#শিমুল ফুল পর্ব ২৩
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
শিমুলের বিয়ের কথা শুনে সুইটি কেঁদেকেটে একাকার করে ফেলেছে।
আসমা আর পেশকারা কারোর কথাই শুনছে না।আসমা তার আম্মাকে বলে,
“দেখলেন কি করলো?ঠিকই ছোটলোকের বাচ্চাকে বিয়ে করে ফেললো।আপনার নাতিও একটা!”
পেশকারা বেগম বললো,
“শিমুলের মতো পোলা যে এমন জায়গায় যাবে আমার কল্পনার বাহিরে ছিলো।আমার মন বলে তাবিজ করে পোলার মাথা নষ্ট করে দিয়েছে।তাইতো এমন পাগলের মতো কান্ডকারখানা করে।দেখলি না কেমন মাথা টাথা ফা/টিয়ে কি অবস্থা করেছে।”
পেশকারার কথা শুনে আসমাও মাথা নাড়ে।তারপর সুইটির মাথায় হাত ভুলিয়ে বললো,
“কাঁদিস না মা।আমি তোর জন্য এমন ছেলে খুঁজে আনবো যে তার সামনে শিমুলও ফেইল।”
সুইটি বলে,
“আমার অন্য কাউকে লাগবে না আমার শিমুলকেই লাগবে।”
“কিন্তু শিমুলের তো বিয়ে হয়ে গেছে।”
সুইটি ফুসফুস করে বললো,
“তো কি হয়েছে?বিয়ে হয়েছে ডিবোর্সও হবে।”
আসমা মাথা নেড়ে বলে,
“ডিবোর্স?এই মেয়ের জন্য যেই পাগল।”
সুইটি তার নানুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।
“নানু আমি কিছু জানিনা।তুমি জানো কি করবে।কিন্তু একটা কথা শুনে রাখো আমি শিমুলকে ছাড়া বাঁচবোনা।”
পেশকারা বলেন,
“পুষ্পকে একবার এই বাড়িতে আসতে দে,চেয়ারম্যান বাড়ির বউ হওয়ার স্বাধ মিটিয়ে দেবো।লেবুর মতো চিপে চিপে তেল বের করবো।”
সুইটি তার নানুকে ভালো করেই চিনে।মলিন মুখে শুয়ে তার আর শিমুলের বিয়ের স্বপ্ন দেখে।
শওকত হাওলাদার সারাঘর পায়চারী করছে।রাগে মুখ থমথমে।বারবার হাত মুঠ করে আবার খুলছেন।তার পরিবারের প্রথম আত্মীয়তা কিনা এমন ফ্যামিলির সাথে হলো?ছিহ ছিহ।সমাজের মানুষ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে।আর হাসাহাসি করবে কি?হাসাহাসি শুরু হয়ে গেছে শিমুল যা করলো ভাবতেই উনার মেজাজ খারাপ হয়।বিয়ে হলে হয়েছে এই মেয়েকে এই বাড়ির সিমানায় আসতে দিবে না।বাড়ির প্রথম বউ হিসেবে এই মেয়েকে মানায় না,পুষ্পকে দেখলেই উনারা রাগ লাগে,শিমুল যে কিভাবে এই মেয়েকে পছন্দ করলো তা আল্লাহই জানে।এর চেয়ে ভালো ছিলো সুইটিকেই বউ করে নিতো।তার সব পরিকল্পনা বাদ হলো পুষ্পর কারনে।এই মেয়ের গালে ঠাসঠাস চড় মারতে পারলে ভালো লাগতো।
রাবেয়া স্বামীর অস্থিরতা দেখে শান্তি পাচ্ছেন।কয়েকবছর আগে নিধির বিয়ের দিন পলাশ ঠিক এভাবেই অস্থির হয়ে ছিলো,পা/গলের মতো চুপিচুপি কেঁদেছিলো।উনি তো মা ঠিক বুঝেছেন কিন্তু এই পা/ষাণ মানুষের মন গলেনি,নিজের অহংকার ধরে রেখেছিলেন।আজকে শিমুলের কাজে রাবেয়া ভীষন খুশী।নিজস্বার্থ দেখা লোকদের এমন শিক্ষা হওয়া উচিত।পুষ্পকে বিয়ে করা নিয়ে সবাই অখুশী হলেও রাবেয়ার বুকটা ঠান্ডা হয়ে গেছে।এবার বউ ঘরে আসলেই হলো তার একটা সঙ্গি হবে।
পলাশ উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।নিঃশব্দে চোখ থেকে পানি পড়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে।নিজেকে কাপুরুষ মনে হচ্ছে।কেন সে শিমুলের মতো হতে পারলো না?এমন হলে তো তার নিধি তারই থাকতো,বুকভরা কষ্ট নিয়ে থাকতে হতো না।পলাশ শক্ত করে বালিশ খা/মচে ধরে,ঠোঁট কাঁপে তিরতির,বুকে ব্যাথা হয় অসহনীয়।নিজেকে খুব ঘৃনা লাগে।নিধিকে আজকাল খুব মনে পড়ে,বাচ্চা মেয়েটা তার জন্য কতো কষ্ট সহ্য করেছে কিন্তু সে কিনা তার আব্বার কথার বাহিরে যায় নি।ছিহ! পলাশ প্রেমিক হবার যোগ্য না।
পুষ্প মুগ্ধ চোখে শিমুলকে দেখে।কালো গেঞ্জি কালো ট্রাউজার পরাতে ফর্সা শরীর আরো ফুটে উঠেছে।ফর্সা কপাল সাদা ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢাকা।এই যে ছেলেটা এতো অসুস্থ দেখলে কেউ বলবেনা। ব্যান্ডেজ মাথায় রেখেই কেমন হাসছে।এই প্রণয়পুরুষ তার এটা ভেবেই পুষ্পর নিজেকে সুখী সুখী মনে হলো।শিমুলের কথা শুনে দুই হাত মুড়ে দাঁড়ায়।
“বাসর রাত!তো?”
