#দ্বিতীয় পুরুষ
পর্ব ২০
_নীলাভ্র জহির
ভরদুপুর। উত্তপ্ত গরম চারদিকে। কোকিলের কুহু কুহু ডাক ভেসে আসছে। ঘরের দাওয়ায় বসে আছে চিত্রা। হঠাৎ খেয়াল করলো গোয়ালঘর থেকে ছাগলের দড়ি হাতে নিয়ে রুবিনা ঘরের দিকে যাচ্ছে। প্রথমে বিষয়টা তার কাছে স্বাভাবিক মনে হল। কারণ সকাল বেলা ছাগলগুলোর গলা থেকে দড়ি খুলে ছেড়ে দেয়া হয় ঘাস খাওয়ার জন্য। তারপর আবার সময়মতো দড়ি গলায় বেঁধে ছাগলগুলোকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু যখন দেখল রুবিনা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল তখন মনে খটকা লাগল চিত্রার। এই ভর দুপুরে দড়ি নিয়ে মাঠে না গিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করবে কেন?
চিত্রা কিছুক্ষণ ওর দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল নিরবে। এখনো রুবিনা দরজা খুলছে না। চিত্রার মনের খচখচানি বেড়ে গেল। সে ধীরে ধীরে উঠে রুবিনার ঘরের দিকে এগিয়ে আসলো। গত কয়েকদিন ধরে জোসনা বেগম চিত্রার সঙ্গে সারাক্ষণ খারাপ আচরণ করছেন। রান্নাঘরে ওকে ঢুকতে দেয়া হয় না। এমনকি বাড়ির কোন কাজে হাত দিতে দেননা জোসনা বেগম। কথায় কথায় পাড়া-পড়শিকে দেখে তিনি যৌতুকের বিষয়ে নানান আজেবাজে কথা শোনাতে থাকেন। এসব কিছু নিয়ে চিত্রার মনটা সারাক্ষণ খারাপ হয়ে থাকে। সে বেশিরভাগ সময় নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে বসে কাটায়। বাড়ির আর কারো দিকে তার খেয়াল ছিল না। আজকে হঠাৎ মনে হল গত কয়েকদিন ধরে রুবিনার মনটা খুব বিষন্ন। সেটা সে আগে খেয়াল করেনি। রুবিনার ঘরের দিকে আস্তে আস্তে চিত্রা সেসব কথাই ভাবছিল। তার মনের ভেতর এক ধরনের কু ডাক ভেসে আসছে।
টিনের ঘর রুবিনার। চিত্রা দরজায় ধাক্কা না দিয়ে আগে টিনের ফুটা দিয়ে দেখার চেষ্টা করল ঘরে কি ঘটছে? কিন্তু মনের কু ডাক সত্যি এভাবে ফলে যাবে সেটা কল্পনাতেও আসেনি চিত্রার। ফুটা দিয়ে ভেতরে তাকানো মাত্রই তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। এটা কি করছে রুবিনা? উপরের বাঁশের খুঁটির সঙ্গে সে ছাগলের দড়ি দিয়ে বেঁধে গলায় ফাঁস দেয়ার চেষ্টা করছে। মুহূর্তেই পুরো দুনিয়া যেন অন্ধকার হয়ে গেল। ছোটখাটো একটা চিৎকার করে উঠল চিত্রা। তবে তার চিৎকার শুনে এগিয়ে আসার মত এই সময় বাড়িতে কেউ নেই। রুপক ও তার বাপ গেছে দোকানে। জোসনা বেগম গেছেন গরুর ঘাস কাটতে। চিত্রা দৌড়ে এসে খুব জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। তবে দরজা খুব শক্তভাবে বাধা হওয়ার কারণে তার শক্তিতে কিছুই ঘটল না। চিত্রার খুব ছটফট লাগছে। পাগলের মত সে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে লাগলো। একবার দৌড়ে গেল জানালার কাছে। জানালা বন্ধ। আবার দৌড়ে এল দরজার কাছে।
