#এক কাপ চা
.
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ৩৪
(১০০)
তাশদীদের খুব ইচ্ছে হয়েছে তার নিজ বৌ, একমাত্র বৌ এর হাতে সে লেবুর এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত খাবে। তার পুরো দিনের সকল যন্ত্রণা, চিন্তা, ক্লান্তির থেকে কিছুটা স্বস্তি পাবে সে। আর সাগরিকার ইচ্ছে হলো সে তার প্রাণ প্রিয় স্বামীকে আজ ইচ্ছে মতোন নাকানিচুাবানী খাওয়াবে। যখন তখন তাকে ওমুক তমুকের সাথে গুলিয়ে ফেলার এই বাজে ইনফেকশন টা যে তার হয়েছে, এই ইনফেকশন থেকে তাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তার এই নাকানিচুাবানীটা বড্ড বেশি প্রয়োজন।
ফ্রিজ থেকে গোটা চারেক লেবু বের করলো সাগরিকা। খুব যত্ন সহকারে লেবু গুলো পরিষ্কার করে কেটে একটা গ্লাসে চিপড়ে নিয়ে দেখলো আধা গ্লাস লেবুর রসেই ভরে গেছে।
এটা দেখে মনে মনে বেশ খুশি হলো সে। এরপর ছোট্ট একটা জগে পানির সাথে লেবু মিশিয়ে তাতে চার চামচ লবণ মিশিয়ে ইচ্ছে মতো নাড়তে লাগলো সে। এরপর একটা গ্লাসে শরবত আর বরফ নিয়ে এগিয়ে চলল তাশদীদের দিকে।
ইদানীং তার মাথায় একটাই গান বাজে। যার গীতিকার, সুরকার সবই হচ্ছে ইয়ামিন। আর গানটা হলো,
পানির নিচে ডলফিন টা তো জঙ্গলের মতোন এ দাদা জংগলের মতোন।
গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে তাশদীদের সামনে শরবতের গ্লাস রেখে দাঁড়িয়ে রইল সে।
তাশদীদ যেই মাত্র গ্লাসটা হাতে নিয়ে শরবতে চুমুক দিবে সেই মুহুর্তে তার মা এসে সাগরিকাকে বলল,
“তাশদীদ থামো।শরবর মুখে তুলো না।শরবতে লবন।আর সাগরিকা, জানিস? পুরুষ মানুষ সারাদিন পর শান্তি খুঁজে তার ঘরের মানুষের কাছে। সারাদিন তুমি কি কাজ করো? সব তো আমি আর তোমার মা মিলেই করি। বেহুশের মতোম দশটা অবধি ঘুমাও। সকালে ছেলেটা যখন অফিসে যায় তখন ও তুমি এগিয়ে এসে কোনো দিন বলো না যে এক গ্লাস পানি বা একটা ফাইল এগিয়ে দেই। সারাটা দিন ঘুমাও, ফোন টিপো। অথচ আজ এক গ্লাস লেবুর শরবত চেয়েছে তাই তুমি দিতে পারো নাই?চিনি বাদ দিয়ে লবন দিছো? দেওয়ার আগে কি একবার মুখে দিয়ে দেখা যায় না? এই শরবত খেলে ও বমি করবে না?এখন মনে হচ্ছে তোমার বড় আব্বু ঠিক বলেছিল
ঘরের মেয়ে ঘরে রেখে কোনো সংসার হবে না। তাকে দিয়ে কোনো কাজ করানো যাবে না, না যাবে তাকে কিছু বলা। মাঝ থেকে ছেলের জীবন, সংসার নষ্ট।”
তাশদীদের মা এতগুলো কথা বলে গ্লাসের দিকে হাত বাড়ালো।তাশদীদ সাগরিকার দিকে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে পানি টলমল করছে। এই বাড়িতে তাশদীদ ছাড়া ওকে কেউ কখনো ধমক দেয় না।যতই ভুল করুক না কেন সবাই ভুল শুধরে দেয় কিন্তু আজ কেন এতগুলো কথা শোনালো তা বুঝতে পারলো না।
তাশদীদের মায়ের হাত থেকে শরবতের গ্লাস সে নিজে হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটা শেষ করে ফেলল।
মা বার বার বারণ করা স্বত্বেও সে শুনলো না।খাওয়া শেষ করে সাগরিকার দিকে তাকিয়ে সে বলল,
“মা, যেমন হোক না কেন ওর সব অধিকার আছে আমার উপর। ও যাই খাবার বানিয়ে আনুক, যেমন হোক আমি খেতে পারবো।তার থেকে বড় কথা তোমাদের কাজে সমস্যা হলে কাজের লোক বাড়িয়ে নেও।আমিও চাই না তোমাদের বুড়ো বয়সে তোমাদের কষ্ট হোক।ওকে হাতে ধরে কাজ শিখিয়ে নাও, বকাবকি করো না।আর এখন কী ওর বয়স হয়েছে সংসার সামলানোর? সময় হলে ও দায়িত্ব নিয়ে নিবে মা।”
সাগরিকা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তাশদীদের দিকে। তাশদীদ খুব ভালো করেই জানে সাগরিকা ইচ্ছে করে তাকে এমন শরবত এনে দিয়েছে তবুও তার কোনো অভিযোগ নেই। কারণ সে চায় সাগরিকার পুরো পৃথিবী তাশদীদময় হোক, সেখানে অন্য কারো প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা থাকুক আজীবন।
(১০১)
