কোথাও কেউ ভালো নেই
পর্ব ৯
তানভীরদের বাড়িতে গিয়েছে পূরবী দুই দিন হলো।বাবার বাড়িতে দুদিন থেকেই চলে এসেছে তানভীদের বাড়িতে। এখানে এসে পূরবীর মনে হলো কিছুটা যেনো স্বস্তি পাচ্ছে এবার সে।
অন্তত তানভীরকে ছোট হতে হচ্ছে না। বাবার বাড়িতে যেই দুদিন ছিলো পূরবীর ভীষণ লজ্জা লাগছিলো।তানভীর নিজে বাজার করেছে,পূরবী রান্নাবান্না করেছে।সালমা একবারও ডেকে কথা বলে নি।
পূরবী মনে মনে চেয়েছে যাতে তাড়াতাড়ি চলে আসে এই বাড়িতে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই নামাজ পড়ে পূরবী বাড়ির উঠোন ঝাড়ু দিলো। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের পানি বসিয়ে দিলো।
একটা বিষয় দেখে পূরবী কিছুটা অবাক হলো। এই বাড়িতে কেউ-ই খুব একটা নামাজ কুরআন পড়ে না।শুধু তমিজ মিয়া আর তানভীর মসজিদে যায় ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে।পূরবী পড়ে নেয় নিজের রুমে।
বাড়ির মহিলারা কেউই সকালে উঠে না।সবাই ৮ টা বাজলে ঘুম থেকে উঠে। সবার রুটিন একটাই,ঘুম,খাওয়া আর সিরিয়াল দেখা।
পূরবী চা বসিয়ে আরেক চুলায় আটার কাই করে নিলো।তাহেরা এসে আলু,গাজর কুঁচিয়ে দিলো।পূরবী রুটি বানালো,ভাজি বসয়ে দিলো।
তাহেরা দুপুরের রান্নার জন্য মাছ তরকারি কাটতে বসলো। পূরবী এই দুই দিন ধরে সব কাজ করা শুরু করেছে।তানভীরের প্রবল আপত্তি পূরবী অগ্রাহ্য করে কাজ কর্ম করতে লাগলো ঘরের।
পূরবীর রুটি বানানোর মাঝখানে তানভীর ডাক দিলো পূরবীকে চা দেয়ার জন্য।
তানভীরের ডাক শুনে পূরবী আড়ষ্ট হয়ে গেলো।
পূরবী জানে এই লোকটা বাহানা খুঁজছে পূরবীকে রুমে নেয়ার জন্য।
পূরবী তাহেরা কে বললো,”আপা,আপনি আপনার ভাইকে এক কাপ চা দিয়ে আসেন,আমি গিয়ে আব্বাকে দিয়ে আসি।”
তাহেরা পূরবীর কথামতো চা নিয়ে গেলো তানভীরের রুমে।তাহেরাকে দেখে তানভীর রেগে গেলো ভীষণ পূরবীর উপর।
তাহেরাকে জিজ্ঞেস করলো,”পূরবী কি করছে আপা,ওকে বলো আসতে রুমে।আমার ওয়ালেট খুঁজে পাচ্ছি না।”
তাহেরা এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,”কি কন ভাইজান,ওই যে দুই বালিশের মাঝখানে আপনের ওয়ালেট। “
লজ্জা পেলো তানভীর তাহেরার কথায়।কিন্তু চেহারায় তা প্রকাশ পেতে দিলো না।আমতাআমতা করে বললো,”আরে দূর,ওয়ালেট না তো,আমার ঘড়ি খুঁজছি।”
তাহেরা বিরক্ত হয়ে বললো,”ভাইজান কি আন্ধা না-কি?
