ভয়ংকর নির্জন পর্ব ৫
ডোরা ঠিক বলতে পারবে না কতটুকু সময় পার হয়েছে, শুধু ও বুঝতে পারে পায়ে সেই অস্বস্তিকর অনুভূতিটা আর পাচ্ছে না। কাল কেউটেটা কী নেমে অন্য দিকে চলে গেল?
এই যখন ভাবছিল ঠিক তখন জনের তীক্ষ্ণ গলা পাওয়া যায়, ‘ওই আমজাদ, সাপটা তো কামড় না দিয়া উলটা কুন্ডলী পাকিয়ে বসে আছে।’
আমজাদ চিন্তিত গলায় বলে, ‘স্যার, এই সাপটা তো এমনই, ভয় পাইলে কুন্ডলী পাকাইয়া বইয়া থাকে। কিন্তু কেউ আঘাত করলে তখন কামড়ায়।’
জন ক্ষিপ্ত গলায় বলে, ‘তাইলে বসে আছিস কেন। একটা লাঠি দিয়ে খোঁচা দিয়ে ওর গায়ে ফেলে দে।’
আমজাদ মিয়ার মনটা সাই দিচ্ছে না কিছুতেই। ও বুঝতেই পারেনি স্যার এই সাপটা দিয়ে ম্যাডামকে কামড়ানোর প্ল্যান করেছে। নিজেকে বিশ্বাসঘাতক মনে হয়।
ওকে গড়িমসি করতে দেখে দারুল এবার লাফ দিয়ে সামনে আসে, একটা লাঠি হাতে নিয়ে বলে, ‘আমজাদ ভাই, তুমি সরো। আমিই ব্যবস্থা করতেছি।’
জন মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়, বুঝতে পারে দারুলের রাগটা বেশি। দারুল লাঠিটা নিয়ে সাপটার দিকে এগিয়ে যায়। ডোরা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে, কী নিষ্ঠুর মানুষ এরা! আমজাদ হয়ত ওদের মতো না, কিন্তু ওরও করার কিছুই নেই। ডোরা জানে, এই সাপকে রাগালে একদম মুহুর্তেই কামড়ে ধরবে, আর পুরো বিষটা ঢেলে দেবে।
দারুল দূর থেকে লাঠিটা দিয়ে হালকা করে গুতা দেয়, তাতে সাপটা আরও কুন্ডলী পেঁচিয়ে মাথাটা গুঁজে থাকে। বিরক্ত হয়ে দারুল এবার আরেকটু সামনে এগিয়ে যায়, এবার জোরে একটা গুতো দিতেই কেউটেটা মাথা বের করে হিসহিসিয়ে উঠে।
জন হাত তালি দিয়ে বলে, ‘এই তো বেটা ফণা তুলছে। সাব্বাস দারুল। এবার লাঠিটা দিয়ে সাপটা ওর গায়ে ছুড়ে মার।’
জনের চোখেমুখে এক আদিম নিষ্ঠুরতা খেলা করছে। ডোরার ভয় লাগছে এখন, হাত পা কুঁকড়ে আসছে। কেন জানি মরতে ইচ্ছে করছে না। মায়ের মুখটা মনে হতেই চোখে জল চলে আসে। ডোরা চোখটা বন্ধ করে আবার।
দারুল এবার বিপদজনকভাবে সাপটার কাছে এসে লাঠিটা দিয়ে একটু তুলে ধরে। সাপটাও এখন পুরো এক হাতের মতো মাথা উঁচু করে জোরে জোরে হিসহিস করছে। দারুল হাতটা বাঁকিয়ে জোরে লাঠিটা ডোরার দিকে ঠেলা দিতে যেতেই সাপটা পিছলে উলটো ওর উপর এসে লাফ দিয়ে পড়ে। মুহুর্তের মধ্যেই দারুলে হাতে কামড় বসায় কাল কেউটে।
দারুল গগনবিদারী চিৎকার করে ওঠে, ‘ওর বাবারে, মইরা গেলাম।’
তারপর জোরে একটা ঝটকা মারতেই সাপটা জন যেদিকে দাঁড়িয়ে ছিল সেইদিকে পড়তেই পুরো ঘরে একটা হুটোপুটি শুরু হয়ে যায়। জন এক লাফে রুমের একটা কোণে চলে আসে, আমজাদ মিয়াও লাফ দিয়ে সরে পড়ে। সাপটা হিসহিস শব্দ করে রুমের এককোণে একটা গর্তে ঢুকে পড়ে।