শিমুল দুঃখী দুঃখী চেহারা করে বললো,
“ঘুমাতে গিয়েছিলাম কিন্তু ঘুম আসেনা।আমিতো এখন আর সিংগেল না।ম্যারিড পারসন!আজকেই বিয়ে করলাম আর প্রথম রাতে কি বউ ছাড়া ঘুম আসে?আসেনা তো!”
পুষ্প দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।
“ঘুম আসেনা?”
“না।বিবাহিত পুরুষের বউ ছাড়া ঘুমানোর নিয়ম নেই।আমি নিয়ম পালন করতে এসেছি।”
তারপর থেমে বললো,
“তোমার সাথে ঘুমাবো।”
পুষ্প শীতল চোখে তাকিয়ে হাসে।
“আচ্ছা।ভেতরে আসেন ঘুমিয়ে যান।”
শিমুল মাথায় হাত রেখে চুলকে রেখে দাঁত বের করে হাসে।
“শুধু ঘুমালে হবে না তো!”
“কেন?”
“কিছু মিছু করতে হবে?”
“কি?”
শিমুল চোখ ছোট ছোট করে বললো,
“বাসর রাতে কি হয় জানো না?”
পুষ্প জানে।বাসর রাতে কি হয় তার আবছা ধারনা কিশোরী পুষ্পর জানা।তারপরও মাথা নেড়ে বললো,
“না।”
শিমুল অবাক হয়ে বলে,
“সত্যিই জানো না?”
“না।আর তো বাসর রাত আসেনি কিভাবে জানবো?”
শিমুল পুষ্পর দিকে তাকিয়ে বললো,
“আচ্ছা চলো আমি শিখিয়ে দেই।”
পুষ্প লজ্জালজ্জা চোখে তাকিয়ে থাকে।শিমুল পুষ্পর চোখে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে।শিমুল উপরে উঠে আসে পুষ্প একপা পিছিয়ে যায়।শিমুল মুচকি হাসে।বাহ্ তার ফুল তাকে ভয় পাচ্ছে?শিমুল পুষ্পর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
“কিছু করবনা তো এতো ভয় পাচ্ছো কেন?আমি এতোটাও খারাপ না।”
আজকে শিমুল তার সাথে যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে এটা ভেবেই পুষ্পর ভয় লাগছে।পুষ্প যে ভয় পাচ্ছে এটা লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলো কিন্তু চালাক জামাইটা ঠিক বুঝে ফেলেছে।শিমুলের কথা শুনে পুষ্প বললো,
“ভয় পাবো কেন?আমি সাহসী।”
শিমুল আবার বাহিরে গিয়ে দাঁড়ায়।
“তা তো দেখতেই পাচ্ছি।”
তারপর দুজনেই চুপচাপ।চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।শিমুল বললো,
“চল সামনে যাই।”
পুষ্প দ্বিরুক্তি করে না।দরজা আটকে শিমুলের পিছু পিছু যায়।রাস্তায় নেমে শিমুল পুষ্পর হাত ধরে।কোন ভয় নেই লুকোচুরি নেই,নেই কোন বাধা।দুজনেই কোন কথা না বলে চুপচাপ হাটে।নিঝুম নিস্তব্ধ রাতে ঝি ঝি পোকার ডাকের সাথে দুজনের মনটা খুশীতে বাক-বাকুম ডাকছে।চাঁদের দিকে তাকালে দেখা যায় আজকে নতুন চাঁদ উঠেছে।নতুন চাঁদ বিধায় আলো কম চারদিকে আবছা অন্ধকার।দুজন অন্ধকারে হাটতে হাটতে অন্ধকারের নিজ্বস্ব আলো চোখ চিনে নেয়।শিমুল বললো,
“আজকে চাদেঁর আলো কম কেন জানো?”
