্রহণ করেছে এবং আমার জানামতে উনারা বেশ ভালো আছেন। জুয়েল ভাই ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে আনিস ভাই আমার চোখে উড়নচণ্ডী মানুষ।
তিনি প্রায় মানুষের কাজে দৌড়াদৌড়ি করেন। একবার উনাকে দেখলাম মন খারাপ করে বসে আছেন। তখন ভাবী এবং বাচ্চারা উনার সঙ্গে থাকতেন। আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম
কি ব্যাপার আনিস ভাই? আপনার মন খারাপ কেন?
ভাই জানেন আমার উপর তালায় একজনের ক্যান্সার। উনাকে দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নেয়া উচিত। দেশের ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু লোকটার বাঁচার বড় ইচ্ছে। আমার সঙ্গে দেখা হলেই বলে
আনিস আমার মনে হয় দেশের বাইরে গেলে আমি সুস্থ হয়ে যাবো।
টাকা পয়সা থাকলেতো পরিবারের সদস্যরা উনাকে দেশের বাইরে নিয়ে যেতেই পারে। আমি বললাম।
টাকা পয়সাতো আছে। দুই ছেলে কানাডাতে থাকে। আর মেয়ে থাকে দুবাইতে । কিন্তু সবচাইতে সমস্যা কি জানেন কারোই সময় নেই। সবাই বেশ ব্যস্ত। উনাকে দেখলে এত মন খারাপ হয়। মনে হয় আমি উনাকে দেশের বাইরে নিয়ে যাই। লোকটার মনের আশা পূরণ হউক।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম আনিস ভাইয়ের চোখ ছলছল করছে। এর কিছুদিন পর দেখি উনি ইন্ডিয়া থেকে আমাকে ফোন দিয়েছেন।
ভাইজান চাচার জন্য খাস দিলে দোয়া করবেন। আজকে উনার একটা অপারেশন আছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম
আনিস ভাই আপনার বাবাতো একমাত্র ছেলে জানতাম। চাচা আসলো কোথা থেকে?
আরে ভাই আমার উপর তালার সেই চাচা। উনাকে নিয়ে ইন্ডিয়াতে আসছি। অনেক কষ্টে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। চাকরি থাকে কিনা সন্দেহ। তবুও চাচার আশা পূর্ণ হউক।
সেই আনিস ভাই কয়েকদিন ধরে আমাকে নক করছে।
ভাই আপনার বাসা চেক করে দেখবেন। কোন পুরাতন শীত বস্ত্র আছে কিনা? এই দেশের কত মানুষ যে শীতে কষ্ট পাচ্ছে তার হিসেব নেই। কত বাচ্চা শিশু এই শীত বস্ত্রের অভাবে রাতের বেলায় ঠাণ্ডায় কাপতে কাপতে ঘুমাতে পারছে না। অথচ আমাদের ঘরের আলমিরাতে কত শীত বস্ত্র অবহেলায় পরে আছে।
আমি আনিস ভাই কথার সঙ্গে একমত হই। কিন্তু সেগুলো আর বের করা হয় না। একদিন তিনি নিজে এসে হাজির।
আমি কিঞ্চিত বিরক্ত হই। মানুষ এতো নাছোড়বান্দা হলে মুশকিল। উনি আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন
ভাই আপনি যখন নিজের হাতে আপনার একটা সুয়েটার শীতের রাত্রিতে কাঁপতে থাকা কোন মানুষকে দিবেন। সে যখন আপনার দিকে তাকিয়ে স্বর্গীয় হাসি দিবে তখন আপনার কাছে মনে হবে আপনি বুঝি বেঁচে আছেন এই মুহূর্তটির জন্য।