তাশদীদের দাদীর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে সে সম্পূর্ণ ভাবে সুস্থ নয়। তার কথাগুলো এখনো অস্পষ্ট। অস্পষ্ট উচ্চারণে সে তার ছেলেদের কাছে ডাকলেন।সামিনার কথা কিংবা স্নেহার কথা একবারো জিজ্ঞেস করলেন না, সে মুখ খুলে প্রথমেই জানতে চাইলেন জুলি কোথায়। জুলি দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে ডাকতেই সে দ্রুত ঘরের ভিতরে ঢুকলো।
জুলিকে হাত ইশারায় ডেকে ভদ্রমহিলা বলল,
“তুই আমার কাছে থাক। বাকীদের বাইরে যেতে বল।তোরে ছাড়া আমি আর কাউরে বিশ্বাস করি না।”
“আম্মা, আফনে কোনো টেনশন নিয়েন না আমি আছি এইখানে। আফনে কী খাইবেন?আমি নিজ হাতে রাইন্ধা আনুম।জানি কাউরে বিশ্বাস আপনি করতে পারতাছেন না।আর এইটাই স্বাভাবিক। কারণ নিজের পোলার বৌ যদি শাশুড়ীরে তাও বয়স্ক শাশুড়ীরে ধাক্কায় মাইরা ফেলতে চায় তখন কী আর কিছু থাকে?নিজের ছায়ারেও অবিশ্বাস হয়।”
সাগরিকার বাবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনলেন। তার মায়ের অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো জুলেখার বলা প্রতিটি কথা সত্য।তিনি এক মুহুর্ত অপেক্ষা করলেন না সেখানে। বাইরে এসে দ্বিধায় পড়ে গেলেন। তবে কী সত্যি?ইখুম তার মা কে ধাক দিয়ে মেরে ফেলে দিয়েছিল?
না কী তার মা হার্ট অ্যাটাক এর কারণে বিছানা থেকে পড়ে গিয়ে নাকে মুখে ব্যথা পেয়েছিল।কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যে এসব নিয়ে দ্বিধায় থাকা সাগরিকার বাবা উত্তরের আশায় অপেক্ষা করতে লাগলেন তার মা এবং ইখুমের সুস্থতার।
এক পক্ষের কথা শুনে তিনি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চান না, বা এমন কোনো কথা বলতে চান না যার ফলে পরিবারের সকলের মধ্যে একটা বিভেদ সৃষ্টি হোক।
(১০২)
ইখুমের বাচ্চাটাকে তাদের কাছে এখনি দেওয়া হবে না।কারণ বাচ্চাটার প্রিম্যাচ্যুরিটি।নিজের বাচ্চার সুরক্ষার জন্য তারা তার কাছে যায় না। বাইরের কত প্রকার জীবাণু থাকে,কত রোগ থাকে। এসব কথা চিন্তা করেই তারা যেতে পারে না বাচ্চার কাছে। ইখুমের অনেক ইচ্ছে করে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিতে। দুই হাত দিয়ে তাকে ধরতে। তার কান্না শুনতে।ইখুম মাঝেমধ্যে স্বপ্নে দেখে তাদের মাঝে বাচ্চাটা ঘুমিয়ে আছে। হুট করেই বাচ্চাটা কাঁদতে শুরু করলেই তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভাংতেই খালি বিছানা দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে ইখুম।মা হওয়ার যন্ত্রণা বড় যন্ত্রণা। একজন নারী শুধু সন্তান জন্ম দিলেই মা হয় না, মা হওয়ার জন্য তাকে দীর্ঘ নয় মাস তাকে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হয়। নিজ রক্ত মাংসে গড়া ছোট্ট জানটাকে ধীরে ধীরে বড় করতে থাকে। নিজের খাওয়া,ঘুম, নিজের সকল আরাম আয়েস ত্যাগ করতে হয়। ইখুম মা হয়েও হতে পারছে না।নিজ সন্তান কে ধরতে না পারার যন্ত্রণা তাকে পুরোদিন পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে।
আজ তাজবিদ এসেছিল ইখুমকে নিয়ে তারা চলে যাবার পর জুলেখা বেরিয়ে এলো তাশদীদের দাদীর কেবিন থেকে।সে বেরিয়ে আসতেই বাইরে থাকা দুজন সাদা পোশাকের লোক দাঁড়িয়ে তাকে বলল,
“ম্যাম কোনো প্রয়োজন?”
“আমাকে সবার সামনে ম্যাম ডাকবেন না।আর কিছুর প্রয়োজন নেই। শুধু যা করতে বলেছি তাই ঠিক মতো করুন। আর হ্যাঁ ডক্টরের সাথে কথা বলুন যেন এই বৃদ্ধ মহিলার সুস্থ হতে দীর্ঘ সময় লাগে। সে যেন কথা খুব একটা না বলতে পারে, ডক্টরের সাথে কথা বলুন। আর বাচ্চাটার কী খবর?”
“বাচ্চাটা সুস্থ আছে।”
“বাচ্চাটা নিজেই এক যোদ্ধা। যুদ্ধ ক্ষেত্রে যোদ্ধাদের মৃত্যু হবে এটাই স্বাভাবিক।আশা করি আপনাদের কাজ বুঝতে পেরেছেন।”
ইখুমের সন্তানের মৃত্যু গল্পে নতুন মোড় আনবে এটা জুলি জানে।জানে বলেই সে বাচ্চাটাকে মারতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। নিজের ভিতরের ঝড় যে ওদের চোখের পানিতেই নিভে।
চলবে ….