#ইশরাত_জাহান_জেরিন
পর্ব ৬১
#প্রথমাংশ
সাল ২০০০। এলাহী বাড়ির অন্দরমহলে বসে পরিবানু চাঁদের মতো দেখতে চন্দ্রপুলি পিঠা বানাচ্ছেন। বড় বউ সাফিয়ে সুলতানা তার পাশেই বসে আছেন। সঙ্গে বসে হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছেন মেজো বউ রুমানা, ছোট বউ মমতাজ। এই শীত মৌসুমে এলাহী বাড়িতে বিরাট পিঠাপুলির আয়োজন করা হয়। বাড়ির কর্তা ফখরুল এলাহী বাগানে সকালের রোদ পোহাচ্ছেন। চোখে চশমা। লম্বা সাদা দাঁড়ি। এখনো কত সুন্দর, লম্বা-চওড়া একজন মানুষ। না জানি যৌবন কালে কেমন দেখতে ছিলেন? বাগানের মধ্যে এলাহী বাড়ির বাচ্চারা খেলাধুলো করছে। ওই যে রাজন, রোশান, জোহান সবাই একসঙ্গে। ফারিয়া, নিরুদের খেলার বয়স হয়নি। এতগুলো মানুষ খেলা করছে কিন্তু এই দেখো ফারাজ এলাহী তার আদরের নাতিটা দাদুর পাশে বসে আছে। নয় বছরের এই বাচ্চা ছেলেটা এখনোই কত তীক্ষ্ণ ভাবনাচিন্তার অধিকারী। তাই তো ফখরুল তার এই নাতিকে একটু বেশিই ভালোবাসেন। একেবারে আকাশ থেকে নেমে আসা একটা তুষারের রাজপুত্র যেন। ফারাজ এলাহীর বাবা ফারহাদ এলাহী এই বাড়ির বড় ছেলে। তবে মেজো ছেলে সুলেমান তার আগেই বিয়ে করে ফেলেন। তাও-ও প্রেম করে বিয়ে। পেটে রাজন আসার পর বউ নিয়ে বিয়ে-শাদী করে বাসায় হাজির হন। বড় বউ সাফিয়ে আর ছোট বউ মমতাজ ফখরুলের পছন্দের। এই দু’জনকে নিজে পছন্দ করে বাড়ি এনেছেন। ফখরুল যখন কাজের সূত্রে ডেনমার্ক যান সেখানে মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে সাফিয়েকে তার পছন্দ হয়। মনে মনে ঠিক করেন ফারহাদের সঙ্গে এই মেয়েরই বিয়ে দেবেন। ওই মেয়ের আবার বাবা ডেনমার্কের হলেও মা বাঙালী। বাংলা ভাষায় তার যে কি দক্ষতা। অনেক আলাপআলোচনা করে বড় করে আয়োজন করে ওই দেশের মেয়েকে ফখরুল এলাহী এই দেশে বিয়ে করিয়ে আনেন। ফখরুল এলাহীর ডেনমার্কে মাছের ফ্যাক্টরি আছে। কত বড় পরিবার! তাকে কী আর মেয়ের বাড়ির লোক না করতে পারে? তবে বিয়ের দশ বছর পর ফখরুল এলাহী আন্দাজ করতে পেরেছেন তার জীবনে তিনি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছেন। সাফিয়ের জীবনটা নষ্ট করেছেন। তার ছেলে ফারহাদ রোজ রাতে সাফিয়ের গায়ে হাত তুলেন। বিয়ের পর থেকেই। সাফিয়ে কেবল সব সহ্য করে নেন। ফারহাদ এই বাড়ি, সম্পত্তি ভাগাভাগির জন্য চাপ তো অনেক আগ থেকেই দিচ্ছিল। তবে এসব এখন বেড়েই যাচ্ছে।
ফারহাদ এলাহী জুয়ারি ছিলেন। মেয়ে মানুষের নেশা তার বরাবরের মতোই ছিল। তবে বাড়িতে নিজেকে এমন ভাবে উপস্থিত করতেন যেন সে দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো মানুষ। বাড়ি, বউ বাচ্চা কারো প্রতি তার কোনো আকর্ষণ ছিলনা। সাফিয়ে অপ্সরার মতোন দেখতে। কিন্তু চোখ যার বাইরের মোমবাতির দিকে সে কেমন করে ঘরের আলোর মর্ম বুঝবে? সাফিয়ে নারী হিসেবে একেবারে স্বামীভক্ত, শান্ত স্বভাবের ছিলেন। ফারাজের জন্মের পর থেকে ফারহাদ আরো বেশি হিংস্র হয়ে উঠেন। ফারাজকে কখনোই দেখতে পারতেন না। সাফিয়ের একটা প্রতিচ্ছবি দেখতে পেতেন ছেলে ফারাজের মধ্যে তিনি। উঠতে বসতে বিশ্রী ভাষায় ছেলেকে গালাগাল দিতেন। মারধো করতেন। ফারাজের তখন চার বছর বয়স ছিল। একদিন বৈঠকখানায় তার বাপ-চাচারা মিলে নিজস্ব