আমি তবুও আমার বিরক্ত গোপন করে আলমিরা থেকে আমার পুরাতন শীতবস্ত্র তাকে বের করে দিলাম।
আমার মনে মনে হাসি পায়। এই লোকটার কাণ্ড কারখানা দেখে। উনার বউ উনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। ছেলেমেয়েরা উনার সঙ্গে নেই। লোকটার তেমন টাকা পয়সা নেই। আমি শুনেছি উনি যেই ডিপার্ট্ম্যান্টে কাজ করে সেটাতে টাকা বানানোর অনেক সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সততার কারণে উনার জীবনে প্রাচুর্যতা নেই। খুব সাধারণ জীবন উনার।
উনি আমাকে রীতিমত জোর করে শীতের রাত্রিতে বের করে নিয়ে এসেছেন। হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে শীত বস্ত্র সংগ্রহে আমার বাসায় চলে আসাতে আমি বিরক্ত হয়েছিলাম। এখন কোনভাবে সেই ঘটনাকে ব্যালেন্স করার চেষ্টা করছেন। ঢাকায় বেশ শীত পড়েছে। আমি শার্ট, ভেতরে গঞ্জি, তার উপর জাম্পার, এবং একটা জ্যাকেট দিয়ে ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার চেষ্টা করছি। কানে কান টুপি। আমরা মালিবাগের রাস্তা দিয়ে হাটছি। এদিক সেদিক অনেক মানুষ, অনেক বাচ্চা ছেলে, মেয়েকে দেখতে পাচ্ছি যে শীতে কাঁপছে। কেউ কেউ আগুন ধরানোর চেষ্টা করছে। তাদের পড়নের পোশাক দেখে আমার নিজের কাছেই লজ্জাই লাগছে। মনে হচ্ছে এতদিন এদের দেইনি কেন। আনিস ভাই একটা ভ্যান গাড়ি ভাড়া করেছে। ভ্যান গাড়ি ভর্তি শীত বস্ত্র। যাকেই পাচ্ছেন তাকেই সুয়েটার, জ্যাকেট, শার্ট দিচ্ছেন।
সেইসব মানুষের হাসি দেখে, তাদের চোখের জল দেখে আমার সত্যি বেশ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে ভালো খাওয়া, সুন্দর জায়গায় ঘুরা, এইসবের চাইতে বড় আত্মতৃপ্তি একজন মানুষকে যদি খুশী করা যায়। তার প্রয়োজনে যদি পাশে দাঁড়ানো যায়। কিছুক্ষণ পর দেখি একটা গাড়ি থেকে দুইজন ছেলেমেয়ে এবং একজন মহিলা নেমেছে। ছেলে মেয়ে গুলো অনেক শীতবস্ত্র নিয়ে এসে আনিস ভাইয়ের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তারা প্রবল উৎসাহ নিয়ে বিতরণ করছে।
মহিলাটি আমার সঙ্গে হাঁটছে।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম
আপনারা কি কোন এন জি ও থেকে এসেছেন?
জি না আমি ওর স্ত্রী ছিলাম। এবং এই দুইজন ছেলে মেয়ে হচ্ছে আমাদের ছেলে মেয়ে।
আমার সঙ্গে আনিস ভাই এর অনেক দিনের পরিচয় থাকলেও উনি আমাকে কখনো বউ বাচ্চার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন নি। তাই আমার চেনার কথাও না। কিন্তু উনাদেরকে এখানে দেখে আমার অবাক লাগছে। আনিস ভাই কিছুক্ষণ পর পর বাচ্চা দুটোকে জড়িয়ে ধরছেন।
ভাবি ভালো আছেন?