সে ভেবেছিল তার চিৎকার শুনে রুবিনা দরজা খুলে বের হয়ে আসবে। কিন্তু না, উল্টো শুনে রুবিনা আরো তাড়াতাড়ি রশির ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। টিনের ফুটো দিয়ে আবারও তাকিয়ে সেই দৃশ্য দেখে যেন চিত্রার গায়ে অশুরের শক্তি ভর করল। ঝড়ের বেগে ছুটে এসে দা দিয়ে টিনের উপর বড় বড় কোপ দিয়ে টিন কেটে ফেলল। ঘরের ভিতরে লাফ দিয়ে ঢুকে পড়ল চিত্রা। ততক্ষনে রুবিনা দড়ির ভেতর গলা ঢুকিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এখনো পায়ের তলা থেকে টুল সরাতে পারেনি। চিত্রা সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে তার দুই পা জাপ্টে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। চিত্রার কান্না দেখে হতবিহ্বল হয়ে গেল রুবিনা। এর আগে কেউ কোনদিনও তাকে এভাবে ভালোবেসেছে বলে তার মনে পড়ল না । মা বাবা ভাই তাকে অনেক ভালোবাসে। তবে চিত্রার কান্না দেখে মনে হচ্ছে সে হারিয়ে গেলে সব থেকে বেশি কষ্ট পাবে তার ভাবি। এভাবে তাকে মরে যেতে দেবে না চিত্রা।
রুবিনা নিজেও হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। চিত্রা তার দুই পা জাপ্টে ধরে রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল, বইন তুমি এইকাম কইরো না। আমি জানিনা তোমার কি হইছে? কিন্তু এই কাম কইরো না। আমারে কও কি হইছে? কিসের কষ্ট তোমার। কেন তুমি মইরা যাইতে চাইতেছ?
রুবিনা কাঁদতে কাঁদতে বলল ভাবী আমারে ছাইড়া দাও। আমি কাউরে আর কোন কষ্ট দিতে চাইনা। আমি আমার বাপ মায়েরে কোন কষ্ট দিতে পারুম না।
বাপ মায়েরে কষ্ট দিবা ক্যান? তুমিতো খুব ভালো একটা মাইয়া। কষ্ট দেয়ার মত কোন কাম তুমি করবা না।
আমি যে কাম করছি তাতে তারা অনেক কষ্ট পাইব। এই কষ্ট পাইলে আমার আব্বা সহ্য করতে পারবো না। তিনি নিজে আমারে কাইটা টুকরা টুকরা কইরা নদীতে ভাসাইয়া দিব।
কি হইছে তোমার বইন? আমারে কও।
চিত্রার কান্না থামল না। সে বলল, তুমি উপর থাইকা নাইমা আসো নাইলে আমি কিন্তু চিৎকার করমু। তোমার পা ছারুম না।
ভাবির কান্না দেখে বাধ্য হয়ে রুবিনাকে নিচে নেমে আসতে হল । রুবিনা আসার পর তাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে চিত্রা কাঁদতে কাঁদতে বলল, কি হইছে তোমার বইন? কষ্টের কথা কেন কইতাছো?
মান সম্মান সব নষ্ট কইরা ফেলছি।
ক্যান বইন? কি ভুল করছ তুমি?
ভাবি আমি সেদিন আপনারে একটা কথা কই নাই।
কথাটা বলতে বলতে আবার ওকে কাঁদতে শুরু করল রুবিনা। চিত্রা ওর হাত ধরে বলল, কি কথা?
আপনের কাছে একটা জিনিস লুকাইছিলাম। কইছিলাম মেইন জিনিসটা বাদ দিয়ে সব হইয়া গেছে। মিথ্যা কইছিলাম। আমাগো কোন কিছুই বাদ নাই। সবকিছুই হইয়া গেছে। মেলা কয়বার আমরা একলগে থাকছি।
তাতে কি হইছে? সেই জন্য মরতে হইবো? ওই পোলায় কি কইছে তোমারে বিয়া করব না?