ব্যবসা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। টেবিলে চা নাস্তা দেওয়া হয়েছিল। ফারহাদ এলাহী সবে মাত্র চায়ের কাপটা হাতে নিয়েছেন। ছোট ফারাজের জন্য তার দাদু নতুন খেলনা মেশিনগান এনেছিল সেটা দেখাতেই অবুঝ ফারাজ বাবার কাছে ছুটে এলো। তবে বাবার কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়তেই বাবার হাত থেকে গরম চা পড়েছে। ফারহাদ এলাহীর গায়ে গরম চা পরেন। সেই সময় সে যে কি ভীষণ রেগে গেলেন। ফারাজকে তুলে সোফায় আছাড় মারলেন। ফারাজ সেইবার টানা ছয়দিনের মতো অসুস্থ ছিল। জ্বর চলে এসেছিল। ওই টুকু বাচ্চাটার জন্য ফারহাদের একটু মায়া হলো না। আস্তে আস্তে ফারাজ বড় হতে লাগল। রোজ রাতে মা তাকে আগে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত। কারণ সে চাইত না তার বাবা নামক জানোয়ারের এমন হিংস্র, বিভৎস রূপ সে দেখুক। চাইতো না দেখুক তার বাবা নেশা করে এসে কেমনে হামলে পরে, কেমন গালাগাল করে মারধর করে, ভাঙচুর করে। কারণ সাফিয়ের কলিজার টুকরো ছিল ছেলে ফারাজ। ফারাজও না, হয়েছিল একটা মা পাগল। সারাদিন মায়ের পেছন পেছন ঘুরত। মা তার জীবনের শুরু, মা শেষ। কত গল্প তার মায়ের সঙ্গে। মায়ের মতো তাকে কেউ ভালোবাসেনি,আগলে রাখেনি। ছোট্ট ফারাজকে তার বাবা রাতে মায়ের পাশে কখনোই শুতে দেননি। রোজ রাতে বাবা মদ খেয়ে মাকে মারধর করত। ফারাজ চাইলেও কিছুই বলতে পারত না। কাউকেই না। কারণ মা যে নিষেধ করেছে বাবার সম্মান নষ্ট হয় এমন কিছুই না করতে। তবে ফারাজ অনেক পরে জানতে পারল। তার বাবা মাকে, রোজ রাতে বিশ্রীভাবে পেটানোর সময় গলা চেপে ধরে বলতেন, ‘যদি এইসব কথা বাইরে যায় তাহলে আগে তোর চোখের সামনে তোর পোলার কলিজা বের করে আনব।’ ফারাজ বড় হয়েছেই বাবার মুখ থেকে রোজ রাতে কলিজা বের করার কথা শুনে। ভয়ে সে চোখ বন্ধ করে রাখত, কানে হাত দিয়ে রাখত। যেন পাশের ঘরের সেই শব্দ তার কানে না পৌঁছায়। তবুও ভয় যে কাটেনি। সেদিন রাতের কথা, বাসায় ফখরুল এলাহীর সঙ্গে ফারহাদ এলাহীর জায়গা সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা হয়। পরদিন সকাল বেলা ফখরুল এলাহী দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে পরলোকে চলে যান। তবে যেই দলিলের জন্য, এলাহী বাড়ির জন্য এত ঝামেলা সেই সম্পত্তি নাতি ফারাজ এলাহীর নামে লিখে নিজের অজান্তেই তাকে ধ্বংস করে দিয়ে যান ফখরুল। ফারহাদ জানতেন সেই দলিল সাফিয়ের নামে। তাই দলিল নিজের নামে পাওয়ার জন্য তিনি নতুন বুদ্ধি করেন। সাফিয়ের সঙ্গে ভালো আচরণ, ভালো রূপ নিয়ে হাজির হন। সাফিয়ে জানতেন তার স্বামীর নারী দোষ, জুয়ায় টাকা উড়ানো, নেশাপানির অভ্যাস ছিল। তবে কখনোই জানতে পারেননি স্বামী তার মানুষ তুলে এনে পাচারকারীদের হাতে তুলে দেওয়া ব্যবসার আসল প্রতিষ্ঠাতা। সঙ্গে সুলেমান এলাহী, জুনায়েদ এলাহীও জড়িত। সাফিয়ে ভেবেছিল তার সুখের দিন শুরু। সেইরাতের কথা। তালুকদার বাড়িতে অনুষ্ঠান ছিল। বাবার ব্যবসায় সবচেয়ে বড় পার্টনার ছিল তালুকদার বাড়ির মানুষ। মা জানতেন তালুকদার বাড়ির ছেলে ফারহাদ এলাহীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তবে জানতেন না ওই বাড়ির নারীরা, পুরুষদের জঘন্য কাজে এত গর্ববোধ করত। কত গর্বের কাজ! স্বামী মেয়ে