#যেদিন তুমি এসেছিলে পর্ব ৪০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
আজকের আকাশ ভীষণ সুন্দর। রোদের তেমন ঝাঁঝ নেই। সত্যি বলতে, রোদও মিষ্টি লাগছে। সবসময়ের মতো বিরক্তিকর নয়। অর্ষা জানালার ধারে বসে রয়েছে। লামিয়া আর নিহাল এসেছে বিকেলের দিকে। বাড়িতে এসেই নিহাল স্মিথকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে বাড়ির আশপাশটা দেখার জন্য। লামিয়া গেছে ওয়াশরুমে।
অর্ষা তখনো আহনাফের কথাগুলো ভেবে চলছিল। মানুষটা কি তাকে ভালোবাসে? তার হাভভাব, কথাবার্তা কিংবা আচরণ যেসবের কথাই বলি না কেন, সবকিছু তো পজিটিভ দিকে-ই ইঙ্গিত করে।
‘এত কী ভাবছিস?’ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছে লামিয়া। চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে নিতে নিতে অর্ষার কাছে ভাবনার বিষয়-বস্তু জানতে চাইল।
অর্ষা লামিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,’কিছু না।’
‘কী কিছু না? অবশ্যই কিছু না কিছু ভাবছিস। আচ্ছা আগে এটা বল যে, কাজ কি কিছু হয়েছে?’
‘কীসের কাজ?’
লামিয়া এবার বিছানায় পা তুলে বসে। একটু ভাব নিয়ে বলে,’কাল রাতে আমি একটা চিঠি লিখেছিলাম।’
‘কী! কাকে?’
‘তোর হাজবেন্ডকে। ভাবিস না আবার আমি প্রেমপত্র লিখেছি। অভিযোগ পত্র লিখেছি।’
‘তোর কথার মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘মানে হচ্ছে আমি তুই সেজে ভাইয়াকে একটা চিঠি লিখেছি।’
অর্ষা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,’কী লিখেছিস?’
চিঠির কথাগুলো অর্ষাকে হাসতে হাসতে বলে লামিয়া। অর্ষা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,’ওহ আচ্ছা! এজন্যই সকালে তাহলে এমন আচরণ করেছে।’
লামিয়া উদগ্রীব হয়ে ওঠে। অর্ষাকে টেনে এনে বিছানায় বসায়। উৎসাহিত কণ্ঠে জানতে চায়,’কী করেছে রে?’
‘তেমন কিছু না। রোমান্টিক হওয়ার চেষ্টা করেছে।’
সকালের ঘটনা শুনে লামিয়া মুখে হাত দিয়ে হাসে। হাসতে হাসতে অর্ষার গায়ে লুটিয়ে পড়ে বলে,’যাক, প্ল্যানে তাহলে কাজ হচ্ছে।’
অর্ষা মৃদু হেসে বলে,’হুম। তো কোথায় কোথায় ঘুরবি ঠিক করেছিস?’
‘আমি কিছু জানি না। প্লেস নিহাল ঠিক করেছে। ভাইয়ার অফিস থেকে ছুটি দিয়েছে?’
‘না রে! এর আগে হুটহাট বেশ ক’দিন ছুটি নিয়েছে তো। তাই এখন আর ছুটি পায়নি। তোরা এক কাজ কর, তোরা দুজনে তোদের মতো করে ঘোরাফেরা কর। রাতে আমাদের এখানে চলে আসবি। একসাথে ডিনার করব।’
লামিয়ার মনটা খারাপ হয়ে যায়। সে বিমর্ষ হয়ে বলে,’ধুর!’
