#প্রেমাতাল
পর্ব ৩৫
লেখিকাঃ মৌরি মরিয়ম
প্রত্যেকটা মানুষই সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট স্টক নিয়ে পৃথিবীতে আসে। সেই স্টক শেষ হয়ে গেলে যেমন আর পাওয়া যাবে না তেমনি শেষ না হলেও মৃত্যুর আগে যেভাবেই হোক শেষ হতে হবে। তিতিরের সুখের স্টক শেষ বোধহয়। আর কষ্টের স্টকে তো হাতই পড়েনি এতদিন। ছোটবেলা থেকে কেঁদেছে অনেকবারই তবে সেটা শুধুই সুখে,আবেগে। আজ থেকে যে কষ্টের কান্না শুরু, বুঝতে অসুবিধা হলো না তিতিরের। এটাও বুঝতে পারছে মুগ্ধকে ও কখনোই পাবে না। তবু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাবে।
মাঝরাতে আবার ফোন করলো মুগ্ধ। তিতির বলল,
-“ঘুমাওনি কেন? সকালে অফিস নেই?”
-“কাল শনিবার।”
-“ও হ্যা। খেয়াল ছিল না।”
-“তোমাকে বাসা থেকে এখনো কিছুই বলেনি?”
-“বলেছে।”
-“কি বলেছে?”
কে কি বলেছে সবটা মুগ্ধকে খুলে বলল তিতির। সব শুনে মুগ্ধ বলল,
-“সো নাও ইউ হ্যাভ জাস্ট 2 অপশনস টু পিক ওয়ান।”
তিতির চুপ করে রইল। মুগ্ধ বলল,
-“তো কি ডিসিশান নিলে?”
তিতির চুপ, মুগ্ধও কিছু বলল না.. সময় দিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিতির বলল,
-“তোমাকে বিয়ে করলে আমার ফ্যামিলি ছাড়তে হবে। সেটা তো পারব না আমি।”
-“জানতাম আমি।”
-“আমি তোমাকেও অনেক ভালবাসি কিন্তু বাবা-মা ছোটবেলা থেকে কত কষ্ট করেছে আমার জন্য তাদের আমি কষ্ট দিতে পারব না।”
-“হুম। কিন্তু তিতির তুমি যদি চলে আসো, আমরা বিয়ে করে ফেলি তারপর এক সময় তোমার ফ্যামিলি ঠিকই মেনে নেবে। এখন কষ্ট পেলেও তখন তো সব ঠিক হয়ে যাবে তাইনা?”
-“যারা পালিয়ে বিয়ে করে তাদের সবারই ফ্যামিলি এক সময় না এক সময় মেনে নেয়। তাই আমরা ভাবি সব ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু আসলে কি ঠিক হয়? কতটুকু ঠিক হয় বলো তো? বাবা-মায়ের মনে যে ক্ষতর সৃষ্টি হয় সেটা কি কখনো মিলিয়ে যায়? যায়না, হয়তো সন্তানের মুখ চেয়ে মেনে নেয় একসময়। কিন্তু ক্ষতটা ভেতরে রয়েই যায়।”
মুগ্ধ ভাবলো, বাহ তিতির বড় হয়ে গেছে! এই চিন্তাটা মুগ্ধর মাথায় আসা উচিৎ ছিল, কিন্তু আসেনি। আসলো তিতিরের মাথায়। তিতির ওকে চুপ থাকতে দেখে বলল,
-“কিছু বলো?”
-“আমার আর কিছু বলার নেই। যা ভাল মনে হয় করো।”
এভাবেই চলতে থাকলো, তখন প্রতিদিন ওদের কথা হত। কেমন আছো কি করোর পর ওদের কথা ফুরিয়ে যেত। তারপর শুধু শুধু কতক্ষণ ফোন কানের কাছে ধরে রেখে তারপর রেখে দিত। মুগ্ধ কোনো ফাজালামো করতে পারতো না। তিতিরও তেমন কথা খুঁজে পেত না। ওরা একসাথে থাকলেও ওদের জীবনে কোন সুখ ছিল না। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর কথায় কথায় হুট করে একদিন মুগ্ধ রেগে গিয়ে বলল,
-“যেইনা ফ্যামিলি তার জন্য আবার জান দিয়ে দিচ্ছে। আমার জীবনে আমি এত ফালতু ফ্যামিলি দেখিনি।”
তিতির অবাক হয়ে বলল,
-“কি বললে তুমি?”
