#প্রেমাতাল
পর্ব ৪৪
লেখিকাঃ মৌরি মরিয়ম
সবাই একে একে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। শুধু চম্পা ঘরের এক কোনায় বসে কাঁদতে লাগলো। তিতির উপুর হয়ে শুলো। পিঠটা বিছানায় রাখতে পারছে না। পিঠের এমন কোন যায়গা নেই যে স্কেল পড়েনি। কোথাও কোথাও একই যায়গায় বারবার পড়েছে। উপুর হয়েও ব্যাথা অনুভব করলো। বুকে, পেটেও বোধহয় দুএকটা লেগেছে। বাবা এসে এভাবে দেখে অস্থির হয়ে পড়েছিল। ভাইয়া এসে ওর গায়ের দাগ দেখে কেঁদে ফেলেছিল। কিন্তু মনের ভেতর এর চেয়েও যে কত ব্যাথা আর দাগ রয়েছে তার খবর তো কেউ রাখেনা।
তিতির বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করলো। বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে মুগ্ধ। তিতির বলল,
-“চম্পা, দরজাটা লক করে চলে যা।”
চম্পা চুপচাপ দরজা লক করে বেড়িয়ে গেল। তিতির ফোন দিল মুগ্ধকে। মুগ্ধর গলায় আতঙ্ক!
-“তিতির, কি হয়েছে তোমার? ফোন করলে তখন আমি মিটিং এ ছিলাম। পরে এতবার ফোন করলাম ধরলে না?”
তিতির গলাটা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,
-“এরকম তো আগেও হয়েছে।”
-“হ্যা কিন্তু আজ আমার মনটা কেমন করছিল! কি হয়েছে বলোতো?”
-“বাবা-মা, ভাইয়া সবাই আমার রুমে ছিল তাই ধরতে পারিনি।”
-“কেন তুমি কি অসুস্থ? আর ভয়েসটা এমন লাগছে কেন? দুপুরে তো সুস্থই ছিলে। কি হলো এর মধ্যে?”
-“বলবোনে, তুমি কোথায়?”
-“অফিসে।”
-“এখনো বাসায় যাওনি?”
-“না, ৮ টার মত বেজে যাবে বের হতে। অনেক কাজ। তুমি বলো না কি হয়েছে?”
-“বাসায় যাও তারপর বলবো।”
-“না তিতির আমার টেনশান হচ্ছে। বলো প্লিজ। নাহলে কাজে মন বসাতে পারবো না।”
-“নতুন কিছু না, তোমার আমার ব্যাপারটা নিয়েই বাসায় আবার একটু ঝামেলা হয়েছে।”
-“তিতির, তোমাকে কি মেরেছে?”
তিতিরের কান্না পেল। কি করে পারে ও সবকিছু বুঝতে? মুগ্ধ আবার বলল,
-“কি হলো চুপ করে আছো কেন? তোমাকে কি মেরেছে?”
তিতির ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
-“হ্যা।”
মুগ্ধ বুঝি কিছু একটা তে ঘুষি দিল। প্রচন্ড শব্দ হলো। আর বলল,
-“উফ! এটাই শুধু বাকী ছিল।”
মুগ্ধর গলাটা রাগে কাঁপছে। তিতির কিছু বলল না। মুগ্ধ বলল,
-“কে মেরেছে? নাকি সবাই মিলে?”
-“মা।”
-“কি দিয়ে মেরেছে?”
-“স্কেল।”
-“কি এমন বলেছিলে?”
-“ডিটেইল টা রাতে বলি?”
-“আচ্ছা, তোমাকে কি অনেক মেরেছে?”
মুগ্ধ এমনভাবে বলল যেন ওর গায়ে ব্যাথা লাগছে। তিতির হেসে ফেলল। বলল,
-“মোটামুটি। কিন্তু তুমি আহ্লাদ করছো বলে ব্যাথাটা কমে যাচ্ছে।”
-“আমাকে শান্তনা দিও না তো।”
-“এখন তুমি সামনে থাকলে আমার কপালে একটা কিস করতে, তাইনা?”
-“ধুর! কি সময় কি কথা!”