অর্ষা লামিয়াকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী স্বরে বলল,’ওলে! রাগ করে না। ঘুরাঘুরি করার সময় কি শেষ হয়ে গেছে? অন্য এক সময় সবাই একসাথে ঘুরব।’
লামিয়াও তাই মেনে নিল। আসলে অর্ষা মিথ্যে বলেছে লামিয়াকে। আহনাফের সাথে কথা বলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যাতে করে নিহাল এবং লামিয়া তাদের হানিমুনটা সুইজারল্যান্ডে ঠিকমতো করতে পারে।
অর্ষা নিহালকেও আলাদা করে সব বুঝিয়ে বলেছে। লামিয়ার পাগলামিতে সায় না দিতে অনুরোধও করেছে। পরেরদিন বাংলাদেশ থেকে রেশমি জানিয়েছে পাত্রপক্ষ পছন্দ করে গেছে। তারা বিয়ের ব্যাপারে আগাতে চায়। রেশমি বুদ্ধি করে ছেলের সাথে কথা বলে সময় চেয়ে নিয়েছে। লামিয়া দেশে ফিরলে এরপর সবাই মিলে একটা গোল বৈঠকে বসবে। তারপর যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেওয়া যাবে।
এদিকে একটা দিন শুধু আহনাফ, অর্ষা, লামিয়া আর নিহাল চারজনে একসাথে ঘুরতে বের হয়েছিল। একদিন রাতে ডিনার করতে বাইরে রেস্টুরেন্টে গেছিল। বাকি সময়টা নিহাল এবং লামিয়াকে আলাদা কাটানোর জন্য দিয়েছে। লামিয়া অবশ্য প্রথমে মানতে চায়নি। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তবেই না ও’কে মানানো গিয়েছে। ঘোরাফেরা, আড্ডা, একসাথে সময় কাটানো সকল মুহূর্তগুলো সুন্দর ছিল। সুইজারল্যান্ড থেকে ফিরে যেতে একদমই ইচ্ছে হচ্ছিল না। কিন্তু উপায়-ই বা কী? চলে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এসেছে। ইচ্ছের পরোয়া সময় করবে না।
লামিয়া ও নিহালের ফ্লাইটের দিন অর্ষার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। তার মুখের মলিনতা দৃষ্টিতে আটকে যায় আহনাফের। দুজনে মিলে রেডি হচ্ছিল লামিয়া এবং নিহালকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। এখান থেকে ওদের হোটেলে যাবে। হোটেল থেকে পিক করে যাবে এয়ারপোর্টে।
আহনাফ গলা খাঁকারি দিয়ে অর্ষার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে,’কী হয়েছে?’
অর্ষা নির্লিপ্তস্বরে বলে,’কিছু না।’
‘মন খারাপ?’
‘না।’
আহনাফ অর্ষার কাছে এগিয়ে যায়। দু’কাঁধে হাত রেখে মৃদু হেসে বলে,’লামিয়া চলে যাবে বলে মন খারাপ হচ্ছে?’
অর্ষা মায়াভরা দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকায়। আহনাফ বলে,’মন খারাপ কোরো না। তোমাদের আবার তো দেখা হবেই। এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। নয়তো ওদের দেরি হয়ে যাবে।’
অর্ষা ছোটো করে বলল,’হুম।’
‘গুড গার্ল।’
দুজনে একসাথে রেডি হয়ে হোটেলে যায়। সেখান থেকে নিহাল ও লামিয়াকে পিক করে গাড়ি ঘোরায় এয়ারপোর্টের দিকে। লামিয়া ও অর্ষার মন ভীষণ খারাপ। কীভাবে যে সময়গুলো এত দ্রুত চলে গেল!
লামিয়া অর্ষার কাঁধে মাথা রেখে বলে,’তোকে খুব মিস করব বোকারানী খুব!’
অর্ষা কিছু বলে না। শুধু শক্ত করে লামিয়ার হাতটা ধরে। এয়ারপোর্ট পৌঁছে দুই বান্ধবী শেষবারের মতো সুইজারল্যান্ডে আলিঙ্গনবদ্ধ হয়। এই মুহূর্তটিতে দুজনে আর নিজেদের কান্না আটকে রাখতে পারে না।
চোখের পানি মুছতে মুছতে লামিয়া আহনাফকে বলে,’খবরদার! আমার বান্ধবীকে কষ্ট দেবেন না ভাইয়া। সবসময় আগলে রাখবেন।’
প্রত্যুত্তরে আহনাফ মৃদু হাসল। দুজনের উদ্দেশ্যে বলল,’সাবধানে যেও।’
বিদায় দেওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও বান্ধবীকে বিদায় দিতে হলো। ওরা চলে যাওয়ার পর আহনাফ আর অর্ষা গাড়ির কাছে যাচ্ছিল। তখনো অর্ষার চোখে পানি ছিল। এটা দেখে আহনাফ বলে,
‘বিয়ের দিনও তো মনে হয় এত কান্না করোনি। বান্ধবীর জন্য এত দরদ?’