রুবিনা কিছু বলতে পারলো না। কান্নায় ভেঙে পড়ল। চিত্রা তার হাত চেপে ধরে বলল কি হইছে বইন। আমি তো তোমার বড় বইন। আমারে কও।
ভাবি আমি অনেক বড় সর্বনাশ কইরা ফেলছি। আমার প্যাটে বাচ্চা আইছে।
চিত্রার সমস্ত শরীর হঠাৎ করে যেন প্রচন্ড কম্পন করে সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেল। মনে হচ্ছে এই ভ্যাপসা গরম ভরদুপুরে কোকিলের ডাক সবকিছুই অবাস্তব। দরিয়ার অতল গহব্বরে সে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। ডুবতে ডুবতে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে রুবিনার ভয়াবহ মৃত্যু। দেখতে পাচ্ছে তার স্বামীর আর্তনাদ ও শ্বশুর-শাশুড়ির চিৎকার। দেখতে পাচ্ছে পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন ও গ্রামবাসী সবাই কিভাবে তার স্বামীর পরিবারকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে অপমান করছে। সব কিছু ভাবতে ভাবতে তাঁর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইল। এবার তার পায়ের কাছে বসে কাঁদতে লাগল রুবিনা। কাঁদতে কাঁদতে বলল ভাবি আমি কি করবো আপনি কন। এই কথা আমি কাউরে কইতে পারুম না। এই কলঙ্ক নিয়া আমি কি করুম? আমি কই যামু?
রুবিনার কান্না যেন পুরো বাড়িটাকে আরো গুরুগম্ভীর করে তুলল। এ যেন অকুল দরিয়ায় তুমুল ঝড়। অবশেষে চিত্রা ফিরে এলো তার বাস্তব জগতে। ধীরে ধীরে সে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিল। ভেঙে পড়লে চলবে না। সে যদি ভেঙ্গে পড়ে তবে চোখের সামনে যা ভাসছিল সেটাই ঘটবে। বরং এই মুহূর্তে মাথা ঠান্ডা রেখে সবকিছু ধীরেসুস্থে সামাল দিতে হবে। কথা বলতে গিয়ে টের পেল তার গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না।
আস্তে আস্তে সে রুবিনাকে তুলে তার পাশে বসালো। তারপর বলল আমি তোমারে যা কমু তুমি সেটা করতে পারবা?
ফ্যালফ্যাল করে চিত্রার দিকে তাকালো রুবিনা।
চিত্রা রুবিনার হাত ধরে বলল তার আগে আমারে তুমি একটু বিশ্বাস করতে হইবো। আমি এসব কথা কোনদিনও কাউরে কমু না। আমি বাইচা থাকতে তোমার মান সম্মানের হানি হয় এমন কোনকিছুই কাউরে কমু না। তুমি আমারে বিশ্বাস করো। মন একটু শক্ত করো। এইখানে একটু চুপচাপ বস। আমি যা কই শুনো
শান্ত হয়ে বিছানার উপর বসল রুবিনা। চিত্রা সবার আগে ছাগলের দড়ি দিয়ে টাঙ্গানো ফাঁসটা খুলে ফেলল।
কিন্তু ঝামেলা হল টিনের বেড়া কেটে ফেলেছে। এটা কিভাবে জোড়া দিবে? সেই চিন্তা বাদ দিয়ে দা লুকিয়ে রেখে আপাতত চিত্রা রুবিনার পাশে এসে বসল। রবিনা অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। চিত্রা বলল, বইন সবথেকে বড় কথা হইল এই কথাটা তুমি কাউরে কইবানা। কাউরে বুঝতেও দিবানা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, পারলে দুই-একদিনের মধ্যে ওই পোলার লগে তোমার বিয়ার ব্যবস্থা করতে হইবো।
সেটা কেমনে হইব ভাবি? সে তো বেকার। কাম কাজ কিছুই করে না। আমার বাপ ভাই জীবনেও ওর লগে আমার বিয়া দিব না।
তোমার ভাইরে আমি বুঝাই কমু । তুমি কিছু কইবানা। আমি যা কওনের কমু। তুমি শুধু আমার কথায় হ হ কইরা যাইবা। যত ঝামেলা ঝাটি যাইহোক বিয়েটা দিতেই হইবো। বিয়া হইয়া গেলে কয়টা দিন পরেই সবাইরে কইবা তুমি পোয়াতি হইছ।
কিন্তু কিভাবে ওর লগে আমার বিয়া কেমনে হইব? আমাগো বাড়ির কেউ রাজী হইবো না। ওর বাড়ির মানুষজনের কেমনে রাজি করাইব এত তাড়াতাড়ি।
ওর বাড়ির মানুষজনের রাজি করানোর দায়িত্ব তুমি কইরা দিবা। সবচাইতে বড় কথা হইলো এই মুহূর্তে মান সম্মান রক্ষা করতে হইবো। তাও এমন ভাবে করতে হইবো যেন গ্রামের লোকজন কিছু না জানে। ওই পোলা কি তোমারে বিয়া করব?