-“যা বলেছি একদম ঠিক বলেছি। তোমার ফ্যামিলির কাছে নিজেদের ইগোর মূল্য সবচেয়ে বেশি। তোমার সুখ কিচ্ছু না।”
তিতির কিছু না বলে ফোন কেটে দিল। হঠাৎই পায়ের তলা থেকে একদল কীট যেন ঢুকে গেল পায়ের ভেতর। পা থেকে সমস্ত শিরা,উপশিরা বেয়ে বেয়ে রকেটের গতিতে বুকের মধ্যে উঠে এসে একটা মোচড় দিয়ে আবার বেয়ে বেয়ে উঠে গেল মাথায়। তারপর আবার একটা মোচড় দিয়ে পানির রূপ ধরে বেড়িয়ে এল চোখ দিয়ে! মুগ্ধ এভাবে কথা বলল ওর সাথে? তিতির জানে ওকে ছাড়া থাকতে মুগ্ধর কষ্ট হয়। ওর কি কষ্ট হয়না? এতবড় পৃথিবীতে একমাত্র মুগ্ধই তো ছিল ওকে বোঝার মানুষ। এখন সেও বুঝতে পারছে না!
মুগ্ধ সাথে সাথেই আবার কল দিল। কয়েকবার ধরলো না তিতির। কিন্তু মুগ্ধ একের পর এক কল করেই যাচ্ছে। অবশেষে না ধরে থাকতে পারলো না। তিতির ভেবেছিল মুগ্ধ সরি বলার জন্য ফোন করছে। কান্নাটা কোনভাবে থামিয়ে, চোখ মুছে ফোনটা ধরলো। মুগ্ধকে কিছুতেই বুঝতে দেয়া যাবে না যে ও কাঁদছিল। কিন্তু ফোন ধরতেই মুগ্ধ ঝাড়ি দিয়ে বলল,
-“কথা বলছি তার মধ্যে না বলে ফোন কাটলে কেন?”
-“এমনি।”
-“এমনি মানেটা কি? ফ্যামিলি তোমার একলারই আছে? আর কারো নেই?”
-“সবারই ফ্যামিলি আছে আর সবার ফ্যামিলির প্রতিই তাদের দূর্বলতা আছে। তাই আমার ফ্যামিলি নিয়ে আর আজেবাজে কথা বলোনা।”
-“কেন বলবো না? তোমার তোমার ভাই ইচ্ছেমত বাবা-মার ব্রেইন ওয়াশ করবে আর তারা কিছু যাচাই না করেই ওয়াশড হবে। তোমার ভাই তাদের ছেলে আর তুমি কি কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে যে তোমার দিকটা দেখবে না?”
-“তোমার সাথে কথা বলার আর কোন ইচ্ছে আমার নেই।”
-“তোমার সাথে কথা বলার জন্য লাগে আমি বসে আছি? ফোন রাখো!”
শেষের ‘ফোন রাখো’ টা মুগ্ধ প্রচন্ডভাবে ধমকে বলল। তিতির বলল,
-“তুমি রাখো।”
-“আর একটা কথা বললে তোমার ভাইরে আমি খুন করবো। এক্ষুনি ফোন রাখো।”
-“আমি ফোন দিয়েছি মনে হয়? তুমি ফোন দিয়েছো, তুমিই ফোন রাখবে।”
-“ধুর বা*।”
একথা বলেই ফোন রেখে দিল মুগ্ধ। আবার কান্নায় ভেসে গেল তিতির। আচ্ছা ঠিকাছে এই ব্যাবহার করলো তো মুগ্ধ? মনে থাকবে।
আশ্চর্যজনকভাবে তিন চারদিন চলে গেল অথচ মুগ্ধ একবারও ফোন করলো না। থাকতে না পেরে তিতিরই কল করলো। ওই নাহয় প্রথমে সরি বলবে। কিন্তু কল ঢুকছে না। তিতির অবাক হলো। অনেকবার ট্রাই করলো। কিন্তু কল ঢুকছেই না! ভাবীর রুমে গিয়ে ভাবীর ফোন থেকে কল করতেই কল ঢুকলো। এবং মুগ্ধ সেই কল রিসিভও করলো। কথা না বলে কেটে দিল তিতির। ভাবীকে বলল,
-“যদি কল ব্যাক করে তো বলবে নাম্বার টাইপ করতে গিয়ে ভুল করে ফেলেছিলে। পরে অপরিচিত গলা শুনে কেটে দিয়েছো।”
-“কে মুগ্ধ ভাইয়া?”