মানুষ মারে, ধর্ষণ করে, তাদের জিম্মি করে পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয়। ফারাজ বাবাকে কখনোই পছন্দ করত না। বাবাকে দেখলেই চোখের সামনে ভয়ানক গা গুলানো সব দৃশ্য চোখের সামনে ভাসত। মায়ের শরীরে গরম ফুটন্ত পানি ঢেলে দেওয়া, মাছ ভাজার তেলের কড়াইতে হাত চুবিয়ে দেওয়া। বাবা এসব করে আনন্দ পেতেন। তার নাকি খুব শান্তি লাগত। ফারাজ তাই বাবাকে একটুও পছন্দ করত না। মা তার গান গাইতে পারত বেশ। তিনতলায় একটা রুম ছিল। বউ হয়ে এই বাড়িতে আসার সময় মা তার পিয়ানো নিয়ে এলো সঙ্গে করে। মায়ের কি সুন্দর গানের গলা। ফারাজের তো মায়ের কাছ থেকেই গান শেখা। সেইরাতে মা অনেক সুন্দর করে সেজেছিল। মায়ের পছন্দের রঙ ছিল মেরুণ। ফর্সা শরীরে ওই রঙয়ে যে তাকে কি মানাত। সেই রঙে মাকে দেখেই ফারাজের পছন্দের রঙ হয় মেরুণ। ওই রাতে মাকে একটু বেশিই সুন্দর দেখাচ্ছিল। কি নিষ্পাপ সাধাসিধে একজন নারী। স্বামীর একটু ভালোবাসা পেয়ে দশ বছরের সব দুঃখ এক নিমিশেই ভুলে গেলেন। ভুলে গেলেন স্বামী যে তার বিয়ের রাতে পাসপোর্টটা পুড়িয়ে দিয়েছিল। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েও তাকে শেষ দেখা দেখতে দেয়নি। সেই সময় আফসোস করেছিলেন, এক দেশ রেখে অন্য দেশের বউ হওয়ার আফসোস। মায়ের একজন সহচর ছিল, জুনায়েদ এলাহীর স্ত্রী মমতাজ। দু’জনের মধ্যে এত মিল। মায়ের পর যদি ফারাজকে কেউ ভালোবাসতেন, বুকে আগলে রাখতেন তিনি সেই মমতাজ। এই বাড়ির কাজের বয়স্কা মহিলা লতামণিও তাদের মতোই ফারাজের আপন ছিলেন। দাদু বলে ডাকতেন কিংবা বেশিরভাগ সময়ই মণি। ফারাজকে দুষ্টুমি করে জামাই বলে ডাকতেন, ফারাজও বলত, ‘বড় হলে তোমায় বিয়ে করব আমি। তুমি আমার বড় বউ।’
তালুকদার বাড়িতে যাওয়ার সময় মা ফারাজকে তৈরি করে দেয়। সেখানে গিয়েও সে ভাবতে পারেনি আজকেই তার পৃথিবীতে শেষদিন। এটাই শেষ সাজ। তার সুখের গল্প শুরু নয় বরং দুঃখের গল্পের সমাপ্তি হতে চলেছে। সেদিন আয়োজন করে তালুকদার বাড়ির উঠানে মাকে শেষ বিদায় দেওয়া হয় কেবল সম্পত্তি, সম্পত্তি আর সম্পত্তির বিষাক্ত লোভে। বাড়ির পুরুষরা মিলে মদের আয়োজন করে। নেশার আয়োজন করে। মাকে বলা হয়েছিল জন্মদিনের অনুষ্ঠান। মা সেখানে আবিষ্কার করলেন শেষবার ছেলেকে দেখতে পাওয়ার বেদনা। সেদিন রাতে মায়ের ওপর ছোট্ট ফারাজ এলাহীর সামনে কি অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। জোর করে দলিল নিজের নামে হস্তান্তর করেন। মাকে যেই মহিলাটি ফারাজের চোখের সামনে চেপে ধরে পুরুষদের সঙ্গে মিলে শাড়ি টেনে হিঁচড়ে ছিড়ে ফেলছিলেন তিনি ছিলেন চৈতী মজুমদার। সঙ্গে আরোও মানুষ ছিল। তালুকদার বাড়ির সবাই ছিল। জুনায়েদ এলাহী কেবল চেয়ে চেয়ে সবটা দেখছিলেন তবে সুলেমান এলাহী সুযোগের সম্পূর্ণ ফয়দা লুটেছেন। ফারাজকে জোর করে ধরে রেখেছিলেন রুমানা। মমতাজকে সেদিন অনুষ্ঠানে আনা হয়নি। সে বাড়িতেই ছিলেন। তবে মনটা যে তারও ছটফট করছিল। আঁতিপাঁতি করছিলেন ঘরের মধ্যে থেকে। কারণ সুফিয়ে ফারহাদ এলাহীকে বিশ্বাস করে নিলেও মমতাজ কখনোই করতেন না। সেই রাতে তালুকদার বাড়ির পুরুষরা তার মাকে চোখের সামনে অর্ধনঙ্গ করে গায়ে মদ ঢেলেছেন। মা তার চিৎকার করে কান্না করছিল। শরীর ঢাকার