-“আমাকে একটা কিস করো। দেখবে আমার অর্ধেকটা ব্যাথা চলে যাবে।”
-“ফোনের মধ্যে কিস করতে পারিনা আমি। ফোনে কিস করে লাভ কি? তুমি কি পাবে?”
-“হুম পাব।”
মুগ্ধ একটা কিস করলো। তিতির বলল,
-“তুমি এত দুষ্টু কেন বলোতো?”
-“কেন?”
-“এইযে কিস করতে বললাম কপালে আর করলে ঠোঁটে!”
মুগ্ধ হেসে দিল। তিতির যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য এসব বলছে তা বুঝতে বাকী রইলো না মুগ্ধর।
ব্যাথায় কুঁকড়ে ছিল তিতির। রাতে খেতে গেল না। কেউ ডাকতেও এল না। ১০ টার দিকে ফোন দিল মুগ্ধ। তিতির বলল,
-“বাসায় গিয়েছো?”
-“হ্যা।”
-“ফ্রেশ হয়েছো?”
-“হুম।”
-“খেয়েছো?”
-“তুমি তো জানো তিতির আমি এত তাড়াতাড়ি খাই না। যাই হোক, এখন তো বলো কি এমন বলেছিলে যে মা তোমাকে এত মারলো?”
সকালে মাকে প্রেগনেন্সির কথা বলা থেকে শুরু করে পুরো ঘটনাটা তিতির মুগ্ধকে খুলে বলল। শুধু মারের ব্যাপারটা ডিটেইলে বলল না। বললে শুধু শুধু অনেকটা কষ্ট পাবে মুগ্ধ।
সব শুনে মুগ্ধ বলল,
-“যেটুকু আশা ছিল রাতেও পানি ঢেলে দিলে।”
-“মানে?”
-“তোমার ফ্যামিলির কাছে তুমি আমাকে আরো খারাপ বানিয়ে দিলে।”
-“কিভাবে? শেষে তো জানলোই যে আমি প্রেগন্যান্ট না।”
-“হ্যা, কিন্তু যেহেতু তুমি প্রেগনেন্সির কথা বলতে পেরেছো সেহেতু আমি তোমার সাথে করেছি। এটাই ভাবছে মা তুমি দেখে নিও।”
-“রাগ করোনা প্লিজ। আমি বুঝতে পারিনি এমন হবে। আমি ভেবেছিলাম এবার রাজী হয়ে যাবে।”
-“তুমি আমার সাথে একবার ডিসকাস করে নিতে পারতে। তাহলে তো আমি নিষেধ করতাম।”
-“সরি, আসলে আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।”
-“হায়রে আমার সারপ্রাইজিং প্রিন্সেস রে! সবকিছুতেই কি সারপ্রাইজ দেয়া লাগে? লাগে না বরং লাইফের বড় বড় ডিসিশান দুজনে মিলে নিতে হয়।”
-“সরি, এমন আর কখনো হবে না। এরপর থেকে সবকিছু তোমার সাথে ডিসকাস করে করবো।”
-“সেই সুযোগটা তুমি পাবে কোথায়? আমার সাথে তো তুমি থাকতেই পারবে না। কদিন পর তোমার বিয়ে হয়ে যাবে অন্য কারো সাথে। আর আমারও।”
তিতিরের প্রচন্ড কান্না পেল। কিন্তু ও কাঁদল না। মুগ্ধ বলল,
-“তিতির, কাল একটু দেখা করবে?”
-“কখন?”
-“দিনের বেলায় তো পারব না। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বের হলেও ৫/৬ টা বাজবে। ধানমন্ডি যেতে আরো ১ ঘন্টা।”
-“তার মানে সন্ধ্যাবেলা। ঠিকাছে, পারব।”
পরেরদিন সন্ধ্যাবেলা ওদের দেখা হলো। তিতিরের সারাটা শরীর ব্যাথা হয়ে আছে। হাটতেও কষ্ট হচ্ছে। তিতিরের গলির সামনে থেকে মুগ্ধ ওকে পিক করে নিল। তারপর একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামাতেই তিতির বলল,
-“এখানে যাব না।”
-“তাহলে কোথায় যাবে বলো?”
