#এক কাপ চা পর্ব ১৩
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ১৩
(৩৭)
রাতের বেলা স্নেহার শরীর হঠাৎ করে খারাপ হলো।শ্বাস নিতে পারছিল না।জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদছিল মেয়েটা।
ইখুমের দুচোখ সবে মাত্র লেগেছিল। রাশেদ পাশে নেই। বেড সাইডের ল্যাম্প জ্বালিয়ে ইখুম উঠে বসে ফ্লোরে পা রাখার আগেই অনুভব করলো তার শরীর ভালো লাগছে না।মাথাটা ঝিম মেরে আছে। দরজা খোলা এতে মনে হলো স্নেহার চিৎকার বেশি জোড়ে শোনা যাচ্ছে।ধীর পায়ে বের হয়ে দেখলো রাতের বেলা সবাই জড়ো হয়েছে ড্রয়িং রুমে। তাশদীদের মা তখন স্নেহাকে কোলে নিয়ে হয়তো কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। সামিনা দাঁড়িয়ে আছে একটা পিলারের পাশে। সাগরিকার মা গা মুছিয়ে দিচ্ছে স্নেহার।
বমি করে অস্থির মেয়েটা। ইখুম কাছাকাছি যেতেই সে জিজ্ঞেস করলো,
“কী হয়েছে? কাঁদছো কেন?”
তাশদীদের মা রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
“পালতে না পারলে পয়দা দিতে হয় না।আর পয়দা দিলে পালার ধৈর্য্য রাখতে হয়।”
বড় জায়ের মুখে এমন কথা শুনে কিছুটা অবাক হলো ইখুম।সে এমন ভাষা ব্যবহার করে না কিন্তু পরক্ষণে মনে হলো বাচ্চারা তার প্রাণ। সবাইকে একা হাতে তিনিই মানুষ করেছে। তাদের কিছু হলে সে ক্ষেপে যায় সহজেই।
কিছুক্ষণ পর ইখুম জানতে পারলো স্নেহার রাতে ক্ষুধা লাগে। সে রাতে খায় বলে সব সময় তার জন্য খাবার রাখা থাকে।আজ সামিনা তাকে খাওয়ানোর সময় সে কিছুটা জ্বালাতন করছিল।তাই সে তার পিঠে দুম করে কিল বসিয়ে দিয়েছে। এতে স্নেহার গলায় খাবার আটকেছে। সাথে সাথে সে বমি করেছে। এদিকে চিৎকার করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নিয়েছে।
“এমন কেন করেন মেঝ ভাবী?আপনি ভুলে গেছেন? ওর হৃদরোগ আছে। হার্টে ছিদ্র আছে মেয়েটার। আপনি ভুলে কেন যান?”
রাশেদের কথায় সামিনা মুখ তুলে চাইলো। তার দুচোখে পানি টলমল করছে। মুখে ফুঁটে উঠেছে অসহায়ত্ব। কিছু বলার থাকলেও গলা দিয়ে বের হলো না কিছু। তার শরীরটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। ঘুম থেকে উঠে মেয়েকে খাওয়ানোর মতোন আজ তার শক্তি ছিল না।কিন্তু তবুও উঠেছিল। মেয়েটা এত জ্বালাচ্ছিলো যে রাগ উঠে যায় তার।
স্নেহার হৃদরোগের কথা শুনে চমকে উঠেছে ইখুম।ব্যকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কবে? কবে জানলেন এসব?”
নিরুত্তাপ গলায় রাশেদ জবাব দিলো,
“আমাদের বিয়ের দিন রাতে। সে রাতেও স্নেহার গলায় খাবার আটকে গিয়েছিল।হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় পুরো রাস্তা বমি করেছিলো।সে রাতে জানতে পারি ওর হার্টে ছিদ্র আছে।”
(৩৮)
তাজবীদ, মুনির স্টেজের পাশে বসে কথায় ব্যস্ত ছিল।ফুল ভলিউমে বাজছে বিভিন্ন গান।গান গুলো মোটেও স্বাভাবিক নয়৷ রগরগে হিন্দি গানগুলো।যে গানে তাল মিলিয়ে চলছে ছেলে-মেয়েদের নাঁচ।কেউ কাউকে তোয়াক্কা না করে নেঁচে চলেছে। আনন্দের থেকে বেহায়াপনা যেন বেশি ফুটে উঠেছে।
হঠাৎ ছেলেদের এক সাথে দেওয়া শীষ এবং করোতালিতে সে দিকে তাকালো মুনির এবং তাশদীদ। স্টেজে উঠেছে মৌসুমি।
গানের তালে চলছে তার কোমর৷ পাতলা শাড়ি সরে যাচ্ছে কোমর থেকে। সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো মুনির৷আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো শ’খানেক চোখ অনবরত কামুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার বোনের দিকে। একটা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো মুনিরের। তার বাবার উচিৎ ছিল মেয়েকে শাসন করার কিন্তু সে যেন আরো বেশি খুশি।সবাই যে তার মেয়ের নাঁচের প্রশংসা করছে।
একজন তো বাবা কে এসে বলেই ফেলল মেয়েকে কেন অভিনয়ে দিচ্ছে না।
তাশদীদ বেরিয়ে আসছিল সেখান থেকে। মুনির বলল,
“চলে যাবি এখনি?”