চেষ্টা করছিল। হয়তো কখনোই চাননি ছেলের সামনে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে। তারকাঁটা দিয়ে মায়ের শরীরে ওরা আঘাত করে। নয় বছরের সেই ফারাজ চেষ্টা করেছিল ছুটে গিয়ে মাকে বাঁচাতে। তবে ওর যে কান্না করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। রুমানা যখন ওকে ধরে রাখতে পারছিল না তখন সুলেমান এসে গালে ঠাঠিয়ে চড় বসিয়ে শক্ত করে চেপে ধরেন। ‘জানোয়ারের বাচ্চা চুপ কর’ বলতেই পাশ থেকে ফারহাদ বলল, ‘আব্বে হালা পোলা কিন্তু আমারই। খালি জানোয়ার ক।’
দলিলে জবরদস্তি করে সই করিয়েই গায়ে কেরাসিন ঢেলে দেওয়া হয় সাফিয়ের। একে আর এলাহী বাড়ির মানুষদের কোনো দরকার নেই। ততক্ষণে সাফিয়ে জেনে গিয়েছে তার স্বামী, দেবরদের ব্যবসা কি। রুমানা সব মেনে নিয়েছিল বলে সে তাদের কাছে ভালো। সাফিয়ের তখন দম ফুরিয়ে এলো। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। তবুও শেষ পর্যন্ত সে আর্তনাদ করে বলে গেছে, ‘আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও। ও নিষ্পাপ। ওকে কিছু করো না।’ মা ছেলের আর্তনাদ সেদিন কেউ দেখেনি। ফারাজের মা, মা বলা এক একটা চিৎকার সাফিয়ের অন্তরে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। ফারহাদ সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল। সাফিয়েকে টেনে তুলে গাছের সঙ্গে বেঁধে দিলো। পৃথিবীর জঘন্য স্বামীর পরিচয় দিয়ে হাতের দেশলাই থেকে আগুন ধরিয়ে কাঠিখানা ছুঁড়ে ফেলল সাফিয়ের দিকে। আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। জীবন্ত মানুষটা বাঁচার জন্য ছটফট করছিল। চিৎকার করছিল। সবাই সেই দৃশ্য দেখে কেবলই হেসে যাচ্ছিল। কেউ বাঁচাতে এলো না। কেউ না। মাংসের পোড়া গন্ধ তখন বাতাসে। শরীর থেকে মাংস ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ছে। গলে যাচ্ছে চোখের সামনে। লম্বাচুল গুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেল। সাফিয়ের জীবনের শেষ বিদায় ঘটল ছেলেকে বাঁচাতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে। শেষ সময়েও তিনি চিৎকার করে হয়তো ছেলেটাকে ছেড়ে দেওয়ার কথাই বলতে চাইছিল। কিন্তু পারছিল না। জীবনের সাজানো স্বপ্ন নিমিষেই পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। ফারাজ এলাহীর জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক দিন। সবচেয়ে ব্যর্থতায় ভরা দিন ছিল সেইদিনটা। মাকে চোখের সামনে পুড়ে মরতে দেখল। অথচ এই মা তাকে প্রতিটি আঘাত থেকে রক্ষা করে গেছেন সারাজীবন। শেষ মুহূর্তে কি মায়ের এটাই প্রাপ্য ছিল? জ্বলসে যাওয়া দেহ কুঁড়রে গেল। সব শেষ হতেই ফারাজকে মুক্ত করে দেওয়া হলো। ফারাজ মায়ের জ্বলসে যাওয়ার দেহর কাছে গিয়ে পাথর বনে রইল। এটা কি আসলেই তার মা? সে কেন চিনতে পারছে না? শরীরের আকৃতি এত বিভৎস হয়ে গেল যে চিনতেই পারল না ওই টুকুন ফারাজ। নিষ্ঠুরতা তখনো যে শেষ হয়নি। সুলেমান ফারাজের দিকে একবার চাইল। তারপর ফারহাদকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই এখন বাসায় যাইবেন না? আপনার পোলার চোখে তো আগুন জ্বলতাছে। রক্ত কিন্তু আমাগোই। এই দিনের কথা ভুইলা যাইব মনে হয়? কি করবেন?’