পুষ্প শিমুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কেন?”
“তুমি খেয়াল করেছো?সবসময় আমরা রাতে দেখা করলে চাঁদের ভরা পূর্নিমা থাকতো কারণ চাঁদ তখন জানতো শিমুল প্রেম করে আর প্রেম করলে বেশী দুষ্ট হওয়া যায় না।আর এখন শিমুল তার ফুলের বর।যতো ইচ্ছা দুষ্টু হতে পারে।এসব অন্য কেউ দেখলে লজ্জা।তাইতো এই লজ্জায় চাঁদ মুখ লুকিয়েছে।ইন্টিলিজেন্ট চাঁদ।”
পুষ্প মাথা নিচু করে হাসে।প্রেম অবস্থায়ই তো ফিজিক্সের ক্লাস নেয়া শেষ।আরো দুষ্টু হওয়া বাকি?পুষ্পর লজ্জা লাগে।লজ্জায় নাকের ডগা শিরশির করে।পুষ্পর লজ্জায় অবনত মুখ দেখে শিমুল হাসে।দুজন হাটতে হাটতে হিজল গাছের নিচে আসে।শিমুল বলে,
“এই গাছটা আমাদের প্রেমের সাক্ষী।”
“হুম।”
“বেচারা কতো কি দেখে ফেলেছে।”
পুষ্প ঠোঁট টিপে হাসে।
“ফাও কথা।”
শিমুল গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।পুষ্প কিছুটা দূরে দাঁড়ায়।একে অপরের দিকে তাকিয়ে আপনা-আপনিই হাসে,তৃপ্তির হাসি।পুষ্প শিমুলের চোখে চোখ রাখে।দুজনের চোখে অজস্র কথা হয়।পুষ্পর চোখের ভাষা তখন গাঢ়।শিমুলের বুকে অজানা শিহরণ নেচে উঠে সে মুচকি হাসে।মাথা নেড়ে বললো,
“কি?”
পুষ্প কিছু বলেনা।তাকিয়েই থাকে।
শিমুল পুষ্পর হাত ধরে কাছে আনে।
“বালিকা আমাকে বি/ষ ব্যাথা শিখাতে এসোনা,আমি নিজেই বি/ষের রাজা।”
পুষ্প লাজুক হেসে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
শিমুল বললো,
“আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।”
“আমারো।”
শিমুল পুষ্পর দু’গালে হাত রেখে বললো,
“তোমাকে সারাজীবনের জন্য পেয়ে গেছি।তুমি আমার।”
পুষ্পর চোখে পানি আসে।সুখে গলা বন্ধ হয়ে আসে।
“তুমিও আমার।আমার বর।”
“আমার বউ।”
“ভালোবাসি।”
শিমুল পুষ্পর গালে নিজের গাল ঘসে।পুষ্প চোখ বন্ধ করে নেয়।শিমুল পুষ্পকে দেখে।এই মেয়েটাকে সে খুব ভালোবাসে আর এখন থেকে যখন খুশী ভালোবাসা যাবে।পুষ্পর হাতের ব্যান্ডেজে চুমু খায়।দুজনের শ্বাস হয় ঘন,বুক কাঁপে ধুপধাপ।দুজন দুজনকে খুব করে উপলব্ধি করে।শিমুল আদরে আদরে পুষ্পকে ভরিয়ে নেয়।সারা মুখে এঁকে দেয় ভেজা চুম্বন।পুষ্প শিমুলের বুকে তার পিঠ লাগিয়ে দাঁড়ায়।জড়ানো গলায় ফিসফিস করে বললো,
“এতো আদর করতে হয় না জান।”
শিমুল পুষ্পকে দু’হাতে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।কানের কাছে মুখ এনে পুষ্পর মতই ফিসফিস করে বললো,
“তুমি আমার জন্য যত আঘাত সহ্য করেছো এতো আদর দিলেও সেগুলো মুছে যাবে না।”
পুষ্প মাথা নেড়ে বললো,
“মিথ্যে কথা।সব আঘাত মুছে গেছে।”
“মুছে গেছে?”
পুষ্প শিমুলের দিকে ফিরে তার গলা আঁকড়ে ধরে।তারপর শিমুলের নাকের সাথে নিজের নাকের ডগা আলতো ধাক্কা দিয়ে বললো,
“যখন কবুল বললাম তখন সব ব্যাথা গায়েব হয়ে গেছে।”
“তাই?”
“হ্যাঁ।”
শিমুল পুষ্পর দিকে নেশা নেশা চোখে তাকিয়ে থাকে।তারপর খুব জোড়ে জড়িয়ে ধরে বললো,
“ইশ কবে বাড়িতে নিয়ে যাবো।আর তো ভালো লাগে না।”
চলবে……