“এখন না গেলে সকালে আসতে পারবো না।”
“রাত থেকে যা।”
বিনিময়ে একটা মিষ্টি হাসি ফিরিয়ে দিয়ে তাশদীদ আলিংগন করলো মুনিরকে।
এরপর ফিসফিস করে বলল,
“দৈত্যের প্রাণ ভ্রমরী তো টিয়াপাখির ভিতর। তাকে রেখে থাকা যায় না।”
“তুই শোধরাবি না। বলে দিলেই পারিস।কেন অযথা ইঁদুর বিড়ালের খেলা খেলছিস?”
“বলবো। তবে জোড় করে নয়। সম্পর্কটা হবে শিউলি এবং শরৎের মতোন।শরৎ এলেই কিন্তু শিউলি ফোঁটে। আমি কাছাকাছি থাকলেই যেন প্রেমে ভাসে।”
“আটকাবো না। যা তবে।”
তাশদীদ বাসায় ফিরে স্নেহার কথা শুনতে পেরে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।ইখুম তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি সব’টা জানো তাই না বাবা?”
“হ্যাঁ।শুরু থেকেই।”
“তবে আমাকে কেন বলোনি?”
“বিষয়টা তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর আমি কী বলবো?”
“আমার ওয়ালিয়া তুমি।তবে কেন বলবে না?”
“যখন যখন তোমার ঢাল হয়ে দাঁড়াতে হবে তখন তখন আমাকে পাশে পাবে। কিন্তু অন্যায়কে শেল্টার দিলে আমাকে পাবে না।”
“তুমি কী বলতে চাইছো?”
“পুরুষ মানুষকে শক্ত হতে হয়। স্ত্রী তার শরীরের অংশ নয় যে ইচ্ছে মতোন ব্যবহার করবে, স্ত্রী হচ্ছে আত্মার অংশ।বাকীটা তুমি বুদ্ধিমতি।”
তাশদীদ দাঁড়ায়নি। দ্রুত পা ফেলে উপরে উঠে এসেছে। ইখুম নিজেকে শক্ত করে নিচ্ছে কারণ সে অন্যায় মেনে নিতে পারবে না। রাশেদের মা তাকে পছন্দ করে না এটা তার দোষ নয়৷ স্নেহার বাবা মারা গেছেন এতেও তার কোনো হাত নেই। তবে সে কেন গুমরে গুমরে কেঁদে জীবন পার করবে?
রাশেদকে সে ছাড়বে না। এই সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে। যদি ছেড়ে দেয় তবে সে শাশুড়ির কাছে হেরে যাবে।তবে রাশেদকে মাফও সে করবে না। তার দেওয়া প্রতিটি মানসিক আঘাত তাকে ফিরিয়ে দিয়ে রাশেদকে সে বুঝিয়ে দিবে প্রিয় মানুষের দেওয়া আঘাত কতটা যন্ত্রণার হয়ে থাকে। কতটা যন্ত্রণার।
(৩৯)
ঘুম থেকে উঠে সাগরিকার মনে হচ্ছে কেউ তার মাথার উপর শ’খানেক ওজনের কিছু একটা বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। বিছানায় উঠে বসতেই তার প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে। হঠাৎ করেই মনে হলো গতকাল তাশদীদের বলা কথাগুলো।বাড়ি ফিরে মরার মতোন ঘুমিয়েছে। কিছুই মনে নেই। পরনের শাড়ি অবধি খোলেনি সে। তাশদীদ গতকাল।ও কথা বলছিল কেন?দ্রুত পায়ে বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে গেল তাশদীদের ঘরে। ভয়, অস্বস্তি নিয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে যেতেই দেখলো তাশদীদ পুশআপ দিচ্ছে। সাথে হয়তো কারোর সাথে ফোনে কথা বলছে। কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলো সাগরিকার মনে। বেরিয়ে যাবে ঠিক তখন তাশদীদ ডাক দিয়ে বলল,
“চা কই আমার?সারাদিন মহিষের মতোন ঘুমাস কেন?”
“পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
“৫ মিনিটে ফ্রেশ হয়ে আমার জন্য চা নিয়ে আয়।”
কিন্তু তাশদীদের আর চা খাওয়া হলো না।কারো ডাকে সে সাগরিকার পিছু পিছু নিচে নেমে এলো।
ইখুম বসে আছে এক পাশে। রাশেদ দাঁড়িয়ে, তার হাতে ফোন, লাউড স্পিকার দেওয়া। অপর পাশ থেকে কথা বলছিল তাশদীদের দাদু। তার একটাই কথা ইখুম কেন এখনো বাড়িতে।
“ইখুম আমার স্ত্রী তাই এই বাড়িতে। আমার সন্তানের মা তাই এই বাড়িতে।”
“কিন্তু আমার কথার কোনো মূল্য নাই?চিনহার শইলড্যা খারাপ হইল কেন?ও তোর দায়িত্ব না?”
“স্নেহার শরীরের দায়ভার ওর মায়ের। আমার নয়।”
“কথা তো ওইডা আছিলো না।তুমি কিন্তু কোর-আনে হাত রাইখা কসম দিছো। চিনহার সব দায়িত্ব তোমার। এর লাইগা ইখুমের লগে বিয়ার পারমিশন আমি দিছি।যদি চিনহার দায়িত্ব না নিবার পারো তো ইখুমরে এখনি মুখে মুখে তালাক দিবা নইলে সামিনা কাইল রাইতে তোমারে যা কইছে তাই তুমি মাইনা নিবা।সিদ্ধান্ত তোমার।”
রাশেদ এক পলক তাশদীদের দিকে তাকালো নজর ফিরিয়ে ইখুমের দিকে তাকিয়ে তার মা কে বলল,
“আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।”
চলবে ……