‘ওর ব্যবস্থা করা শেষ। ওরে আমি কবেই বেঁইচা দিছি। ইতালি পাচার হইব। লোক আইসা একটু পরেই নিয়া যাইব।’
ফারাজ সেদিন মায়ের পোড়া লাশকে শক্ত করে চেপে ধরে বসে ছিল। মায়ের হাড়গোড় আলাদা হয়ে গেছে। সব শেষ। সেইসবই ফারাজ আঁকড়ে ধরে বসেছিল। কোথাও যাবে না সে তার মাকে রেখে। মায়ের পা ধরতেই বাবা তাকে মুখের ওপর লাথি মারল। ফারাজ চারিদিকে তাকিয়ে দেখল। কত কত মানুষ। কেউ এলো না তাকে বাঁচাতে। ফারাজ কেবল অসহায়ের মতো কাঁদল। কেঁদেই চলল। কিছুলোক জন এসে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল। সে কেবল একটাই কথা বলল, ‘বাবা আমাকে বাঁচাও। বাবা আমি তোমার ভালো ছেলে হয়ে দেখাবো। তোমার সব কথা শুনে চলব। আমাকে ওরা নিয়ে যাচ্ছে বাবা। মাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। বাবা রাতে মায়ের গল্প না শুনলে আমি ঘুমাতে পারি না। মা আমার পরে আছে বাবা। মাকে ছাড়া কোথাও যাব না আমি।’
ফারহাদ ছেলের দিকে ফিরেও তাকালেন না। কানে নিলেন না কোনো কথা। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণিত মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে বাস্তবতার জঘন্য খেলায় সন্তানকে ঠেলে দিলেন, মা হারা এতিম করলেন। তবে পাপের পরে তার বিনাশ লুকিয়ে থাকে তা কী সে ওই ছোট্ট ফারাজের চোখে সেদিন দেখেনি? হয়তো দেখেনি। দেখলে কি আর এমন সে কাজ কখনো করত?
চলবে?
#চিত্রাঙ্গনা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৬১
#বর্ধিতাংশ
ফারহাদ ছেলের দিকে ফিরেও তাকালেন না। তার কাঁধ থেকে বোঝা নেমেছে। বিয়ে-শাদীর ওপর কোনো আগ্রহ ছিলনা। এসব তো ফখরুল এলাহীর সামনে ভালো সাজার জন্য করা। দশটা বছর সহ্য করেছে সে সবকিছু। দশ দোকান থেকে পন্য কেনা ব্যক্তির কখনো এক দোকান পছন্দ হবে না এটাই স্বাভাবিক। এবার সে স্বাধীন ভাবে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে। ওইদিন লতামণি ঘটনাস্থলে ছিল। তবে গোপনে। সাফিয়েকে না বাঁচাতে পারার ব্যর্থতার কারণে কেঁদেছিলেন সে নীরবে। মমতাজের সন্দেহ হয়েছিল অনেক আগেই। সাফিয়ের সঙ্গে আগেই কথা বলেন তিনি। দলিলের একটা নকল কপি বানান। সেখানে সাফিয়ের নামে দলিল ছিল। সাফিয়ে জানতেন এই দলিল তার ছেলের জীবনটা শেষ করে দিবে। বাঁচতে দিবেনা ওরা। নিজের জীবনের পরোয়া করেননা সে। ছেলেটা বাঁচলে সে বাঁচতে পারবে। হয়তো মনে মনে অনেক কিছুই আন্দাজ করে ফেলেছিলেন। তবুও ছেলেটাকে ওরা বিক্রি করে দিল। জীবিত অবস্থায় জানতে পারলে হয়তো ওখানেই লাশ হয়ে যেত সাফিয়ে। সাফিয়ের সঙ্গে একটা আশ্রমের সম্পর্ক ভালো ছিল। প্রায় তার সেই বৃদ্ধাআশ্রমে যাওয়া হতো। লতামণির কাছেই আবদার করা হয়েছিল যদি সে মারা যায়,আর ফিরতে না পারে ওই আশ্রমেই যেন তাকে দাফন করা হয়। লতা তাই করল। তবে দেহের তো কিছুই পেলেন না। পেলেন হাড়গোড়, শাড়ির সঙ্গে লেগে থাকা চামড়া। মাটির নিচে তাই দাফন করা হয়। তাও বেওয়ারিশ কবর হিসেবে। এমন দিনও কখনো দেখতে হবে লতামণি ভাবেননি। দুধের মতো মেয়েটার এত ভয়ানক পরিণতি? এমন ভাবে দাফন করতে হলো যেন কেউ তাকে খুঁজে না পায়? জানতে না পারে এটা সেই অভাগী সাফিয়ে, এলাহী বাড়ির বড় বউ? সম্পত্তির দলিলটা রয়ে গেল লতামণির কাছেই। আগলে রাখলেন কোনো একদিন ফারাজ আসবে বলে। অনিশ্চিত একটা আশা নিয়ে অপেক্ষা করতেই থাকলেন। সাফিয়ের মৃত্যুর কিছুদিন পর জানা গেল দলিল ভুয়া। লতামণিকে মমতাজ আগেই দূরে কোথাও চলে যেতে বলেছেন। সে কখনো চায়নি একজন অসহায় বৃদ্ধা এসবে জড়াক। তবে শেষ বিদায়ে বললেন, ‘আমার নিজের সন্তান গুলোতো আমায় কখনো বুঝল না। মেয়েটা এখনো ছোট। বুঝে না কিছু। আপনি দলিলটা আপনার কাছেই আগলে রাখুন। ফারাজ কোনো একদিন ফিরে এলে দলিলটা ওকে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। আপনাকে বাঁচতে হবে। ফারাজের জন্য অপেক্ষা করতেই হবে।’ মমতাজ জানতেন ফারাজকে যাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছেন তারা ভালো মানুষ না। ফারাজের ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। তবুও…তবুও একটা আশায় লতামণিকে দূরে পাঠিয়ে দেন। কিছুদিন পর মমতাজের মৃত্যু হয়। কেউ বলে আত্মহত্যা, কেউ বলে খুন। হয়তো সে ট্রমা থেকে বের হতে পারেননি। সাফিয়েকে বাধা না দেওয়ার আফসোস, ফারাজকে বাঁচাতে না পারার আফসোস তাকে বাঁচতে দেয়নি।
ইতালিতে ফারাজ প্রথম কয়েকমাস কথাই বলেনি কোনো। সেখানে তখন তার জাহান্নামের মতো এক একটি দিন কেটেছে। এক বেলা খেতে দিত। তাও শুঁকনো খাবার। সেই খাবার নিয়েও কারাকারি। কে কার খাবার ছিনিয়ে বেঁচে থাকতে পারে তার অসংখ্য লড়াই। ফারাজ একগুয়ে, চুপচাপ থাকত বলে তাকে অগুনিত নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এমন রাতও গেছে যখন শাস্তি স্বরূপ তাকে ভয়ানক সব পোকামাকড় আচ্ছাদিত ঘরে থাকতে হয়েছে। এমন রাত হয়েছে ক্ষুধার চোটে মাটি খুবলে খেয়েছে। ঘাস-পাতা খেয়ে বেঁচেছে। হাসি জিনিসটা কি ফারাজ তো তা পুরোই ভুলতে বসেছিল। ধীরে ধীরে সে কেমন যেন রুক্ষ, একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিল। ওই রাতের পর কখনোই ফারাজ কান্না করেনি। তাকে কেউ কাঁদতে দেখেনি। হাসির সঙ্গে কান্নাটা গলায় আঁটকে হয়ে উঠেছিল সে এক অন্য মানুষ। কিছুদিন পর ফারাজ ইতালির বড় একজন স্মাগলারের হাতে পড়ে। সে কেবল অস্ত্র আর নেশাদ্রব্য পাচার করতেন। স্ত্রী সন্তান ছিল না। শোনা গেছে বোমা হামলায় তারা মারা গিয়েছিল বহু আগেই। ফারাজকে প্রথম দেখায় তার অনেক পছন্দ হয়। সেই থেকে রাখেন নিজের সঙ্গে। ফারাজের জীবনই বদলে যায়। লোকটির নাম এলেনসন। নিজের ছেলের মতো করে ফারাজকে মানুষ করেন। ফারাজ অস্ত্র চালানোতে তার থেকেও বেশি দক্ষ হয় ওঠে। এত তীক্ষ্ণ এই ছেলের বুদ্ধি। ব্যবসায় লাভ আর লাভ। এলেনের যোগ্য উত্তরসূরী ছিল ফারাজ এলাহী। ইতালিতে এলেনের থেকেও মানুষ ফারাজ এলাহীর নাম শুনে বেশি কাঁপত। আতঙ্কে পরিণত হয় সে মানুষের। তারপর সময় চলে যায়। এগারোটা বছর পর দেশের মাটিতে পা রাখে ফারাজ। এই যে এগারোটা বছর কেটে গেল একটা রাতও ফারাজ ঘুমাতে পারেনি। মায়ের পোড়া মুখটার হাহাকার কানে এমন ভাবে আঘাত করত যে ফারাজ রাতে ঘুমাতে পারত না। এত হাই সিকিউরিটি, এত আলিশান জীবনও তাকে শান্তিতে কখনো চোখ বুজতে দেয়নি। নিজের বিশ বছর বয়সে দেশে ফিরে সবচেয়ে আনন্দ লাগে তখনই, যখন সে তার বাবাকেও একই ভাবে একই জায়গায় পুড়িয়ে মেরেছে। একই যন্ত্রণায় তার বাবা ছটফট করেছে। সেই রাতের কথা আজও মনে পড়লে শিহরণে মস্তিষ্ক পর্যন্ত শীতল হয়ে আসে। সেই রাতে ফারহাদ এলাহী তালুকদার বাড়িতেই উৎসব অনুষ্ঠানে মাতোয়ারা ছিলেন। মায়ের মতোই একটা মেয়ের গায়ে মদ ঢেলে ফূর্তি করছিল। চোখের সামনে এক মুহূর্তে পুরোনো অতীত ভেসে এলো। সেদিন বাবাকে ফারাজ এক চুলও ছাড় দেয়নি। বাবার আর্তনাদ সেদিন ফারাজের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তালুকদার বাড়ির সবাই যখন নেশা করে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয় তখন বাড়ির উঠোনোর চৌকিতে পড়ে থাকা ফারহাদ এলাহী কি কল্পনা করতে পেরেছিল আজকেই তার শেষ দিন? আজকের পর সে আর কখনো পাপ করতে পারবে না?
