#যেদিন তুমি এসেছিলে .
#সিজন_টু
#পর্ব ১০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
মাথা ব্যথার যন্ত্রণায় আজ কলেজে যায়নি সকাল। একপাশ ফিরে বিছানায় শুয়ে রয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার প্রতিও এসেছে চরম অরুচি। জ্বরটর আসবে কিনা কে জানে। সে বিছানায় শুয়ে শুয়েই শুনতে পাচ্ছে বাড়ির মেইন দরজার বাইরে থেকে কেউ ডাকাডাকি করছে। ঘোরের জন্য কণ্ঠ বুঝতে পারছে না। তবে এতটুকু ঠাওর করতে পারছে কণ্ঠটি কোনো ছেলের। রুহুল ভাইয়া এসেছে কী? ভাইয়া তো বাড়িতে ফেরে না অনেকদিন হলো। কোনো যোগাযোগও রাখেনি এতদিন। কতবার সবাই ফোন করে খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছে! কিন্তু বরাবরই সকলকে ব্যর্থ হতে হয়েছে। সে যা হোক, এতক্ষণ ধরে বাইরে থেকে ডাকছে কেউ দরজা কেন খুলে দিচ্ছে না? বিরক্তিতে সে আর শুয়ে থাকতে না পেরে টলমল অবস্থায় হেলতে-দুলতে নিজেই আসে দরজা খোলার জন্য।
দরজা খুলে সে রুহুলকে দেখতে পায় না। ঘোলাটে দৃষ্টিতে অন্য এক অপরিচিত যুবককে দেখে তার ভ্রুঁ কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায়। কুঁচকানো ভ্রুঁ আরও কিছুটা কুঁচকে সে জানতে চায়,
“কে আপনি?”
উত্তর আসে যুবকটির ম্রিয়মাণ কণ্ঠস্বর থেকে,
“আমি আহিল। অর্ষার বন্ধু। অর্ষা আছে?”
“না। আপু তো অফিসে। কোনো দরকার?”
“দরকার তো ছিল!”
“তাহলে ফোন করুন।”
“করেছিলাম। ফোন ধরছে না।”
“তাহলে দুঃখিত। আর কোনোভাবে হেল্প করতে পারলাম না।”
এমন কটমটে কথার প্রেক্ষিতে আহিল জবাব দেওয়ার মতো কোনো কথা খুঁজে পেল না। সকালের চোখে-মুখে বিরক্তের ভাঁজ দেখেও তার মনে অস্বস্তিবোধ হচ্ছিল। মূলত সে এসেছিল অর্ষার সাথে জবের বিষয়ে কথা বলতে। এমন করুণ পরিস্থিতিতে তার নিজেরও একটা জব ভীষণ প্রয়োজন। সে সকালকে আর বিরক্ত না করে বলল,
“ঠিক আছে, আমি আসছি এখন।”
সকালের উত্তরের অপেক্ষা না করেই আহিল সেখান থেকে প্রস্থান করে। সকালও দরজা লাগিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।
.
.
সন্ধ্যায় ডুবুডুবু অবস্থা চারদিকে। আবছা অন্ধকারেও আকাশ মেঘে তলিয়ে আছে। এই বুঝি বৃষ্টি শুরু হবে হবে ভাব! অথচ অফিসের ভেতর থেকে একবিন্দু পরিমাণ বাইরের অবস্থা বোঝা যায় না। আজ পাঁচটার বদলে ছয়টায় ছুটি হয়েছে বলেই সন্ধ্যে নেমে পড়েছে। সন্ধ্যা তো আর সময় আটকে বসে থাকবে না! অর্ষা অফিসের বাইরে এসে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে। কাজের জন্য ফোন হাতে নেওয়া হয়নি। ভুলবশত সে ফোনটাও সাইলেন্ট করে রেখেছিল। আহিল বেশ কয়েকবার তাকে ফোন করেছে দেখে কিছুটা অবাকও হয়েছে সে। রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আহিলকে কলব্যাক করে অর্ষা। এমনিতে আজ গাড়িটাড়ি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। হাঁটা ছাড়া গতি নেই। সামনে থেকে যদি কোনো রিকশা বা সিএনজি পেয়ে যায় তাহলে সেটাকে বোনাস-ই ধরা শ্রেয়। এজন্য শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করতে চায় না সে।
ওপাশ থেকে আহিল ফোন রিসিভ করল। প্রথমে স্বাভাবিক বাক্য আদান-প্রদান করার পর অর্ষা কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“আসলে কাজের জন্য ব্যস্ত ছিলাম। ফোন দিয়েছিলি খেয়াল করিনি। ফোনও সাইলেন্ট করা ছিল।”
আহিল অর্ষাকে আশ্বস্ত করে বলল,
“সমস্যা নেই। আমি বুঝতে পেরেছিলাম। তুই এখন কোথায়?”