চিৎকার শুনেই ডোরা চোখ খুলে তাকিয়েছে, অবাক চোখে দেখে দারুল আতংকিত চোখে হাত চেপে ধরে বসে আছে। জন আর আমজাদ চোখ বড় বড় করে দারুলের দিকে তাকিয়ে আছে। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে ওর কিছুটা সময় লাগে, কাল কেউটেটা দারুলকে কামড়িয়েছে! ওর চোখেমুখে একটা আতংক, দিশেহারা ভাব, সেই লোলুপ দৃষ্টিটা আর নেই। কেন জানি ডোরার কোনো খারাপ লাগে না, এই জঘন্য লোকটার উচিত শিক্ষা হয়েছে।
এবার প্রথমে আমজাদ এগিয়ে আসে তারপর জন। কাছে এসে বলে, ‘দারুল, ভয় পাস না। আমি তোরে ওষুধ দিচ্ছি।’
ভয়টা কাটে, দারুল একটু স্বাভাবিক হয়, তারপর বলে, ‘মনে হয় সাপটা বিষ ঢালতে পারে নাই। আমার কুনু ব্যথা করতাছে না। একটু ভয় পাইয়া গেছিলাম। বেটায় কামড়ানোর আগেই ফেলাই দিছি।’
ডোরা মনে মনে হাসে, কাল কেউটের দংশনে কোনো ব্যথা অনুভুত হয় না তাই বেশিরভাগ সময় মানুষ বুঝতেই পারে না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই দারুল টের পাবে, তখন তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করবে , সারা শরীর অবশ হয়ে যাবে সাথে প্রবল শ্বাসকষ্ট হবে। মর হারামাজাদা, দাঁতে দাঁত পিষে ডোরা ভাবে।
এদিকে জন একটু সামলে নিয়ে এবার আমজাদের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এই সাপটা তো পালাই গেল। আরেকটা নতুন দেইখা সাপ নিয়া আয়, তাড়াতাড়ি খেলা খতম করি। এইবার তুই করবি পুরা কাজটা।’
আমজাদ মিয়া মুখ কালো করে বাইরে চলে যায়।
জন ডোরার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আহা, মুখটা দেখে খুব ভালো লাগছে। ভয়ে কেমন শুকিয়ে গেছে। আমার পায়ে পড়ে মাপ চাইলে ক্ষমা করে দিতাম।’
ডোরা লম্বা একটা নিশ্বাস নেয়, তারপর বলে, ‘তোর মতো মানুষ সাপের চেয়েও ভয়ংকর। তার চেয়ে সাপের কামড় খেয়ে মরা ভালো।’
জন ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে।
একটু পর আমজাদ মিয়ে আরেকটা কালো রঙের সাপ নিয়ে ঢোকে। ওর দিকে তাকিয়ে জন বলে, ‘এইটারে ওর গায়ে ছুড়ে মার। এত সময় নাই হাতে।’
ডোরা আমজাদের চোখের দিকে তাকায়, লোকটার চোখে একটা অপরাধবোধের ছায়া। ওর হাতের কালো সাপটা ভয়ংকরভাবে দুলছে। আমজাদ লম্বা একটা নিশ্বাস নেয়, তারপর এক ঝটকায় সাপটা ছুড়ে মারে ডোরার গায়ে। ডোরা সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেলে, মুখ দিয়ে চাপা আর্তচিৎকার বের হয়ে আসে, ‘মা গো।’
সাপটা কেমন পেচিয়ে ধরেছে ওকে, হাতে কামড়ে ধরেছে। ডোরার গা টা কেমন গুলিয়ে ওঠে, মাথাটা ঘুরে জ্ঞানটা হারায়।
জন নিশ্বাস বন্ধ করে দেখছিল, ডোরার মাথাটা একপাশে ঝুলে পড়তেই পৈশাচিক আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, ‘কাজ হইছে। সাব্বাস আমজাদ। সাপটা নিয়া আগে খাঁচায় রাখ। তারপর এর হাতের বাঁধন খুল। বাকি কাজ পুকুরে।’