তিতির দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল,
-“হ্যা।”
-“রাগারাগি হয়েছে?”
তিতির ম্লান হেসে বলল,
-“সব তো শেষই, এখন রাগারাগি হলেই কি আর না হলেই কি!”
ভাবী অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তিতির নিজের ঘরে চলে এল। তার মানে মুগ্ধ ওকে ব্লক করে রেখেছে। ফেসবুকে ঢুকলো ম্যাসেজ করার জন্য। কিন্তু মেসেজ গেল না। মুগ্ধ ওকে ফেসবুকেও ব্লক করে দিয়েছে! কতক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। ও পারে পিউ বা মা কে কল করতে। কিন্তু করবে না। কেন করবে? মুগ্ধ তো ইচ্ছে করেই সবকিছু থেকে ব্লল কিরেছে যাতে ওর সাথে আর কথা বলতে না হয়। ঠিকাছে মুগ্ধ পারলে ও অবশ্যই পারবে। তিতির সিদ্ধান্ত নিল কোনভাবেই আর মুগ্ধর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। যেদিন মুগ্ধ নিজ থেকে যোগাযোগ করবে সেদিন মুখ ঘুরিয়ে থাকবে, খুব কথা শুনিয়ে দেবে সেদিন।
সারাটা দিন মাস্টার্সের ক্লাস আর ফ্রেন্ডস নিয়ে ব্যস্ত থাকতো তিতির। কিন্তু রাতটা কাটতেই চাইতো না। একটা রাতও শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি তিতির। ঘুম তো আসতোই না, কোনভাবে ঘুমিয়ে পড়লেও দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যেত। আগে এত স্বপ্ন দেখতো না। ইদানিং বেড়েছে। মানুষের মন যত বেশি অশান্তিতে থাকে তত বেশি স্বপ্ন দেখে একথা বুঝি আসলেই সত্যি।
৫ মাস পর যেদিন মুগ্ধ ফোন করলো তিতিরকে কোনো কথাই শোনাতে পারেনি সেদিন ও। পারেনি কোনো অভিমান করতে, পারেনি আহ্লাদ করতে, এমনকি পারেনি ওর সামনে কাঁদতেও। যেন অনেক দূরের মানুষ। কঠিন হয়ে থাকতে পেরেছিল শুধু। সেদিন মুগ্ধ বলেছিল,
-“সরি তিতির, লাস্ট যেদিন আমাদের কথা হয়েছিল সেদিন আমি তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যাবহার করেছি।”
তিতির বলেছিল,
-“৫ মাস পর সরি ফিল করলে?”
-“নাহ, ২/৩ দিন পরেই সরি ফিল করেছিলাম কিন্তু ইচ্ছে করেই ফোন করিনি। তোমাকেও ব্লক করে রেখেছিলাম কারন যেহেতু দূরেই থাকতে হবে তাই অভ্যাস করছিলাম।”
-“বাহ ভালই তো। তা অভ্যাস ভেঙে ফোন করতে গেলে কেন?”
-“আসলে আমার মোবাইলে তোমার যে ছবিগুলো ছিল ওগুলো পিসিতে রেখে ডিলিট করে দিয়েছিলাম। যাতে সবসময় সামনে না পরে। সামনে পড়লেই তো দেখতে থাকি আর মায়া বাড়ে। নিজেকে কন্ট্রোলে রাখার জন্যই এসব করেছিলাম। আজ হঠাৎই তোমার একটা ছবি সামনে পড়লো। তারপর লোভ হলো অন্য ছবিগুলো দেখার, দেখলাম। তারপর লোভ আরো বাড়লো তোমার ভয়েস রেকর্ডিং গুলোও শুনলাম। তারপর তোমাকে লাইভ শোনার লোভ হলো। আর থাকতে না পেরে কল করলাম। এখন তোমাকে লাইভ দেখার লোভ হচ্ছে।”
-“এতদিন যখন কন্ট্রোলে রাখতে পেরেছো তো এখনো পারবে, বাকী জীবনটাও পারবে।”
-“হুম, কন্ট্রোল করার চেষ্টা করেছি, করতে তো আর পারলাম না। অনেক কষ্ট হয়েছে এই ৫ টা মাস। জানি তোমারও কষ্ট হয়েছে। অনেক কষ্ট দিয়েছি, ক্ষমা করো।”
-“না না একদম ঠিকই করেছো তুমি। ৫ মাস যে পারে সে সারাজীবনও পারবে।”
-“ওকে বাট, এটলিস্ট স্কাইপে তে আসো?”