“অফিস থেকে বের হলাম। টিউশনিতে যাব।”
“অফিস করে আবার টিউশনিও করিস?”
“হু, ঐ একটা বাচ্চাকেই পড়াই।”
“তুই কি হাঁটছিস?”
“কেন বলতো?”
“নিঃশ্বাসের গতি দ্রুত চলছে তাই। শোন, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলার প্রয়োজন নেই। টিউশনি শেষ করে বাসায় গিয়ে একটা নক করিস।”
“সমস্যা নেই তো! তুই বল না কী বলবি।”
“সমস্যা আছে। দুর্ঘটনা কখনও বলে-কয়ে আসে না। আমি ফোন রাখছি। সাবধানে যাবি।”
অর্ষা আর জেদ না ধরে বলল,
“ঠিক আছে।”
অর্ষা ফোন রাখার পর খেয়াল করল গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। একটা গাড়িও এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। গাড়ির জানালার কাচ নেমে যেতেই আহনাফের মুখটি দৃশ্যমান হলো। সে শীতল দৃষ্টিতে অর্ষার পানে তাকিয়ে রয়েছে। গাড়ির দরজাটি হালকা মেলে দিয়ে ম্রিয়মাণ স্বরে আহনাফ বলল,
“উঠে আসুন।”
অর্ষা হাভাতের মতো একটা প্রশ্ন করে বসল,
“কোথায়?”
আহনাফের ঠোঁটের কোণে তখন এক চিলতে মৃদু হাসির ঝিলিক দিয়ে উঠল যেন। সেই হাসিটা না নিভিয়েই বলল,
“কোলে নিশ্চয়ই নয়! গাড়িতে উঠুন।”
অর্ষা ভ্যাবাচ্যাকা খায়। অস্বস্তি লাগতে শুরু করে। সেই সাথে কিছুটা বোধ হয় মুগ্ধতারও রেশ লেগেছে। উঁহু! কিছুটা নয়। অনেকটা মুগ্ধতার মাঝে সে আকন্দ বুদ হয়ে রয়েছে। বিলীন হয়ে গেছে হঠাৎ ওঠা তপ্ত রৌদ্রের তেজি উত্তাপের বদলে মিষ্টি উত্তাপ পেয়ে। মানুষটা হাসলে তাকে এতটা সুন্দর, আবেদনময় লাগে?
অর্ষা অবিশ্বাস্য ঘোরের মাঝে বলে ওঠে,
“সুন্দর!”
“কী?” ভ্রুঁ উঁচু করে জানতে চায় আহনাফ।
অর্ষা পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে কথা ঘুরিয়ে বলল,
“ওয়েদার! আজকের ওয়েদারটা সুন্দর। ভাবলাম হেঁটেই যাই।”
“মাঝপথে বৃষ্টিতে পেয়ে বসবে। তখন আর ঠাণ্ডা না লাগিয়ে সে যাবে না। এসময় অসুস্থ হওয়াটা কি ঠিক হবে?”
“তাও ঠিক!”
“উঠে আসুন। অবশ্যই গাড়িতে!”
কথাটা বলে ফের মুচকি হাসি প্রদান করল আহনাফ। এই ছেলের সমস্যা কী? আজ কি সে তার হাসিতেই ফাঁসাবে বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে আছে নাকি? বিনা বাক্যব্যয়ে অর্ষা উঠে বসল। গাড়ির দরজা লাগানোর পরপর জানালার কাচও তুলে দিল আহনাফ। অস্বস্তিতে গাট হয়ে বসে থাকা অর্ষা চোরের মতো আড়চোখ আহনাফকে দেখছে। দুজনের মাঝখানে দূরত্ব রয়েছে বেশ। আহনাফ তার ফোন নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু অর্ষা তো কোনোভাবেই নিজের মনকে, চোখকে আটকে রাখতে পারছে না। ব্যস্ত রাখতে পারছে না। তার বুকে দামামা চলছে। অচেনা, অদৃশ্য দামামা! বুকে কাঁপন ধরে। এমন কেন হচ্ছে আজ হঠাৎ? শুধুমাত্র এক হাসিতেই তুই কুপোকাত হয়ে গেলি অর্ষা? ছি, ছি! কেউ জানলে মান-সম্মান আর রইবে না। এসব তোকে মানায় না, না, না! এমন হাজারও শব্দের বাণী দ্বারা সে নিজেকে আবদ্ধ রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মিথ্যে ব্যস্ততার বাহানা ধরে সে নিজেও ফোন নিয়ে বসে থাকে। অযথাই হাতের আঙুল দ্বারা ফোনের স্ক্রিনে নিউজফিড স্ক্রল করছে। ধ্যানজ্ঞান তো রয়েছে সব অন্য স্থানে। বলতে অসুবিধা নেই, কেমন যেন এক অন্য রকম ভালোলাগা, খুশির ঢেউও তুলছে প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মানুষটিকে আজ ভালো লাগছে। প্রয়োজনের চেয়ে অনেক অনেক অনেক বেশিই!