কথাটা শেষ হয় না, তার আগেই দারুল হঠাৎ পেট চেপে বসে পড়ে, ‘স্যার, আমার কী যেন হইছে। তলপেটে মারাত্মক ব্যথা, আর হাত পা কেমুন জানি ছাইড়া দিতাছে। চোখে ঝাপসাও দেখতাছি।’
জনের হুশ ফেরে, চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, হায় হায় ওর যে বিষক্রিয়া শুর হয়েছে। দ্রুত আমজাদের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে, ‘ওরে নিয়া আমার ল্যাবরেটরিতে যা। এরে আগে এন্টিভেনম দিয়ে নেই। হারামজাদা কয় ওরে নাকি সাপে বিষ দিতে পারে নাই। মর এখন।’
আমজাদ সাপটাকে খাঁচায় রেখে আসে। তারপর, দারুলকে ধরে নিয়ে ল্যাবরেটরির দিকে যায়। জন একবার ডোরার নিঃসাড় মুখের দিকে তাকায়, তারপর একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বের হয়ে আসে।
ল্যাবে এসেই ও আমজাদকে বলে, ‘তুই মাইয়াটারে কোলে নিয়ে পুকুরে যে নৌকাটা আছে, ওইটাতে তোল। আমি ওরে ইঞ্জেকশনটা দিয়া আসতেছি। কমপক্ষে দশটা ইঞ্জেকশন লাগব।’
আমজাদ মাথা নেড়ে বের হয়ে যায়। তারপর দ্রুত পায়ে ডোরাকে যেখানে আটকে রেখেছে সেখানে চলে আসে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দ্রুত ডোরার হাতের বাঁধন খুলে দেয়, তারপর পাশে পড়ে থাকা একটা পানির বোতল থেকে পানি নিয়ে মুখে ছিটাতে থাকে। আমজাদের বুকটা ধকধক করছে। নাকের কাছে আঙুল ধরে, একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, শ্বাস পড়ছে।
ডোরা ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়, আমজাদকে ওর দিকে ঝুকে থাকতে দেখে কুঁকড়ে যায়, দুর্বলভাবে দু’হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু ও কী বেঁচে আছে এখনও?
আমজাদ উদবেগের গলায় বলে, ‘আপা, আপনার কিছু হয় নাই। আপনি উঠে বসেন।’
ডোরা অবাক হয়ে উঠে বসে, বোঝার চেষ্টা করে, নাহ, ওর কোথাও ব্যথা নেই, শ্বাসকষ্ট নেই। কী করে সম্ভব হলো! সাপটা তো জোর কামড়েছিল।
আমজাদ এবার তাড়া দিয়ে বলে, ‘আপা, আমি ইচ্ছা কইরা পরেরবার একটা নির্বিষ সাপ নিয়া আসছিলাম। জন স্যার উত্তেজনায় খেয়াল করে নাই। এখনই উনি আইসা পড়ব। আমারে কইছে আপনারে কোলে নিয়া পুকুরের কাছে নৌকায় উঠাইতে।’
ডোরা অবাক হয়ে ওর কথা শুনছিল, লোকটা সত্যি বলছে? দ্রুত ও ওর হাতের ক্ষতটা পরীক্ষা করে, আরে, সত্যিই তো, এটা তো বিষাক্ত সাপের কামড় না। তার মানে ও সত্যিই বেঁচে আছে!
কৃতজ্ঞতায় চোখে জল চলে আসে, বলে, ‘আপনি এত ঝুঁকি নিয়ে আমাকে বাঁচালেন! কিন্তু পুকুরে কেন?’
এরপর আমজাদ দ্রুত ওকে সব বুঝিয়ে বলতেই ডোরার চোখটা জ্বলে ওঠে। দাঁতে দাঁত পিষে বলে, ‘ঠিক আছে, আমি মরার ভাণ করেই পড়ে থাকব।’
২.