হাতে ঘড়ি দিয়া বইস্যা আছেন আবার কইতাছেন ঘড়ি পান না।”
তানভীরের প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো। তাহেরার সাথে আর একটা কথাও না বলে বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো। এই পূরবী মেয়েটার উপর ভীষণ অভিমান জন্মেছে তানভীরের। মেয়েটা চড়ুই পাখির মতো শুধু ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ উড়াল দিয়ে পালিয়ে যায় তানভীরের হাত থেকে।কিছুতেই তানভীর বন্দী করতে পারছে না একে।
তাহেরা রান্নাঘরে গিয়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলো।পূরবী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তাহেরার দিকে।হাসি থামিয়ে তাহেরা বললো,”তানভীর ভাই মিছা কতাও কইতে জানে না ভাবী।খাটের উপরে মানিব্যাগ,আমারে কয় আপনারে ডাইকা দিতে মানিব্যাগ নাকি খুঁইজ্যা পায় না।আমি কইলাম ওই তো খাটের উপর। তারপর কয় না ভুল হইছে,আমার ঘড়ি পাই না।
আমি কইলাম ঘড়ি তো হাতে দিয়াই বইসা আছেন।বেচারা আর কিছু না বইলা চিৎ হইয়া শুইয়া পড়লো খাটে।”
লজ্জায় পূরবীর ফর্সা দুই গাল পাকা টমেটোর মতো লাল হয়ে গেলো। ধীর পায়ে হেটে গেলো রুমের দিকে।
যতোই রুমের দিকে যাচ্ছে পূরবীর হার্টবিট ততই বেড়ে যাচ্ছে।পূরবীর মনে হলো আর এক পা সামনে আগালে সে মরেই যাবে।
তবুও গেলো রুমে।গিয়ে দেখে চা পড়ে আছে ড্রেসিং টেবিলের উপর। তানভীর শুয়ে আছে।পূরবীকে দেখেই তানভীর জড়িয়ে ধরলো। তারপর রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো।
বাড়ির সবাই একে একে ঘুম থেকে উঠতে লাগলো। খাবার টেবিলে বসে সবাই নাশতা করছে।বাদ শুধু সুরভী আর তানভীর। তমিজ মিয়া ভাজি মুখে দিয়ে বললেন,”ফার্স্টক্লাস ভাজি বানাইছস আজকে তাহেরা।জীবনে প্রথম তুই এতো ভালো রান্না করছস।”
তাহেরা হেসে বললো,”খালুজান কি কন,রান্না তো করছে নতুন ভাবী।হের রান্নার হাত ভালা।”
আনিকা রুটি ছিড়ে মুখে পুরতে পুরতে বললো,”ভালোই তো,বাড়িতে নতুন রাধুনির আগমন হয়েছে।এসব রান্নাবান্নার কাজ আমার জাস্ট পেইন লাগে।”
তারিন বললো,”আগুনের তাপ আমার সহ্যই হয় না ভাবী।’
রেবেকা কথা না বলে খেলেন।তমিজ মিয়া খেতে খেতে বললো,”যে রান্ধে,হে চুল ও বান্ধে বুঝলা।পূরবীর মেট্রিকের রেজাল্ট জানো?
গোল্ডেন এ প্লাস পাইছে ও,আর তোমাগো না আছে বিদ্যা না আছে বুদ্ধি আর না আছে কাজের গুণ। ও কাজ ও করছে বাপের ঘরের,পড়ালেখা ও করছে।”
মিম বললো,”ঠিকই কইছেন আব্বা।পূরবীর আরেকটা গুণ ও আছে,ওর রূপ।আমগো তো বিদ্যা,বুদ্ধি,রূপ কোনোটাই নাই,এরজন্যই বিয়ার এতো বছর হইছে নিজের স্বামীরে হাত করতে পারি নাই।আমাগো স্বামীরা আমাগো কথামতো উঠে না,বহেও না।আর পূরবীর কি গুণ দেখেন আব্বা,বিয়া হইতে না হইতে সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসরে নিজের হাতের মুঠায় নিয়া নিছে।তানভীর এহন বউয়ের আঁচলের নিচে ঘুরঘুর করে তাই।”
মিমের এরকম জবাবে তমিজ মিয়া হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলেন।চেয়ারে বসে থাকা বাকি সদস্যদের মুখে ২০০ ওয়াটের বাল্বের মতো জ্বলজ্বল করে উঠলো। রেবেকা নিজেও খুশি হলেন।
তমিন মিয়া টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন।তমিজ মিয়া উঠে যেতেই খাবার টেবিলে হাসির রোল পড়ে গেলো।
দরজা খুলে তানভীড় বের হয়ে এলো পূরবীকে নিয়ে।চেয়ার টেনে পূরবীকে বসতে বলে নিজেও বসলো।
প্লেটে খাবার নিতে নিতে তানভীর মিমকে বললো,”মেজো ভাবী,বউয়ের আঁচলের নিচে থাকা যদি এতোই খারাপ হয়ে থাকে তবে তুমি কেনো প্রতি সপ্তাহে জোবেদা খালার বাড়িতে যাও মেজো ভাইয়ের জন্য পান পড়া আনতে।”
রেবেকা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো মিমের দিকে।মিমের মুখ শুকিয়ে গেলো ভয়ে।গমগমে গলায় রেবেকা বললেন,”আমার খেয়ে,আমার পরে তুই আমার পোলার লাইগ্যা তাবিজ করছ যাতে আমার পোলা আমার কথা না শুনে?”
তারিন বললো,”ছি মেজো ভাবী,ভালোবাসা দিয়া স্বামীর মন জয় করতে না পারলে এসব করে মন জয় করতে চাও ক্যান?”
তানভীর হেসে বললো,”আপা,তুই ও এমন কোনো সাধু মহিলা না,গত দুদিন আগেই তো তুই আর মা মিলে গেলি খালার বাড়িতে। তুই গেলি তোর স্বামীর জন্য আর মা গেলো আমার জন্য।এমনকি সেই চিনি মা গতকাল আমার চা’য়েও মিশিয়ে দিয়েছিলো।তোরা পারিস ও সবাই।এতো অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে থাকিস কিভাবে সবাই?