মহিলাটি হেসে ফেললেন। ভাই আমি একসময় ভাবী ছিলাম কিন্তু এখন নেই। কিন্তু এখনো ও যেখানে কোন চ্যারিটি করতে যায় আমাদের জানায় আমরা ওর সঙ্গে যুক্ত হই। আমাদের ছেলে মেয়েরা ওর জন্য পাগল বলতে পারেন।
আমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছি।
ভাই সত্যি কথা কি জানেন আমার সন্তানেরা আনিসকে ভীষণ ভালোবাসে। তারা তাকেই তাদের রোল মডেল হিসেবে চিন্তা করে। আমার ছেলে, মেয়েরা আমার মতো লোভী হয়নি। আমার কাছেও আনিস খুব ভালো একজন মানুষ। বলতে পারেন আমি তার জীবনে নেই কিন্তু সে আমাদের জীবনে প্রবলভাবে আছে। তবে আমার ও উপায় ছিল না। ভালো একজন মানুষ হওয়া এবং একজন ভালো স্বামী হওয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। সংসার জীবনের ভালো থাকা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। সেখানে শুধু ভালোমানুষি দিয়ে চলে না।
আমি মাথা নাড়লাম।
আপনি কি উল্টা দিকে একজন মানুষকে দেখতে পাচ্ছেন। সিগারেট টানছে।
জি।
উনি আমার বর্তমান স্বামী জুয়েল। ও আমাকে সবকিছু দিয়েছে। প্রাচুর্যতা, আলিশান লাইফ, আমাদের বাচ্চাদের জন্য উন্নত পড়াশুনা, তাদের জন্য অভিজ্ঞ টিচার। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন। আমার বাচ্চারা সেসব সুবিধে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা খুব সাধারণ জীবন যাপন করে আনিসের মতো।
তাদের স্কুলে এইম ইন লাইফ রচনায় তারা লিখেছে যে তারা তাদের জন্মদাতা পিতার মতো পরোপকারী হতে চায়। তারা আনিসের মতো হতে চায়। মাঝে মাঝে খুব দুঃখ পাই, কষ্ট পাই কিন্তু আবার কখনো আমার সন্তানদের নিয়ে খুব গর্বও হয়। ওরা আমার মত হয়নি। ভালো মানুষ হয়েছে। জানেন আজ তাদের আপনি যেই আনন্দ দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু বাসায় তারা সারাক্ষন মনমরা হয়ে থাকে। আমি তাদের সবকিছু দিতে চেষ্টা করার পরেও তাদের আনন্দ দিতে পারিনি। জানেন জুয়েলের কোনদিন সন্তান হবে না। ও কিন্তু এদের নিজ সন্তানের মতো ভালোবাসে। জুয়েল আনিসকে খুব ঈর্ষা করতো তার জীবনের সবসময়। সে আমাকে নিয়ে আনিসকে পরাজিত করতে চেয়েছে। সে আমাকে ঠিকই পেয়েছে। কিন্তু আনিসকে পরাজিত করতে যেয়ে আমি এবং জুয়েল দুইজনই পরাজিত হয়ে বসে আছি।
আমি দেখতে পাচ্ছি চাঁদের আলোয় এক বাবা, তার সন্তানদের মানবতা শিখাচ্ছে। ভালোবাসা, মায়া ছড়িয়ে দিতে হয় তা শিখাচ্ছে। বাচ্চাগুলোর চোখ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। তাদের মুখে আনন্দের, উচ্ছ্বাসের হাসি।
আমি ভাবছি মানব জীবন কত অদ্ভুত হয়। মানুষের কত ধরনের প্রাপ্তি হয়। এই আপাদমস্তক অতি সাধারন মানুষটা আমার কাছে ব্যর্থ একজন মানুষ কিন্তু আজকে তাকে আমার চাইতেও সফল মানুষ মনে হচ্ছে।
#আনন্দের_ফেরিওয়ালা
#আমিনুলের_গল্প_সমগ্র
3.ভাই বোনের সম্পর্ক নিয়ে স্ট্যাটাস
#গল্পঃ_আপুর_রুম
কাল কলেজের অনুষ্ঠানে নাচানাচি করে সকালে বাসায় এসে কোন রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছি জানি না।