জনের মেজাজটা খিচড়ে আছে। বেটা দারুল, একটা কাজ যদি ঠিকঠাক করতে পারে। ইঞ্জেকশনগুলো শেষ করে, কিন্তু ভরসা পায় না। দেরি হয়ে গেছে, ওর লক্ষণ সুবিধার ঠেকছে না। হাত পা কেমন ছেড়ে দিচ্ছে। নাহ, মরুক ব্যাটা। জন এবার আর দেরি করে না, উঠে পড়ে। ডোরাকে আগে পুকুরের ছোট দানবগুলোর হাতে ফেলে দিয়ে আসা যাক। তাহলেই নিশ্চিন্ত।
চারদিক অন্ধকার, দু’ একটা বাতি জ্বলছে। জন পুকুরের কাছে এসে হাঁক দেয়, ‘আমজাদ, মাইয়াটারে নিয়া আসছিস?’
আমজাদ নৌকা থেকে জবাব দেয়, ‘হ স্যার, আপনি নাওয়ে ওঠেন।’
জন নৌকার কাছে আসতেই আমজাদ ওকে এক হাত ধরে ওঠায়। জন একবার ডোরার নিথর পড়ে থাকা দেহটার দিকে তাচ্ছিল্যের সাথে তাকায়। নাহ, এবার বড্ড তাড়াহুড়ো হয়ে গেল। ওই কথাটা শুনে এমন রাগ ওঠে গেল যে মাথাটা নষ্ট হয়ে গেল। সুমিও ওকে এমন করে অপমান করেছিল। জন দাঁতে দাঁত পিষে, এক দলা থুতু ফেলে।
আমজাদ নৌকাটা বেয়ে একটু গভীরে যায়। টের পায় পুকুরের ভেতর ক্ষুদে দানবগুলো এর মধ্যেই জেগে উঠেছে, একটা কলকল শব্দ হচ্ছে।
জন একবার অন্ধকারে পানির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এইগুলারে এই কয়দিন তো খাবার দেওয়া হয় নাই?’
আমজাদ মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘না স্যার। এইটাতে যারেই ফেলা হইব তারে ছিড়া ফালাইব। দেহেন না কেমুন খলবল করতাছে।’
জনের মুখে একটা নিষ্ঠুর হাসি খেলা করে। তারপর নিজে যেয়ে ডোরাকে একটু তুলে ধরে, তারপর দাঁতে দাঁত পিষে বলে, ‘হারামজাদি, বল দেখি আবার ওই কথাটা, আমি নপুংসক। এত সাহস তোর, আমারে এই কথা বলছিলি। এখন বল, বল।’
জন ওর কাঁধ ধরে জোরে জোরে ঝাঁকাতে থাকে।
ডোরা এতক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ করে মরার মতো পড়েছিল। কাজটা আমজাদের করার কথা। কিন্তু জনের এমন কুৎসিত কথায় ও আর পারে না, হঠাৎ করেই চোখ খুলে, তারপর তীব্র গলায় চিৎকার করে বলে, ‘তুই নপুংসক। তুই পশু, অমানুষ।’
মনে হয় একটা বোমা ফাটল, জন তীব্র ভয়ে ছিটকে নৌকার এক কোণায় চলে যায়, তোতলানো গলায় বলে, ‘ভূত, ভূত!’
ডোরা হা হা করে অশরীরী আত্মার মতো হেসে ওঠে, রাতের অন্ধকারে সেই হাসি দেখে আমজাদ মিয়া পর্যন্ত শিউরে ওঠে। মাইয়াটা কী আসলেই প্রেতাত্মা?
