#দ্বিতীয় পুরুষ
পর্ব ৫
নীলাভ্র জহির
উনুনের আলোয় রাঙা হয়ে উঠেছে নতুন বউয়ের মুখ। সেদিকে তাকিয়ে রূপক শিন্নি দিয়ে মুড়ি খাচ্ছে। তার হঠাৎ মনে পড়ল তার বউটার নিশ্চয়ই অনেক ক্ষুধা পেয়েছে। কিন্তু মায়ের সামনে সে তার নতুন বউকে খেতে বলতে পারছে না।
অনেক ভাবনাচিন্তার পর রূপক বলল, আমারে এক গ্লাস পানি দিয়া যাও।
কথার সুর শুনেই বোঝা যাচ্ছে সে তার বউকে বলেছে কথাটা। জ্যোৎস্না বিষয়টা বুঝতে পেরে চিত্রাকে বললেন, যাও ওরে এক গ্লাস পানি দিয়া আসো।
চিত্রা কাঁপা কাঁপা হাতে একগ্লাস পানি নিয়ে এসে রূপকের পাশে দাঁড়ায়।
ভর সন্ধ্যা। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রান্নাঘরের জ্বলন্ত কুপির আলো খানিকটা বাইরে এসে পড়েছে। সেই আলোয় বসেই শিন্নি খাচ্ছিল রূপক। নতুন বউ পাশে এসে দাঁড়াতেই সে গ্লাস ধরার অজুহাতে বউয়ের হাতটা খপ করে ধরলো।
হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল চিত্রা। কিন্তু তার ভয় ভয় লাগছে। পরে যদি গ্লাসটা হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায়। চিত্রা ফিসফিস করে বলল, কি করেন? কি করেন? হাত ছাইড়া দেন। আম্মায় দেইখা ফেলবো।
রূপক চিত্রার হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে একটা নরম মোচড় দিলো। এইটুকুতেই সে কি আনন্দ পেল বুঝতে পারল না চিত্রা। রূপক মুচকি হেসে তার খেয়ে অর্ধেক করে রাখা শিন্নির গামলাটা তার বউয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আর খামু না। প্যাট ভইরা গ্যাছে। এইটা তুমি খাইয়া লও।
চিত্রার লাজে রাঙা মুখ আরো টকটকে লাল হয়ে উঠলো । আবছায়া অন্ধকারেও সেই রক্তিমতা টুকু দেখতে ভুল করল না রূপক ।
ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিল সে। নিজের অর্ধেক করে ফেলে রাখা খাবারটা বউকে ভালবেসে দিতে পেরে সে গর্ববোধ করছে। এই খাবার খেলে তার প্রতি বউয়ের মহব্বত বাড়বে। এই কথা সে ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে। কারো অর্ধেক খাওয়া খাবার অন্য কেউ খেলে দুজনের প্রতি একটা নতুন মহব্বত কাজ করে। যদিও তার বউ তাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু মানব মনের বৈশিষ্ট্য হলো, সে যত ভালোবাসা পায় আরো বেশি ভালোবাসা পেতে চায়।
চিত্রা রান্নাঘরের চালায় গিয়ে ঢুকলো। শিন্নির গামলাটা রেখে দিল এক পাশে। শাশুড়ির সামনে স্বামীর দেয়া শিন্নি খেতে তার লজ্জা লাগছে। তাছাড়া এখন কাজের সময়। রান্নাঘরের কাজ ফেলে খেতে বসে গেলে শাশুড়ি মা রাগ করবেন।
তাকে অবাক করে দিয়ে জোৎস্না বললেন, হাত ধুইয়া চারটা খাইয়া লও। আমি তরকারি রানমু। কেমনে রান্ধে সেইটা শিইখা লও। আমরা কিন্তু তরকারিতে নুন একটু বেশি খাই।
চিত্রা ঘাড় বেঁকিয়ে সায় দিল। তারপর হাত ধুয়ে শিন্নি খেতে বসলো সে। শাশুড়ি মা একহাতে মাঝে মাঝে ভাতের জ্বাল ঠেলে দিচ্ছেন। তরকারি কুটছেন তিনি। চিংড়ি মাছ দিয়ে মিষ্টি কুমড়া। সঙ্গে আছে আলু ভর্তা। রূপক উঠে যাওয়ার সময় জোসনাকে বলল, বেশি কইরা ধইনা পাতা কুঁইচা দিয়া ভর্তা কইরো মা।
রুপক ঘরে চলে গেলে চিত্রার কেমন শূন্য শূন্য লাগে। মানুষটা যতক্ষণ আশেপাশে থাকে অস্থির হয়ে থাকে ও। তবুও সবকিছুই ভালো লাগে তার। কিন্তু মানুষটা একটু আড়ালে গেলেই কেমন যেন হাহাকার কাজ করে। মন চায় সারাক্ষণ শাড়ির আঁচলে তাকে বেঁধে রাখতে। কিন্তু সমাজের নিয়ম বলে একটা কথা আছে। আগামীকাল থেকে রূপক আবারও নিয়মিত দোকানে বসবে। স্বামীকে না দেখে সারাদিন সে কি অস্থিরতায় সময় কাটাবে সেটাই ভাবছিল চিত্রা।
রাতে ঘুমাতে এসে চিত্রা রূপককে বলল, আপনি তো কাল থাইকা ব্যস্ত হইয়া যাইবেন। দোকানে গিয়া কি আমার কথা আপনার মনে পড়ব?
– ক্যান মনে পড়বোনা? আমি যহন একটা সুন্দর কাপড় কাস্টমাররে দেখামু , তোমার কথা মনে হইবো। মনে মনে ভাববো এই কাপড়টা আমার বউয়ে পিনলে না জানি কত সুন্দর লাগতো।
– ইস আপনার খালি ঢং এর কথা।
– ঢঙের কথা না কইলে কিসের কথা কমু। পিরিতি তো খালি ঢং আর ঢং।
কথাটা বলেই সে বউয়ের থলথলে পেটে জোরে চাপ দেয়।
চিত্রা রূপকের হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, আপনে এমন ক্যান?
কথাটা শুনে খিলখিল করে হাসে রূপক। সেই হাসি চুড়ির রিনিঝিনি শব্দের মত অনেকক্ষণ বাজনা বাজায় চিত্রার কানে। আস্তে আস্তে রূপক ঘুমে ঢলে পড়ে। চিত্রা ওর স্বামীর ঘুমের শব্দ শুনে। সে জানে মাঝরাতে হঠাৎ তার উপর চড়াও হবে রূপক। অনেক আদরে আদরে তাকে ভরিয়ে দিবে। চিত্রার ভালো লাগে তার স্বামীর প্রত্যেকটা স্পর্শ। মনে হয় এই স্পর্শগুলো গৌরবের। পরম সুখের। পৃথিবীতে এর চাইতে কোন সুখ নাই।
খুব সকালবেলা গরম ভাত খেয়ে কাজে বেরিয়ে গেল রূপক। রূপক বের হওয়ার সময় জোসনা বলছিল, আর কয়টা দিন। সাইকেলটা পাইয়া গেলে তোর অনেক সুবিধা হইবো। তখন আর ভ্যানে করে যাইতে হইবো না। ট্যাকাও বাঁচবো।
মায়ের কথা শুনে রূপক আড়চোখে একবার চিত্রার দিকে তাকালো। চিত্রার বুকটা হাহাকার করে ওঠে। তার ভাইয়েরা কি পারবে রূপকের জন্য সাইকেল এর ব্যবস্থা করে দিতে? এমনিতেই বিয়ে বাবদ তাদের অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে।
সারাটা দিন অনেক ছটফট করে কাটলো চিত্রার।রুবিনা ও নাজমার সঙ্গে টুকিটাকি গল্প আর সংসারের কাজকর্ম করে সে দিনটা কাটানোর চেষ্টা করল। পাড়া-প্রতিবেশী দু একজন এসেছিল তার সঙ্গে দেখা করতে। সবকিছুর ভিড়েও বারবার রূপকের কথা মনে পড়ছিল চিত্রার। দুপুরের খাবার রূপক সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। বিয়েতে উপহার পাওয়া নতুন টিফিন ক্যারিয়ারে করে রূপকের জন্য ভাত বেড়ে দিয়েছে চিত্রা। একেবারে রাত্রিবেলা দোকান বন্ধ করে তারপর বাড়িতে আসবে রূপক। সারাদিন তার কথা ভেবে চিত্রা ছটপট করেছে সেটা কি রূপক জানবে?
রাত দশটা। কুন্দনপুর গ্রামে তখন নিশুতি রাত। প্যাঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে। ঝিঝি পোকার ডাকে রাত হয়ে উঠেছে অনেক গভীর। সন্ধ্যার পর থেকে পায়ের আওয়াজ শোনার জন্য অপেক্ষা করছে চিত্রা। এখনো সেই পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। তার চোখে ঘুম লেগে এসেছে। না খেয়ে শুয়ে পড়েছিল সে। রূপককে ফেলে খেতে ইচ্ছে করছিল না। জোসনা নিজেও এখনো না খেয়ে আছেন। জেগে আছেন পেটে খিদা নিয়ে। স্বামী-সন্তান ফিরলে তারপর তাদেরকে নিয়ে একসঙ্গে বসে ভাত খাবেন বলে।
গলার আওয়াজ শুনে চিত্রার ঘুম ভেঙে গেল। রূপকের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বিছানার উপর ধরমর করে উঠে বসল সে। দরজায় শব্দ হওয়ার আগেই সে দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিল।
রূপক দরজা ঠেলে দিয়ে তার বউকে জাপটে ধরলো। বউয়ের নরম শরীরের এখানে সেখানে হাত দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিলো। তার অস্থির হয়ে ওঠা বৌ স্বামীর বুকে মাথা রেখে শান্তি খুঁজে বেড়ায়।
রুপক বলল, ঘুমাইয়া পড়ছিলা?
– চোখ লাইগা আইছিল।
– খাওন দাও। খিদা লাগছে।
– আপনি মুখ হাত ধুইয়া আসেন। খাওয়ান দিতাছি।
রুপক দাঁত বের করে হেসে বলল, এই খাওয়ন সেই খাওয়ান না।
– তাইলে ?
রুপকের মুখের হাসি দেখেই চিত্রা বুঝে ফেলল তার স্বামী কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে। স্বামীকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে চিত্রা বলল, অহন সরেন। আগে দুইটা খাইয়া লন।
– খাওয়ন তো অনেক খাইবো। আগে আমার মিষ্টি বউটারে একটু দেহি।
দেখার ছল করে রূপক তার বউকে জাপটে ধরে। বউয়ের গলায় মুখ ডুবিয়ে ঘ্রাণ নেয়। ক্রমাগত মাথা নাড়িয়ে অস্থির করে তোলে চিত্রাকে। এমন সময় শোনা যায় জোসনার গলা, খাইতে আয় বাবা । তোর বউ ঘুমাইয়া পড়ছে নাকি। ওরেও নিয়া আয়। ভাত না খাইয়া বইসা আছে।
রূপক বলল, চলো খাইয়া আসি। তারপর দেখামু মজা।
চিত্রা মাথায় ঘোমটা টেনে দেয়। ঘোমটার নিচে চুল ঠিক করে। বিয়ের পর থেকেই তার স্বামীর ভালোবাসার অত্যাচার সে পিষ্ট। নতুন নতুন বউ পেলে নাকি ছেলেরা এমন করে। তার ফুফাতো ভাইয়ের বউ বলেছে আর কয়েকদিন পরেই এত সোহাগ থাকবে না। তখন বাসায় ঢুকেই সবার আগে বলবে ভাত দে। সারাদিন তার বউটা কিভাবে অস্থিরতায় ছটফট করেছে সেই কথা মনে থাকবে না। ভাত খেয়ে বিছানায় শুয়েই নাক ডেকে ঘুম দেবে তার স্বামী। কথাগুলো শুনে চিত্রার খুব মন খারাপ হয়েছিল । রূপকের ওরকম হয়ে যাওয়া মোটেও মেনে নিতে পারবে না সে। রূপককে এমনই ভালো লাগে। সে মনে মনে প্রার্থনা করে আজীবন যেন তার স্বামী এ রকমই থাকে।
ভোরের দিকে একবারে চিত্রার ঘুম ভেঙে গেল। ঘর অন্ধকার। রূপকের গলায় হাত বুলিয়ে চিত্রা মনে মনে বলল, তোমারে পাইয়া আমি যে কি পাইছি। এ আমার জীবনের সবচাইতে বড় পাওয়া।
কোন এক অজানা কারণে চিত্রার চোখে পানি আসল। খুব আবেগপ্রবণ হয়ে উঠল সে। তার অতীতের কালো অধ্যায়ের কথা মনে পড়ল। মনে জাগলো অনেক আতঙ্ক। রূপক যেন সারা জীবন তাকে এভাবেই আগলে রাখে সেটাই কামনা করছে চিত্রা। এ ছাড়া তার আর কিছুই চাওয়ার নেই।
সুড়সুড়ি পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল রূপকের। রূপক স্ত্রীর হাতটা ধরে বলল, কি হইছে? ঘুমাও নাই?
– ঘুম ভাইঙ্গা গেছে।
– ঘুমাইয়া পড়ো।
চিত্রার হাত নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে রেখে রূপক আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করে। চিত্রা হাত সরিয়ে নেয়।
রুপক বলল, কি হইছে বউ? তোমার কি মন খারাপ?
চিত্রা চমকে উঠে বললো, আপনি কেমনে বুঝলেন আমার মন খারাপ?
ঘুম জড়ানো কন্ঠে রূপক উত্তর দিল, তুমি যে আমার কলিজার পাখি। আমি বুঝবো না কে বুঝবো। মন খারাপ লাগতাছে ক্যান? আব্বার কথা মনে পড়ছে?
– আপনের কথা মনে পড়ছে।
– কি কও? আমি তো তোমার লগেই আছি।
– আপনেরে যদি কখনো হারাইয়া ফেলি।
অন্ধকারের মাঝেই রূপক বউয়ের মুখ চেপে ধরল। অভয় দিয়ে বলল, রাত-বিরাতে এসব অলক্ষুণে কথা কইও না তো। তুমি আমার বউ। আমার জনম জনমের সাথী। এইসব খারাপ কথা মনের মধ্যে আনবা না।
– আপনে কালকে সকাল বেলা উইঠাই দোকানে চইলা যাবেন। সারাটা দিন আপনার কথা মনে পড়ে। বাড়িতে আইবেন সেই নিশি রাইতে।
– ওরে আমার আদরের বৌ রে। দোকানের মধ্যে বইয়া আমিও সারাদিন তোমার কথাই ভাবি। তোমারে ঘরে রাইখা বাইরে যাইতে আমার মন টানে না। না যাইলে তো হইবো না। কাম কাজ না করলে খামু কি?
চিত্রা কোন উত্তর দিল না। এইসব ছেলেমানুষি কথাবার্তা বলা ঠিক না। এতে স্বামীর মন হালকা হয়। মন হালকা হইলে তারা ভালোমতো কাজকর্ম করতে পারেনা।
সে বলল, আপনি আমার কথা চিন্তা কইরেন না। ভালো কইরা আপনের কাজটা কইরেন।
– দোকানে বইয়া থাকোন ছাড়া আমার কোন কাম নাই। বইসা বইসা শুধু তোমার কথাই ভাবি।
– এত ভাবতে হইব না।
– ঠিক আছে। অহন ঘুমাইয়া পড়ো।
চিত্রার তবুও মনটা খচখচ করে। মনে হচ্ছে কথা বলে মন ভরেনি তার। আরো কিছুক্ষণ যদি সে কথা বলতে পারতো মন খুলে।
রূপক বলল, তোমারে একটা মোবাইল কিইনা দিবো। তুমি আমার লগে মোবাইলে কথা কইবা।
– কি কন?
চিত্রার যেন বিশ্বাস হতে চায় না তার স্বামীর কথা। একটা মোবাইল ফোনের অনেক দাম। তাছাড়া তার কোনো মোবাইলের প্রয়োজন নেই।
রুপক বলল, সেকেন্ড হ্যান্ড মোবাইলের দাম কম। আমি খোঁজ লাগাইছি। একটা পাইলে তোমারে দিমু। আমার কথা যহনই তোমার মনে হইবো তুমি আমারে শুধু একটা মিস কল দিবা। আমি কল ব্যাক দিয়া তোমার লগে কথা কইব।
– আপনি তো আর বিদেশে থাকেন না। মোবাইলে কল দিলে মানুষে কি কইবো?
– এখনকার দিনে সবাই সবার বউয়ের লগে মোবাইলে কথা কয়। আমার বন্ধু আরমানরে দেখছো? বিয়া খাইতে আইছিল। লম্বা কইরা, হ্যাংলা কইরা। ওরে দেখছি। স্কুলের মাঠে বইসা বউয়ের লগে কথা কয়। আমাগো সামনে কয়না। একটু দুরে গিয়া কয়। আমরা ওরে লইয়া বহুৎ হাসাহাসি করছি। অহন মনে হইতাছে, বউয়ের লগে কথা কইতে পারাটাই শান্তির। এই কথাগুলান মানুষের সামনে কওন যায় না।
চিত্রা শক্ত করে তার স্বামী রূপককে জড়িয়ে ধরল। মানুষটা ভীষণ ভালো। এই মানুষটাকে পেয়েছে সে অনেক সৌভাগ্য করে। মানুষটা যেন আজীবন তার সাথে থাকে।
সবকিছু ভালই চলছিলো। একদিন ঘটলো বিপত্তি।
চলবে..