সেদিন ফারাজ তার বাবাকেও একই ভাবে ওই পুড়িয়েছিল। পুরো বিয়ে বাড়িকে ফারাজ এলাহী জাহান্নাম বানিয়ে ছাড়ল। নেশায় ফূর্তি করা মানুষগুলো জ্বলেপুড়ে পড়ল রাতের আঁধারে, হাহাকার করে বাঁচার জন্য আর্তনাদ করল তালুকদার বাড়ির বউ চৈতী মজুমদার, তার স্বামী তৌকির তালুকদার। যে কিনা ফারহাদ এলাহীর সবচেয়ে বড় পার্টনার ছিল। সবাই শেষ হয়ে গেল। কিন্তু নিজের বাবাকে কি এত সহজে মারা যায়? বাবাকে সে মারল বিশেষ ভাবে। প্রথমে জ্যান্ত অবস্থায় তার চোখের সামনে কলিজাটা বের করে তার হাতের মুঠোয় রেখে সেদিন বলেছিল, চিনতে পারছ ফারহাদ এলাহী? আমি ভালো হতাম কি করে বলো? তোমার পাপের রক্ত যে এই শরীরে বইছে। অনেক কলিজার শখ ছিল না তোমার? প্রথম কলিজা বের করা তোমারটা দিয়েই শুরু করলাম। আজ থেকে যতবার কোনো পাপীর কলিজা বের করল ততবার আজকের দিনের কথা মনে করব। মনে করব ফারহাদ এলাহীর কলিজা বের করছি। আর ঠিক তখনোই কলিজা দিয়ে তৃপ্তি ভরে ভাতও খাবো। মনে মনে এই ভেবে নেব তোমার কলিজা খাচ্ছি। শান্তি করে।’
‘বাবা, আমি তো তোর বাবা হই। ছেড়ে দে।’
ফারাজ এলাহীর নয় বছরের সেই ছোট্ট ছেলেটার কথা মনে পড়ে। তার মায়ের কথা মনে পড়ে। সেদিন শরীরের কোনো অংশ বাদ নেই যেখান থেকে ফারাজ নিজ হাতে মাংশ তুলে নেয়নি। বাবা তার যখন পানির তৃষ্ণায় ব্যাকুল তখন সে সামনে এগিয়ে দিয়েছিল অ্যাসিড। ফারহাদের মাথা তখন ঠিক নেই। পানি ভেবে অ্যাসিড মুখে দিতেই কণ্ঠনালি থেকে শুরু করে সব পুড়ে যায়। সেই ব্যক্তির গায়েও ফারাজ একই ভাবে মদ ঢেলে একই গাছের সঙ্গে বেঁধে পুড়িয়ে মেরেছিল। ওইদিন বিয়ে বাড়িতে ফারাজ আগুন লাগিয়ে একসঙ্গে তালুকদারের পুরো বংশকে শেষ করেছিল। ওরা এমন মৃত্যুরই যোগ্য ছিল। আর ওদের তো মারতেই হতো। কারণ নয় বছর বয়সী ছেলেটাকে যেদিন টেনে হিঁচড়ে তার বাবা অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছিল, দহনে পুড়তে থাকা ছেলেটি তখন ঝলসে যাওয়ার মায়ের দেহটার দিকে শেষবার চেয়ে শপথ নিয়েছিল, প্রতিটি খুনিকে সে নিজ হাতে একদিন শেষ করবে। তবে ফারাজ সুলেমান এলাহী, রুমানা ওদের কাউকে মারেনি। ওদের মৃত্যুটা এত সহজে দিলে মজা লাগবে কি? প্রতিটি দিন ভয় আর আতঙ্কে জীবনের শেষ পর্যন্ত কাটাতে হবে ওদের। ফারাজ জানত যেই কারবার তার বাবা রেখে গেছেন তার সঙ্গে এখন এই বাড়ির ছেলেরাও জড়িত। যদিও রোশান, জোহান তখন এসবে জড়ায়নি। রোশান ভাইয়ের ছোট থেকেই মন মানসিকা ভিন্ন ছিল। ফারাজের একমাত্র খেলার সাথী, ভালো-মন্দের সহচর কেবলই সে ছিল। এগারো বছর পর ফারাজকে দেখে যেই মানুষটা বুকে জড়িয়ে কান্না করেছিল সে ছিল ওই রোশান এলাহী। মমতাজের বিষয়ে জানতে পেরে ফারাজের খারাপ লাগে। তবে এখন আর তাকে কিছু ভাবায়না। ভাবার আগেই