নিশ্চয় আপুর রুম এইটা। কাঁঠালচাপা ফুলের গন্ধ এই রুমে। ও মনে হয় বাসায় নেই। ভার্সিটি গিয়েছে। আমার রুমে তো নিজের মোজা আর শার্টের গন্ধে নিজেরেই বমি আসে।
হঠাৎ আপুর চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গে।
-এই ছাগলটা আমার রুমে কেন? পুরো ঘরে পাঠা পাঠা গন্ধ বেড়োবে এখন। এই উঠ, যা বের হয় রুম থেকে।
গায়ে কয়েকটা কিল ঘুসি দিতেই ঘুম আর একটু ভাঙ্গল। কোন মতে উঠে ঢুলতে ঢুলতে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। এতক্ষন নাকে সুবাস ছিলো। নিজের রুমে আসতেই আর নেই।
বাসায় মেহমান এলে সব গাদাগাদি করে আমার রুমে। আপুর রুম টা কত বড়। সব কেমন যেন গুছানো। একটা জানলা আছে। এইটার জন্য রুমটা প্রতি আমার লোভ। আমার রুম টা সামনের দিকে জানলা খুললে রাস্তা। রাতের ১ টা অবধি মানুষ হাটে। সিগারেট খাওয়া যায় না। আপুর রুম টা পিছনের দিকে। ওদিকে সব গাছ। ওর রুমে শুধু কাজিনরা আসলে শুতে পারে। কাজিন-
ও শিট। মিতুকে ফোন করতে ভুলেই গেছি। আবার বাসায় না বিচার নিয়ে আসে। মামাতো বোনের সাথে প্রেম করলেও জ্বালা আছে। মায়ের বোনের কাছে বিচার পাঠিয়ে দেয়। উঠে ফ্রেশ হয়ে খেতে গেলাম।
আপু তখনো নাকি রুম পরিস্কার করছে। আমি নাকি গন্ধ করে ফেলেছি সারা রুম। দেখলাম আমার ফেলে আসা শার্ট গেঞ্জি সব ধুয়ে দিয়েছে। খেতে বসলাম। সবাই আসল।
আজ মাছ রান্না হয়েছে।
– মা মাছের মাথাটা কিন্তু আজ আমি খাবো,
-আহা, কত শখ! আমি খাবো মাছের মাথা। তুই আবার মাথা খেতে জানিস?
এই বলে মাথা টা নিয়ে নিলো আপু।
-মা, তুমি কিছু বলো না আপুকে।
মা বলল-
– ও খেতে চায়। খেতে দেয় না।
-মায়েরা নাকি ছেলের পক্ষ নেয়৷ আর তুমি?
– মেয়েকে তো বিয়ে দিয়ে দিলে চলে যাবে। যত ভালো ঘরে দিই না কেন আমি দেখব কি খাচ্ছে না খাচ্ছে? খাওয়াতে পারব? তোকে তো সারাজীবন খাওয়াতে পারব।
-কখন দিচ্ছো বিয়ে? তারাতারি দিয়ে দাও। তারপর ওর রুমটা আমি নিয়ে নিবো।
– কত শখ! মাথা ফাটিয়ে দিবো আর আমার রুমে গেলে।
বিকেলে আপুর রুমে গেলাম। আপুর রুমে ডুকলেই মনে হয় ভিন্ন এক রুম। চারিদিকে কেমন টানাটানা গুছানো সব। বিছানার চাদর, পড়ার টেবিল, ওর জিনিসপত্র। জানলা দিয়ে বাগানবিলাস দেখা যায়। আর কোথায় থেকে যেন কাঠালচাঁপা ফুলের সুভাস। ওর সাথে অনেকক্ষন গল্প করে আসার সময় পারফিউমের বোতলটা নিয়ে এলাম।
কিছুদিন পর বাসায় বেশ নাস্তা রেডি হচ্ছে। জানলাম আপুকে দেখতে আসছে। বিয়ের পাকা কথা ওরা আপুকে আগেই দেখেছে।
বেশ খুশী সবাই। আপুকে বেশি খুশি লাগছে।আমারো বেশ খুশি লাগছে। সব হয়ে যাওয়ার পর মিতুকে ফোন দিলাম,
-জানো আপুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সামনের মাসে বিয়ে।
– বাহ, বেশ ভালো তো। এখন তাইলে তিশা আপুর রুমটা তোমার হবে।
-মানে? আপু কোথায় থাকবে তো?
-ওমা, আপু শুশুড় বাড়ি চলে যাবে না? তখন তো রুমটা খালিই পড়ে থাকবে।
আমার মনটা কেমন যেন খালি খালি লাগছে এরপর থেকে। আপু থাকবে না?