তিতিরের বুক ফেটে কান্না পাচ্ছিল তখন কিন্তু কান্নাটা চেপে রাখলো। বড্ড অভিমান হলো। ইশ ৫ টা মাস একটা কথা না বলে থেকেছে আর এখন এসেছে চেহারা দেখতে! চিন্তা করলো বেঁচে থাকতে এ চেহারা আর দেখাবে না মুগ্ধকে। বলল,
-“না স্কাইপে তে আসতে পারবো না। ইন্টারনেট নেই।”
তারপর থেকে গত দুই মাসে মুগ্ধ অনেকবারই ফোন করেছে। প্রথম কয়েকবার ফোন ধরেনা তিতির, তারপর ঠিকই ধরে, না ধরে পারেনা। কিন্তু দুজনের কথাবার্তা যতক্ষণ হয় এধরণের কথাই হয়। তিতিরের অভিমানটা একসময় চলে যায় কিন্তু তবু শক্ত থাকে কারন ও জানে ওর ফ্যামিলি মানবে না। তাই আর জড়াতে চায় না। যত জড়াবে কষ্ট তত বাড়বে। মুগ্ধ জানে তিতির কেন এত স্ট্রং হয়ে থাকে, ও জানে তিতির যত কাটা কাটা কথাই বলুক না কেন ওর বুকের মধ্যে মুগ্ধর জন্য যে ভালবাসা ছিল তা আজও আছে। সেখানে অনেক বরফ জমিয়ে ফেলেছে মুগ্ধ, এখন গলাতেও হবে ওরই। তাই হাল ছাড়েনি।
সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। তিতির এখনো ওঠেনি। এরপর না গেলে ওর বাপ-ভাই খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেবে। তখন আরেক অসান্তি হবে। মুগ্ধ তিতিরের মাথার কাছে বসে চুলের ভেতর হাত বুলিয়ে ডাকলো,
-“তিতির? এই তিতির?”
তিতির উঁ করে নড়ে উঠলো। মুগ্ধ বলল,
-“উঠবে না?”
-“না।”
তিতিরের সেই ঘুমন্ত কন্ঠস্বর যা শুনলে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায় মুগ্ধর। ও তিতিরের মাথাটা বালিশ থেকে উঠিয়ে নিজের কোলে নিল। তারপর আবার ডাকলো,
-“ওঠো না বাবা, বাসায় যেতে হবে তো।”
-“না আজকে যাব না, তুমি টিকেট ক্যান্সেল করে দাও। আজও আমি তোমার আদর খাব।”
মুগ্ধর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। শরীরে কাঁপন ধরলো। অনেকদিন পর সেই পুরোনো অনুভূতি। যেন আবার ওরা কোথাও বেড়াতে গিয়েছে। তিতির ঘুমের মধ্যে আহ্লাদ করছে। মুগ্ধ তিতিরকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-“পাগলী, এত ভালবাসা লুকিয়ে কেন রাখো?”
কিন্তু তিতির তখনো ঘুমে। মুগ্ধ আরো কয়েকবার ডাকার পর চোখ মেলে তাকালো ওর দিকে। কয়েক সেকেন্ড পর লাফিয়ে উঠে সরে গেল তিতির। মুগ্ধ কিছু বলল না। তিতির ভাবতে লাগলো ও তো ছিল রাস্তায়! মুগ্ধর বাড়িতে এল কি করে? আর ওর বুকের উপরই বা পড়ে ছিল কেন? ইশ বুকটা ধকধক করছে। কতদিন পর মুগ্ধ ওর সামনে! মুগ্ধ বুঝতে পারলো বোধহয় তাই বলল,
-“তুমি রাস্তায় সেন্সলেস হয়ে পড়ে গিয়েছিলে। একটা ছেলে তোমার ফোনের ইমারজেন্সি কললিস্টে আমার নাম্বার পেয়ে আমাকে ফোন করে। তারপর আমি সেখান থেকে তোমাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাই, সেখানে তোমাকে ঘুমের ইঞ্জেকশান দেয়া হয়। তারপর আমি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি ঘুমানোর জন্য। ওই অবস্থায় তোমার বাসায় দিতে গেলে আমাকে ভেতরে ঢুকতে হতো। তখন তো আরেক গ্যাঞ্জাম লাগতো। তাই এখানে এনেছি।”
তিতিরের মনে পড়ে গেল। বলল,
-“কোন রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলাম?”