অর্ষা কিছুই বলল না। চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসে রইল। দৃষ্টি রাখল জানালার বাইরে। আহনাফ বুঝতে পারে, অর্ষার মনটা আজ বেশিই খারাপ। তাই আর সে বেশি কিছু বলে না। বাড়িতে অর্ষাকে নামিয়ে দিয়ে সে অফিসে চলে যায়। মন ভালো হয়েছে কিনা জানার জন্য অফিসে গিয়ে বার দুয়েক ফোনও করে। অর্ষার প্রতিটি কথাই ছিল মনমরা। তাই সে বাড়িতে ফেরার পথে অর্ষার জন্য ওর প্রিয় চকোলেট নিয়ে আসে। চকোলেট পেলে নিশ্চয়ই খুশি হবে?
রাতে বাড়িতে ফেরার সময় চকোলেটের প্যাকেটটি লুকিয়ে রাখে। কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুলে দেয় লিলিয়া। অর্ষা ড্রয়িংরুমেই ছিল। স্মিথকে পড়াচ্ছিল। দুজনের চোখাচোখি হয়, তবে আজ আর অর্ষার চোখ হাসে না। রাগও প্রকাশ করে না। কেমন যেন নির্জীব!
আহনাফ রুমে যাওয়ার পূর্বে বলে গেল,’একটু রুমে আসো তো অর্ষা।’
অর্ষা সঙ্গে সঙ্গেই রুমে যায়। আহনাফ শার্টের হাতার বোতাম খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে? এত মন খারাপ কেন আজ?’
‘মন খারাপ না।’
‘আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোমার মন খারাপ। আমায় বলো না কী হয়েছে? বান্ধবীর জন্য এত বিরহ?’
‘এমন কিছু নয়।’
‘তাহলে কেমন কিছু? বন্ধুদের সবাইকে মিস করছ?’
‘তা তো সবসময়ই করি।’
‘তাহলে? বাংলাদেশে যেতে ইচ্ছে করছে?’
অর্ষা নিরুত্তর। মাথা নত করে রেখেছে। আহনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকে। গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,’আচ্ছা চোখ বন্ধ করো তো! একটা সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য।’
অর্ষা বিনাবাক্য ব্যয়ে চোখ বন্ধ করল। আহনাফ বলল,’হাত পাতো।’
অর্ষা হাত মেলে ধরার পর আহনাফ চকোলেটগুলো অর্ষার হাতে দিয়ে বলল,’এবার চোখ খোলো।’
চোখ খুলে চকোলেট দেখে আহনাফের দিকে তাকায় অর্ষা। স্মিত হেসে বলে,’থ্যাঙ্কিউ।’
‘চকোলেট পেয়েও মন ভালো হয়নি? এখন তো মনে হচ্ছে তোমার মন সাংঘাতিক লেভেলের খারাপ। আচ্ছা কী করলে মন ভালো হবে? রোমান্টিক হওয়ার ট্রাই করব একটু?’
‘আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি খাবার গরম করি।’
অর্ষা উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে যায়। অবাক হয় আহনাফ। দুষ্টুমি করল তাও হাসল না। রাগও করল না। হঠাৎ করে এত গম্ভীরতা কেন? সে কি কোনো ভুল করে ফেলেছে? কই না তো! লামিয়া আসার পর থেকেই তো অর্ষার সাথে সে স্বাভাবিক আচরণ করেছে। তাহলে হঠাৎ করে অর্ষা কেন এমন করছে?
রাতে খাওয়ার টেবিলে আহনাফ জেদ ধরে বলল,’যতক্ষণ না বলবে মন খারাপ কেন ততক্ষণ আমি কিছু খাব না।’
অর্ষা বিরসমুখে বলল,’কোথায় মন খারাপ দেখতেছেন আপনি? আমি ঠিক আছি তো!’