একটা মাস কোনদিকে চোখের পলকে চলে গেল। আপুর বিয়ে হয়ে গেলো। আপুকে বিদায় দিতে আমার মনে হচ্ছিল কি যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
আপুর বিয়ের পর থেকেই বুঝা যায় কি হারিয়ে গেছে ঘর থেকে। সব যেন নিশ্চুপ। ঘরে টানাটানা গুছানো ভাবটা নেই। ঘরে সে হাসি খুশি ভাবটা নেই। খেতে বসলে আমি মা বাবা কেমন যেন চুপচাপ খেয়ে উঠি। আপু থাকতে এমন খাবার টেবিল চিন্তায় করা যেত না।
আমি আপুর রুমে যাই এখন। কেমন যেন ঢিলেঢালা এখন রুম। সব আছে তারপর ও কেমন যেন। ফুল গাছ ও আছে তবে এখন আর কাঁঠালচাপা ফুলের গন্ধটা নেই।
আমি প্রায় আপুর রুমে গিয়ে বসে থাকি। ওর অনুভব পাই। ওর বিছানায় ঘুমাই না এখন। ঘুমালে মনে হয় এই বুঝি এসে মারবে।
-এই ছাগল, এই সৌরভ, উঠ।
আপু আসে না। এই ভাবে ডেকে তুলে দেয় না। এইভাবে ঘুম ভাঙার আশায় আমার ঘুমেই আসে না।
আপু এখন বাসায় আসে দুই দিনের জন্য। আসলে এই রুম নিয়ে ওর কোন বাড়াবাড়ি নেই। মায়ের সাথেই থাকে। নানান কথা সংসারের। যে আপু গল্প আর কবিতা নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করত। এখন নুন পেয়াজ আর শাশুড়ীর গল্পে তার ঘন্টা চলে যায়। দুলাভাই সহ ঘুমাই সে রুমে। তারপর চলে যায়। সে রুমে তার কিছু ফেলে যায় না। শুধু ফেলে যায় আমার জন্য ওর গায়ের গন্ধ এই রুমে।
আমি ওকে জিজ্ঞেস করি –
-তোর এই রুমের জন্য মন কেমন করে না?
ও বলে-
-খুব করে রে। এই রুমটাই আমার বলতে শুধু আমার ছিলো। খাট, টেবিল, আয়নাটাও শুধু আমার ছিলো। এখন যতই আমি সব গুছিয়ে রাখি না কেন যেন ঠিক তা আমার নয়।
দুপুরে খেতে বসলে মা আমায় মাছের মাথা তুলে দিলে। আমি বলি-
-আমাকে দিচ্ছো কেন?
-তো কাকে দিবো?
-আপুকে –
বলতে গিয়ে থেমে যাই আমি। মাকে বলি,
-তুমি মাছের মাথাটা হটবক্সে দাও আমি আপুকে দিয়ে আসি।
-যা, একটা মাছের মাথা নিয়ে বোনের বাড়ি যায় নাকি?
-আরে তুমি দাও না। কিছু হবে না।
মায়ের কথা না শুনে আমি আপুর শশুড় বাড়ি গিয়ে ভুলেই করে ফেলি। বাসা ভর্তি মেহমান। কোরমা, পোলাও, খাসির রেজালা রান্না হয়েছে। আমি গিয়ে হাজির একটা মাছের মাথা নিয়ে। আপুরও সবার সামনে বক্স খুলে লজ্জায় পড়ে গেল।
সবার খাওয়ার পর আমাকে খেতে বলে। আমি আপুকে ডাকতে গিয়ে দেখি আপু আবার ভাত রান্না করছে।
-কিরে আবার ভাত রাধছিস? আমি খেয়ে এসেছি।
-আরে না। পোলাও অনেক আছে। তুই খেয়ে ফেল। আমি মাছের মাথাটা খাওয়ার জন্য সাদা ভাত রাধছি। আসলে এইখানে মাথা খাওয়া হয় না। ছেলেরা খায় তো।
আপু অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে ভাত নাড়তে থাকে।
খেয়ে আপুর রুমে গেলাম। এই রুমটা আমাদের বাড়ির রুম থেকে বিশাল। এইখানে সব কেবিনেট। বড় বড় আলমারি কেমন যেন সব সাজানো। আপুর কোন ছোঁয়া নেই। জানলাও নেই কারণ সব দিকে এসি।
এই রুম টা দুলাভাইয়ের।কেমন যেন আপুর মনে হয় না আমার। এই রুম টা নাকি আগে দুলাভাইয়ের বড় বোনের ছিলো।
আমি আর কখনো মাছের মাথা নিয়ে আপুর শশুড় বাড়ি যাই নি।
অনেক বছর পর এক সকালে আপুর রুমটা চেঞ্জ হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলে,
বাবা বলে,
-তোর জন্য নতুন খাট আর আলমারী বসানো হচ্ছে।
-কেন?