-“চেয়ারম্যান বাড়ি।”
-“চেয়ারম্যান বাড়ি কি করে আসলাম? আমি তো ছিলাম ধানমন্ডি। লেকের ধার ধরে হাটছিলাম।”
-“মানে কি? তুমি হাটতে হাটতে ধানমন্ডি থেকে বনানী এসেছো?”
তিতিরের মাথাটা ঝিমঝিম করছে। তিতির দুহাতে মাথা চেপে ধরলো। মুগ্ধ ওর হাত ধরে বলল,
-“কি হয়েছে? খারাপ লাগছে?”
তিতির বলল,
-“না ঠিকাছে।”
-“আগে কখনো এমন হয়েছে?”
-“নাহ। আর আমি বাসায় যাব, অনেক দেরী হয়ে গেছে।”
-“আচ্ছা, চলো। তার আগে একটু হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। ভাল লাগবে।”
হাতমুখ ধুয়ে বের হতেই তিতির দেখলো মুগ্ধর মা বসে আছে একটা ট্রে নিয়ে। ট্রে ভর্তি দুনিয়ার খাবার-দাবার। তিতিরকে দেখেই উনি উঠে এলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন,
-“ইশ, মা কি চেহারা করেছো? খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করোনা না?”
তিতির একটু হাসার চেষ্টা করল,
-“না না আন্টি খাই তো। আসলে বয়স বাড়ছে তো, আগের মত অত ছোট তো নেই।”
-“এহ আমার কাছে বয়সের কথা বলছো? বলোনা। এই অবস্থা কেন হয়েছে জানিনা ভাবছো? এত ভেঙে পড়োনা মা। তোমার ফ্যামিলি যখন মুগ্ধকে মেনে নেবেই না আর তুমিও যখন পারবে না ফ্যামিলি ছেড়ে আসতে তাহলে সেটাই বাস্তবতা ভেবে মেনে নাও। সুখী হবে।”
তিতির কিছু বলল না, মাথা নিচু করে রইলো। মা বলল,
-“এসো মা একটু ভাত খেয়ে নাও।”
-“নাহ, আন্টি আমি এখন খাব না।”
-“একটা মাইর দিব ধরে। আমি খাইয়ে দিচ্ছি তোমাকে। খাব না বললে তো হবে না।”
মুগ্ধর মা তারপর জোর করে খাইয়ে দিল তিতিরকে। মুগ্ধ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। মা বলল,
-“মুগ্ধ, তুইও তো খাসনি। একটু প্লেটে নিয়ে খেয়ে নে না বাবা।”
মুগ্ধ একটা প্লেটে অল্প একটু ভাত নিয়ে খেল। তারপর তিতিরকে নিয়ে বের হলো।
তিতির পাশে বসে আছে। মুগ্ধ ড্রাইভ করছে। মুগ্ধর নিজের গাড়ি। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় নিজেই ড্রাইভ করে যায়। তারপর ড্রাইভার গিয়ে গাড়ি নিয়ে আসে। মা,পিউ,স্নিগ্ধ ব্যবহার করে। সন্ধ্যায় ড্রাইভার আবার গাড়ি মুগ্ধর অফিসে দিয়ে আসে। মুগ্ধ ডাইভ করে ফেরে। প্রথমবার যখন মুগ্ধর প্রমোশন হয় তার পরপরই বাবা মারা যায়। লোন নিতে সাহস পায়নি তখন। পুরো ফ্যানিলির দায়িত্ব যে এখন ওর উপর! তারপরের বছর আবার প্রোমোশন হয় তখন মুগ্ধ কারলোন নিয়ে গাড়িটা কেনে। গাড়িতে বসতেই তিতিরের মনে পড়ে গেল এই গাড়িটা নিয়েও ভাইয়া কত কিছুই না বুঝিয়েছে বাবাকে। এত তারাতারি গাড়ি কিনলো কি করে? কি এমন চাকরী করে? নির্ঘাত অসৎ পথে আয় করেছে। বাপ পুলিশ ছিল না? ম্যাক্সিমাম পুলিশরাই তো দুই নাম্বার হয়। দুই নাম্বারের ছেলেও হয়েছে দুই নাম্বার। আঙ্কেলের মত অমন মানুষ সম্পর্কে ওসব কথা শুনে তিতির কান্না করে দিয়েছিল। নিজের ভাইকে বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘সবাই তোর মত দু’মুখো সাপ না। তোর যোগ্যতা নেই বলে তুই চাকরীতে উন্নতি করতে পারিসনি। বাপের টাকায় ফুটানি মারছিস। মুগ্ধর যোগ্যতা আছে তাই মুগ্ধ উন্নতি করতে পেরেছে।’ কিন্তু বলতে পারেনি তিতির। ছোটবেলা থেকেই ও কখনো বাসায় কারো মুখের উপর কথা বলেনি। এখনো বলেনা তবু ওকে পদে পদে শুনতে হয় ও বেয়াদব। কারন ও ফ্যামিলির সবার সামনে দাঁড়িয়ে স্পষ্টভাবে বলতে পারে, ‘আমি মুগ্ধকে ভালবাসি।’
জ্যামে পড়লো ওরা। গাড়িতে ওঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত দুজনের একজনও কোন কথা বলেনি। মুগ্ধ একটা গান প্লে করলো,
“আমার আকাশ জুড়ে
বিশাল পাখির ডানা
তোমার ভেতর দিয়ে আমার আনাগোনা
তোমার ধমনীতে আতুর হয়ে যখন
চাঁদের আলোয় ভিজে সামিলে মন যখন
মাঝে মাঝে একা লাগে..