-“কোন নদীর পাড়ে।”
-“কোন নদীর পাড়ই রাতের বেলা সেফ না। নদীর পাড়ে অন্য কোনদিন নিয়ে যাব।”
-“আমি কোন রেস্টুরেন্টে যেতে চাচ্ছি না। এমন কোথাও যেতে চাচ্ছি যেখানে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ থাকবে না।”
-“এমন যায়গা এখন কোথায় পাব?”
-“গাড়িতেই থাকি। গাড়িটা কোথাও পার্ক করো।”
-“কতক্ষণ থাকতে পারবে?”
-“৯ টা?”
-“বাসায় প্রব্লেম হবে না?”
-“আমার খোঁজখবর আজকাল সেভাবে কেউ রাখেনা। ভালমতো বুঝে গেছে আমি আর যাই করি পালাবো না। ৯ টার মধ্যে বাসায় না গেলে ফোন করবে।”
মুগ্ধ একটানে হাতিরঝিল চলে গেল। পৌঁছে জিজ্ঞেস করলো,
-“নামবে?”
-“না।”
মুগ্ধ অভ্যাসবসতই কথা বলতে বলতে তিতিরের একটা হাত নিজের কোলের মধ্যে নিচ্ছিল। তিতির হাতটা দিতে সংকোচ করছিল। কিন্তু ততক্ষণে মুগ্ধ দেখে ফেলেছে ওর হাতে মারের দাগ গুলো। নীল হয়ে আছে। রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে মুগ্ধর কান্না পেল। কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করে বলল,
-“আর কোথায় মেরেছে?”
-“এতকিছু হিসেব করে কি মেরেছে? ইচ্ছেমত মেরেছে। পরে গিয়েছিলাম তাই পিঠেই বেশি লেগেছে।”
-“উল্টো ঘোরো।”
-“কেন?”
-“ঘোরো তুমি।”
মুগ্ধর চোখমুখ শক্ত। তিতির জানে কেন মুগ্ধ ওকে ঘুরতে বলছে। কিন্তু এখন ওর কথা না শুনলে তো তুলকালাম বাধাবে। তিতির এসব ভাবতে ভাবতেই মুগ্ধ তিতিরকে ধরে উল্টো ঘুরিয়ে চুলগুলো সরালো। সাথে সাথেই দেখতে পেল ঘারের উপর মারের দাগ। মুগ্ধ তিতিরের কামিজের চেইনে হাত দিতেই তিতির বলল,
-“কি করছো?”
-“একদম চুপ।”
তারপর মুগ্ধ চেইনটা খুলল। পুরো পিঠটা দেখে শিউরে উঠলো। পিঠে একফোঁটা যায়গা নেই যেখানে দাগ নেই। একটা দাগের উপর বাকা হয়ে পড়েছে আরেকটা দাগ। সারা শরীরটাই নীল হয়ে আছে। এটাকে মার বলে না। এটাকে বলে পেটানো। এলোপাথারি পিটিয়েছে ওকে। এই দৃশ্য দেখামাত্রই রাগে মুগ্ধর কপালের দুপাশের রগদুটো ফুলে উঠলো। দাঁতে দাঁত কাটলো। অতঃপর চোখ ভরে গেল জলে। চেইনটা লাগিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে বাইরে তাকালো। তিতির ওকে স্বভাবিক করার জন্য জড়িয়ে ধরলো। সেই ফাঁকে মুগ্ধর চোখ দিয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তেই তিতির দেখার আগে তা নিজের হাতে মুছে ফেললো। তিতির বলল,
-“এই, এত কিপটামি করছো কেন? হোল্ড মি।”
-“ধরার জন্য যায়গা থাকা লাগবে তো। কোথাও তো বাদ রাখেনি।”
মুগ্ধর গলা কাঁপছিল। তিতির ওকে আরো ভাল করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর মুগ্ধও তিতিরকে খুব সাবধানী হাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধ ধরতেই তিতিরের পিঠে ব্যাথা লাগলো কিন্তু অন্তরে লাগলো হাজার ফুলের ছোঁয়া। তিতির বলল,
-“এরকম আরো হাজারবার মার খেয়েও যদি তোমাকে পাওয়া যায় তাহলে আমি তাতে খুশিমনে রাজী।”
মুগ্ধ বলল,
-“এইটুকুন একটা মেয়ে তোমার কত ধৈর্য! আল্লাহ তোমাকে অনেক সুখী করবে দেখো।”
-“সেই সুখটা তুমি ছাড়া যেন না হয় সেই দোয়াটা করো!”