গাড়ি যখন আহনাফদের বাড়িতে পৌঁছে যায় তখনও অর্ষা ঘোরের মাঝে প্রতিহতমান। ধরিত্রীতে সে আছে কিনা সন্দেহ। সামান্য গলা খাঁকারি দেয় আহনাফ। অর্ষার দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টা। তবু তো অর্ষার সম্বিৎ ফিরল না। সে তো তখনও জানালার কাচ ভেদ করে তাকিয়ে রইছে বাইরে। বৃষ্টিধারা যে এতটা মনোযোগ দিয়ে দেখছে না সেটা ১০০% গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়। তাহলে এত মনোযোগ দিয়ে দেখছেটা কী? উঁহু! দেখছে না। ভাবছে সে। স্বপ্নের রাজকুমারকে নিয়ে!
“শুনছেন? নামবেন না?”
আচানক ভয়ে কম্পিত হয়ে ওঠে অর্ষা। বুকে থুথু দেয়। বুকে থুথু দিলে সত্যিই ভয় কেটে যায় নাকি এটা মনের প্রচলিত একটা ভুল ধারণা তা বোধ করি অর্ষার মতো অনেকেরই উত্তরটি অজানা।
ঘোরে আবদ্ধ হয়ে আটকে থাকা হতচকিত অর্ষা আরও একবার লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। মৃদু হাসার চেষ্টা করে বলল,
“নামছি।”
রাশেদ একটা ছাতা নিজের মাথায় ধরে অন্য ছাতা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফ গাড়ি থেকে নামার পর ছাতাটি সে আহনাফের হাতে তুলে দিল। আহনাফ ছাতা নিয়ে অপেক্ষারত প্রিয়জনের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইল অর্ষার জন্য। দুজনে একই ছাতার নিচে। অল্পটুকু পথ মাত্র একসাথে এতটা কাছাকাছি, পাশাপাশি চলা তবুও মনে হচ্ছে সময়টা অনন্তকাল। এখানেই যদি থমকে যেত!
কলিংবেল চেপে ধরে রাশেদ। দু’তিনবার টিংটিং শব্দ তোলার পর রেণু দরজা খুলে দেয়। সে আহনাফের দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“ভাইজান আপনের আইতে আইজ দেরি হইল ক্যান? ভাবিজান কখন থেইকা আপনের জইন্য অপেক্ষা কইরা আছে।”
রেণুর কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকালো। অর্ষার মনে হলো এই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট শব্দটি তার বর্মে বর্মে হচ্ছে। সূর্যকিরণের মতো তার ঝলমলে প্রস্ফুটিত হাসিটুকু বর্ষার বৃষ্টিস্নাতের সাথে ধুয়ে মুছে রঙহীন পানির সঙ্গে একত্রিত হয়ে যাচ্ছে যেন।
আহনাফ কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
“শশী এসেছে?”
রেণু তার ঝলমলে মুখখানা দুলিয়ে উপর-নিচ সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকাল। অর্ষা বুঝতে পারছে না অচেনা এক নারীর আগমনে তার বুকে শীল বেঁধার মতো কষ্ট কেন হচ্ছে? মস্তিষ্কের মাঝে প্রশ্নের দানা বাঁধতে শুরু করেছে। কে এই শশী? রেণু কেন তাকে ভাবিজান বলে সম্বোধন করছে? নাহ্ এই হৃদযন্ত্রণা সহনশীল মাত্রায় থাকছে না যে আর! অবাধ্য মনটা বারবার প্রশ্ন করেই যাচ্ছে,’কে এই শশী?’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]