‘তাহলে এমন মনমরা দেখাচ্ছে কেন তোমায়? আমি কিছু করেছি? কোনো ভুল করে থাকলে সেটাও আমায় বলো।’
‘আপনি কিছুই করেননি। আমারই ভালো লাগছে না। সবসময় সবার মুড এক রকম থাকে না। প্লিজ এটা নিয়ে আর কোনো জোর-জবরদস্তি করিয়েন না। খেয়ে নিন।’
আহনাফের কাছে এসব কথার পিঠে বলার মতো আর কোনো কথা নেই। তাই সে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,’ঠিক আছে। তুমিও খেতে বসো।’
অর্ষা খেতে তো বসল ঠিক-ই। তবে তেমন কিছুই খেতে পারল না। মন-মেজাজ ভালো নেই বলে আহনাফও আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। খেয়ে-দেয়ে সে রুমে চলে গেছে।
রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে সে ল্যাপটপ নিয়ে বসে। মিনিট বিশেক পার হওয়ার পরও অর্ষা রুমে আসেনি। এবার তার কেন জানি মনে হচ্ছে, হয়তো তার-ই কোনো ভুলের জন্য অর্ষা এমন আচরণ করছে। অর্ষাকে ডাকার জন্য রুম থেকে বের হয়ে থেকে অর্ষা ড্রয়িংরুমের ফ্লোরে দুই হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে। সে একা নয়। পাশে স্মিথ রয়েছে। আর একটু দূরত্বে সামনে রয়েছে ক্যাথিওন আর অ্যানিওন। ওরা একটু পরপর অর্ষাকে দেখছে আর একটু করে খাচ্ছে।
আহনাফও নিঃশব্দে অর্ষার পাশে এসে বসে। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,’খুব বেশি মন খারাপ তাই না?’
অর্ষা ঘাড় ঘুরিয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড। এরপর শীতলকণ্ঠে বলে,’ক্যাথি আর অ্যানিকে একটু ধরতে শেখাবেন?’
অর্ষার এই কথাটি আহনাফকে বিস্মিত করে তোলে। যেই অর্ষা কিনা বিড়ালের নাম শুনলেই দশ হাত দূরে থাকে সে-ই অর্ষাই যেতে বিড়াল ধরতে চাচ্ছে! এটা কি অবিশ্বাস্য কথা নয়?
‘কী হলো?’
অর্ষার ডাকে ভাবনার প্রহর শেষ হয়। আহনাফ অর্ষার হাত ধরে ক্যাথির মাথার কাছে নিতে যাবে, তখন অর্ষা ভয়ে চোখ বন্ধ করে হাত সরিয়ে নেয়। একটু সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,’এবার নিন!’
আহনাফ আস্তে করে হাতটা ক্যাথির মাথায় রাখে। এরপর আস্তে আস্তে বুলিয়ে দেয়। চোখ মেলে তাকায় অর্ষা। একটু একটু করে তার ভয় কাটছে। দু’হাত দিয়ে ক্যাথি ও অ্যানির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আহনাফ। কিছুক্ষণ পর আহনাফের সাহায্য ছাড়াই সে বিড়াল দুটোকে আদর করে দেয়। ক্যাথি এবং অ্যানিও বোধ হয় আজ অর্ষার থেকে অবিশ্বাস্য এবং সেরা আদর পেয়েছে। আহনাফ মুচকি হাসে অর্ষার দিকে তাকিয়ে।
‘আজ তোমার কেন এমন পরিবর্তন বলতে পারো অর্ষা?’
অর্ষা কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকে। বিড়াল দুটোর মাথায় হাত বুলায়। মৌনতা কাটিয়ে বলে,’আর মাত্র তিনদিন পর আমিও লামিয়ার মতো সুইজারল্যান্ড থেকে চলে যাব।’
আহনাফ অবাক হয়ে জানতে চায়,’মানে?’
‘মানে আমার ভিসার মেয়াদ শেষ। ট্যুরিস্ট ভিসায় এসেছিলাম। চলে যেতে হবে এবার আমাকে!’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]