– কেন মানে? বিয়ের পর তুই কি তোর ঐ গুদাম ঘরে থাকবি নাকি? এখন থেকে তোর রুম এইটা।
আমার রুম? না আমি মানতে পারি না। আমার মনের মাঝে অজান্তে এইটা আপুর রুমেই জানি।
মা আমাকে মাঝে মধ্যে বলে,
– তোর রুম থেকে জিনিসটা নিয়ে আয়।
আমি সারাঘর খুঁজে আসি। শেষে মা বলে
– আরে গাধা তোর আপুর রুমে।
-হুম। আপুর রুম এখন যা আমার রুম।
আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে আপুর সব কিছু। মা এখন আপুর ফেলে যাওয়া ওরনা গুলো দিয়ে কাথা কম্বল ঢেকে রাখে৷ ওর সেলোয়ার কামিজ এখন ফ্লোরে পানি পড়লে উইজ করা হয়। হারিয়ে যাচ্ছে ওর ছোঁয়া এই ঘরের থেকে।
রুমটাতে এখন আবার প্রাণ ফিরে এসেছে। মিতু ও সব গুছিয়ে রাখে। তবে সে যেন টানটান ভাবটা নেই। তবে এখন কামীনি ফুলের সুবাস ছড়ায় এই রুমে।
এক দুপুরে খেতে বসলাম। তখন বেল বেজে উঠে। অয়ন এসেছে। অয়ন আর মিতু পিটেপিটি ভাই বোন। খুব মারামারি করত।
একবার মিতুর হাত ভেঙ্গে দিয়েছিল মারামারি করে।
– অয়ন, আয় আয়।
– মা একটা মাছের মাথা পাঠিয়েছিল মিতুর জন্য।
আমি হেসে বলি,
-মামী পাঠিয়েছে নাকি তুই এনেছিস?
মিতু তুমি মাছের মাথা খেতে ভালোবাসো বলো নি কেন?
– না মানে তুমি খাও তো।
-আরে আমি তো কেউ খায় না তাই খাই। এখন থেকে তুমি খাবে।
আমি রুমে গিয়ে সিগারেট ধরালাম। টেবিল থেকে অয়ন আর মিতুর হাসির শব্দ হচ্ছে। আসলে কি অদ্ভুত পবিত্র হয় ভাই-বোনের সর্ম্পক গুলো তাই না?
বিশ বছর পর। বাসায় চিৎকারের শব্দ। এখন বাবা মায়ের রুম টা আমাদের রুম। আমি রুম থেকে বের হই, আমার ছেলে অর্ক চোখ মুছতে বের হচ্ছে।
-কি রে কি হয়েছে?
-আপুর রুমে শুয়েছিলাম। আপু মেরে বের করে দিয়েছে।
আমি বিড়বিড় করে বলে উঠলাম,
-আপুর রুম?
যেন অনেক বছর পর কারো সাথে দেখা এমন লাগল শব্দটা৷
আমি সে রুমে গেলাম। এইটা এখন আমার মেয়ে পারুলের রুম। সব দিক যেন সে টানাটানা গুছানো ভাব টা আছে এখন। আর আমার নাকে হঠাৎ সেই কাঁঠালচাপা ফুলের গন্ধটা লাগলো।
#দোলনা_বড়ুয়া_তৃষা
#Repost.