ডোরা উঠে দাঁড়ায়, তারপর জনের দিকে এগোতেই একটা তীব্র ভয় জনকে গ্রাস করে, তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে হঠাৎ পা পিছলে হুড়মুড় করে পুকুরের গভীর পানিতে পড়ে যায়।
মুহুর্তের মধ্যে পানিতে যেন একটা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ঝাঁকে ঝাঁকে আফ্রিকান পিরানহা জনকে আক্রমণ করে। তীক্ষ্ণ দাঁত দিয়ে ছিড়ে খুবলে খেতে থাকে। একটা ভয়ংকর তীব্র আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে এই নির্জন এলাকায়। জনের শরীরটা একবার ভেসে ওঠে আবার ডুবে যায়।
ডোরা চোখ ফিরিয়ে নেয় বীভৎস দৃশ্যটা থেকে। আমজাদ মিয়া দ্রুত নৌকাটা পাড়ে ভিড়ায়। তারপর হাত ধরে ডোরাকে নামাতেই ডোরা পাড়ে মাটিতে বসে পড়ে। শরীরটা অবসন্ন লাগছে।
আমজাদ পুকুরের গভীরে তাকিয়ে থাকে, তারপর উদাস গলায় বলে, ‘শয়তান লোকটা নিজের অস্ত্রেই মারা গেল। আফ্রিকা থেকে এই পিরানহা মাছ নিয়া আসছিল। তারপর এই মাছগুলান নিয়া কি যেন পরীক্ষা নিরীক্ষা করত। পরে এই নতুন জাতের রাক্ষস পিরানহা বানাইছে। কোনো মাইয়ারে মারার পর শরীরটা এই পুকুরে ফালাই দিত। তার আগে এই শয়তান মাছগুলারে না খাওয়ায় রাখত। তাতে মাছগুলান পাগল হইয়া থাকে। এই পুকুরের নিচে কমপক্ষে তিনটা কংকাল আছে। আমি আপনারে বাঁচাইতে পারছি, আমার আগের অপরাধ কিছুটা হইলেও কমল।’
ডোরা ক্লান্ত গলায় বলে, ‘আচ্ছা, এখানে এতগুলা খুন হলো, তোমরা কেউ কেন পুলিশকে কিছু বলো নাই?’
আমজাদ বিষন্ন গলায় বলে, ‘এইহানে আমরা যারা কাম করতাম সবাই দাগী আসামী। পুলিশ আমাগো খুঁজতাছে। এই জন স্যার আমাগো খুঁইজা বাইর করে, এই নির্জন জায়গায় চাকরির কথা কয়। আস্তে আস্তে বুঝতে পারি লোকটা একটা পিশাচ। কিন্তু পুলিশরে কিছু কইতে গেলে যে আমরাই ধরা পড়মু। তাই আমরা মুখ বুইজা থাকতাম, এইহান থেকে বাইরাতাম খুব কম।’
এতক্ষণে ব্যাপারটা ওর কাছে পরিস্কার হয়, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘এবার যে পুলিশকে সব জানাতে হবে। আপনি কী পালিয়ে যাবেন?’
আমজাদ মাথা নাড়ে, বলে, ‘এমুন পালাই থাকার চাইয়া জেল খাটান ভালো। আমার কোন আফসোস নাই এখন, আমি জীবনে একটা হইলেও ভালা কাম করছি।’
ডোরা এবার আমজাদ মিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘আপনার প্রায়শ্চিত্ত হয়েছে। আমি পুলিশকে বলব, তাতে আপনার শাস্তি নিশ্চয়ই কম হবে। দারুল কী বেঁচে আছে? আর বাবুর্চি কালাম মিয়া কই?’
আমজাদ মাথা নাড়ে, বলে, ‘দারুলের অবস্থা ভালো দেইখা আসি নাই। আর কালাম মিয়া নিশ্চয়ই এতক্ষণে পালাই গেছে। চলেন আপা, বাংলোয় যাই। কাল সকালেই আপনারে ঢাকার বাসে উঠাই দিমু আর আমি পুলিশে ধরা দিমু।’
ডোরা ক্লান্ত পায়ে ফিরে আসে। হ্যাঁ, কালাম মিয়া ইতিমধ্যেই পালাইছে। আমজাদ কিছুক্ষণ পর আসে, মন খারাপ গলায় বলে, ‘দারুল মইরা গেছে। কাল কেউটের বিষ, কেউ বাঁচে না। ওর শাস্তি ও পাইছে। জন স্যারের সাথে থাইকা ও নিজেও একটা পিশাচ হইয়া গেছিল।’
আমজাদ চলে যায়। ডোরা নিচ তলায় নেমে খুঁজে পেতে ব্রেড আর কলা পায়। টের পায় ওর তীব্র ক্ষুধা পেয়েছে। পাগলের মতো দুটো ব্রেড আর তিনটা কলা খায়। তারপর এক কাপ কফি বানিয়ে বাংলোর দোতলার বারান্দায় এসে বসে। শেষ রাত এখন, চারদিক নিঝুম নির্জন। ডোরা কফি খেতে খেতে ভাবে কী ভয়ংকর এক নির্জনে ও এসে বন্দি হয়ে পড়েছিল। একটা আপাত সুন্দর মানুষের ভেতর যে এমন একটা অমানুষ লুকিয়ে ছিল তা ও বুঝতেই পারেনি। ইশ, তিনটা মেয়ের জীবন শেষ হলো শুধুমাত্র এমন একটা মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষের খপ্পরে পড়ে!