মুগ্ধ হাসলো। তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-“হাসছো যে?”
-“এমনি।”
সেদিন বাসায় এসে রাতের বেলা লুকিয়ে চোখের জল ফেললো মুগ্ধ। ওর অসহায়ত্ব, অপারগতা আর মাথা গরম করে করা ভুলের কারনে আজ তিতির এতটা শাস্তি পাচ্ছে। নিজেকে মনে হলো নর্দমার কীট।
তারপর কদিন ধরে মুগ্ধ অনেক চিন্তাভাবনা করলো। তিতিরের সাথে ঠিকমতো কথা বলল না। দেখা করলো না। তাই সপ্তাহখানেক পর এক ছুটির দিনের সকালে তিতির হুট করে গিয়ে উপস্থিত হলো মুগ্ধর বাসায়। পিউ দরজা খুলে ওকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো।
-“ভাবীইইইই! ওয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ!! কতদিন পর তোমাকে দেখলাম। ভেতরে এসো।”
-“কেমন আছো পিউ?”
-“ভাল, তুমি কেমন আছো ভাবী?
-“আমিও ভাল। আন্টি কোথায়?”
-“মা রান্নাঘরে। দাঁড়াও, ডেকে আনছি।”
ততক্ষণে মা নিজেই চলে এল কে এসেছে দে জন্য। তিতিরকে দেখেই বলল,
-“ওমা, এ আমি কাকে দেখছি? আমার মা যে!”
তিতির সালাম দিয়ে বলল,
-“কেমন আছেন আন্টি?”
-“ভাল মা। তোমার চেহারাটা দিন দিন এমন কেন হয়ে যাচ্ছে মা? জীবনে যাই হয়ে যাক, সেটা তোমাকে দেখলে যেন কিছুতেই বোঝা যায় মা। একটু নিজের যত্ন নিতে হবে।”
-“চেষ্টা তো করি আন্টি।”
-“হুম। অলওয়েজ স্ট্রং থাকবে। আল্লাহ যা করে ভালর জন্যই করে।”
তিতির চুপ করে রইলো। মা আবার বলল,
-“চলো নাস্তা করবে।”
-“আন্টি আমি নাস্তা করে এসেছি। আমি এখন কিছু খাব না। দুপুরে ভাত খাব একসাথে।”
-“আচ্ছা ঠিকাছে। মুগ্ধর কাছে যাও, ঘরেই আছে। ওঠেনি এখনো।”
একথা বলে আন্টি রান্নাঘরে চলে গেল। পিউ তিতিরকে টেনে নিয়ে গেল ভাইয়ের ঘরের সামনে। তারপর বলল,
-“যাও যাও, কেউ তোমাদের ডিস্টার্ব করবে না।”
তিতির লজ্জা পেল। পিউ আবার বলল,
-“আরে ধুরো, লজ্জা পেতে হবে নাগো ভাবি। তুমি যাও তো।”
পিউ চলে যেতেই তিতির দরজা ঢেলে ভেতরে ঢুকলো। মুগ্ধ নেই ঘরে। ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ। ও ওয়াশরুমেই গেছে বোধহয় তাহলে। তিতির ব্যাগটা সোফার উপর রেখে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আন্টি এভাবে বললো কেন, খুব কি চেঞ্জ এসেছে ওর মধ্যে?
মুগ্ধ টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এল। বেড়িয়ে তিতিরকে দেখেই অবাক হয়ে গেল। তিতির ওর দিকে তাকাতেই একটু অপ্রস্তুত বোধ করল। বলল,
-“তুমি কখন এলে?”
-“কিছুক্ষণ আগে।”
-“হঠাৎ?”
-“ফোন ধরছিলে না তো কি করবো? আমি থাকতে পারছিলাম না।”
মুগ্ধ টাওয়ালটা বারান্দায় মেলে দিতে দিতে বলল,
-“আমাকে ছাড়াই তো থাকতে হবে সুন্দরী। থাকতে পারছোনা বললে তো আর হবে না।”
-“এভাবে বলছো কেন?”
তিতির দাঁড়িয়ে ছিল। মুগ্ধ তিতিরের উল্টো পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
-“আমি এতদিন খুব সিরিয়াসলি চিন্তা করলাম সবটা নিয়ে। আমি আগেই জানতাম তান্না কখনো আমাদের সম্পর্ক মেনে নেবে না। কিন্তু তোমার বাবা-মায়ের আশায় ছিলাম, যদি কখনো তাদের মন গলে! কিন্তু তোমাকে যেদিন মারলো সেদিন থেকে আমি বুঝে গিয়েছি তাদের মন কখনো গলবে না। তাই যদি হয় তাহলে আমাদের আর যোগাযোগ না রাখাই উচিৎ। সেটা আমাদের দুজনের জন্যই ভাল হবে।”
তিতির মুগ্ধর কাছে গিয়ে ওর বুকে হাত রেখে বলল,
-“এমন কথা বলোনা প্লিজ।”
-“আমি না ভেবে বলছি না। গত এক সপ্তাহ ধরে দিনরাত আমি এসব নিয়েই ভেবেছি তিতির।”
-“বাবা-মা না মানলে কি? আমরা আমাদের মত সম্পর্ক রাখবো। সেটা তো আর তারা আটকাতে পারবে না।”
-“না তিতির, এভাবে সম্পর্ক রাখা যায়না।”
তিতিরের কান্না পেয়ে গেল। বলল,
-“তুমি এরকম কথা বলছো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”
-“আমি রিয়েলিটি যা তাই বলছি।”
-“তুমি যখন কাউকে বিয়ে করবে তখন আমি নিজেই সরে যাব। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত তো সম্পর্ক রাখাই যায়।”
-“আমি কখনো বিয়ে করবো না”
-“আমিও তো করবো না। তাহলে সম্পর্কটা রাখতে দোষ কি?”
-“দোষ আছে। তোমার সাথে কথা বললে আমি কন্টিনিউয়াসলি কথা না বলে থাকতে পারিনা। তোমার সাথে দেখা করলে ডেইলি দেখা করতে ইচ্ছে করে। তোমার একটু কাছে গেলে আরো কাছে যেতে ইচ্ছে করে।”
-“তাতে সমস্যাটা কি? আমি কি তোমাকে কিছুতে নিষেধ করেছি?”
-“না কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে স্মৃতির পাল্লা ভারী হচ্ছে।”
তিতির এবার কেঁদেই ফেললো। মুগ্ধ বলল,
-“কাঁদছো কেন? কেঁদে কি হবে? কাঁদলে যদি সমস্যা মিটে যেত তো দুজন মিলে কাঁদতাম। কিন্তু মিটবে না, কান্না থামাও নাহলে আমি কথা বলতে পারবো না। আমি এই কথাগুলো তোমাকে দু’তিন দিনের মধ্যেই বলতাম। তুমি আজ আসায় আজ বলছি।”
সবসময়ই তিতির কাঁদলে মুগ্ধ পাগল হয়ে যায়, চোখ মুছিয়ে দেয়, বুকে নিয়ে আদর করে কান্না থামায়। আর আজ ও কত স্বাভাবিক। বন্ধ ঘরের মাঝেও দূর থেকে এসব বলছে! একবার চোখটাও মুছিয়ে দিচ্ছে না! এই কি তিতিরের চেনা মুগ্ধ! পুরো পৃথিবীটা ভেঙে পড়লো তিতিরের মাথার উপর। তিতির মুগ্ধকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,
-“তুমি এভাবে বলোনা। আমার তোমাকে অচেনা লাগছে।”
-“না আমি বলবো। যত কষ্টই হোক তিতির বাস্তবতাটা ফেস করতেই হবে।”
তিতির কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না। মুগ্ধ একটু থেমে আবার বলল,
-“ধরো সিলেটে আমরা যেভাবে ছিলাম, আমি যা পেয়েছি আসার পর থেকে তা আমার প্রতিদিন পেতে ইচ্ছে করে। একটা রাত আমি ঠিক করে ঘুমাতে পারিনি। সম্পর্ক থাকলে আমাদের মধ্যে আরো অনেক কিছু হবে কারন, এখন আমাদের মধ্যে কন্ট্রোলটা নেই বললেই চলে। আগে আমরা জানতাম একদিন না একদিন আমরা দুজন দুজনের হবোই। তাই তুমিও আগে সবকিছুতেই বাধা দিতে, আমিও তোমার বাধা শুনতাম। শত ফাজলামো করলেও কখনোই সেভাবে আগাইনি। আর এখন যখন দুজনেই জানি আমাদের এক হওয়াটা আর কখনোই সম্ভব না, তখন তুমিও কিছুতেই বাধা দাও না আর আমিও নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনা। পাগল হয়ে গিয়েছি দুজন দুজনের জন্য। কন্ট্রোললেস হয়ে গিয়েছি। শুধু মনে হয় আর তো পাব না, এই শেষ। অসম্পূর্ণ, অনিশ্চিত সম্পর্কগুলো এমনই হয়।”
তিতির চুপচাপ সব শুনছে আর কাঁদছে। মুগ্ধ আবার বলল,
-“তিতির, যতই বলি বিয়ে করবো না বিয়ে করবো না বিয়ে আমাদের করতেই হবে। কারন আমাদের ফ্যামিলি। তোমার যে ফ্যামিলি! এমন কিছু করবে যে তুমি বাধ্য হবে বিয়ে করতে। আর আমার মা! সে তো প্রতিনিয়ত আমাকে বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে। এখনো সাকসেসফুল হয়নি কিন্তু কবে যে হয়ে যাবে জানিনা। বিয়ে আমাদের দুজনেরই করতে হবে তিতির কিন্তু যে কোন একজনের আগে হবে। সেই দিনটি হবে আমাদের দুজনের জীবনের সবচেয়ে অসহ্যকর দিন। সেদিন আমরা দুজনই থাকবো অসহায়। অসহায়ত্বের চেয়ে কষ্টের কিছু নেই এই পৃথিবীতে। আমরা যদি এর পরেও সম্পর্ক রাখি তাহলে আরো ক্লোজ হতে থাকবো। তখন ওই দিনটি ফেসই করতে পারবো না তিতির।”
তিতির ঝাঁপিয়ে পড়লো মুগ্ধর বুকে। জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“তুমি এমন করোনা প্লিজ। যতদিন একসাথে থাকা যায় আমরা থাকিনা প্লিজ? যতটুকু পাব ততটুকুতেই তো শান্তি।”
মুগ্ধ তিতিরকে জড়িয়ে ধরলো না। বলল,
-“না তিতির, শান্তি নেই। আমি নিশ্চিন্তে তোমাকে আদর করতে পারিনা। মন খুলে কথা বলতে পারিনা। সবসময় হারানোর ভয়, অতঙ্ক। এভাবে পারছি না আর। এই ঝুলন্ত অবস্থার একটা শেষ হওয়া চাই।”
তিতির কাঁদতে কাঁদতে মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই হাটু গেড়ে বসে পড়লো। মুগ্ধর হাটু জড়িয়ে ধরে বলল,
-“আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না প্লিজ। আমি মরে যাব।”
মুগ্ধ তিতিরকে উঠালো না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তিতিরকে এভাবে কষ্ট দিতে ওর বুকটা ছিড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মুগ্ধ শক্ত করলো নিজেকে। অনেকক্ষণ পর তিতির নিজেই উঠে দাঁড়ালো। কান্না আরো বাড়লো। কাঁদতে কাঁদতেই মুগ্ধর বুকে হাত রেখে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে বলল,
-“এই তুমি দেখছো না আমি কাঁদছি?”