এভাবে যদি মানুষ বশ করা যেতো তবে রাজনৈতিক নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে এসব করে জিতে যেতো।”
তানভীর পূরবীকে নিয়ে পূরবীদের বাড়ি যাচ্ছে। পূরবী ভীষণ খুশি আজ।সুরভীকে আজকে লেডিস হোস্টেলে দিয়ে দিবে তাই আনতে যাচ্ছে তাকে।
বাড়িতে পা দেয়ার সাথেসাথে পূরবীর এতোক্ষণের আনন্দ সব উবে গেলো। সালমার ঘরের বারান্দায় সুরভী উপুড় হয়ে পড়ে আছে বেহুশ অবস্থায়। ফর্সা হাত পা নীল হয়ে আছে মারের দাগে।
পূরবীর বুক ফাটা আর্তনাদ শুনে সালমা ঘর থেকে বের হলো।বের হয়ে দেখে পূরবী আর তানভীরকে।বিরক্ত হলো সালমা।কোনো কথা না বলে ঘরে ঢুকে গেলো।
সুরভীর হুঁশ এলো দশ মিনিটের মধ্যে। বোনকে দেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সুরভী। কান্না করতে চেয়েও পারলো না কান্না করতে।
শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো বোনকে।
সুরভীর এই অবস্থা দেখে তানভীরের আকাশচুম্বী রাগ উঠলো।সে এই বাড়ির জামাই সেটা ভুলে গিয়ে লাথি মেরে সালার রান্নাঘর ভেঙে ফেললো,রান্নাঘরে থাকা চুলা,বালতি,হাড়ি পাতিল আছড়ে সব ভেঙে ফেললো।
সালমা জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলো তানভীরের দিকে।এবং সাথে সাথে নিজের স্বামীকে ভিডিও কল দিয়ে সব দেখালো।
ফয়েজ আহমেদ এখনো মেয়ের জামাইয়ের সাথে কথা বলেন নি।নতুন জামাইয়ের এই কাজ দেখে অত্যন্ত রেগে গেলেন তিনি।তানভীরকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে সালমাকে বললেন ফোন দিতে তানভীরের কাছে।সালমা কিছুটা ভয় পেলো যদি তানভীর তার গায়ে হাত তোলে তবুও ভয়ে ভয়ে গেলো।
কোনোরকম হেডফোন না থাকায় তানভীর শ্বশুরের দেওয়া গালি সবটা শুনতে পেলো নিজ কানে।
এরকম অশ্রাব্য ভাষার গালি শুনে তানভীর হাত মুষ্টি করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলো।সফল না হলেও কোনোমতে বললো,”আপনাদের যখন এতো সমস্যা,আমি আজকেই সুরভীকে নিয়ে যাবো।ও আর এখানে থাকবে না।”
ফয়েজ আহমেদ বললেন,”আমার মাইয়া আমার বাড়ি ছাইড়া কোত্থাও যাইবো না।যেই ….. পোলা আমার মাইয়ারে নিতে চাইবো তারে আমি দেইখা লমু।”
তানভীরের রাগ বহুগুণ বেড়ে গেলো। পূরবীর কোল থেকে সুরভীকে নিয়ে কোলে তুলে নিলো। তারপর বললো,”আমি যাচ্ছি সুরভীকে নিয়ে,আজ থেকে আমি জানলাম আমার শ্বশুর বাড়ি নাই,শাশুড়ী মারা যাবার সাথে সাথে আমার শ্বশুর ও মরে গেছে। পূরবী সুরভীর বাবা মারা গেছে।কোনোদিন কেউ যদি বাবার দাবি নিয়ে ওদের সামনে যায় তবে আমি নিজ হাতে তার গলায় চুরি চালামু।”
তারপর সালমার সামনে গিয়ে বললো,”মহিলা মানুষ বলে আপনি বেঁচে গেছেন,নয়তো আপনার মতো ডাইনি মহিলাকে আমি আমার এই শক্ত হাতের এক থাপ্পড়ে সোজা করে দিতাম।”
এই টুকু বলে থুথু এনে তানভীর থুথু মারলো সালমার পায়ের উপর। তারপর বললো,”মনে রাখবেন,এই থুথু আপনার পায়ে না,আমি আপনার মুখে মেরেছি।আমি ভালোর ভালো,আবার বেয়াদবের চূড়ান্ত। “
সালমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তানভীর চলে গেলো। পূরবীর মাথা এখনো ঘুরছে।কি থেকে কি সব হয়ে গেলো পূরবী বুঝতে পারছে না এখনো।
চলবে…….
জাহান আরা