তো হাতে রক্ত,পাপ লেগে গিয়েছিল। যেখান থেকে ফেরার পথ সেই, মুক্তি নেই। লতামণিকে খুঁজতে ফারাজের ভালোই সময় লাগে। ফারাজ সবখানে খুঁজে-ফিরে তাকে। তবে একেবারে শেষে ওই আশ্রমে গিয়েই খুঁজে পায়। খুঁজে পায় মায়ের বেওয়ারিশ কবরটাও। একদিন এমন সময় আসবে যখন এই কবরের নাম হবে, পরিচয় হবে। ফারাজের এতটুকুই চাওয়া। লতামণি অসুস্থ হওয়ার পর তার ছেলেরা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। শেষে গিয়ে ওই আশ্রমেই তার জায়গায় হয়।
ফারাজ চিত্রার সঙ্গে এখন পর্যন্ত কি কি করেছে সবই খুলে বলে। বাড়ির মানুষগুলো সম্পর্কেও তো চিত্রা জানত না। এবার একেবারে সব জানল। গভীর ভাবে জানল। জানল আরো গভীরভাবে ফারাজকে। সম্পত্তির দলিলটা আগলে রেখেছিল লতা। সেটা ফারাজের হাতে যেদিন তুলে দেন সেদিন ফারাজ বেশ অনেক্ক্ষণ দলিলটা খুঁটিয়ে দেখেছিল। এই সম্পত্তি, লোভ কত খারাপ জিনিস। সব কেঁড়ে নিল। আবার দেখো এর কত ক্ষমতা, এক নিমিষেই গোটা বাড়ির মানুষকে এই ক্ষমতা দিয়ে হাতের মুঠোয় বন্দী করাও সম্ভব হয়ে দাঁড়াল। সেই থেকে ফারাজের দেশে যাওয়া-আসা হতো। এসেই আগে তিনতলার সেই বন্দী রুমটায় যাওয়া হতো। যেখানে মায়ের পিয়ানোটা, টুকটাক জিনিস রাখা ছিল। কখনো কখনো মন খারাপ হলে সারা রাত পিয়ানো বাজাত সে। কেবল মায়ের শেষ স্মৃতি গুলো মায়ের খুনীর মেয়ের হাতের স্পর্শ পাবে বলেই ফারাজ চিত্রাকে কখনো তিনতলার ঘরটায় যেতে দেয়নি। ফারাজ অনেক পরে জানতে পেরছিল চিত্রার কথা। তালুকদার বাড়ির মেয়ের কথা। তারও তো কোনো বেঁচে থাকার অধিকার নেই। কারণ তার বাবা-মা কি করেছে ফারাজ কি তা ভুলে যাবে? অসম্ভব। বাড়ির কিছু মানুষ ছাড়া সবাই জেনেছে ফারাজও রুমানা-সুলেমানের ছেলে। আজও তাই জানছে। কেবল ফারাজ এলাহী চায় বলেই। ওইযে পরের বাড়ির মেয়েগুলো আছে না? ওদের জানা নেই ফারাজ এলাহী কার ছেলে। চিত্রাকে ওই বিয়ের দিন ছাড়া ফারাজ আগে কখনো দেখেনি। ইচ্ছে হয়নি দেখার। কিন্তু প্রথম যেদিন দেখেছিল এক মুহূর্তের জন্য তার হৃদয়ের গতি কি ভয়ানক ভাবেই না বেড়ে গিয়েছিল। নিজেকে সামলাতে খানিকটা কষ্ট হয়। এলেনসনের মৃত্যুর পর তার সকল সম্পত্তি, ব্যবসায়ের মালিক হয় ফারাজ তবে সে জীবনে কখনো নির্দোষ কাউকে মারেনি। এই যে ফারাজ এখন প্রচুর হাসে, হেসে হেসে কথা বলে। তাকে দেখলে কেউ তার ভেতরের হালচাল বুঝে উঠতে পারেনা। হয়তো সে বোঝাতে চায় না বলেই কেউ বুঝেনা। সে চায় না তার অতীত কেউ জানুক। নয় বছর বয়সী ছেলেটির ব্যর্থতার গল্প কেউ জানুক। কিছু গল্প না জানাই ভালো। তবে চিত্রাকে বিয়ে করার পর এই বাড়িতে যতগুলো খুন হয়েছে তা সে তো করেনি। তবে কে করেছে জানার ইচ্ছে হয়নি। কে মরল, কে বাঁচল তাতে ফারাজের কিছুই আসে যায় না।
চলবে?