ভীষন সুখেও একা লাগে..
এ অসময়ে একা লাগে..
এ বালির পথ একা লাগে..
রাত পেড়িয়ে দিন আসে
দিন পেরিয়ে রাত
প্রত্যেকদিন বাড়ছে শুধুই এই অজুহাত।
তোমার ধমনীতে আতুর হয়ে যখন
চাঁদের আলোয় ভিজে সামিলে মন যখন
মাঝে মাঝে একা লাগে..
ভীষন সুখেও একা লাগে..
এ অসময়ে একা লাগে..
এ বালির পথ একা লাগে..
সব বুঝতে সময় লাগে
ভুল বুঝতে নয়।
কার সাধ্য ঘোচাবে
আমাদের সংশয়?
তোমার ধমনীতে আতুর হয়ে যখন
চাঁদের আলোয় ভিজে সামিলে মন যখন
মাঝে মাঝে একা লাগে..
ভীষন সুখেও একা লাগে..
এ অসময় একা লাগে..
এ বালির পথ একা লাগে।”
হঠাৎ তিতির গানটা বন্ধ করে দিল। মুগ্ধ বলল,
-“কি হলো গানটা বন্ধ কেন করলে?”
-“গানটা খুব বাজে ছিল।”
মুগ্ধ মৃদু হেসে চোখ ফিরিয়ে নিল। বাকী রাস্তাও তিতির আর একটা কথাও বলল না। বিজয় স্মরনী থেকে ধানমন্ডির দিকে না গিয়ে তেজগাঁর দিকে যেতেই তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-“ওদিকে কোথায় যাচ্ছো?”
-“এখন কথা কেন বলছো? এতক্ষন যেমন কথা বলার প্রয়োজন মনে করোনি তেমন এখন ও করার দরকার নেই।”
তিতির বলল,
-“বাসায় যেতে দেরী হলে প্রব্লেম হবে।”
-“কোন প্রব্লেম হবে না। সারাদিন তো বাসার বাইরে, কেউ তো একবার ফোন করে খবরও নিল না! আর যদি প্রব্লেম হয়ও তাতে আমার কি?”
তিতির আর কোন কথা বলল না। আসলেই রাত ১০ বাজলে হয়তো কেউ ফোন করবে তার আগে ইদানিং কারোর সময়ই হয়না ওকে নিয়ে চিন্তা করার। হাতিরঝিল গিয়ে লেকের ধারে গাড়ি থামালো মুগ্ধ। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
-“সমস্যা কিরে বাবা তোমার? প্ল্যান করে দেখা তো করিনি। হঠাৎই দেখা হয়ে গেছে। এখন একটু স্বাভাবিকভাবে কথা বলতেও তোমার সমস্যা?”
-“হ্যা, অনেক সমস্যা।”
একথা শুনে রাগ ধরে রাখতে পারলো না মুগ্ধ। আচমকা তিতিরের কোমড় জড়িয়ে ধরে তিতিরের ঠোঁটে চুমু খেল। প্রথমে তিতির ওকে সরিয়ে দিতে চাইছিল। কিন্তু অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পরেও এক ইঞ্চি সরাতে পারলো না মুগ্ধকে। তারপর কি যেন হলো তিতিরের, তখন ও নিজেও মুগ্ধর গলাটা জড়িয়ে ধরে সাড়া দিল।
To be continued…