মুগ্ধ চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। তিতির উন্মাদের মত মুগ্ধর হাতদুটো দিয়ে নিজের চোখের জল মুছিয়ে বলল,
-“আমার চোখের পানি মুছে দাওনা। দাওনা মুছে।”
মুগ্ধ ওর চোখের পানিও মুছে দিল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। তিতির এবার মুগ্ধর বুকে মাথা রেখে ওকে জড়িয়ে ধরলো। একটু পর মুগ্ধর হাতদুটো নিজের কোমরে রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“ধরো না আমাকে।”
মুগ্ধ ধরলো না। তিতিরের কান্না থামলোই না। আবার বলল,
-“এমন করোনা, আমি মরে যাব। প্লিজ এমন করোনা। আমাকে দূরে সরিয়ে দিওনা। আমাকে ছোড়ো না।”
মুগ্ধ এতক্ষণে বলল,
-“তাহলে তুমি ছাড়ো, তোমার ফ্যামিলিকে!”
তিতির অবাক হয়ে তাকালো মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধ আরো বলল,
-“হ্যা যেহেতু তারা অপশন দিয়েই দিয়েছে হয় ফ্যামিলি নাহয় আমি। দেন ইউ হ্যাভ টু পিক অনলি ওয়ান।”
তিতির মুগ্ধকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কিছু বলল না শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মুগ্ধ বলল,
-“তুমি আজ আর যেওনা। আজই বিয়ে করবো। তাহলেই তো আমাদের আর দুজন দুজনকে ছেড়ে থাকতে হবে না।”
-“তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছো?”
-“যদি তাই ভাবো তবে তাই।”
তিতির চোখ মুছলো। বিশেষ লাভ হলোনা, সংগে সংগে আবার গাল ভিজে গেল নতুন চোখের জলে। বলল,
-“আমি জানি আমার ফ্যামিলির কাছে তুমি অনেক অপমানিত হয়েছো। তোমার তাদের উপর রাগ থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তবু তো আমার ফ্যামিলি। আমি রাগ করতে পারিনা, উল্টো আমার ফ্যামিলি নিয়ে তুমি কিছু বললে আমার গায়ে লাগে। এখন যাই ব্যবহার করুক, ছোটবেলা থেকে যে ভালবাসা আর সাপোর্ট দিয়েছে তা আমি ভুলতে পারিনা। আর সবাই যেমন তেমন আমার বাবার জন্য আমি পারিনা। আর তুমি যে ভালবাসাটা আমাকে দিয়েছো তা সব মেয়েদের স্বপ্ন থাকে। তুমি আমার রক্তে মিশে গেছো, তা থেকে আলাদা করতে পারবো না কিছুতেই। তাই বাবা আর তুমি দুজনকেই আগলে থাকতে চেয়েছিলাম। যাই হোক, আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছো তুমি! আর করতে হবে না। আজ থেকে তুমি ফ্রি।”
একথা বলেই তিতির ব্যাগটা সোফার উপর থেকে তুলে বেড়িয়ে যাচ্ছিল ঘর থেকে। মুগ্ধ বলল,
-“কোথায় যাচ্ছো?”
-“বাসায়।”
-“দাঁড়াও, আমি তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি।”
তিতির পিছনে ফিরে তাকিয়ে হেসে বলল,
-“লাগবে না, আমি চলে যেতে পারবো।”
তিতিরের চোখ উপচে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। মুগ্ধ বলল,
-“হ্যা আমি জানি তুমি একা যেতে পারবে কিন্তু যেহেতু তুমি আমার বাসায় এসেছো, আমার একটা দায়িত্ব আছে।”
-“নাহ, আমার প্রতি আজ থেকে তোমার আর কোন দায়িত্ব পালন করতে হবে না। অনেক দিয়েছো তুমি আমাকে, কোনদিনও ভুলবো না।”
কথা শেষ করেই তিতির বেড়িয়ে গেল। ঘর থেকে বের হতেই মুগ্ধর মা বলল,
-“তিতির, তুমি কাঁদছ কেন মা?”
-“আন্টি আমি চলে যাচ্ছি। মাফ করবেন বলেছিলাম দুপুরে একসাথে খাব। সেটা এখন আর সম্ভব না।”
ততক্ষণে মুগ্ধ বেড়িয়ে এসেছে ঘর থেকে। তিতির বেড়িয়ে যেতেই মা পেছন পেছন যাচ্ছিল। মুগ্ধ বলল,
-“ওকে যেতে দাও মা।”
To be continued…