হ, করব।
তাইলে তুমি এই মুহূর্তে ওরে আমার লগে দেখা করতে কও। আমি চিন্তা করতেছি কেমনে সব কিছু সামাল দিব।
রুবিনা তার ভাবিকে জাপ্টে ধরে কেঁদে ফেলল। চিত্রা চোখ মুছে দিল রুবিনার।
রুবিনা বলল ভাবি। তুমি মানুষটা বড় ভালা। আমার মানসম্মানের কথা তুমি এমন কইরা ভাব। তোমারে আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে মন চাইতেছে।
তুমি তো আমার বোইন। তোমাগো সম্মান আমার সম্মান। আমি এই পরিবারের সম্মানের কথা ভাববো না তোকে ভাববো?
তুমি যে এত ভাল মানুষ এটা আমি আগে বুঝিনাই ভাবি। আমি ওরে একটা কল দিমু। সাবিনা আপার মোবাইল থেকে মিসকল দিলে ও কল ব্যাক করব। যেহেতু আম্মা বাড়িতে নাই, ওরে আমাগো বাড়িতে আসতে কমু?
আম্মা যদি আইসা পড়ে?
বাড়ির বাইরে বইসা কথা কইবেন। আম্মা কিছু মনে করব না। এলাকার পোলাপান। মাঝেমধ্যে তো বাড়িতে আসে। আম্মা কিছু টের পাইব না।
আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি ওরে আইতে কও। আমি কমু তোমার ভাইয়ের খোঁজে আইছিল।
শরীরে কম্পন কিছুটা কমেছে মনে হচ্ছে রুবিনার। সে মাথায় ওড়না দিয়ে পাশের বাড়ির সাবিনার কাছে গেল । সাবিনা কলেজে পড়ে। তার কাছে মোবাইল আছে। সাবিনার সঙ্গী রুবিনার সম্পর্ক বেশ ভালো। তাই ওর ফোন থেকে মাঝে মাঝে প্রেমিকের সঙ্গে ফোনালাপ করতে পারে রুবিনা।
রুবিনা বেরিয়ে গেলে নিস্তব্ধ বাড়িতে দাঁড়িয়ে চিত্রার বুকটা কেমন যেন হাহাকার করতে লাগলো। এত বড় জটিল একটা সমস্যা কিভাবে সমাধান করবে সেটা ভেবেই তার শরীর কাঁপছে। এই কথাটা রূপক কে বললে রূপক অনেক কষ্ট পাবে। রুবিনার প্রতি রূপকের ঘৃণাও জন্মাতে পারে। তাছাড়া রুবিনা কে সবার চোখে ছোট হতে দেয়া যাবে না। সবাইকে না জানিয়েই কিছু একটা করতে হবে।
উঠানে পায়চারি করতে করতে ছটফট করছিল চিত্রা। আর মনে মনে ভাবছিল কিভাবে এই জটিল সমস্যার সমাধান করবে। রুবিনার কাটা টিনের বেড়ার দিকে তাকিয়ে তার বুকের ভেতরটা আরো বেশি হাহাকার করে উঠলো। জোসনা বেগম বাড়ি এসে জানতে চাইবেন কী করে বেড়ায় এই অবস্থা হলো। তাকে মিথ্যা কথা বলে সামাল দিতে হবে। বলতে হবে রুবিনা ও চিত্রা গোসল করতে গিয়েছিল। বাড়িতে এসে দেখেছে এই অবস্থা। কে বা কারা এসে এমন করেছে তারা জানে না। এই মিথ্যা কথা বলা ছাড়া জোসনা বেগমের চোখ ফাঁকি দেওয়ার কোনও উপায় নেই।
রুবিনা বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে চিত্রা কে বলল, ভাবি আমি ওরে আইতে কইসি। ও সাইকেল লইয়া আইতাছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আইসা পড়বো।
চলবে…