একটু পর ভোরে পুব আকাশে সূর্যের প্রথম আলোর রেখা ফুটে ওঠে, ডোরার মনে হয় ওর জীবনে নতুন সূর্য উদিত হলো।
৩.
আজ সকাল থেকেই মনোয়ারা কাঁদছেন, চোখটা ফুলে গেছে। কিছুতেই যে ডোরাকে খুঁজে পাচ্ছেন না। এই ক’টা দিনে শুধু প্রথম দিন ডোরার মেসেজ পেয়েছিলেন। তারপর আর কোনো খোঁজ না পেয়ে মনোয়ারা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। বন্ধুরা কেউ কিছু বলতে পারেনি। কাল না পেরে পুলিশের কাছে যেতেই ওরা বলল আজকের দিনটা দেখতে। আজ সকালেই ডোরার ফেরার কথা ছিল। কিন্তু আসেনি!
ডোরার চাচাদের বলেছিল, তাতে ওরা উলটো ওকেই দোষ দিল, কেন মেয়েটাকে এমন ট্রেকিংয়ে পাঠায়? মনোয়ারা শুধু কাঁদেন। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ করেই কলিং বেলের শব্দে ঘুমটা ভেঙে যায়। এলোমেলো শাড়িটা ঠিক করে দরজা খুলতেই চোখ বড় বড় হয়ে যায়, আঁৎকে ওঠে চিৎকার করে ওঠেন, ‘ডোরা, মাগো!’
ডোরা ঝাপিয়ে পড়ে মায়ের বুকে, ডুকরে কেঁদে ওঠে। কান্নার দমকে কথা বলতে পারে না। মনোয়ারা মেয়েকে ধরে বসার ঘরে নিয়ে আসেন। সোফায় নিজের পাশে বসিয়ে মুখের দিকে তাকাতেই ভয় পেয়ে যান, মুখটা ক্ষতবিক্ষত, ঠোঁটটা বিশ্রীভাবে কাটা। মনোয়ারার বুকটা কেমন করে ওঠে, ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘তোর কী হইছে মা?’
ডোরা মায়ের বুকের ভেতর ঢুকে ক্লান্ত গলায় বলে, ‘সব বলব মা।’
ডোরা ধীরে ধীরে মাকে সব খুলে বলেছিল। মা শিউরে শিউরে সেসব ভয়ংকর ঘটনা শুনছিল। পুলিশ এর মাঝে ওই পুকুর থেকে জন সহ আরও তিনটা কংকাল উদ্ধার করেছে। আমজাদ মিয়া রাজসাক্ষী হয়েছে। ডোরার নামটা পুলিশ ইচ্ছে করেই সাংবাদিকদের থেকে আড়াল করে রেখেছে। ডোরা নিজেও সব ঘটনার সাক্ষী দিয়েছে। পরে ও জেনেছে ওখানে সিসি ক্যামেরা ছিল তাতে জনের পৈশাচিকতার অনেক ফুটেজ ওরা পেয়েছে। সাংবাদিকরা যখন এই ভয়ংকর মানসিক বিকারগ্রস্ত জনের কথা তুলে ধরে, পুরো দেশে যেন একটা ঝড় বয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া মেয়ে তিনটার বাবা মায়ের কান্নাজড়িত মুখের ছবি ছাপা হয় সংবাদপত্রে।
রাত নামে, ডোরা মাকে জড়িয়ে ধরে পরম নির্ভরতায় ঘুমিয়ে থাকে। ও যেন ওর নিরাপদ আশ্রয় ফিরে পেয়েছে। মাঝে মাঝে অবশ্য সেই ভয়ংকর নির্জন জায়গাটা স্বপ্নে দেখে, ভয়ে কুঁকড়ে ওঠে। মা তখন ওকে আরও শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখে। ডোরা তখন আবার সাহস ফিরে পায়, ভাবে, মায়ের এই রক্ষাকবচ থাকতে পৃথিবীতে কেউ ওর কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
সমাপ্ত
.
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর